মূল: শাইখ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল উসাইমিন রহ.
অনুবাদ: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله. أما بعد
❑ কুরবানির বিধি-বিধান:
কুরবানি মূলত: জীবিত মানুষের জন্য। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের পক্ষ থেকে এবং তাঁদের পরিবার-পরিজনের পক্ষ থেকে কুরবানি করতেন। কিন্তু কিছু মানুষ মনে করে কুরবানি কেবল মৃতদের সাথে সংশ্লিষ্ট। এর আদৌ কোন ভিত্তি নাই।
মৃত মানুষের পক্ষ থেকে কুরবানি করা তিনভাগে বিভক্ত। যথা:
▪ ১) জীবিতদের সাথে মৃতদেরকেও শরীক করা। যেমন, নিজের এবং নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানিতে মৃতদেরও নিয়ত করা। এর দলীল হল, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে এবং তাঁর পরিবারের জীবিত ও মৃত সবার পক্ষ থেকে কুরবানি করেছেন।
▪ ২) মৃত মানুষের ওসিয়ত মোতাবেক কুরবানি করা। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
فَمَن بَدَّلَهُ بَعْدَ مَا سَمِعَهُ فَإِنَّمَا إِثْمُهُ عَلَى الَّذِينَ يُبَدِّلُونَهُ
“যদি কেউ ওসিয়ত শোনার পর তাতে কোন রকম পরিবর্তন করে, তবে যারা পরিবর্তন করে তাদের উপর এর পাপ পতিত হবে।” [সূরা বাকারা: ১৮১]
▪ ৩) জীবিতদের থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্রভাবে কেবল মৃতদের পক্ষ থেকে কুরবানি করা। এটা জায়েজ। হাম্বলি ফকিহগণ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, এর সওয়াব মৃত ব্যক্তিগণ লাভ করবে। এটা তারা মৃতের পক্ষ থেকে দান করার উপর কিয়াস করে ফতোয়া দিয়েছেন।
কিন্তু কেবল মৃতদের উদ্দেশ্য করে কুরবানি করাকে আমরা সুন্নত মনে করি না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন মৃতকে উদ্দেশ্য করে আলাদাভাবে কুরবানি করেন নি। তিনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয়জন চাচা হামজা রা. কিংবা তাঁর যে সকল সন্তান তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যু বরণ করেছিলেন যেমন তিন বিবাহিত কন্যা ও তিন শিশু পুত্র-তিনি এঁদের কারো পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কুরবানি করেননি। অনুরূপভাবে সব চেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা রা. এর পক্ষ থেকেও কুরবানি করেননি।
কোন সাহাবি থেকেও এমন কোন তথ্য বর্ণিত হয় নি যে, তাদের কেউ মৃতের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কুরবানি করেছেন।
আরেকটি ভুল প্রথা দেখা যায় যে, কোন ব্যক্তি বছরের শুরুতে মারা গেলে তার পক্ষ থেকে আলাদা একটা কুরবানি করা হয়। তাদের ধারণা, এর সওয়াবে অন্য কারো অংশীদার হওয়া জায়েজ নয়। আরও দেখা যায়, কিছু মানুষ মৃতের পক্ষ থেকে দান হিসেবে বা মৃতের ওসিয়ত মোতাবেক কুরবানি করে কিন্তু নিজের বা নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানি করে না।
এ মানুষগুলো যদি জানত যে, কোন ব্যক্তি যদি নিজস্ব সম্পদ দ্বারা নিজের এবং নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানি করে তবে তা তার পরিবারের জীবিত-মৃত সকলের জন্য যথেষ্ট হবে, তবে তারা এই আমল বাদ দিয়ে অন্য কিছু করত না।
❑ যে কুরবানি করতে চায় সে কোন কাজ থেকে বিরত থাকবে?
◆ যে ব্যক্তি জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার মাধ্যমে বা জিলকদ মাসের ৩০ দিন পূর্ণ হওয়ার মাধ্যমে জিলহজ মাসে প্রবেশ করল এবং কুরবানি করার ইচ্ছা পোষণ করল তার জন্য কুরবানির পশু জবাই করা পর্যন্ত নখ, চুল বা শরীর থেকে চামড়া উঠানো হারাম। উম্মে সালামা রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِذَا دَخَلَ عَشْرُ ذِى الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّىَ فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعَرِهِ وَأَظْفَارِهِ
“জিলহজ মাস শুরু হওয়ার পর যে ব্যক্তি কুরবানি করার ইচ্ছা পোষণ করল সে যেন তার নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকে।” [আহমদ ও মুসলিম] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, “সে যেন কুরবানি করা পর্যন্ত তার চুল ও চামড়া স্পর্শ না করে অর্থাৎ না কাটে।”
◆ জিলহজের দশ দিন শুরু হওয়ার পর যদি নিয়ত করে তবে নিয়ত করার সময় থেকেই নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকবে। নিয়ত করার আগে কেটে থাকলে তাতে গুনাহ হবে না।
◆ এর পেছনে হেকমত হল, হাজীদের সাথে কুরবানি কারীর কিছু ক্ষেত্রে বৈশিষ্টগত মিল থাকা। অর্থাৎ হাজীগণ যেমন কুরবানি করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে থাকে তেমনি কুরবানি কারীও কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে থাকে। ঠিক তদ্রূপ হাজী সাহেবগণ যেমন এহরাম অবস্থায় নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকে কুরবানি কারীগণও নখ-চুল ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থেকে তাদের এই অবস্থার সাথে শামিল হয়।
◆ এই ভিত্তিতে মাসয়ালা হল, কুরবানি কারীর পরিবারের জন্য নখ-চুল ইত্যাদি কাটা জায়েজ। নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকার হুকুম কেবল কুরবানি কারীর জন্য প্রযোজ্য। যাদের পক্ষ থেকে কুরবানি করা হচ্ছে তাদের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। কারণ, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে কুরবানি করতে ইচ্ছুক…” তিনি বলেন নি যে, যাদের পক্ষ থেকে কুরবানি করা হচ্ছে তারাও বিরত থাকবে। তাছাড়া তিনি তাঁর পরিবারের কাউকে নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকতে আদেশ করেছেন এমন কিছু বর্ণিত হয়নি।
◆ কেউ যদি নখ-চুল, চামড়া ইত্যাদি কাটে তার জন্য আবশ্যক হল, আল্লাহর নিকট তওবা করা এবং এ কাজ আর না করা। তবে এ জন্য কোন কাফফারা দিতে হবে না এবং এতে কুরবানি করতেও কোন বাঁধা নাই।
◆ ভুল বা অজ্ঞতা বশত: যদি কেউ নখ, চুল, চামড়া ইত্যাদি কেটে ফেলে বা অনিচ্ছা বশত: শরীর থেক চুল পড়ে যায় তাতে কোন গুনাহ হবে না। অনুরূপভাবে বিশেষ প্রয়োজনে যদি কারো এসব কাটতে হয় তবে তাতেও কোন সমস্যা নাই। যেমন, নখ উঠে কষ্ট পেলে তা তুলে ফেলা যাবে, চোখের মধ্যে যদি চুল প্রবেশ করে তা উঠানো যাবে অথবা চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার করার কারণে চুল তোলার প্রয়োজন হলে তা তোলা যাব…ইত্যাদি।
❑ ঈদের বিধি-বিধান ও আদব:
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ। আল্লাহর মহাত্মের ঘোষণা এবং তাঁর ইবাদত ও কৃতজ্ঞতার বর্হি:প্রকাশের উদ্দেশ্যে পুরুষদের জন্য মসজিদে, বাজারে, বাড়িতে ও পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে উচ্চ স্বরে তাকবির পাঠ করা সুন্নত।
▪ ২) কুরবানি করা: ঈদের দিন ঈদের সালাতের পর কুরবানি করা। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈদের আগে জবেহ করল, তার উচিত তদস্থলে আরেকটি কুরবানি করা। আর যে এখনো কুরবানি করেনি, তার উচিত এখন কুরবানি করা।” (বুখারী ও মুসলিম) কুরবানি করার সময় চার দিন। যথা: নহরের দিন এবং তার পরবর্তী তাশরীকের তিন দিন। যেহেতু রসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তাশরিকের প্রতিটি দিনই হল কুরবানির দিন।” [সিলসিলা সহীহাহ-২৪৬৭]
▪ ৩) গোসল করা, সুন্দর পোশাক পরিধান করা ও পুরুষদের জন্য সুগন্ধি মাখা: তবে অপচয় করা হারাম। অনুরূপভাবে পুরুষদের জন্য টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান ও দাঁড়ি মুণ্ডন করা হারাম। নারীদের জন্য ঈদগাহে যাওয়া বৈধ, তবে সুগন্ধি ও সৌন্দর্য প্রদর্শন পরিহার করা আবশ্যক। মুসলিম নারীর জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, সে আল্লাহর ইবাদত ও সালাতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পর পুরুষের সামনে বেহায়াপনা প্রদর্শনী ও সুগন্ধি ব্যবহারের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হবে।
▪ ৪) কুরবানির গোস্ত ভক্ষণ করা: ঈদুল আজহার দিন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহ থেকে ফিরে আসার আগে খাবার গ্রহণ করতেন না। বরং তিনি কুরবানি করার পর তার গোস্ত খেতেন। [যাদুল মায়াদ: ১/৪৪১]
▪ ৫) সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া: ঈদগাহে সালাত আদায় করা সুন্নত। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে পড়েছেন। তবে বৃষ্টি বা অন্য কোন কারণে মসজিদে পড়া বৈধ।
❑ কতিপয় ভুল-ভ্রান্তি:
প্রিয় মুসলিম ভাই, অনেক মানুষ ঈদে নানা ধরণের ভুল-ভ্রান্তিতে পতিত হয়। এগুলো থেকে আমাদেরকে সতর্ক থাকা আবশ্যক। তন্মধ্যে:
পরিশেষে, প্রিয় মুসলিম ভাইদের প্রতি আহবান, আপনারা উপরে বর্ণিত নেক আমল ছাড়াও অন্যান্য নেক আমল করতে যেন ভুলে না যান। যেমন আত্মীয় স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করা, পারষ্পারিক রাগ-গোস্বা, হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা পরিহার করা। এ সব থেকে অন্তরকে পরিচ্ছন্ন করা। এতীম, গরীব-অসহায় মানুষের প্রতি দয়া করা, তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করা।
No comments:
Post a Comment