প্রশ্ন: হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং তার প্রকৃত হত্যাকারী কে? একটি দলিল ভিত্তিক পর্যালোচনা।
▬▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ্র জন্য। আমাদের নবী, সর্বশেষ নবী, রাসূলদের সর্দার মুহাম্মদ ﷺ এর প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবায়ে কেরাম সকলের প্রতি আল্লাহ্র রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর জান্নাতী যুবকদের সরদার প্রখ্যাত সাহাবী হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) ছিলেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর দৌহিত্র (নাতি), ইসলামের চতুর্থ খলীফা আলী ইবনু আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) ও ফাতেমা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা)-এর পুত্র। তিনি চতুর্থ হিজরির ১৫ই শা‘বানে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর উপনাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ এবং রাসূল (ﷺ) তাঁকে সাইয়্যিদু শাবাবি আহলিল জান্নাহ—জান্নাতী যুবকদের সরদার বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর পূর্ণ নাম: হুসাইন ইবনু আলী ইবনে আবী তালিব ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম। তিনি ছিলেন বনী হাশিম গোত্রের কুরাইশ বংশোদ্ভূত এবং আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত। হুসাইন (রদিয়াল্লহু আনহু) দৈহিক অবয়বে রাসূল ﷺ-এর সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ ছিলেন। সাহাবী আনাস (রদিয়াল্লহু আনহু) বলেন, “হুসাইন নবী করীম (ﷺ)-এর অবয়বে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যশালী ছিলেন।” তিনি পশমী পোশাক পরতেন, বাম হাতে আংটি পরিধান করতেন এবং তাঁর চুল-দাড়িতে খিযাব ব্যবহার করতেন।নবী করীম (ﷺ)-এর মৃত্যুর সময় হুসাইন (রদিয়াল্লহু আনহু)-এর বয়স ছিল আনুমানিক ছয় বছর। তিনি শৈশবেই নবীজির সান্নিধ্য ও ফাতেমা (রদিয়াল্লহু আনহা)-এর তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হয়েছেন এবং জ্ঞানার্জনে পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি নবী (ﷺ) আলী (রদিয়াল্লহু আনহু), ফাতেমা (রদিয়াল্লহু আনহা ),উমর (রদিয়াল্লহু আনহু) প্রমুখ সাহাবাদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। হুসাইন (রাঃ) একাধিক বিবাহ করেছেন।তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে কয়েকজন হ’লেন, লায়লা বিনতু আবী মুররাহ, আর-রিবাব বিনতু ইমরাউল ক্বায়েস বিন আদী আল-কালবিয়াহ, উম্মু ইসহাক বিনতু ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ আত-তায়মী ও কুযা‘আহ প্রমুখ। আর তার সাল্লামাহ বিনতু ইয়াযদাজির (পারস্যের বাদশাহ) নামে একজন দাসী ছিল। যার গর্ভে হুসাইন (রদিয়াল্লহু আনহু)-এর একজন পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।তাঁর সন্তানদের মধ্যে ছিলেন পাঁচ পুত্র—আলী আল-আকবর, আলী আসগর, জা‘ফর, আব্দুল্লাহ ও ওমর এবং দুটি কন্যা—সুকাইনা ও ফাতেমা। হুসাইন (রদিয়াল্লহু আনহু) আহলে বায়তের অন্তর্গত। নবী করীম (ﷺ) তাঁর প্রিয় দৌহিত্র হুসাইনকে অত্যধিক মহববত করতেন। তার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করতেন। কখনও তিনি হুসাইনকে নিজের কাঁধে উঠাতেন। তাকে কোলে নিয়ে কখনও সালাত আদায় করেছেন।তিনি সাহাবায়ে কেরামের নিকট সম্মানিত ও প্রিয় ছিলেন এবং অনেক জিহাদ অভিযানে অংশ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ২৭ হিজরিতে আফ্রিকা অভিযান (আবদুল্লাহ ইবনু আবী সারহ-এর নেতৃত্বে),৩০ হিজরিতে তবারিস্তান অভিযান (সাঈদ ইবনুল আস-এর নেতৃত্বে), ৫১ হিজরিতে কনস্টান্টিনোপল যুদ্ধ (ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়ার নেতৃত্বে)।রাসূল (ﷺ) বলেছেন: الحَسَنُ وَالحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الجَنَّةِ“হাসান ও হুসাইন জান্নাতী যুবকদের সরদার।”(তিরমিযী হা/৩৭৬৮; সিলসিলা সহীহা হা/৭৯৬) অবশেষে, হুসাইন ইবনু আলী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) ৬১ হিজরির ১০ই মুহাররম, শুক্রবার, কারবালার প্রান্তরে ৫৮ বছর বয়সে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি শাহাদতের অমর মর্যাদা অর্জন করে ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
.

.
অনেকেই প্রকৃত ঘটনা না জেনেই হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু)- এর হত্যার ব্যাপারে খলীফা ইয়াযীদকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু খলীফা ইয়াযীদের শাসনামলে ৬১ হিজরীর ১০ মুহাররম ইরাকের কারবালা নামক স্থানে হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে হত্যা করা হলেও তার হত্যার ব্যাপারে ইয়াযীদ দায়ী ছিলেন না। ইতিহাস গ্রন্থগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, হুসাইন (রযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হত্যার ব্যাপারে প্রকৃত দোষী দুইজন। ওবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ ও সীমার।এ মর্মে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত যে, নিশ্চয় ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়া হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে হত্যার নির্দেশ দেননি। তিনি ওবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে কেবল ইরাক দখল করা হতে বাধা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলে।(মাজমূউ ফাতাওয়া; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪১১)।
.
এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত ঘটনা হচ্ছে: মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মৃত্যুর সময় পরবর্তী খলিফা হিসাবে তার সন্তান ইয়াযীদকে মনোনীত করেন। অতঃপর মুআবিয়া (রাযি.)-এর ইন্তিকালের পর ইয়াযিদ খিলাফতের দায়িত্ব নেন, তখন জীবিত প্রায় ষাটজন সাহাবিসহ সিংহভাগ মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাঁর হাতে বায়আত করেন। বলা হয় কেবল চারজন সাহাবি (ইবনু উমর, ইবনু আব্বাস, ইবনু যুবায়ের ও হুসাইন ইবনু আলি রাযি.) কিছুটা গড়িমসি করেন; পরের দু’জন পরে বায়আত সম্পন্ন করেন, কিন্তু হুসাইন ও ইবনু যুবায়ের মদীনা থেকে মক্কায় গমন করেন। ইবনু উমর (রাযি.) তাঁদের সতর্ক করে বলেন, “আল্লাহকে ভয় করুন, মুসলিম একত্বে বিভক্তি আনবেন না।” এ দিকে কূফাবাসীরা জানতে পারে যে হুসাইন (রাযি.) ইয়াযিদের বায়আত করেননি। তারা সুলাইমান ইবনু সূরাদের বাড়িতে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়—হুসাইন (রাযি.)-কে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁকে খলিফা হিসেবে গ্রহণ করবে এবং ইয়াযিদের প্রতিনিধি নু‘মান ইবনু বাশীরকে সরিয়ে দেবে। পরবর্তী কদিনে কূফার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ধারাবাহিকভাবে প্রায় দেড়শো চিঠি ও দূত হুসাইন (রাযি.)-এর নিকটে পত্র প্রেরণ করে এ মর্মে যে, আমরা নুমান বিন বাশীরের সাথে জামা‘আতে সালাত আদায় করব না এবং ঈদেও তার ইমামতিতে সালাত আদায় করব না। আর ইরাক বাসীরা আপনার হাতে খেলাফতের বায়আত করতে আগ্রহী। ইয়াজিদকে তারা সমর্থন করেন না বলেও সাফ জানিয়ে দিল। তারা আরও বলল যে, ইরাক বাসীরা ইয়াজিদের পিতা মুয়াবিয়া (রদিয়াল্লহু আনহু)-এর প্রতিও মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না।সুতরাং আপনি আমাদের নিকটে আসুন। আপনি আসলে আমরা নু‘মানকে সিরিয়ায় বের করে দিব।কূফাবাসীদের ধারাবাহিক চিঠি ও দূতদের আগমনে হুসায়েন (রদিয়াল্লহু আনহু) বুঝতে পারেন যে, তারা সত্যিই নেতৃত্বহীন এবং ইয়াযীদের প্রতি অনুগত নয়। তারা কূফার গভর্নর নু‘মান ইবন বাশীরকে সরিয়ে দিতে প্রস্তুত এবং এমন একজন ন্যায়পরায়ণ নেতার খোঁজে, যার নেতৃত্বে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। তাদের সেই আশার প্রতীক ছিলেন হুসায়েন (রদিয়াল্লহু আনহু)। তারা বলেছিল, “إنه ليس علينا إمام” – ‘আমাদের কোন নেতা নেই’, এবং আহ্বান জানায়—”لعل الله أن يجمعنا بك على الهدى والحق” – ‘হয়তো আল্লাহ আপনার মাধ্যমে আমাদের হেদায়াত ও সত্যের উপর একত্রিত করবেন’।পরিস্থিতি যাচাই করতে হুসাইন (রদিয়াল্লহু আনহু) তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনু আক্বীলকে কূফায় পাঠান। তিনি ৬০ হিজরির রমজানের মাঝামাঝি মক্কা থেকে রওয়ানা হয়ে ৫ই শাওয়াল কূফায় পৌঁছান। হুসায়েন (রদিয়াল্লহু আনহু) তাঁকে কূফার বিশ্বস্ত কারো আশ্রয়ে থাকার নির্দেশ দেন। প্রথমে মুসলিম মুখতার ইবনু উবায়দের বাড়িতে, পরে হানী ইবনু উরওয়ার বাড়িতে অবস্থান নেন। সেখানে ১২ থেকে ১৮ হাজার লোক হুসায়েন (রদিয়াল্লহু আনহু)-এর পক্ষ নিয়ে তাঁর হাতে বায়আত করে। কিছু বর্ণনায় সংখ্যাটি ৩০ হাজারেরও বেশি বলা হয়েছে। অতঃপর মুসলিম বিন আকিল কুফায় ব্যাপক সমর্থন পেয়ে ইমাম হুসাইন (রদিয়াল্লহু আনহু)- কে তৎক্ষণাৎ আগমনের আমন্ত্রণ জানান। তার চিঠি পৌঁছতেই ৬০ হিজরির ৮ যিলহজ্জ—হজের ঠিক আগের দিন—ইমাম হুসাইন পরিবারসহ মক্কা ত্যাগ করেন। এদিকে কুফার নরমপন্থী গভর্নর নু‘মান ইবনু বাশীরকে সরিয়ে উবায়দুল্লাহ ইবনু জিয়াদকে নিয়োগ করা হয়। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়েই মুসলিম ইবনু আক্বীল ও তাঁর সহায় হানী ইবনু উরওয়াহকে গ্রেফতার করে শহিদ করেন, ফলে কুফাবাসীর প্রতিশ্রুতি স্তব্ধ হয়ে যায়। কুফার লোকদের কারও কারও অন্তরে হুসাইনের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও তাদের তলোয়ার ছিল উবাইদুল্লাহ ইবনু জিয়াদের পক্ষে।হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তখনো জানতেন না যে মুসলিম ইবনু আকীলকে হত্যা করা হয়েছে এবং কুফার লোকেরা তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।এদিকে হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) রওনা হওয়ার আগে শীর্ষ সাহাবিরা—ইবনু আব্বাস, ইবনু উমর, ইবনু জুবায়র, জাবির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) প্রমুখ—ইমামকে বারবার নিষেধ করেন এবং আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে কূফাবাসীদের পূর্ববর্তী বিশ্বাসঘাতকতার কথা তাঁকে জোরালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেন। ইবনু আববাস ও ইবনু ওমরের বারবার তাকীদ সত্ত্বেও যখন তিনি ফিরলেন না, তখন ইবনু আববাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাকে বললেন, যদি ইরাকীরা সত্যিই আপনাকে চায়, তবে তারা সদলবলে এসে আপনাকে সসম্মানে নিয়ে যাক। কিন্তু তারা তো কেবল চিঠি পাঠিয়েছে। কিন্তু হুসায়েন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কোন কথাই শুনলেন না। অবশেষে বারবার অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়ে ইবনু আববাস বললেন, ইরাকীরা প্রতারক। আপনি তাদের ধোঁকায় পড়বেন না। এরপরেও যদি আপনি নিতান্তই যেতে চান, তবে আমার অনুরোধ, আপনি মহিলা ও শিশুদের নিয়ে যাবেন না। আমি ভয় পাচ্ছি যে,উসমান যেভাবে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে নিহত হয়েছেন, আপনিও তেমনি ওদের চোখের সামনে নিহত হবেন’। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এসে তাঁকে বুঝালেন। কিন্তু তাতেও তিনি ফিরলেন না। তখন তিনি তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসিয়ে শেষ বিদায় দেন এই বলে, أَسْتَوْدِعُكَ اللهَ مِنْ قَتِيْلٍ ‘হে নিহত! আল্লাহর যিম্মায় আপনাকে সোপর্দ করলাম’।এভাবে একে একে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের, মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিইয়াহ, আবু সাঈদ খুদরী, আবু ওয়াক্বিদ লায়সী, জাবের বিন আব্দুল্লাহ, মিসওয়ার বিন মাখরামাহ, উমরাহ বিনতে আব্দুর রহমান, আবুবকর বিন আব্দুর রহমান, আব্দুল্লাহ বিন জা‘ফর, আমর বিন সাঈদ ইবনুল ‘আস প্রমুখ সাহাবীগণ তাঁকে কূফায় না যাওয়ার অনুরোধ করেন। বিশেষ করে আবু বকর বিন আব্দুর রহমান এসে তাঁকে বলেন,هُمْ عَبِيْدُ الدُّنْيَا فَيُقَاتِلُكَ مَنْ قَدْ وَعَدَكَ أَنْ يَّنْصُرَكَ ‘ওরা দুনিয়ার গোলাম। অতএব যারা আপনাকে সাহায্যের নিশ্চিত ওয়াদা করেছে, ওরাই আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে’। কিন্তু সবাইকে নিরাশ করে হুসাইন জবাব দেন, مَهْمَا يَقْضِى اللهُ مِنْ أَمْرٍ يَكُنْ ‘আল্লাহ যেটা ফায়সালা করবেন, সেটাই হবে’। এই জবাব শুনে আবু বকর বিন আব্দুর রহমান বলে উঠলেন, ‘ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজি‘ঊন’। হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঈমানদীপ্ত অবিচলতা ও কুফাবাসীদের বিশ্বাসভঙ্গই তাঁকে ইরাকের কারবালার প্রান্তরে অবস্থান নিতে বাধ্য করে। কারবালায় পৌঁছে তিনি উপলব্ধি করেন—কুফার লোকেরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে সময় তিনি শত্রুপক্ষের নিকট তিনটি ন্যায়সংগত প্রস্তাব পেশ করেন: আমাকে মক্কায় ফিরে যেতে দাও, অথবা আমি সরাসরি ইয়াজিদের দরবারে গিয়ে কথা বলি, কিংবা আমাকে সীমান্তে জিহাদে যেতে দাও। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তাঁর কোনো প্রস্তাবই গৃহীত হয়নি। বরং তাঁকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়, যা তিনি ঈমানী দৃঢ়তায় প্রত্যাখ্যান করেন।অবশেষে, যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়। উবায়দুল্লাহ ইবনু যিয়াদের নির্মম দমননীতি এবং শিমরের নিষ্ঠুর নেতৃত্বে সংঘটিত জালিম বাহিনীর আক্রমণে ৬১ হিজরির ১০ই মুহাররম, পবিত্র কারবালার প্রান্তরে অপরাধহীন, পবিত্র ও সত্যের উপর অটল এক মুমিন হিসেবে হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সহ সর্বমোট ৭২ জন শাহাদাত বরণ করেন— আর এইভাবেই ইবনে যিয়াদের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে এক কালো ইতিহাসের যবানীপাত হলো (এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৩৮-২৫০; ইমাম যাবাহী সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৯৯/২৮৫, ৪/৩৫১; তাহযীবুল কামাল; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৪০৪; তাহযীবুত তাহযীব খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৪৬। আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৮; ৯/১৬৫; ১৮৩; ১১/৪৭৩–৫২০; ইবনু সা‘দ, তাবাকাতুল কুবরা, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪১৯; ত্বাবারী, তারীখুল উমামি ওয়াল মুলূক, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৮১-৮২ পৃঃ; মুক্বাতালুত ত্বালেবীন, পৃষ্ঠা; ৬৭-৬৮; তাহযীবুত তাহযীব ২/৩০৭; ইবনু আবী শায়বাহ ১৫/৯৫; তাফসিরে তাবারী; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩৮৪-৩৮৫)।
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ,শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেন—
وُلِدَ يَزِيدَ بْنَ مُعَاوِيَةَ فِي خِلَافَةِ عُثْمَانَ بْنِ عفان رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، وَلَمْ يكن مِنْ الْمَشْهُورِينَ بِالدِّينِ وَالصَّلَاحِ ، وَكَانَ مِنْ شُبَّانِ الْمُسْلِمِينَ، وَتَوَلَّى بَعْدَ أَبِيهِ عَلَى كَرَاهَةٍ مِنْ بَعْضِ الْمُسْلِمِينَ ، وَرِضًا مِنْ بَعْضِهِمْ ، وَكَانَ فِيهِ شَجَاعَةٌ وَكَرَمٌ ، وَلَمْ يَكُنْ مُظْهِرًا لِلْفَوَاحِشِ كَمَا يَحْكِي عَنْهُ خُصُومُهُ ،
وَجَرَتْ فِي إمَارَتِهِ أُمُورٌ عَظِيمَةٌ: – أَحَدُهَا مَقْتَلُ الْحُسَيْنِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ .وَهُوَ لَمْ يَأْمُرْ بِقَتْلِ الْحُسَيْنِ ، وَلَا أَظْهَرَ الْفَرَحَ بِقَتْلِهِ ؛ وَلَا نَكَّتَ بِالْقَضِيبِ عَلَى ثَنَايَاهُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، وَلَا حَمَلَ رَأْسَ الْحُسَيْنِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ إلَى الشَّامِ ، لَكِنْ أَمَرَ بِمَنْعِ الْحُسَيْنِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، وَبِدَفْعِهِ عَنْ الْأَمْرِ ، وَلَوْ كَانَ بِقِتَالِهِ .
فَزَادَ النُّوَّابُ عَلَى أَمْرِهِ ؛ وَحَضَّ الشمر بن ذي الْجَوشَن عَلَى قَتْلِهِ لِعُبَيْدِ اللَّهِ بْنِ زِيادٍ؛ فَاعْتَدَى عَلَيْهِ عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ زِيَادٍ ، فَطَلَبَ مِنْهُمْ الْحُسَيْنُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنْ يَجِيءَ إلَى يَزِيدَ ، أَوْ يَذْهَبَ إلَى الثَّغْرِ مُرَابِطًا، أَوْ يَعُودَ إلَى مَكَّةَ ؟
فَمَنَعُوهُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، إلَّا أَنْ يَسْتَأْسِرَ لَهُمْ ، وَأَمَرَ عُمَرَ بْنَ سَعْدٍ بِقِتَالِهِ ـ فَقَتَلُوهُ مَظْلُومًا ـ لَهُ وَلِطَائِفَةِ مِنْ أَهْلِ بَيْتِهِ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ .
وَكَانَ قَتْلُهُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ مِنْ الْمَصَائِبِ الْعَظِيمَةِ ، فَإِنَّ قَتْلَ الْحُسَيْنِ، وَقَتْلَ عُثْمَانَ قَبْلَهُ: كَانَا مِنْ أَعْظَمِ أَسْبَابِ الْفِتَنِ فِي هَذِهِ الْأُمَّةِ ، وَقَتَلَتُهُمَا مِنْ شِرَارِ الْخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ .
وَلَمَّا قَدِمَ أَهْلُهُمْ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ عَلَى يَزِيدَ بْنِ مُعَاوِيَةَ : أَكْرَمَهُمْ وَسَيَّرَهُمْ إلَى الْمَدِينَةِ، وَرُوِيَ عَنْهُ أَنَّهُ لَعَنَ ابْنَ زِيَادٍ عَلَى قَتْلِهِ. وَقَالَ: كُنْت أَرْضَى مِنْ طَاعَةِ أَهْلِ الْعِرَاقِ بِدُونِ قَتْلِ الْحُسَيْنِ ، لَكِنَّهُ مَعَ هَذَا لَمْ يَظْهَرْ مِنْهُ إنْكَارُ قَتْلِهِ ، وَالِانْتِصَارُ لَهُ ، وَالْأَخْذُ بِثَأْرِهِ: كَانَ هُوَ الْوَاجِبَ عَلَيْهِ، فَصَارَ أَهْلُ الْحَقِّ يَلُومُونَهُ عَلَى تَرْكِهِ لِلْوَاجِبِ ، مُضَافًا إلَى أُمُورٍ أُخْرَى .
وَأَمَّا خُصُومُهُ فَيَزِيدُونَ عَلَيْهِ مِنْ الْفِرْيَةِ أَشْيَاءَ
“ইয়াজিদ ইবনে মু‘আবিয়া উসমান ইবনু আফফান (রাঃ)-এর খেলাফতের সময় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ধার্মিকতা বা সালেহ হওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন না, বরং মুসলমান যুবকদের একজন ছিলেন।তবে তিনি কাফের বা মুনাফিকও ছিলেন না।তাঁর খেলাফতের বায়আত কিছু মুসলিমের অপছন্দ এবং কিছু মুসলিমের সম্মতিতে অনুষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে সাহস ও দানশীলতা ছিল। তিনি -তার বিরোধীদের বর্ণনা অনুযায়ী- প্রকাশ্যে গুনাহ করতেন বলে যা বলা হয়ে থাকে তা প্রমাণিত হয়নি। তাঁর খেলাফতের সময় কিছু বড় ঘটনা ঘটে:এর একটি হলো: হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-র শাহাদাত।তবে ইয়াজিদ তাঁকে হত্যা করার নির্দেশ দেননি, তাঁর শাহাদাতে আনন্দ প্রকাশ করেননি এবং তাঁর দাঁতের ওপর ছড়ি চালাননি।এমনকি হুসাইনের মাথাও শামে পাঠানো হয়নি। তবে তিনি হুসাইন (রাঃ)-কে বাধা দিতে ও ক্ষমতা গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে তার গভর্নরদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন, এমনকি প্রয়োজনে শক্তি ব্যবহার তথা যুদ্ধ করে হলেও তা করতে বলেছিলেন।কিন্তু গভর্নর ও সেনাপতিরা এ নির্দেশের সীমা লঙ্ঘন করেন।বিশেষ করে শিমর ইবনে যিল-জাওশন, সে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে হুসাইন (রাঃ)-কে হত্যা করতে উৎসাহিত করে। অতঃপর উবায়দুল্লাহ অন্যায়ভাবে হুসাইন (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালায়। তখন হুসাইন (রাঃ) তাদের নিকট তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন: (১).হয় আমি ইয়াজিদের কাছে যাই,( ২),নয়তো সীমান্তে জিহাদে যাই, (৩).অথবা মক্কায় ফিরে যাই। তারা কোনোটি অনুমতি দিল না বরং সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন,একমাত্র শর্ত হলো তিনি বন্দি হবেন। এরপর উমর ইবনে সা’আদকে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয় এবং তাঁকে শহীদ করা হয়। তিনি এবং তাঁর পরিবারের একদল মজলুম সদস্য (অন্যায়ভাবে) শহীদ হন। হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদাত ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক বড় বিপর্যয়। ঠিক যেমন উসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতও ছিল এক মহা মুসিবত। এই দুই হত্যাই ছিল ইসলামী উম্মাহর মধ্যে ফিতনার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর অন্যতম, আর তাঁদের হত্যাকারীরা আল্লাহর কাছে সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ। যখন হুসাইন (রাঃ)-এর পরিবার ইয়াজিদের কাছে পৌঁছায়, তখন তিনি তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। এমনকি একটি বর্ণনায় এসেছে যে, ইয়াজিদ উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে হুসাইন (রাঃ)-কে হত্যার জন্য অভিশাপ দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন:”আমি তো ইরাকিদের আনুগত্য হুসাইনকে হত্যা না করেও পেতে পারতাম!’ এতসব সত্ত্বেও ইয়াজিদ হুসাইন (রাযি.)-এর হত্যার প্রতি প্রকাশ্য নিন্দা জানাননি, তাঁর পক্ষ নিয়ে কিসাস আদায় বা প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি—যা তাঁর ওপর ফরয ছিল। এ কারণে সত্যনিষ্ঠ ও ইনসাফপ্রিয় ব্যক্তিরা তাঁকে এ ফরয ত্যাগের জন্য তিরস্কার করেছেন; পাশাপাশি অন্যান্য নানা দোষও তাঁর প্রতি আরোপ করেছেন।তবে তাঁর বিরোধীপক্ষ তার চেয়েও অনেক বড় বড় মিথ্যা ও বানোয়াট অপবাদ আরোপ করে অতিরঞ্জনা করেছে।”—(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪১০-৪১৩)।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) হুসাইন (রাঃ) এর জীবনীর কিছু অংশ ও তাঁর ন্যায়পরায়ণতা তুলে ধরতে গিয়ে আরো বলেছেন:
ثم إنَّهُ مَاتَ وَصَارَ إلَى كَرَامَةِ اللَّهِ وَرِضْوَانِهِ، وَقَامَتْ طَوَائِفُ كَاتَبُوا الْحُسَيْنَ وَوَعَدُوهُ بِالنَّصْرِ وَالْمُعَاوَنَةِ إذَا قَامَ بِالأَمْرِ، وَلَمْ يَكُونُوا مِنْ أَهْلِ ذَلِكَ، بَلْ لَمَّا أَرْسَلَ إلَيْهِمْ ابْنَ عَمِّهِ أَخْلَفُوا وَعْدَهُ، وَنَقَضُوا عَهْدَهُ، وَأَعَانُوا عَلَيْهِ مَنْ وَعَدُوهُ أَنْ يَدْفَعُوهُ عَنْهُ، وَيُقَاتِلُوهُ مَعَهُ. وَكَانَ أَهْلُ الرَّأْيِ وَالْمَحَبَّةِ لِلْحُسَيْنِ كَابْنِ عَبَّاسٍ وَابْنِ عُمَرَ وَغَيْرِهِمَا أَشَارُوا عَلَيْهِ بِأَنْ لا يَذْهَبَ إلَيْهِمْ، وَلا يَقْبَلَ مِنْهُمْ، وَرَأَوْا أَنَّ خُرُوجَهُ إلَيْهِمْ لَيْسَ بِمَصْلَحَةٍ، وَلا يَتَرَتَّبُ عَلَيْهِ مَا يَسُرُّ، وَكَانَ الأَمْرُ كَمَا قَالُوا، وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَقْدُورًا. فَلَمَّا خَرَجَ الْحُسَيْنُ – رضي الله عنه – وَرَأَى أَنَّ الأُمُورَ قَدْ تَغَيَّرَتْ، طَلَبَ مِنْهُمْ أَنْ يَدْعُوهُ يَرْجِعُ، أَوْ يَلْحَقَ بِبَعْضِ الثُّغُورِ، أَوْ يَلْحَقَ بِابْنِ عَمِّهِ يَزِيدَ، فَمَنَعُوهُ هَذَا وَهَذَا. حَتَّى يَسْتَأْسِرَ، وَقَاتَلُوهُ فَقَاتَلَهُمْ فَقَتَلُوهُ. وَطَائِفَةٌ مِمَّنْ مَعَهُ، مَظْلُومًا شَهِيدًا شَهَادَةً أَكْرَمُهُ اللَّهُ بِهَا وَأَلْحَقَهُ بِأَهْلِ بَيْتِهِ الطَّيِّبِينَ الطَّاهِرِينَ. وَأَهَانَ بِهَا مَنْ ظَلَمَهُ وَاعْتَدَى عَلَيْهِ، وَأَوْجَبَ ذَلِكَ شَرًّا بَيْنَ النَّاسِ.فَصَارَتْ طَائِفَةٌ جَاهِلَةٌ ظَالِمَةٌ: إمَّا مُلْحِدَةٌ مُنَافِقَةٌ، وَإِمَّا ضَالَّةٌ غَاوِيَةٌ، تُظْهِرُ مُوَالاتَهُ، وَمُوَالاةَ أَهْلِ بَيْتِهِ تَتَّخِذُ يَوْمَ عَاشُورَاءَ يَوْمَ مَأْتَمٍ وَحُزْنٍ وَنِيَاحَةٍ، وَتُظْهِرُ فِيهِ شِعَارَ الْجَاهِلِيَّةِ مِنْ لَطْمِ الْخُدُودِ، وَشَقِّ الْجُيُوبِ، وَالتَّعَزِّي بِعَزَاءِ الْجَاهِلِيَّةِ.وَاَلَّذِي أَمَرَ اللَّهُ بِهِ وَرَسُولُهُ فِي الْمُصِيبَةِ – إذَا كَانَتْ جَدِيدَةً – إنَّمَا هُوَ الصَّبْرُ وَالاحْتِسَابُ وَالاسْتِرْجَاعُ. كَمَا قَالَ تَعَالَى: وَبَشِّرْ الصَّابِرِينَ الَّذِينَ إذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إلَيْهِ رَاجِعُونَ أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمْ الْمُهْتَدُونَ. وَفِي الصَّحِيحِ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ: لَيْسَ مِنَّا مِنْ لَطَمَ الْخُدُودَ، وَشَقَّ الْجُيُوبَ، وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ. وَقَالَ: أَنَا بَرِيءٌ مِنْ الصَّالِقَةِ، وَالْحَالِقَةِ، وَالشَّاقَّةِ. وَقَالَ: النَّائِحَةُ إذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَانٍ وَدِرْعٌ مِنْ جَرَبٍ.وَفِي الْمُسْنَدِ عَنْ فَاطِمَةَ بِنْتِ الْحُسَيْنِ، عَنْ أَبِيهَا الْحُسَيْنِ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ: مَا مِنْ رَجُلٍ يُصَابُ بِمُصِيبَةٍ، فَيَذْكُرُ مُصِيبَتَهُ وَإِنْ قَدِمَتْ، فَيُحْدِثُ لَهَا اسْتِرْجَاعًا إلاّ أَعْطَاهُ اللَّهُ مِنْ الأَجْرِ مِثْلَ أَجْرِهِ يَوْمَ أُصِيبَ بِهَا. وَهَذَا مِنْ كَرَامَةِ اللَّهِ لِلْمُؤْمِنِينَ، فَإِنَّ مُصِيبَةَ الْحُسَيْنِ وَغَيْرِهِ إذَا ذُكِرَتْ بَعْدَ طُولِ الْعَهْدِ، فَيَنْبَغِي لِلْمُؤْمِنِ أَنْ يَسْتَرْجِعَ فِيهَا كَمَا أَمَرَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ لِيُعْطَى مِنْ الأَجْرِ مِثْلُ أَجْرِ الْمُصَابِ يَوْمَ أُصِيبَ بِهَا.وَإِذَا كَانَ اللَّهُ تَعَالَى قَدْ أَمَرَ بِالصَّبْرِ وَالاحْتِسَابِ عِنْدَ حَدَثَانِ الْعَهْدِ بِالْمُصِيبَةِ، فَكَيْفَ مَعَ طُولِ الزَّمَانِ، فَكَانَ مَا زَيَّنَهُ الشَّيْطَانُ لأَهْلِ الضَّلالِ وَالْغَيِّ مِنْ اتِّخَاذِ يَوْمِ عَاشُورَاءَ مَأْتَمًا، وَمَا يَصْنَعُونَ فِيهِ مِنْ النَّدْبِ وَالنِّيَاحَةِ، وَإِنْشَادِ قَصَائِدِ الْحُزْنِ، وَرِوَايَةِ الأَخْبَارِ الَّتِي فِيهَا كَذِبٌ كَثِيرٌ وَالصِّدْقُ فِيهَا لَيْسَ فِيهِ إلا تَجْدِيدُ الْحُزْنِ، وَالتَّعَصُّبُ، وَإِثَارَةُ الشَّحْنَاءِ وَالْحَرْبِ، وَإِلْقَاءُ الْفِتَنِ بَيْنَ أَهْلِ الإِسْلامِ، وَالتَّوَسُّلُ بِذَلِكَ إلَى سَبِّ السَّابِقِينَ الأَوَّلِينَ، وَكَثْرَةُ الْكَذِبِ وَالْفِتَنِ فِي الدُّنْيَا وَلَمْ يَعْرِفْ طَوَائِفُ الإِسْلامِ أَكْثَرَ كَذِبًا وَفِتَنًا وَمُعَاوَنَةً لِلْكُفَّارِ عَلَى أَهْلِ الإِسْلامِ، مِنْ هَذِهِ الطَّائِفَةِ الضَّالَّةِ الْغَاوِيَةِ، فَإِنَّهُمْ شَرٌّ مِنْ الْخَوَارِجِ الْمَارِقِينَ.وَأُولَئِكَ قَالَ فِيهِمْ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم: يَقْتُلُونَ أَهْلَ الإِسْلامِ، وَيَدَعُونَ أَهْلَ الأَوْثَانِ. وَهَؤُلاءِ يُعَاوِنُونَ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى وَالْمُشْرِكِينَ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَأُمَّتِهِ الْمُؤْمِنِينَ كَمَا أَعَانُوا الْمُشْرِكِينَ مِنْ التُّرْكِ وَالتَّتَارِ عَلَى مَا فَعَلُوهُ بِبَغْدَادَ، وَغَيْرِهَا، بِأَهْلِ بَيْتِ النُّبُوَّةِ، وَمَعْدِنِ الرِّسَالَةِ وَلَدِ الْعَبَّاسِ، وَغَيْرِهِمْ مِنْ أَهْلِ الْبَيْتِ وَالْمُؤْمِنِينَ، مِنْ الْقَتْلِ وَالسَّبْيِ وَخَرَابِ الدِّيَارِ.
“অতঃপর তিনি মারা গিয়ে আল্লাহর রহমত ও তাঁর সন্তুষ্টিতে স্থান করে নিয়েছেন। অথচ এমন কিছু দল রয়েছে যারা হুসাইন (রাঃ) এর সাথে পত্র আদান প্রদান করে প্রয়োজনের সময় তাঁকে সমর্থন দেয়ার ও সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তারা সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তিনি যখন তাদের কাছে তাঁর ভাতিজাকে পাঠালেন তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখেনি। শুধু তাই নয় তারা তাঁর পক্ষ নিয়ে লড়াই করার পরিবর্তে তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও ইবনে উমর (রাঃ) এর মত হুসাইন (রাঃ) এর বিচক্ষণ শুভাকাংখীগণ তাঁকে সেসব প্রতিশ্রুতি গ্রহণ না করতে ও তাদের কাছে না যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাদের নিকট যাওয়াতে কোন কল্যাণ নেই, এর পরিণতি শুভ হবে না। তারা যা বলেছেন সেটাই ঘটেছে। তাকদীর তো আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্বনির্ধারিত। যখন হুসাইন (রাঃ) তাদের কাছে পৌঁছে দেখলেন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন; তখন তিনি ফেরত চলে যাওয়ার কিংবা কোন সীমান্ত চকিতে আশ্রয় নেয়ার কিংবা তাঁর চাচাত ভাই ইয়াজিদ এর সাথে দেখা করার সুযোগ চাইলেন। কিন্তু তারা বন্দি হিসেবে আত্মসমর্পণ না করলে তাকে কোন সুযোগ দিতে রাজি হল না। এক পর্যায়ে তারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনিও তাদের বিরুদ্ধে লড়ে গেলেন। অবশেষে তারা তাঁকে ও তাঁর পক্ষের লোকজনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে শহিদ করল। আল্লাহ তাআলা এই শাহাদাতের মাধ্যমে তাঁকে আহলে বাইতের পুতপবিত্র পূর্বসূরিদের সাথে একত্রিত করলেন এবং এর মাধ্যমে তাঁর সাথে যারা অন্যায় করেছে ও সীমালঙ্ঘন করেছে তাদেরকে অপমানিত অপদস্থ করলেন। এই ঘটনা মানুষের মধ্যে অকল্যাণকে অনিবার্য করে তুলেছে। একদল মানুষ- জাহেল ও জালেমে পরিণত হয়েছে। অপর একদল হয়েছে- নাস্তিক মুনাফিক। অপর একদল হয়েছে- পথভ্রষ্ট বিভ্রান্ত। পথভ্রষ্ট দলটি তাঁর প্রতি ও আহলে বাইতের প্রতি মহব্বত প্রকাশ করত। তারা আশুরার দিনকে মাতম, দুঃখপ্রকাশ ও ক্রন্দনের দিন হিসেবে গ্রহণ করত। এই দিনে তারা জাহেলি রীতিতে গালে চড় মারা, বুকের আচ্ছাদন উন্মুক্ত করা ও জাহেলি রীতিতে শোক প্রকাশ করা ইত্যাদি চর্চা করে। অথচ সদ্য ঘটিত বিপদ মুসিবতের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ হচ্ছে- ধৈর্য ধারণ করা, বিপদকে সওয়াব অর্জনের মওকা হিসেবে গ্রহণ করা ও ইন্নালিল্লাহ… বলা। আল্লাহ তাআলা বলেন: (অর্থ- তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের। যারা বিপদে পতিত হলে বলে: ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন (নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁরই সান্নিধ্যে আমরা ফিরে যাবো)। এদের প্রতি আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত নাযিল হয় এবং এরা সুপথেপরিচালিত।)[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫] সহিহ হাদিসে এসেছে- “যে ব্যক্তি গালে চপেটাঘাত করে, বুকের আচ্ছাদন খুলে ফেলে (অসন্তুষ্টি প্রকাশার্থে) ও জাহেলী ডাক চিৎকার করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়”। তিনি আরও বলেন: “(বিপদের সময়) ডাক চিৎকার করে ক্রন্দনকারী, মাথা মুণ্ডনকারী ও পোশাক আশাক ছিন্নভিন্নকারীর সাথে আমার সম্পর্ক নেই”। তিনি আরও বলেন: “যদি বিলাপকারিনী মৃত্যুর আগে তওবা না করে তাহলে কেয়ামতের দিন তাকে এমন অবস্থায় উঠানো হবে তার গায়ে থাকবে আলকাতরার পোশাক, শরীরের চামড়া যেন গুটি বসন্তের বর্ম।” মুসনাদে এসেছে-ফাতেমা বিনতে হুসাইন তাঁর পিতা হুসাইন (রাঃ) থেকে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, “যদি কোন ব্যক্তি তার পুরাতন কোন মুসিবতের কথা স্মরণ করে এবং নতুনভাবে আবার ইন্নালিল্লাহ…পড়ে তাহলে মুসিবতের দিন আল্লাহ তাকে যে সওয়াব দিয়েছিলেন আজকেও সে সওয়াব দিবেন।” এটি মুমিনদের প্রতি আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ। তাই হুসাইন (রাঃ) এর মুসিবত এবং অন্য কারো মুসিবতের কথা স্মরণ হলে মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে- ইন্নালিল্লাহ…পড়া; যেভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন; যাতে করে বিপদের দিন বিপদাপন্ন ব্যক্তিকে আল্লাহ যেভাবে সওয়াব দিয়েছেন তাকেও সে সওয়াব দেন। তাই আল্লাহ তাআলা যদি খোদ বিপদের সময় ধৈর্য রাখার ও সওয়াবপ্রাপ্তির নিয়ত করার নির্দেশ দেন তাহলে এতকাল পরে ব্যাপারটা কেমন হতে পারে!এজন্য পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত গোষ্ঠী কর্তৃক আশুরার দিনে মাতম করা, বিলাপ ও ডাক চিৎকার করা, শোকাবহ কাসিদা (কবিতা) পড়া, বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করা যেগুলো মিথ্যাতে ভরপুর; আর কিছু সত্য হলেও এতে শোককে চাঙ্গা করা ও গোঁড়ামি বাড়ানো ছাড়া কোন ফায়দা নেই- এসব কিছু শয়তানের প্ররোচনা।এতে করে পারস্পারিক জিঘাংসা বাড়ে, যুদ্ধের উস্কানি দেয়া হয়, ইসলামপন্থীদের মাঝে গন্ডগোল সৃষ্টি হয়, পূর্ববর্তীদেরকে গালিগালাজ করার পথ খুলে যায়, দুনিয়াতে মিথ্যার ঢাকঢোল ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এই পথভ্রষ্ট বিভ্রান্ত দলটির মত আর কোন মুসলিম উপদল মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, পারস্পারিক গোলযোগ সৃষ্টি ও কাফেরদের সাথে সহযোগিতা করে না। এরা খারেজিদের চেয়ে জঘন্য; যাদের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তারা মূর্তিপূজকদেরকে বাদ দিয়ে মুসলমানদেরকে হত্যা করে।” আর এরা আহলে বাইত (নবী পরিবার) ও উম্মতে মুসলিমার বিরুদ্ধে ইহুদি, নাসারা ও মুশরিকদেরকে সাহায্য দিয়েছে; তারা বাগদাদে ও অন্যান্য স্থানে আহলে বাইত তথা আব্বাস (রাঃ) এর বংশধরদের বিরুদ্ধে তুর্কি মূর্তিপূজক ও তাতারি মূর্তিপূজকদেরকে সাহায্য দিয়েছে; যারা হত্যাযজ্ঞ, বন্দি ও ঘরবাড়ী ধ্বংস ইত্যাদির কোন কিছু বাদ রাখেনি।”(ইবনু তাইমিয়া; মিনহাজুস-সুন্নাহ আন-নাবাবিয়্যাহ খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫০৯-৫১৩; মুদ্রণ: কায়রো, মুআস্সাসাতু কুর্তুবা, ১৪০৬ হি;) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
No comments:
Post a Comment