নিজের জীবনে ইসলাম বনাম অন্যের জীবনে ইসলাম
দ্বীন প্রতিষ্ঠার দুটি পর্যায় রয়েছে:
সর্বোপরি এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির দায়িত্ব দাওয়াত দেওয়া। কেউ বা সকলে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলে বা অন্যায় পরিত্যাগ না করলে মুমিনের কোনোরূপ দায়বদ্ধতা থাকে না। কিন্তু উগ্রতায় লিপ্ত মানুষদেরকে আমরা এর উল্টো পথে চলতে দেখি। তারা মূলত ‘‘অন্যের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠাকে’’ ফরয আইন ও বড় ফরয এবং নিজের জীবনে দীন পালনকে ‘‘ছোট ফরয’’ বা গুরুত্বহীন বলে মনে করেন। তারা অন্যের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তিগতভাবে হারাম-মাকরূহ কর্মে লিপ্ত হচ্ছেন এবং এরূপ হারাম-মাকরূহ কর্মে লিপ্ত হওয়াকে নানাভাবে বৈধ, বরং জরুরী বা ফরয বলে দাবি করছেন।
তাদের মনের একই চিন্তা, সমাজে বা দুনিয়ায় অমুক অন্যায় হচ্ছে, আল্লাহর আইনের বিরোধিতা হচ্ছে, আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ করা হচ্ছে, কিভাবে নীরব থাকবে মুমিন। কাজেই যেভাবে পার ঝাপিয়ে পড়ে সব অন্যায় মিটিয়ে দিয়ে বিশ্বের সর্বত্র সকলের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কর। বস্ত্তত এরূপ চিন্তা ভাল চিন্তার সাথে খারাপ চিন্তার সমন্বয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ মুমিনের মনে অবশ্যই থাকবে এবং মুমিন সাধ্যমত ইসলাম নির্দেশিত পথে তা প্রতিকারের চেষ্টা করবে বা দাওয়াত দিবে। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, মহান আল্লাহ মুমিনকে তাঁর নিজের ও নিজের দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাস করবেন, দুনিয়ার অন্য মানুষদের পাচাচার সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করবেন না। সাধ্যমত দাওয়াতের পরেও যদি মানুষ তা গ্রহণ না করে সে জন্য মুমিনের কোনোরূপ অপরাধ থাকে না।
মহান আল্লাহ বলেন:
বস্ত্তত সমাজ, রাষ্ট্রে ও বিশ্বে অন্যায়, পাপ ও অপরাধ থাকবেই, কখনো বেশি এবং কখনো কম। মুমিনের দায়িত্ব দাওয়াত দেওয়া, মুমিনের দায়িত্ব হিদায়াত করে ফেলা বা ভাল করে ফেলা নয়।
মহান আল্লাহ তার মহান রাসূল (সাঃ)-কে বলেন:
আল্লাহ আরো বলেন:
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
অনেক সময় আবেগী মুমিন সমাজের পাপাচারে বেদনাগ্রস্ত হয়ে দ্রুত সবকিছু ঠিক করে ফেলতে আগ্রহী হন। তিনি কুরআনসুন্নাহর নির্দেশ ও মানবজাতির পরিচালনায় আল্লাহর সুন্নাতের কথা ভুলে যান। দ্রুত ফলাফল লাভের জন্য ব্যস্ত হয়ে যান। তিনি ভাবেন: ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে বা ইসলামের বিজয় আনতে হবে। অমুক বা তমুক পদ্ধতিতে তা আসবে না, বরং আমাদের এ পদ্ধতিতেই এ বিজয় দ্রুত হাতের মুঠোয় এসে যাবে। অমুক পদ্ধতিতে শত বৎসর বা হাজার বৎসর কাজ করলেও ইসলামের বিজয় আসবে না, কিন্তু আমাদের পদ্ধতিতে কাজ করলে অল্প সময়েই তা এসে যাবে। মনে হয় কে কত তাড়াতাড়ি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারল এর উপরেই আল্লাহ নবী-রাসূল ও মুসলমানদের হিসাব নিবেন!!
ফলাফল লাভের উন্মাদনা আবেগী মুমিনকে বিপথগামী করে। মুমিন চায় যে, সমাজ থেকে ইসলাম বিরোধী ও মানবতা বিরোধী সকল অন্যায় ও পাপ দূরীভুত হোক। কোনো মুমিনের মনে হতে পারে যে, এত ওয়ায, বক্তৃতা, বইপত্র, আদেশ নিষেধ ইত্যাদিতে কিছুই হলো না, কাজেই মেরেধরে জোরকরে সব অন্যায় দূর করে ফেলতে হবে। তখন তিনি দাওয়াতের শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি ও শরীয়ত নিষিদ্ধ পদ্ধতির মধ্যে বাছবিচার না করে ফলাফলের উন্মাদনায় শরীয়ত নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে চেষ্টা করেন।
এ জাতীয় চিন্তভাবনা সবই কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষার সাথে সাংঘষিক। মুমিনের দায়িত্ব নিজের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠা ও দীনের দাওয়াত। দাওয়াতের দ্রুত ফলাফলের চিন্তা তো দূরের কথা, কোনো ফলাফলের চিন্তাই মুমিনের দায়িত্ব নয়। অগণিত নবী-রাসূল আজীবন দাওয়াত দিয়েছেন, কিন্তু অতি অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ তাদের দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। এতে তাঁদের ‘‘দীন প্রতিষ্ঠার’’ বা ‘‘দাওয়াতের’’ দায়িত্ব পালনের কোনো ঘাটতি হয় নি।
পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা দেখব যে, ‘‘দ্রুত সকল অন্যায় মিটিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার’’ জন্য উদগ্রীব মানুষেরা কখনই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি, বরং সুন্নাত পদ্ধতিতে ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ বা দাওয়াত ও দীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সমাজ সংস্কারের কর্ম সম্পাদিত হয়েছে। কাজেই মুমিনের দায়িত্ব হলো নিজের জীবন দীন পালনের পাশাপাশি কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত পন্থায় দীনের দাওয়াত দেওয়া।
আল্লাহ বলেন:
অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে:
বর্তমান বিশ্বে ইসলামী দা‘ওয়াত বা ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্ঠা অনেক সময় ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিরোধ, অত্যাচার বা সহিংস আচরণের সম্মুখীন হয়। এতে দা‘ওয়াতে লিপ্ত মুসলিমের মধ্যে প্রতিক্রিয়ামূলক ‘সহিংসতা’র আবেগ তৈরি হয়। এর সাথে ‘দ্রুত ফললাভে’ চিন্তা ‘দাওয়াত’ বা ‘দ্বীন প্রতিষ্ঠা’র কর্মে রত ব্যক্তিকে ইসলাম নির্দেশিত এ ‘অহিংস’ পদ্ধতি পরিত্যাগ করে আবেগ নির্দেশিত ‘সহিংস’ পথে যাওয়ার প্ররোচনা দেয়। তিনি ভাবতে থাকেন ‘সহিংসতা’ বা কল্পিত ‘জিহাদ’ই দ্রুত ফললাভের বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ, যদিও প্রকৃত সত্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামের ইতিহাসে ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর সহিংসতা, তথাকথিত ‘জিহাদ’ ও ‘শাহাদতের’ অনেক ঘটনা আছে। তারা সকলেই ‘দ্রুত ফললাভের’ আবেগ নিয়ে বৈধ বা কল্পিত ‘জিহাদে’ ঝাপিয়ে পড়ে ‘শহীদ’ হয়েছেন, কিন্তু কেউই দ্রুত বিজয় তো দূরের কথা কোনো স্থায়ী বিজয়ই অর্জন করতে পারেন নি। বস্ত্তত ইসলামের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ‘অহিংস’ ও ‘মন্দের মুকাবিলায় উৎকৃষ্টতর’ আচরণই ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও ইসলামের বিজয়ের একমাত্র পথ। এ পদ্ধতিতেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরবের কঠোর হৃদয় যাযাবরদের হৃদয় জয় করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। পরবর্তী সকল যুগে এ পদ্ধতির অনুসরণকারী আলিম ও ‘দাঈ’গণই ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করুন।
[1] সূরা ৬: মায়িদা, আয়াত ১০৫। [2] সূরা ২৮: কাসাস: ৫৬ আয়াত। [3] সূরা ১২: ইউসূস: ১০৩ আয়াত। [4] সূরা ১০: ইউনুস: ৯৯ আয়াত। [5] সূরা হা মীম সাজদা (ফুসসিলাত): ৩৩-৩৫ আয়াত। [6] সূরা মুমিনূন, ৯৬ আয়াত।
No comments:
Post a Comment