বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ঈদে মিলাদুন্নবি: উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং মিলাদ পন্থীদের ৫টি বহুল প্রচলিত সংশয়ের খণ্ডন।
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
❑ ঈদে মিলাদুন্নবি-এর শুরুর কথা:
◈◈ মিলাদের উৎপত্তি কারক হল, বনি উবায়দিয়া বা ফাতেমিয় সম্প্রদায়:
ঐতিহাসিকগণ বলেন, যারা সর্বপ্রথম এই বিদআতকে রূপদান করে তারা হল, বনি উবাইদ আল কাদ্দাহ। এরানিজেদেরকে ফাতেমি বলে অবিহিত করত এবংনিজেদেরকে আলি রা. এর বংশধর বলে দাবী করত। এরাই ফাতেমি দাওয়াতের প্রতিষ্ঠাতা।” [আল বিদায়াহ ওয়াননিহায়াহ, ১১/২০২]
◈◈ এদের পরিচয় ও আসল রূপ:
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.কে এই ফাতেমিয়দের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা কর হলে তিনি উত্তরে বলেন, “তারা ছিল জঘন্য ধরণের পাপাচারী এবংনিকৃষ্ট কাফের। কেউ যদি তাদেরকে ইমানদার এবং পরহেজগার বলে সাক্ষ্য দেয় অথবা তাদের বংশ পরম্পরাকে সঠিক বলে স্বীকৃতি দেয় তবে তারা এমন বিষয়ে কথা বলল যে ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ
“সে বিষয়ের পিছে ছুট না যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই।“[1] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
إِلَّا مَن شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
“তবে যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দিল।”[2]
এ সকল লোকদের ব্যাপারে সমস্ত আলেম সমাজ, ইমামগণ এবং সর্বস্তরের মানুষ সাক্ষ্য দেয় যে, এরা ছিল নাস্তিক, ধর্মচ্যুত এবং মুনাফিক। এরা বাহ্যিক ভাবে যদিও ইসলাম প্রকাশ করত কিন্তু তাদের অন্তরে লুকানো ছিল কুফরি। সুতরাং কেউ যদি তাদের ইমানের সাক্ষ্য দেয় তবে সে এমন বিষয়ে সাক্ষ্য দিল, যে ব্যাপারে তার জ্ঞান নেই। কারণ, তাদের কার্যক্রম থেকে এমন কিছু পাওয়া যায় না যাতে তাদের ইমানের প্রমাণ পাওয়া যায়।
অনুরূপভাবে তাদের বংশগত সম্পর্কের ব্যাপারেও অধিকাংশ আলেমগণ দোষারোপ করেছেন। তারা বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে এরা অগ্নিপূজক অথবা ইহুদিদের সন্তান। এটাই হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলিদের অনেক আলেমের প্রসিদ্ধ মতামত। এমনকি মুহাদ্দেসিনগণ, আহলে কালাম, বংশ বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষেরও মন্তব্য এটাই। যে সকল লেখক মানুষের জীবন পঞ্জিকা এবং ইতিহাস লিখেছেন তারাও এ বিষয়টি তাদের বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
সর্বপ্রথম যারা মিলাদ তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম অনুষ্ঠান পালনের বিদআত সূচনা করে তারা হল বাতেনি সম্প্রদায়। যাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল, দীন ইসলামের মাঝে পরিবর্তন সাধন করে তার মধ্যে এমন কিছু ঢুকানো যার অস্তিত্ব দীনের মধ্যে ছিল না। কারণ, ইসলামি শরীয়ত এবং রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নত থেকে মানুষকে দূরে সরানোর সব চেয়ে সহজ পদ্ধতি হল, তাদেরকে বিদআতের মধ্যে ব্যস্ত রাখা।
মাকরীযী বলেন, ফাতেমি খলিফাগণ বিভিন্ন দিনকে আনন্দ-উৎসবের দিন হিসেবেনির্ধারণ করেছিল এবং এসব দিনে তারা জন-সাধারণের মাঝে খাদ্য বিতরণ এবং বিভিন্ন উপহার সামগ্রী প্রদান করত।
উবায়দিয়ারা সারা বছর ধরে যে সব দিনকে আনন্দ-উৎসবের দিন হিসেবে পালন করত সেগুলো হল:
১) নব বর্ষ ২) আশুরা ৩) রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিবস ৪) আলি রা. এর জন্ম দিবস ৫) হাসান রা. এর জন্ম দিবস ৬) হুসাইন রা. এর জন্ম দিবস ৭) ফাতেমাতুজ জোহরা রা. এর জন্ম দিবস ৮) ক্ষমতাসীন শাসকের জন্ম দিবস ৯) রজব মাসের ১ম দিন ৯) রজব মাসের ১৫ তারিখের রাত ১০) শাবান মাসের ১ম দিন ১১) অর্ধশাবানের রাত (শবে বরাত) ১২) রমজানের ১ম রাত ১৩) রমাজানের ১ম দিন ১৪) রমজানের মধ্যভাগ ১৫) রমজানের শেষ রাত ১৬) ঈদুল ফিতরের মৌসুম ১৭) কুরবানির মৌসুম ১৮) গাদির উৎসব ১৯) নওরোজ (নববর্ষ) ২০) এবং ২১) যিশু খৃষ্টের জন্ম দিন (বড়দিন) ইত্যাদি।
মাকরিযির পক্ষ থেকে এটা একটি স্পষ্ট সাক্ষ্য। যদিও তিনি এদেরকে আলি রা. এর বংশধর হিসেবে শুধু স্বীকৃতি দেন না বরং তাদের পক্ষাবলম্বন করে বিরোধীদের জবাব দেন। কিন্তু তিনি অকপটে এ কথার সাক্ষ্য দিলেনে যে, এ ফাতেমিয়রাই মুসলিমদের বিপদের কারণ। এরাই বিভিন্ন বিদআতি অনুষ্ঠানের পথ উন্মুক্ত করে। এমন কি এরা অগ্নিপূজক এবং খৃষ্টানদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদীও পালন করে। যেমন নওরোজ বা নববর্ষ এবং যিশু খৃষ্টের জন্ম দিন (বড় দিন) ইত্যাদি।
❑ মিলাদ পন্থীদের কতিপয় ৫টি বহুল প্রচলিত সংশয় এবং সেগুলোর খণ্ডন:
◍ প্রথম সংশয়: আশুরার রোজার উপর ভিত্তি করে মিলাদ উদযাপন!
ইমাম সুয়ুতি বলেন, মিলাদের স্বপক্ষে ইমাম ইবনে হাজার হাদিস থেকে একটি প্রমাণ বের করেছেন। আমি তার সাথে আরও একটি প্রমাণ বের করেছি।
তিনি (ইমাম সুয়ুতি) বলেন, যুগের হাফেজে হাদিস শাইখুল ইসলাম আহমদ ইবনে হাজারকে মিলাদ করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি যা বলেন তা হুবহু তুলে ধরা হল:
“মিলাদ করা বিদআত। এর স্বপক্ষে ইসলামের প্রথম তিন শ্রেষ্ঠ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মনিষী তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈন থেকে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তদুপরি মিলাদে কিছু ভালো জিনিস রয়েছে আর কিছু খারাপ জিনিস রয়েছে। কেউ যদি মিলাদে ভালো জিনিসগুলোর উদ্দেশ্য করে এবং মন্দ জিনিসগুলো পরিত্যাগ করে তবে তা ‘বিদআতে হাসানা’ হিসেবে গণ্য হবে; অন্যথায় নয়। আমি এ ব্যাপারে একটি মজবুত প্রমাণ পেয়েছি। আর তা হল, সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করে মদিনা গমন করার পর দেখলেন ইহুদিরা মুহররম মাসের দশ তারিখে আশুরার রোজা পালন করছে। তিনি এ ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এই দিনে আল্লাহ তাআলা ফেরাউনকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন এবং মুসা আ. কে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই আল্লাহর শুকরিয়া স্বরূপ আমরা এ দিনে রোজা পালন করি।
তাই উক্ত হাদিস থেকে এই প্রমাণ গ্রহণ করা যেতে পারে যে, কোন একটি বিশেষ দিনে সুসংবাদ বা কল্যাণের বার্তা এলে কিংবা কোন বিপদ মুক্ত হলে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে কিছু আমল করা যায় এবং প্রতি বছর ঐ বিশেষ দিনটি ফিরে আসলে সে আমলগুলো পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে। আর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা যায় বিভিন্নভাবে। যেমন: সেজদায়ে শোকর, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা ইত্যাদি। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়ার দিনটির চেয়ে এত বড় আনন্দের এবং এত বিশালনিয়ামতের দিন আর কী হতে পারে?
অতএব এ ভিত্তিতে রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিনটিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যাতে মুসা আ. এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে আশুরার রোজা রাখার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। এ দিকটি যারা খেয়াল করে না তারা মাসের যে কোন দিন মিলাদ করতে কোন দ্বিধা করে না। কিছু মানুষ এটাকে আরেকটু ঢিল দিয়ে বছরের যে কোন একদিন পালন করে থাকে। কিন্তু এতে কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে।[4]
➧ এই সংশয়ের জবাব:
উপরে উত্থাপিত সংশয়ের একাধিক জবাব রয়েছে।নিন্মে সেগুলো তুলে ধরা হল:
◯ প্রথমত:
ইবনে হাজার রাহ. প্রথমেই স্পষ্টভাবে স্বীকার করেনিয়েছেন যে, রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম উপলক্ষে মিলাদ উদযাপন করা বিদআত। যা ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর মনিষীগণ তথা রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈগণ থেকে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। অতএব মিলাদ বাতিল প্রমাণের জন্য এটাই যথেষ্ট। কারণ, মিলাদে যদি ভালো কিছু থাকত তবে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈগণ এবং তাদের পরবর্তীতে ইসলামের জ্ঞানী-গুনি এবং মহা মনিষীগণ সবার আগে সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য ছুটে যেতেন।
◯ দ্বিতীয়ত:
আশুরার দিন রোজা রাখার হাদিসের উপর ভিত্তি করে মিলাদকে বৈধতা দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, ইবনে হাজার রা. তো নিজেই স্বীকার করেছেন যে, মিলাদ করা বিদআত। কেননা সালাফে-সালেহিন তথা ইসলামের প্রথম তিন যুগের মনিষীগণ থেকে প্রমাণিত নয়।
সালাফে-সালেহিন যেহেতু উপরোক্ত আশুরার হাদিসের উপর ভিত্তি করে মিলাদ করেননি। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, এটাকে টেনে এনে মিলাদের পক্ষে দলিল বানানো মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এটাকে মিলাদের স্বপক্ষে দলিল বানাতে চান তাদের বুঝ এবং ইসলামের প্রথম যুগের মনিষীদের বুঝের মধ্যে কোন মিল নেই।
রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবি এবং তাবেঈণগণ হাদিসের বক্তব্যকে যে অর্থে বুঝেননি এবং তা আমল করেননি তার উল্টো অর্থে যদি পরবর্তী যুগের লোকেরা হাদিসকে ব্যাখ্যা দিতে যায় তাহলে তা হবে মারাত্মক অন্যায়। কারণ এটা তাঁদের ইজমা বা সর্ব সম্মত মতের বিপরীত। আর তাঁরা কখনই বতিলের উপর একমত হতে পারে না।
◯ তৃতীয়ত:
আশুরার রোজার উপর ভিত্তি করে মিলাদকে বৈধ করা করা একটি অপচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। কারণ যে কোন এবাদত গ্রহণযোগ্য হতে হলে শরীয়তের সুস্পষ্ট দলীলের উপর তার ভিত্তি থাকতে হবে। এক্ষেত্রেনিজস্ব খেয়াল-খুশি আর মনগড়া ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান যোগ্য।
◯ চতুর্থত:
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো মুহররম মাসে দশ তারিখে রোজা রাখতে উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু তিনি তো মিলাদ করতে বলেননি। কিংবা ঈদে মিলাদুন্নবি তথা তাঁর জন্মোৎসব পালন করতে বলেননি। কিংবানিজেও কখনও করেননি।
মিলাদে যদি কোন উপকার থাকত তবে অবশ্যই তিনি তাঁর উম্মতকে স্পষ্টভাবে তা পালন করার কথা বলে যেতেন। কারণ, দুনিয়া-আখিরাতের এমন কোন কল্যাণকর দিক নেই যা তিনি তার উম্মতকে বলে দেননি কিংবা এমন কোন ক্ষতিকর দিক নেই যে ব্যাপারে সাবধান করেননি। বরং তিনি দীনের ভিতর নতুন নতুন বিদআত তৈরি করার ব্যাপারে কঠিন ভাবে সতর্ক করে গেছেন। তিনি বলেন,
وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ
“দীনের মধ্যে নতুন সৃষ্ট বিষয়াদি থেকে সাবধান! কারণ প্রতিটি নতুন আবিষ্কৃত বিষয়ই গোমরাহি।[5]
তিনি বিভিন্ন সময় বক্তৃতা দেওয়ার শুরুতে বলতেন:
أَمَّا بَعْدُ: فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ
“অতঃপর, সর্বোত্তম বাণী হল আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তমনির্দেশনা হচ্ছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরনির্দেশনা। সব চেয়েনিকৃষ্ট জিনিস হল দীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কৃত বিষয়াদি। আর প্রতিটি নতুন বিষয়ই ভ্রষ্টতা।[6]
◍ দ্বিতীয় সংশয়:
রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃকনিজের আকিকানিজেই করার হাদিস থেকে মিলাদের পক্ষে দলিল আবিষ্কার!!
ইমাম সুয়ুতি আরও বলেন, মিলাদের স্বপক্ষে ইমাম ইবনে হাজার রা. এর উপরোক্ত দলিল ছাড়াও আমি আরেকটি দলিল বের করেছি। আর তা হল,
সুনান বায়হাকিতে আনাস রা. হতে বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়ত প্রাপ্তির পরনিজেইনিজের আকিকা দিয়েছেন। যদিও তাঁর দাদা আব্দুল মোত্তালেব জন্মের সপ্তম দিনে তাঁর আকিকা দিয়েছিলেন। আর আকিকা তো একাধিক বার দেওয়া যায় না। তাই বিষয়টার তাৎপর্য এভাবে গ্রহণ করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা যেহেতু তাকে জগতবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ দুনিয়ার বুকে প্রেরণ করেছেন তার কৃতজ্ঞতা আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি আকিকা দিয়েছিলেন। তা ছাড়া তিনিনিজেইনিজের নামে দরুদ ও সালাম পেশ করতেন।
সুতরাং রসুলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম দিবস উপলক্ষে আমাদের কর্তব্য হল, সম্মিলিতভাবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়, ভোজ সভার আয়োজন সহ আরও বিভিন্ন নেক কাজ আঞ্জাম দেওয়া এবং আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করা।[7]
➧ উক্ত সংশয়ের জবাব:
২. হাফেজ ইবনে হাজার রহ. ফাত্হুল বারীতে উল্লেখ করেছেন, উক্ত হাদিসটি প্রমাণিত নয় এবং তিনি হাদিসটি ইমাম বাজ্জারের দিকে সম্বন্ধ করে বল , ইমাম বাযযার বলেছেন, “এ হাদিসটি আব্দুল্লাহ মুহারারারের একক বর্ণনা। কিন্তু তিনি দুর্বল।[9]
৩. ইমাম নওয়াবি আল মুহাযযাব কিতাবের ব্যাখ্যা গ্রন্থ আল মাজমু কিতাবে বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরনিজের আকিকা করার ব্যাপারে গ্রন্থকার যে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন তা আব্দুল্লাহ বিন মুহাররার কাতাদা থেকে বর্ণনা করেছেন। কাতাদা আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়তের পরনিজেনিজের আকিকা দিয়েছেন। কিন্তু এ হাদিসটি বাতিল। হাদিসের সনদে উল্লেখিত আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাররার সর্বসম্মত ভাবে দুর্বল রাবী (বর্ণনাকারী)। হাফেজ ইবনে হাজার তাকে مَتْرُوْكٌ বা পরিত্যক্ত বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ ভালো জানেন।[10]
৪. ইমাম জাহাবি মিজানুল ইতিদাল গ্রন্থে আব্দুল্লাহ বিন মুহাররার-এর জীবনী লিখেছেন এবং তার ব্যাপারে হাফেজ ইবনে হাজার রাহ. এর মন্তব্য উল্লেখ করার পর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, তিনি একজন পরিত্যক্ত এবং অনির্ভর যোগ্য বর্ণনাকারী। তিনি আরও বলেন, আনাস রা. থেকে কাতাদা কর্তৃক “নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবি হওয়ার পরনিজেনিজের আকিকা করেছেন” মর্মে বর্ণিত হাদিসটি তার অন্যতম একটি সমস্যাপূর্ণ বিষয়।[11]
◍ তৃতীয় সংশয়: স্বপ্নকে দলিল বানিয়ে মিলাদের পক্ষে সাফাই!
ইমাম সুয়ুতি রাহ. বলেন, ইমামুল কুররা হাফেজ শামসুদ্দিন ইবনুল জাযারী তার ‘উরফুত তারীফ বিল মাউলিদীশ শারীফ’ عرف التعريف بالمولد الشريف কিতাবে বলেছেন, আবু লাহাব মারা যাওয়ার পর তাকে স্বপ্ন মারফত দেখানো হল যে, তাকে জিজ্ঞেস করা হল, তুমি কী অবস্থায় আছো? সে বলল, আমাকে জাহান্নামের আগুনে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে প্রতি সোমবারে শাস্তি কিছুটা হালকা করা হয় এবং আঙ্গুলের মাথা সমপরিমাণ জায়গা চুষে পানি পান করতে দেওয়া হয়। এর কারণ হল, আমার দাসী সুওয়াইবিয়া যখন আমাকে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মের সুসংবাদ দেয় তখন তাকে আমি মুক্ত করে দেই এবং তাকে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দুধ পান করার দায়িত্ব প্রদান করি।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আবু লাহাব যদিও কাফের এবং যাকে কুরআনে কঠিন ভাবে তিরস্কার করা হয়েছে তারপরও নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মের সংবাদে খুশি হওয়ার কারণে তার জাহান্নামের শাস্তি হালকা করে তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সুতরাং নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তাওহিদ বাদী মুমিন-মুসলিমগণ যদি তাঁর জন্মে আনন্দিত হয় এবং তাদের সাধ্যানুযায়ী আনন্দ প্রকাশ করে তবে তারা কি সওয়াবের অধিকারী হবে না? হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে তাকে প্রতিদান হিসেবে জান্নাতুন নাঈমে প্রবেশ করাবেন।“ [12]
উপরোক্ত হাদিসটি ইমাম বুখারি মুরসাল সনদে وَأُمَّهَاتُكُمُ اللَّاتِي أَرْضَعْنَكُمْ “তোমাদের সে মাতা, যারা তোমাদেরকে স্তন্যপান করিয়েছে।” [13] অধ্যায়ে এবং রক্ত সম্পর্কের কারণে যা হারাম স্তন্যদান করার কারণে তাই হারাম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।
হাদিসটির সনদ নিম্নরূপ:
উরওয়া বলেন, সুওয়াইবিয়া হল আবু লাহাবের দাসী। আবু লাহাব তাকে মুক্তি দিলে তিনি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দুধ পান করান। আবু লাহাব মৃত্যু বরণ করার পর তার পরিবারের কোন লোক তাকে স্বপ্নে খুব করুণ অবস্থায় দেকে জিজ্ঞেস করল, মৃত্যু বরণ করার পর তোমার পরিণতি কী? সে বলল: তোমাদের নিকট থেকে বিদায় নেওয়ার পর আর কখনো শান্তির সংস্পর্শ পাইনি। তবে সুওয়াইবিয়াকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে আমাকে খুব সামান্য পানি পান করতে দেওয়া হয়েছে।[15]
ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন, এ হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, কাফির কোন কোন সৎ কর্ম দ্বারা আখিরাতে উপকৃত হবে। কিন্তু তা কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য বিরোধী কথা। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُوراً
“আর তারা যে সব আমল করেছিলো সেগুলোর প্রতি অগ্রসর হব অত:পর সেগুলোকে উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবো।“ [সূরা ফুরকান: ২৩] কারণ ইমান, ইখলাস এবং রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ ছাড়া কোন আমলই আল্লাহর নিকট কাজে আসবে না।
➧ এই সংশয়ের জবাব:
৩. উরাওয়া কর্তৃক বর্ণিত উক্ত ঘটনায় বলা হয়েছে, আবু লাহাব তার দাসী সুওয়াইবিয়াকে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দুধ খাওয়ার আগেই মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু এ তথ্য অন্যান্য সিরাত লেখকদের কথার বিপরীত। তারা লিখেছেন, সুওয়াইবিয়া রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুগ্ধ পান করানোর বহুদিন পরে আবু লাহাব তাকে মুক্তি দিয়েছিল।
ذَاكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ وَيَوْمٌ بُعِثْتُ أَوْ أُنْزِلَ عَلَىَّ فِيهِ
“এ দিনেই আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছি এবং এ দিনে আমি নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়েছি অথবা এ দিনেই আমার উপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।” [21]
এ হাদিসের উপর ভিত্তি করে তারা বলে থাকে যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্ম দিবসকে সন্মান করতেন। আর তা প্রকাশ করতেন রোজা রাখার মাধ্যমে। সুতরাং এটাকে মিলাদ বা জন্ম দিবস পালন হিসেবে ধরা যায়। [22]
➧ এই সংশয়ের জবাব:
ক. এ হাদিসে ১২ রবিউল আওয়ালে রোজা রাখার কথা বলা হয়নি বরং যেটা বলা হয়েছে তা হল, তিনি প্রতি সোমবার রোজা রাখতেন। আর সোমবার তো প্রতিমাসে চার বার এসে থাকে। সুতরাং প্রতি সোমবার রোজা রাখার পরিবর্তে রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখকে নির্দিষ্ট করে অনুষ্ঠান পালন করা ইসলামি শরীয়তের মধ্যে নতুন সংযোজন নয় কি? এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমলকে সংশোধন করার অপচেষ্টা করা হল না? এভাবে নিত্য-নতুন বিধান রচনা করে দীন-ইসলামকে বিকৃত করা নিঃসন্দেহে জঘন্যতম অপরাধ।
খ. দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো শুধু সোমবারকে রোজা রাখার জন্য নির্দিষ্ট করেননি। বরং প্রতি সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তিনি এর কারণ হিসেবে বলেছেন,
সুতরাং সোমবারে রোজা রাখার বিষয়টিকে মিলাদ উদযাপন করার পক্ষে দলিল হিসেবে পেশ করা যুক্তি বহির্ভূত এবং অগ্রহণযোগ্য।
গ. রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়াতে আগমনের কারণে যদি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হয় তবে হাদিসে তো রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে। রোজা ছাড়া তো অন্য কিছু করা যাবে না। কিন্তু মিলাদের সমর্থক ভায়েরা তো সে দিন রোজা রাখেন না। কারণ, রোজা রাখলে তো খাওয়া-দাওয়া এবং কামনা-মনোবাসনাকে দমন করতে হবে। তাই তারা এ পথে না গিয়ে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে যেখানে খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দ-ফুর্তির জমজমাট আসর বসানো হয়।
সুতরাং এটা থেকে সুস্পষ্ট ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা আর কী হতে পারে? [24]
ঘ. নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজা ছাড়া তো অন্য কোন অনুষ্ঠান এর সাথে যোগ করেননি। কিন্তু মিলাদ পন্থী ভায়েরা মিলাদ অনুষ্ঠানের জন্য লোক-জন একত্রিত করা, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানে নানা ধরণের কবিতা ও নাতে রসুল পরিবেশন, প্রশংসা-বন্দনা, মিষ্টি-মিষ্টান্ন, বিভিন্ন প্রকার খাবার-দাবার আরও কত কী আয়োজন করে থাকে!
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা করেছেন তা কি আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়? এর উত্তরে তো কোন বিবেকবান মুসলিম না বলতে পারবে না। তাহলে ইসলামি শরিয়তে কেন এই সংযোজন? কেন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগ বাড়িয়ে এ সকল কার্যক্রম? আল্লাহ তাআলা কি বলেননি,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
“আর রসুল তোমাদের যা এনেছেন তা তোমরা গ্রহণ করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক।”[25]
তিনি আরও বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ ও তার রসূলের সামনে অগ্রসর হয়ে কথা বল না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তিনি সব কিছু শুনেন এবং সব কিছু জানেন।[26]
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
وَإِيَّاكُمْ وَالْأُمُورَ الْمُحْدَثَاتِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ
“(দীনের মধ্যে) নতুন সৃষ্ট বিষয়াদি থেকে সাবধান! কারণ প্রতিটি নতুন আবিষ্কৃত বিষয়ই গোমরাহি।”[27]
◍ ৫ম সংশয়: আয়াতের অপব্যাখ্যা:
মিলাদ পন্থী ভায়েরা আরেকটি দলিল পেশ করে থাকেন যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মকে কেন্দ্র করে আনন্দ প্রকাশ করার ব্যাপারে কুরআনে নির্দেশ রয়েছে। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا
“আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত পেয়ে তারা আনন্দিত হোক।”[28]
এই আয়াতে আল্লাহর রহমত লাভ হলে আনন্দিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো দুনিয়াবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় রহমত। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
“আমি তো তোমাকে জগত সমূহের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।” [সূরা আম্বিয়া: ১০৭] সুতরাং নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দুনিয়াতে আগমন উপলক্ষে আনন্দ-উৎসব বা ঈদে মিলাদুন্নবি উদযাপন করা আবশ্যক।[29]
➧ এই সংশয়ের জবাব:
১. উপরোক্ত আয়াতকে ঈদে মিলাদুন্নবি উদযাপন করার পক্ষে দলিল হিসেবে পেশ করা কুরআনকে অপব্যাখ্যা করার শামিল। কারণ, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুরু কওে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, চার মাজহাবের ইমাম সহ পূর্ববর্তী নির্ভরযোগ্য মুফাসসিরগণ কেউই উক্ত আয়াতের এ ধরণের ব্যাখ্যা দেননি।
এটা পরবর্তী যুগের কিছু মানুষের সম্পূর্ণ মনগড়া ব্যাখ্যা। যুগে যুগে বাতিল পন্থী এবং গোমরাহ লোকেরা এভাবেই কুরআনের অপব্যাখ্যা দিয়ে তাদের নিজস্ব ভ্রান্ত মতবাদকে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালায়। এর ভুরিভুরি উদাহরণ রয়েছে।
যাহোক, নিন্মে উক্ত আয়াতের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনগণ এবং বিশ্ব নন্দিত তাফসির কারকগণ কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা হল:
পূর্ণাঙ্গ আয়াতটি হল:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدىً وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ
“হে মানুষ, তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ বাণী, অন্তরের রোগ-ব্যাধির নিরাময়, আর মুমিনদের জন্য দিক নির্দেশনা ও রহমত। বলে দিন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত পেয়ে তারা আনন্দিত হোক। এটা তাদের জমা কৃত সব কিছু থেকে উত্তম।” [30]
উক্ত আয়াতের তাফসিরে সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ মুফাসসির আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আবু সাঈদ খুদরি রা. বলেন, الله فضل (আল্লাহর অনুগ্রহ) দ্বারা কুরআন এবং رحمته (তাঁর দয়া) দ্বারা ইসলাম উদ্দেশ্য। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তারা বলেছেন, الله فضل (আল্লাহর অনুগ্রহ) দ্বারা কুরআন এবং رحمته (তাঁর দয়া) দ্বারা কুরআনের অনুসারী হওয়া উদ্দেশ্য।
বিশিষ্ট তাবেঈ হাসান, যাহহাক, মুজাহিদ এবং কাতাদা রাহ বলেন, الله فضل তথা আল্লাহর অনুগ্রহ দ্বারা ইমান এবং رحمته তথা আল্লাহর দয়া দ্বারা কুরআন উদ্দেশ্য।[31]
“এবং দিক নির্দেশনা ও রহমত” অর্থাৎ এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হেদায়েত এবং রহমত লাভ হয়। আর এসব কেবল ঐ সকল ব্যক্তিগণই পেয়ে থাকেন যারা আল্লাহ তাআলার প্রতি গভীরভাবে ইমান রাখে এবং কুরআনের প্রতি পরম দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস পোষণ করে। যেমন আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন,
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ وَلا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَاراً
“আমি কুরআন হতে (ক্রমশ:) অবতীর্ণ করি যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত কিন্তু তা জিলিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।”[32]
তিনি আরও বলেন,
قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدىً وَشِفَاءٌ
“(হে নবি) বলুন, ইহা তো ইমানদারদের জন্য হেদায়েত এবং আরগ্য।” [33]
قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُون
“বলে দিন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত পেয়ে তারা আনন্দিত হোক। এটা তাদের জমা কৃত সব কিছু থেকে উত্তম।”[34]
বিশিষ্ট আলেমে দীন ইবনে আব্দুল হাদী আস সারিম আল মুনকীالصَّارِمُ المُنْكِي في الرَّدِّ عَلَى السُّبْكِي কিতাবে বলেন, “কুরআনের কোনও আয়াত কিংবা কোনও হাদিসের এমন নতুন কোন ব্যাখ্যা পেশ করা জায়েজ নাই যা পূর্ববর্তী মনিষীদের জামানায় ছিল না কিংবা যা তারা জানতেন না অথবা তারা জাতির সামনে তা প্রকাশ করেনি। কারণ, যদি নিত্য-নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে আসা হয় তবে ধরে নিতে হবে, আগের যুগের মনিষীগণ এ ক্ষেত্রে ‘হক বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন ও তারা ছিলেন হক থেকে বিচ্যুত।পরবর্তীকালের এই ব্যক্তি হকের সন্ধান পেয়েছেন! কিন্তু এই পরবর্তীদের ব্যাখ্যা যদি পূর্ববর্তী মনিষীদের ব্যাখ্যার সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবে বিষয়টি কী দাঁড়ায়? সেটা কীভাবে গ্রহণীয় হতে পারে…?“ [37]
أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللَّهِ أَفَلا تَذَكَّرُونَ
“তুমি কি লক্ষ্য করেছ তার প্রতি যে তার খেয়াল-খুশিকে উপাস্য বানিয়েছে? আল্লাহ জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তাকে গুমরাহ করেছে এবং তার কানে এবং অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন আর তার চোখের উপর টেনে দিয়েছেন পর্দা। অতঃপর আল্লাহর পর আর কে আছে যে তাকে সঠিক পথের সন্ধান দিবে? এর পরও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?”[38]
আল্লাহু আলাম-আল্লাহই সর্বাধিক পরিজ্ঞাত।
[শাইখ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ আত তুয়াইজিরি রচিত ‘আল বিদাহ আল হাওলিয়াহ’ গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত এবং অনুদিত]
No comments:
Post a Comment