জুমআর স্বলাতে পালনীয় ও লঙ্ঘনীয় এসম্পর্কে হাদীস সমূহ
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্বলাত- এর অংশবিশেষশায়খ মুযাফফর বিন মুহসিন
✔ (১) জুমআর স্বলাতের জন্য দুই আযান দেওয়া : জুমআর-স্বলাতে-জুম‘আর স্বলাতের জন্য দুই আযান দেওয়ার যে প্রথা সমাজে চালু আছে তা সুন্নাত সম্মত নয়। জুম‘আর আযান হবে একটি। ইমাম খুৎবা দেওয়ার জন্য যখন মিম্বরে বসবেন, তখন মুয়াযযিন আযান দিবে।[1] রাসূল (ﷺ), আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর আমলে এবং ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের প্রথমাংশে জুম‘আর আযান একটিই ছিল। অতঃপর মানুষের সংখ্যা যখন বেড়ে গেল, তখন ওছমান (রাঃ) মসজিদে নববীর অনতিদূরে ‘যাওরা’ নামক বাজারে জুম‘আর পূর্বে আরেকটি আযান চালু করেন।[2]
ওছমান (রাঃ) যে কারণে আরেকটি আযান চালু করেছিলেন, কোথাও উক্ত কারণ বিদ্যমান থাকলে তা এখনো চালু করা জায়েয। কারণ খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণে ওছমান (রাঃ)-এর আযান যদি সকল মসজিদের জন্য পালনীয় হত, তাহলে তিনি মক্কায় চালু করলেন না কেন? অনুরূপ অন্যান্য মসজিদে চালু হল না কেন? আলী (রাঃ)-এর আমল পর্যন্ত অন্য কোথাও উক্ত আযান চালু হয়নি। এমনকি মক্কাতেও চালু হয়নি। বর্তমানে আমরা কি উক্ত আযান চালু করে ছাহাবীদের চেয়ে বেশী দ্বীনদারীর ভাব দেখাতে চাই? এ জন্যই হয়ত ইবনু ওমর (রাঃ) উক্ত আযানকে বিদ‘আত বলেছেন।[3] অনুরূপ ইমাম কুরতুবী (মৃঃ ৬৭১) ইমামের সামনে মিম্বরের নিকটে দেয়া প্রচলিত আযানকে বিদ‘আত বলেছেন।[4]
ওমর ইবনু আলী আল-ফাকেহানী (৬৫৪-৭৩৪/১২৫৬-১৩৩৪ খৃঃ) বলেন, ডাক আযান প্রথম বছরায় চালু করেন যিয়াদ এবং মক্কায় চালু করেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। আর আমার কাছে এখন খবর পৌঁছেছে যে, নিকট মাগরিবে অর্থাৎ আফ্রিকার তিউনিস ও আলজেরিয়ার পূর্বাঞ্চলের লোকদের নিকট কোন আযান নেই, মূল এক আযান ব্যতীত’।[5] আলী (রাঃ)-এর (৩৫-৪০ হিঃ) রাজধানী কূফাতেও এই আযান চালু ছিল না।[6] ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, উমাইয়া খলীফা হেশাম বিন আব্দুল মালেক (১০৫-২৫/৭২৪-৭৪৩ খৃঃ) সর্বপ্রথম ওছমানী আযানকে ‘যাওরা’ বাজার থেকে এনে মদীনার মসজিদে চালু করেন।[7] ইবনুল হাজ্জ মালেকী বলেন, অতঃপর হেশাম খুৎবাকালীন মূল আযানকে মসজিদের মিনার থেকে নামিয়ে ইমামের সম্মুখে নিয়ে আসেন’।[8] এভাবে হাজ্জাজী ও হেশামী আযান সর্বত্র চালু হয়েছে।[9] অতএব বর্তমানে যে আযান চলছে সেটা রাসূল (ﷺ)-এর আযানও নয়, ওছমান (রাঃ)-এর আযানও নয়। সুতরাং উক্ত বিদ‘আতী আযান অবশ্যই পরিত্যাজ্য। রাসূল (ﷺ)-এর যুগে যে আযান চালু ছিল আমাদের সবাইকে সেই আযানে ফিরে যেতে হবে।
জ্ঞাতব্য : হেদায়ার লেখক উক্ত বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বিদ‘আতী আযানের পক্ষে অবস্থান করে বলেছেন,
(وَإِذَا صَعِدَ الْإِمَامُ الْمِنْبَرَ جَلَسَ وَأَذَّنَ الْمُؤَذِّنُوْنَ بَيْنَ يَدِي الْمِنْبَرِ ) بِذَلِكَ جَرَى التَّوَارُثُ وَلَمْ يَكُنْ عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ إلَّا هَذَا الْأَذَانُ.
‘যখন ইমাম মিম্বরে উঠে বসবেন তখন মুয়াযযিন মিম্বরের সামনে আযান দিবে। আর এই আযানই ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। আর এই আযান ছাড়া রাসূল (ﷺ)-এর যুগে অন্য কোন আযান চালু ছিল না।[10]
সুধী পাঠক! লেখক মসজিদের ভিতরের আযানের সমাধান দিয়েছেন, কিন্তু পূর্বের ডাক আযানের বিষয়টি উল্লেখ করেননি। তাহলে জুম‘আর স্বলাতের আধা ঘণ্টা পূর্বে যে আযান দেয়ার প্রচলন হয়েছে তার ভিত্তি কি? লেখক রাসূল (ﷺ), আবুবকর, ওমর (রাঃ)-এর সুন্নাতী আযানকে উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন কিন্তু ভিত্তিহীন বিদ‘আতী আযান উল্লেখ করতে ভুলেননি।[11] এটা যে মাযহাবী ফাঁদ, এখান থেকে তিনি মুক্ত হবেন কিভাবে? অতএব আমাদেরকে রাসূল (ﷺ)-এর আযানই আকড়ে ধরে থাকতে হবে। অন্যগুলো সব প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
✔ (২) আরবী ভাষায় খুৎবা প্রদান করা এবং খুৎবার পূর্বে মিম্বরে বসে বক্তব্য দেওয়া :
প্রচলিত ডাক আযানকে বৈধ করার জন্য জুম‘আর স্বলাতের খুৎবার পূর্বে মিম্বরে দাঁড়িয়ে বা বসে মাতৃভাষায় বক্তব্য দেয়ার আরেকটি বিদ‘আত চালু হয়েছে। একটি বিদ‘আতকে রক্ষা করার জন্য আরেকটি বিদ‘আতের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। তাছাড়া মূল খুৎবা আরবী ভাষায় দেয়ার কারণে মুছল্লীরা কোনকিছু উপলব্ধি করতে পারে না। বিধায় এটা চালু করা হয়েছে। মূলতঃ খুৎবার পূর্বে আরেকটি খুৎবা দেয়ার যেমন শারঈ কোন ভিত্তি নেই, তেমনি আরবী ভাষায় খুৎবা দেয়ারও কোন বিধান নেই। তাছাড়া জুম‘আর খুৎবা বসে দেয়াও শরী‘আত বিরোধী।[1]
বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সামনে আরবী ভাষায় জুম‘আর খুৎবা দেওয়া অর্থহীন এবং সুন্নাতের বরখেলাফ। রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) মানুষের সামনে আরবী ভাষায় খুৎবা দিতেন না; বরং তিনি তাঁর মাতৃভাষায় খুৎবা দিতেন, যা ছিল আরবী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُوْلٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ.
‘আমি সকল রাসূলকে তার সম্প্রদায়ের ভাষাতেই প্রেরণ করেছি। যেন তিনি তাদের সামনে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন’ (ইবরাহীম ৪)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আমি কুরআনকে তোমার ভাষায় সহজ করেছি, যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে’ (দুখান ৫৮)। রাসূল (ﷺ) কুরআনের আয়াত পাঠ করে উপস্থিত মুছল্লীদেরকে উপদেশ দান করতেন।
عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ كَانَتْ لِلنَّبِىِّ خُطْبَتَانِ يَجْلِسُ بَيْنَهُمَا يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيُذَكِّرُ النَّاسَ.
জাবের ইবনু সামুরা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ﷺ)-এর দু’টি খুৎবা ছিল। উভয় খুৎবার মাঝে তিনি বসতেন। খুৎবাতে তিনি কুরআন পাঠ করতেন এবং লোকদের উপদেশ দিতেন।[2]
এছাড়া রাসূল (ﷺ) প্রয়োজনে মুছল্লীদের সাথেও কথা বলতেন। মুছল্লীরাও কোন বিষয় রাসূল (ﷺ)-এর কাছে পেশ করতেন। যেমন এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে বসে পড়লে তাকে দাঁড়াতে বলেন এবং সংক্ষেপে দু’রাক‘আত ‘তাহ্ইয়াতুল মসজিদ’-এর স্বলাত আদায় করতে বলেন।[3] পরপর দুই জুম‘আয় এক ব্যক্তি এসে রাসূল (ﷺ)-এর কাছে বৃষ্টির ব্যাপারে আবেদন পেশ করেছিলেন।[4]
এক্ষণে যে সমস্ত মসজিদে আরবী ভাষায় খুৎবা দেওয়া হয়, সেখানে মুছল্লীরা কোন আবেদন করতে চাইলে কোন্ ভাষায় করবে? খুৎবা অবস্থায় ইমাম কোন্ ভাষায় জবাব দিবেন? খুৎবায় বাংলা বলা যদি নাজায়েয হয়, তাহলে ইমাম কি তখন আরবী ভাষায় জবাব দিবেন? মুক্তাদী কি তার ভাষা বুঝতে পারবে? প্রশ্ন করে তার কোন লাভ হবে কি? সুতরাং ইমাম মুক্তাদী সকলে আরবী ভাষী হতে হবে। অতএব মানুষের বোধগম্য ভাষায় খুৎবা প্রদান করতে হবে।
✔ (৩) জুম‘আর স্বলাতের মুছল্লী নির্দিষ্ট করা :
সহিহ হাদীছের দৃষ্টিতে দুই জন ব্যক্তি হলেই জুম‘আর স্বলাত আদায় করা যাবে। কারণ জুম‘আর স্বলাত অন্যান্য ফরয স্বলাতের মতই ফরয স্বলাত। কোন স্থানে দুইজন ব্যক্তি থাকলেও রাসূল (ﷺ) তাদেরকে আযান, ইক্বামতসহ জামা‘আত করে স্বলাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।[1] অথচ সমাজে প্রচলিত আছে যে, ৪০ জন ব্যক্তি ছাড়া জুম‘আর স্বলাত হবে না। কিন্তু এর পক্ষে সহিহ কোন দলীল নেই। উক্ত মর্মে যত বর্ণনা এসেছে সবই ত্রুটিপূর্ণ।
✔ (أ) عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ مَضَتِ السُّنَّةُ أَنَّ فِىْ كُلِّ ثَلاَثَةٍ إِمَامٌ وَفِىْ كُلِّ أَرْبَعِيْنَ فَمَا فَوْقَ ذَلِكَ جُمُعَةً وَأَضْحًى وَفِطْرًا وَذَلِكَ أَنَّهُمْ جَمَاعَةٌ .
(ক) জাবের (রাঃ) বলেন, সুন্নাত প্রচলিত আছে যে, প্রত্যেক তিনজনে ইমাম নির্ধারিত হবে, ৪০ জনের উপরে জুম‘আ, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা সাব্যস্ত হবে।[2]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। এর সনদে আব্দুল আযীয বিন ক্বারশী নামে একজন মিথ্যুক রাবী আছে।[3] উল্লেখ্য যে, সহিহ আছার বর্ণিত হয়েছে যে, মদীনায় যখন প্রথম জুম‘আ চালু হয় তখন তার মুছল্লী সংখ্যা ছিল ৪০। উক্ত জামা‘আতের লোকসংখ্যা ছিল ৪০ জন। কিন্তু ৪০ জন না হলে স্বলাত হবে না সে কথা তো বলা হয়নি।[4]
✔ (ب) عَنْ أَبِى أُمَامَةَ أَنَّ نَبِىَّ اللهِ قَالَ عَلَى الْخَمْسِيْنَ جُمُعَةٌ لَيْسَ فِيْمَا دُوْنَ ذَلِكَ.
(খ) আবু উমামা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ৫০ জন ছাড়া জুম‘আর স্বলাত হবে না।[5]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি অত্যন্ত দুর্বল। এই বর্ণনায় জাফর বিন যুবাইর নামক রাবী আছে। ইমাম বুখারী ও নাসাঈ বলেন, সে পরিত্যক্ত। ইমাম হায়ছামীও তাকে নিতান্ত দুর্বল বলেছেন।[6]
✔ (৪) জুম‘আর পূর্বে নির্দিষ্ট রাক‘আত স্বলাত আদায় করা :
জুম‘আর স্বলাতের পূর্বে কত রাক‘আত স্বলাত আদায় করতে হবে, তা হাদীছে নির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। মুছল্লী যখন মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন থেকে ইমাম খুৎবা আরম্ভ করার পূর্ব পর্যন্ত যত ইচ্ছা তত স্বলাত আদায় করতে পারবে। কিন্তু প্রায় মসজিদে মুছল্লীরা পূর্বে মাত্র চার রাক‘আত স্বলাত আদায় করে থাকে। অথচ উক্ত মর্মে যে হাদীছ প্রচলিত আছে তা মিথ্যা ও বাতিল।
(أ) عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ يَرْكَعُ مِنْ قَبْلِ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا لاَ يَفْصِلُ فِىْ شَىْءٍ مِنْهُنَّ.
(ক) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ﷺ) জুম‘আর পূর্বে চার রাক‘আত স্বলাত আদায় করতেন। কিন্তু এর মাঝে সালাম ফিরিয়ে পৃথক করতেন না।[1] অন্য বর্ণনায় রয়েছে,
(ب) عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ يَرْكَعُ قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا وَبَعْدَهَا أَرْبَعًا لا يَفْصِلُ بَيْنَهُنَّ.
(খ) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জুম‘আর স্বলাতের আগে ও পরে ৪ রাক‘আত করে স্বলাত পড়তেন। কিন্তু মাঝে সালাম ফিরিয়ে পৃথক করতেন না।[2]
তাহক্বীক্ব : উভয় বর্ণনাই জাল। এই বর্ণনার প্রায় সকল রাবীই ত্রুটিপূর্ণ। আল্লামা যায়লাঈ বলেন, এর সনদ নিতান্তই দুর্বল। মুবাশশির ইবনু উবাইদ মিথ্যা হাদীছ রচনাকারীদের অন্তর্ভুক্ত। আর হাজ্জাজ ও আতিইয়াহ দুইজনই যঈফ।[3] বুছাইরী বলেন, বাক্বিয়াহ বিন ওয়ালীদও যঈফ।[4] ইমাম নববী বলেন, হাদীছটি বাতিল।[5]
(ج) عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ كَانَ النَّبِىُّ يُصَلِّىْ قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا وَبَعْدَهَا أَرْبَعًا.
(গ) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) জুম‘আর আগে চার রাক‘আত এবং জুম‘আর পরে চার রাক‘আত স্বলাত আদায় করতেন।[6]
তাহ্ক্বীক্ব : বর্ণনাটি মুনকার বা সহিহ হাদীছ বিরোধী। ত্বাবারাণী উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, আত্তাব বিন বুশাইর ছাড়া এই হাদীছ খুছাইফ থেকে কেউ বর্ণনা করেনি।[7] উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন ছাহাবীর নামে উক্ত মর্মে আরো কিছু বর্ণনা রয়েছে। তবে কোন বর্ণনাই বিশুদ্ধ নয়।[8]
✔ সহিহ হাদীছের আলোকে জুম‘আর স্বলাতের সুন্নাত :
✔ জুম‘আর পূর্বে কোন রাক‘আত নির্ধারিত নেই। যত ইচ্ছা তত পড়তে পারে। তবে জুম‘আর স্বলাতের পর চার রাক‘আত স্বলাত আদায় করবে। আর বাড়ীতে গিয়ে পড়তে চাইলে মাত্র দুই রাক‘আত পড়বে।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ قَالَ مَنِ اغْتَسَلَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَصَلَّى مَا قُدِّرَ لَهُ ثُمَّ أَنْصَتَ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ خُطْبَتِهِ ثُمَّ يُصَلِّيَ مَعَهُ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الْأُخْرَى وَفَضْلُ ثَلَاثَةِ أَيَّام.
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি গোসল করে জুম‘আর স্বলাতে আসবে অতঃপর তার সাধ্যানুযায়ী স্বলাত আদায় করবে, তারপর ইমাম খুৎবা শেষ করা পর্যন্ত চুপ করে থাকবে; অতঃপর ইমামের সাথে স্বলাত আদায় করবে, তার এই জুম‘আ ও পরবর্তী জুম‘আর মাঝের পাপ সমূহ ক্ষমা করা হবে। এমনকি অতিরিক্ত আরো তিন দিনের পাপ ক্ষমা করা হবে।[1]
✔ عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمُ الْجُمُعَةَ فَلْيُصَلِّ بَعْدَهَا أَرْبَعًا.
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ জুম‘আর স্বলাত আদায় করবে, তখন সে যেন জুম‘আর পরে চার রাক‘আত স্বলাত আদায় করে।[2]
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ لَا يُصَلِّىْ بَعْدَ الْجُمُعَةِ حَتَّى يَنْصَرِفَ فَيُصَلِّىْ رَكْعَتَيْنِ فِىْ بَيْتِهِ.
ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ﷺ) জুম‘আর পর বাড়ীতে না ফিরে স্বলাত আদায় করতেন না। অতঃপর তিনি তাঁর বাড়ীতে দুই রাক‘আত স্বলাত আদায় করতেন।[3]
উল্লেখ্য যে, ইবনু ওমর (রাঃ) মসজিদে জুম‘আর পর সামনে এগিয়ে গিয়ে দুই রাক‘আত পড়তেন। অতঃপর আবার চার রাক‘আত পড়তেন।[4]
✔ (৫) গ্রামবাসীর উপর জুম‘আ নেই এবং শহর ছাড়া জুম‘আর স্বলাত হবে না বলে বিশ্বাস করা :
✔ শহর ছাড়া জুম‘আর স্বলাত হবে না বলে সন্দেহ করা এবং এজন্য জমু‘আর পরে ‘আখেরী যোহর’ পড়া সুন্নাত বিরোধী আমল। এ মর্মে বর্ণিত হাদীছ জাল।
عَنْ عَلِىٍّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ لاَ جُمُعَةَ وَلاَ تَشْرِيْقَ إِلاَّ فِىْ مِصْرٍ جَامِعٍ.
আলী (রাঃ) বলেন, শহর ছাড়া জুম‘আ ও তাশরীক নেই।[1]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। কারণ মারফূ‘ সূত্রে এর কোন ভিত্তি নেই।[2] উল্লেখ্য যে, উক্ত মিথ্যা বর্ণনা দ্বারাই হেদায়া লেখক গ্রামে জুম‘আর স্বলাত শুদ্ধ হবে না বলে দাবী করেছেন।[3] অথচ নিম্নের সহিহ হাদীছগুলো তার চোখে পড়েনি।
✔ গ্রামে-গঞ্জে জুম‘আ পড়ার সহিহ হাদীছ :
✔ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ إِنَّ أَوَّلَ جُمُعَةٍ جُمِّعَتْ فِى الإِسْلاَمِ بَعْدَ جُمُعَةٍ جُمِّعَتْ فِىْ مَسْجِدِ رَسُوْلِ اللهِ بِالْمَدِيْنَةِ لَجُمُعَةٌ جُمِّعَتْ بِجُوَاثَاءَ قَرْيَةٍ مِنْ قُرَى الْبَحْرَيْنِ. قَالَ عُثْمَانُ قَرْيَةٌ مِنْ قُرَى عَبْدِ الْقَيْسِ.
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, নিশ্চয় মসজিদে নববীতে জুম‘আ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম যে জুম‘আ স্বলাত অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেটা জুছা গ্রামে, যা ছিল বাহরাইনের কোন একটি গ্রাম। ওছমান (রাঃ) বলেন, আব্দুল ক্বায়েস গোত্রের কোন এক গ্রামে।[1]
উক্ত হাদীছ উল্লেখ করার পূর্বে ইমাম বুখারী (রহঃ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَابُ الْجُمُعَةِ فِى الْقُرَى وَالْمُدُنِ ‘গ্রামে ও শহর সমূহে জুম‘আর স্বলাত’ অনুচ্ছেদ। ইমাম আবুদাঊদ (রহঃ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَابُ الْجُمُعَةِ فِى الْقُرَى ‘গ্রামে গ্রামে জুম‘আর স্বলাত’ অনুচ্ছেদ। উল্লেখ্য যে, ‘হেদায়া’ কিতাবটি রচনা করা হয়েছে হাদীছের মূল গ্রন্থসমূহ সংকলনের প্রায় দুইশ’ বছর পরে। উক্ত হাদীছগুলো লেখকের দৃষ্টিগোচর হয়নি এমনটি বলা যাবে কি?
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّهُمْ كَتَبُوْا إِلَى عُمَرَ يَسْأَلُوْنَهُ عَنِ الْجُمُعَةِ؟ فَكَتَبَ جَمِّعُوْا حَيْثُمَا كُنْتُمْ.
(ইয়ামনবাসীরা) ওমর (রাঃ)-এর নিকট চিঠি লিখে জিজ্ঞেস করল জুম‘আর স্বলাত সম্পর্কে। তখন তিনি তার উত্তরে লিখে পাঠান, যেখানে তোমরা অবস্থান করবে সেখানেই জুম‘আর স্বলাত আদায় করবে।[2]
✔ عَنِ ابْنِ عُمَر أَنَّهُ كَانَ يَرَى أَهْلَ الْمِيَاهِ بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِيْنَةَ يُجَمِّعُوْنَ فَلَا يَعِيْبُ عَلَيْهِمْ.
ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি মক্কা-মদীনার মাঝের অঞ্চলের লোকদেরকে জুম‘আর স্বলাত আদায় করতে দেখতেন, কিন্তু তাদেরকে দোষারোপ করতেন না।[3]
অতএব গ্রামে জুম‘আ হবে না এমন দাবী সঠিক নয়। দুঃখজনক হল, জাল হাদীছের আমলই সমাজে চালু আছে। সহিহ হাদীছের আমল সমাজ থেকে বিদায় নিয়েছে। সহিহ হাদীছের প্রতি আত্মসমর্পণ না করে গ্রামের মসজিদে জুম‘আর স্বলাত হবে না ভেবে ‘আখেরী যোহর’ চালু করা হয়েছে। একটি জাল হাদীছকে রক্ষা করতে গিয়ে আরেকটি বিদ‘আত চালু করা হয়েছে। একেই বলে মাযহাবী গোঁড়ামী।[4]
✔ (৬) আখেরী যোহর পড়া :
গ্রামে বা মহল্লায় জুম‘আর স্বলাত হবে না সন্দেহ করে অনেক মুছল্লী জুম‘আর স্বলাতের পর চার রাক‘আত যোহর স্বলাত আদায় করে থাকে। এটা একটি বিদ‘আতী প্রথা।[1] তাছাড়া সন্দেহের উপর তো কোন ইবাদত হয় না।
[1]. আলবানী, আল-আজবেবাতুন নাফে‘আহ, পৃঃ ১৩৯, নং ৭২।
✔ (৭) ইট-বালি-সিমেন্ট ও টাইলস দ্বারা তৈরি মিম্বারে বসে খুৎবা দান করা :
কোন মসজিদে পাথর বা টাইলস দ্বারা মিম্বার তৈরি করা হলে তাকে বর্জন করা উচিত। এমতাবস্থায় ইমামকে সুন্নাতের প্রতি কঠোর হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। কারণ সুন্নাত হল কাঠ দ্বারা মিম্বার তৈরী করা এবং মিম্বারের তিনটি স্তর হওয়া। যেমন হাদীছে এসেছে,
أَرْسَلَ رَسُوْلُ اللهِ إِلَى فُلَانَةَ امْرَأَةٍ مِنْ الْأَنْصَارِ قَدْ سَمَّاهَا سَهْلٌ مُرِىْ غُلَامَكِ النَّجَّارَ أَنْ يَعْمَلَ لِىْ أَعْوَادًا أَجْلِسُ عَلَيْهِنَّ إِذَا كَلَّمْتُ النَّاسَ فَأَمَرَتْهُ فَعَمِلَهَا مِنْ طَرْفَاءِ الْغَابَةِ ثُمَّ جَاءَ بِهَا فَأَرْسَلَتْ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ فَأَمَرَ بِهَا فَوُضِعَتْ هَا هُنَا.
‘রাসূল (ﷺ) জনৈক আনছারী মহিলার নিকট লোক পাঠান। তার নাম সাহল। এই মর্মে যে, তুমি তোমার কাঠমিস্ত্রী গোলামকে নির্দেশ দাও সে যেন আমার জন্য একটি কাঠের আসন তৈরি করে। যার উপর বসে আমি জনগণের সাথে কথা বলব। ঐ মহিলা তার গোলামকে উক্ত মর্মে নির্দেশ দিলে সে গাবার ঝাউ কাঠ দিয়ে তা তৈরি করে নিয়ে আসে। অতঃপর মহিলা তা রাসূল (ﷺ)-এর নিকট পাঠিয়ে দেয়। রাসূল (ﷺ) তাকে এই স্থানে স্থাপন করার নির্দেশ দেন।[1]
উক্ত হাদীছ ইবনু খুযায়মাতে সহিহ সনদে এসেছে, فَعَمِلَ هَذِهِ الثَّلاَثَ الدَّرَجَاتِ مِنْ طَرْفَاءِ الْغَابَةِ ‘অতঃপর সে গাবার ঝাউ গাছ থেকে তিন স্তর বিশিষ্ট মিম্বার তৈরি করেছিল’।[2] ত্বাবারাণীতে এসেছে, তিন স্তর বিশিষ্ট করার জন্য রাসূল (ﷺ)-ই নির্দেশ দিয়েছিলেন।[3] এছাড়া রাসূল (ﷺ) একদা মিম্বারের তিন স্তরে উঠে তিনবার আমীন বলেছিলেন মর্মেও সহিহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[4]
অতএব মিম্বার তিন স্তরের বেশী করা সুন্নাতের বরখেলাফ।[5] এধরনের মিম্বার সরিয়ে তিনস্তর বিশিষ্ট কাঠের মিম্বার তৈরি করে সুন্নাত প্রতিষ্ঠা করা উচিত।
✔ (৮) মিম্বরের পাশে বসা ব্যক্তিদের সাথে সালাম বিনিময় করা :
অনেক মসজিদে ইমাম পৌঁছে মিম্বারের পাশের ব্যক্তিদেরকে সালাম করেন। কিন্তু সুন্নাত হল, মিম্বরে বসে সকলকে লক্ষ্য করে সালাম দেয়া। আশে পাশের লোকদেরকে সালাম দেয়ার পক্ষে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ إِذَا دَنَا مِنْ مِنْبَرِهِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ سَلَّمَ عَلَى مَنْ عِنْدَهُ مِنَ الْجُلُوْسِ فَإِذَا صَعِدَ الْمِنْبَرَ اسْتَقْبَلَ النَّاسَ بِوَجْهِهِ ثُمَّ سَلَّمَ.
ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, জুম‘আর দিনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মিম্বরের কাছাকাছি পৌঁছতেন তখন মিম্বরের নিকটে বসা ব্যক্তিদের সালাম দিতেন। অতঃপর যখন মিম্বরে উঠে মানুষের দিকে মুখ করতেন তখন আবার সালাম দিতেন।[1]
তাহক্বীক্ব : যঈফ। উক্ত বর্ণনার সনদে ওয়ালীদ বিন মুসলিম এবং ঈসা বিন আব্দুল্লাহ নামে দুইজন মুদাল্লিস রাবী আছে।[2] বরং সহিহ হাদীছে এসেছে, রাসূল (ﷺ) মিম্বরে উঠার সময় সালাম দিতেন।
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ أَنَّ النَّبِىَّ كَانَ إِذَا صَعِدَ الْمِنْبَرَ سَلَّمَ.
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) যখন মিম্বরে উঠতেন তখন সালাম দিতেন।[3]
✔ (৯) জুম‘আর খুৎবা দুই রাক‘আত স্বলাতের সমান :
✔ সমাজে উক্ত ধারণা প্রচলিত থাকলেও এর পক্ষে কোন সহিহ হাদীছ নেই। বরং যেগুলো বর্ণিত হয়েছে তার সবই যঈফ।
(أ) عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ أَنَّهُ قَالَ إِنَّمَا جُعِلَتِ الْخُطْبَةُ مَكَانَ الرَّكْعَتَيْنِ فَإِنْ لَمْ يُدْرِكِ الْخُطْبَةَ فَلْيُصَلِّ أَرْبَعًا.
(ক) ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, খুৎবাকে দুই রাক‘আতের সমান করা হয়েছে। সুতরাং যে খুৎবা পাবে না সে যেন চার রাক‘আত স্বলাত পড়ে নেয়।[1]
তাহক্বীক্ব : যঈফ। কারণ আমর ইবনু শু‘আইব ও ওমর (রাঃ)-এর মাঝে রাবী বাদ পড়েছে। আর আমর ইবনু শু‘আইব ওমর (রাঃ)-এর যুগ পাননি। অথচ হাদীছটি সরাসরি বর্ণনা করা হয়েছে।[2]
✔ (ب) عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ مَنْ أَدْرَكَ الْخُطْبَةَ فَالْجُمُعَةُ رَكْعَتَانِ وَمَنْ لَمْ يُدْرِكْهَا فَلْيُصَلِّ أَرْبَعًا.
(খ) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি খুৎবা পাবে তার জন্য জুম‘আর স্বলাত দুই রাক‘আত। আর যে খুৎবা পাবে না সে যেন চার রাক‘আত পড়ে নেয়।[3]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি মুনকার। যদিও হাফেয নূরুদ্দীন আলী ইবনে আবুবকর হায়ছামী (মৃঃ ৮০৭ হিঃ) এর রাবীদের নির্ভরযোগ্য বলেছেন।[4] সহিহ হাদীছ রয়েছে যে, যে ব্যক্তি জুম‘আর স্বলাতের এক রাক‘আত পাবে, সে আরেক রাক‘আত পড়ে নিবে।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِىَّ قَالَ مَنْ أَدْرَكَ مِنَ الْجُمُعَةِ رَكْعَةً فَلْيُصَلِّ إِلَيْهَا أُخْرَى.
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি জুম‘আর স্বলাতের এক রাক‘আত পাবে সে যেন তার সাথে পরের রাক‘আত পড়ে নেয়।[5]
✔ (১০) খুৎবার সময় ইমামের দিকে লক্ষ্য না করা :
ইমাম যখন মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুৎবা শুরু করবেন, তখন সকল মুছল্লী তার দিকে লক্ষ্য করবেন। এটাই ছিল ছাহাবায়ে কেরামের আদর্শ।
عَنْ أَبِىْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ قَالَ جَلَسَ رَسُوْلُ اللهِ عَلَى الْمِنْبَرِ وَجَلَسْنَا حَوْلَهُ.
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) যখন মিম্বরে বসতেন তখন আমরাও তাঁর আশে পাশে বসতাম।[1]
عَنْ عَدِىِّ بْنِ ثَابِتٍ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ كَانَ النَّبِىُّ إِذَا قَامَ عَلَى الْمِنْبَرِ اسْتَقْبَلَهُ أَصْحَابُهُ بِوُجُوْهِهِمْ.
আদী ইবনু ছাবেত (রাঃ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ) যখন মিম্বরে বসতেন তখন তাঁর ছাহাবীগণ তাদের মুখমন্ডলসহ তাঁর দিকে ঘুরে বসতেন।[2] শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন,
وَهَذِهِ مِنَ السُّنَنِ الْمَتْرُوْكَةِ فَعَلَى الْمُحِبِّيْنَ لَهَا إِحْيَاؤُهَا حَيَّاهُمُ اللهُ تَعَالَى وَبَيَّاهُمْ وَجَعَلَ الْجَنَّةَ مَأْوَانَا وَمَأْوَاهُمْ بِفَضْلِهِ وَكَرْمِهِ.
‘পরিত্যক্ত সুন্নাতগুলোর মধ্যে এটি একটি। সুতরাং যারা সুন্নাতকে মহববত করে তাদের উচিত তাকে পুনর্জ্জীবিত করা। তাহলে আল্লাহ তা‘আলাও তাদের সম্মান দান করবেন এবং দয়া করবেন। আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ ও দয়ার বিনিময়ে আমাদের ও তাদের স্থান জান্নাতে নির্ধারণ করুন’।[3]
✔ (১১) খুৎবার সময় মসজিদে এসে স্বলাত না পড়েই বসে পড়া :
উক্ত কাজ সুন্নাত বিরোধী। ইমাম খুৎবা দিলেও দুই রাক‘আত সুন্নাত স্বলাত পড়ে বসতে হবে। নিষেধের পক্ষে যে হাদীছ প্রচার করা হয় তা মিথ্যা।
✔ (أ) عَنْ عَلِىٍّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ لاَتُصَلُّوْا وَ الْإِمَامُ يَخْطُبُ.
(ক) আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছ) বলেন, ইমাম খুৎবা দেওয়া অবস্থায় তোমরা স্বলাত আদায় কর না।[1]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। তাছাড়া সহিহ হাদীছের সরাসরি বিরোধী।[2] অন্য বর্ণনায় এসেছে,
✔ (ب) عَنِ ابْنِ عُمَرَ إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ الْمَسْجِدَ وَالْإِمَامُ عَلَى الْمِنْبَرِ فَلاَ صَلاَةَ وَلاَ كَلاَمَ حَتَّى يَفْرُغَ الْإِمَامُ.
(খ) ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ)-কে আমি বলতে শুনেছি যে, ইমাম খুৎবা দেওয়া অবস্থায় তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন ইমাম খুৎবা শেষ করা পর্যন্ত কোন স্বলাত নেইও কোন কথাও নেই।[3]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি বাতিল। শায়খ আলবানী বলেন, وَإِنَّمَا حَكَمْتُ عَلَى الْحَدِيْثِ بِالْبُطْلاَنِ لِأَنَّهُ مَعَ ضَعْفِ سَنَدِهِ يُخَالِفُ حَدِيْثَيْنِ صَحِيْحَيْنِ. ‘আমি এই হাদীছের উপর বাতিল হওয়ার হুকুম আরোপ করেছি। কারণ এর সনদ যঈফ হওয়ার পাশাপাশি দুইটি সহিহ হাদীছের বিরোধী’। [4]
✔ খুৎবার সময় স্বলাত আদায় করার সহিহ দলীল :
✔ عَنْ جَابِرٍ قَالَ دَخَلَ رَجُلٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالنَّبِيُّ يَخْطُبُ فَقَالَ أَصَلَّيْتَ قَالَ لَا قَالَ قُمْ فَصَلِّ رَكْعَتَيْنِ.
জাবের (রাঃ) বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি জুম‘আর দিনে মসজিদে প্রবেশ করল। তখন রাসূল (ﷺ) খুৎবা দিচ্ছিলেন। তিনি ঐ লোকটিকে বললেন, তুমি কি স্বলাত আদায় করেছ? সে বলল, না। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, তুমি দাঁড়াও দুই রাক‘আত স্বলাত আদায় কর। [1] ইমাম বুখারী (রহঃ) নিম্নোক্ত মর্মে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَابُ إِذَا رَأَى الْإِمَامُ رَجُلًا جَاءَ وَهُوَ يَخْطُبُ أَمَرَهُ أَنْ يُصَلِّيَ رَكْعَتَيْنِ ‘ইমাম খুৎবা দেয়া অবস্থায় যখন কোন ব্যক্তিকে মসজিদে আসতে দেখবেন তখন তিনি তাকে নির্দেশ দিবেন সে যেন দুই রাক‘আত স্বলাত আদায় করে’ অনুচ্ছেদ। আরেকটি অধ্যায় রচনা করেছেন, بَابُ مَنْ جَاءَ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ خَفِيْفَتَيْنِ ‘ইমাম খুৎবা দেয়া অবস্থায় যে মসজিদে আসবে সে যেন সংক্ষিপ্তভাবে দুই রাক‘আত স্বলাত আদায় করে’ অনুচ্ছেদ।
عَنْ جَابِرٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ وَهُوَ يخْطُبُ إِذَا جَاءَ أَحَدُكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ وَلْيَتَجَوَّزْ فِيْهِمَا.
জাবের (রাঃ) বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) একদা খুৎবা প্রদানকালে বলেন, ইমাম খুৎবা দেয়া অবস্থায় জুম‘আর দিনে তোমাদের কেউ যদি মসজিদে আসে সে যেন দুই রাক‘আত স্বলাত আদায় করে। আর এর মাঝে সংক্ষেপ করে।[2]
অতএব মসজিদে যখনই প্রবেশ করবে তখনই দুই রাক‘আত স্বলাত আদায় করতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই। উক্ত হাদীছগুলো জানার পরও যদি কেউ আমল না করে তাহলে তার পরিণাম কী হতে পারে? অথচ হেদায়ার মধ্যে জাল হাদীছের আলোকে এ সময় স্বলাত আদায় করতে সরাসরি নিষেধ করা হয়েছে।[3]
✔ (১২) লাঠি ছাড়া খুৎবা দেওয়া :
হাতে লাঠি নিয়ে জুম‘আর খুৎবা প্রদান করা সুন্নাত। হাকাম ইবনু হাযন (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে জুম‘আর দিন হাতে লাঠি নিয়ে খুৎবা দিতে দেখেছি।[1] অনুরূপ ঈদের মাঠে এবং অন্যান্য স্থানেও বক্তব্যের সময় রাসূল (ﷺ) হাতে লাঠি নিতেন।[2]
উলেখ্য, মিম্বর তৈরীর পর রাসূল (ﷺ) হাতে লাঠি নেননি বলে ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) দাবী করেছেন। কিন্তু উক্ত কথার পক্ষে কোন দলীল নেই।[3]। শায়খ আলবানী (রহঃ) উক্ত দলীল বিহীন বক্তব্য উল্লেখ করে শুধু জুম‘আর খুৎবার বিষয়টি সমর্থন করেছেন। তবে ঈদের খুৎবাসহ অন্যান্য বক্তব্যের সময় হাতে লাঠি নেওয়া যাবে বলে উল্লেখ করেছেন।[4]
মূল কথা হল, মিম্বর তৈরির পরও রাসূল (ﷺ) হাতে লাঠি নিয়ে খুৎবা দিয়েছেন। কারণ মিম্বর তৈরি হয়েছে ৫ম হিজরীতে আর হাকাম বিন হাযন ৮ম হিজরীতে ইমলাম গ্রহণ করে মদীনায় আগমন করেন এবং জুম‘আর দিনে রাসূল (ﷺ)-কে হাতে লাঠি নিয়ে খুৎবা দিতে দেখেন।[5] উল্লেখ্য, হাকাম বিন হাযন (রাঃ) কত সালে ইসলাম গ্রহণ করেছেন সে ব্যাপারে দু’টি মত পাওয়া যায়। আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী বলেন, ৮ম হিজরীই সঠিক।[6]
দ্বিতীয়তঃ হাতে লাঠি নিয়ে খুৎবা দেওয়ার হাদীছটি ব্যাপক। রাসূল (ﷺ) সব সময় হাতে লাঠি নিতেন বলে প্রমাণিত হয়। তৃতীয়তঃ মিম্বর তৈরির পর তিনি আর হাতে লাঠি নিয়ে খুৎবা দেননি, একথার পক্ষে কোন দলীল নেই। চতুর্থতঃ ছাহাবীদের মধ্যেও মিম্বরে দাঁড়িয়ে হাতে লাঠি নিয়ে খুৎবা দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।[7]
✔ (১৩) বিনা কারণে জুম‘আর স্বলাত ত্যাগ করলে কাফফারা দেওয়া :
✔ জুম‘আর স্বলাত পরিত্যাগ করা মহা অন্যায়। কোন কারণ ছাড়াই কেউ যদি জুম‘আ ত্যাগ করে, তবে তাকে মুনাফিকদের তালিকাভুক্ত করা হয়।[1] অলসতা করে পর পর তিন জুম‘আ পরিত্যাগ করলে আল্লাহ তার অন্তরে মোহর মেরে দেন।[2] তাই ছুটে গেলে খালেছ অন্তরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং তওবা করতে হবে। কাফফারা দেওয়ার কোন সহিহ বর্ণনা নেই। এ সম্পর্কে যে সমস্ত বর্ণনা এসেছে তা যঈফ। যেমন-
عَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدُبٍ عَنِ النَّبِىِّ قَالَ مَنْ تَرَكَ الْجُمُعَةَ مِنْ غَيْرِ عُذْرٍ فَلْيَتَصَدَّقْ بِدِيْنَارٍ فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَبِنِصْفِ دِيْنَارٍ.
সামুরা বিন জুনদুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি বিনা কারণে জুম‘আর স্বলাত ত্যাগ করবে সে যেন এক দীনার ছাদাক্বা করে। আর তা যদি না থাকে তাহলে অর্ধ দীনার ছাদাক্বা করে।[3]
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ।[4] অন্য বর্ণনায় এসেছে,
✔ عَنْ قُدَامَةَ بْنِ وَبَرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ فَاتَتْهُ الْجُمُعَةُ مِنْ غَيْرِ عُذْرٍ فَلْيَتَصَدَّقْ بِدِرْهَمٍ أَوْ نِصْفِ دِرْهَمٍ أَوْ صَاعِ حِنْطَةٍ أَوْ نِصْفِ صَاعٍ.
কুদামা বিন ওয়াবারা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, বিনা কারণে যার জুম‘আর স্বলাত ছুটে যাবে সে যেন এক দিরহাম বা অর্ধ দিরহাম কিংবা এক ছা‘ বা অর্ধ ছা‘ গম ছাদাক্বা দেয়।[5]
তাহক্বীক্ব : এটিও যঈফ।[6]
✔ (১৪) ফযীলতের আশায় জুম‘আর দিন পাগড়ী পরিধান করা :
অধিক ফযীলত মনে করে অনেকে এই দিনে পাগড়ী পরে থাকে। জুম‘আর দিন পাগড়ী পরিধান করার ফযীলত সম্পর্কে যত হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, সবই জাল।
عَنْ أَبِى الدَّرْدَاءِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ اللهَ وَمَلاَئِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَى أَصْحَابِ الْعَمَائِمِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ.
আবু দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা এবং ফেরেশতামন্ডলী জুম‘আর দিনে পাগড়ী পরিধানকারী ব্যক্তিদের উপর রহম করেন।[1]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। এর সনদে আইয়ূব ইবনু মুদরাক নামে মিথ্যুক রাবী রয়েছে।[2] ইমাম ইবনুল জাওযী এই বর্ণনাকে জাল হাদীছের গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।[3] শায়খ আলবানীও জাল বলেছেন।[4] অন্য বর্ণনায় এসেছে,
✔ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ إِنِّىْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ صَلاَةٌ بِعِمَامَةٍ تَعْدِلُ خَمْسًا وَّعِشْرِيْنَ صَلاَةً بِغَيْرِ عِمَامَةٍ وَجُمُعَةٌ بِعِمَامَةٍ تَعْدِلُ سَبْعِيْنَ جُمُعَةً بِغَيْرِ عِمَامَةٍ إِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَيَشْهَدُوْنَ الْجُمُعَةَ مُعْتَمِّيْنَ وَلاَ يَزَالُوْنَ يُصَلُّوْنَ عَلَى أَصْحَابِ الْعَمَائِمِ حَتىَّ تَغْرُبَ الشَّمْسُ.
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, পাগড়ী মাথায় দিয়ে এক ওয়াক্ত স্বলাত আদায় করলে পাগড়ী বিহীন ২৫ ওয়াক্ত স্বলাতের সমান নেকী হয় এবং পাগড়ী পরে এক জুম‘আ পড়লে পাগড়ী বিহীন ৭০ জুম‘আর সমপরিমাণ নেকী হয়। নিশ্চয় ফেরেশতারা পাগড়ী পরে জুম‘আর স্বলাতে শরীক হন। তারা পাগড়ী পরিহিত ব্যক্তিদের জন্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত দু‘আ করতে থাকেন।[5]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। এর সনদে আববাস ইবনু কাছীর নামে মিথ্যুক রাবী আছে।[6] ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, বর্ণনাটি জাল।[7]
জ্ঞাতব্য : উক্ত ফযীলতের আশা না করে কেউ চাইলে পাগড়ী পরতে পারে। রাসূল (ﷺ) কখনো জুম‘আর দিন পাগড়ী পরে খুৎবা দিতেন।[8]
✔ (১৫) দু‘আ চাওয়া এবং সালামের পর সম্মিলিত মুনাজাত করা :
জুম‘আর দিন দু‘আ চাওয়া একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে। অনেক মসজিদে ফরয স্বলাত কিংবা জুম‘আর স্বলাতের পর কেউ কেউ পিতা-মাতা বা নিজের রোগমুক্তির জন্য সবার কাছে দু‘আ চায়। অনেকে ইমামের নিকট পত্র লিখে দু‘আ চায়। অথচ দু‘আ চাওয়ার এই নিয়মটি সুন্নাত সম্মত নয়। মূলতঃ স্বলাতের পরে প্রচলিত মুনাজাত চালু থাকার কারণেই দু‘আ চাওয়ার এই পদ্ধতিও চালু আছে। অনেক মসজিদে অন্যান্য স্বলাতের পরে বিদ‘আতী মুনাজাত হয় না কিন্তু জুম‘আর দিনে হয়। কারণ ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ সেদিন স্বলাতে হাযির হয় এবং মসজিদে কিছু দান করে দু‘আ চায়। রাসূল (ﷺ) ও ছাহাবীদের থেকে উক্ত পদ্ধতিতে দু‘আ চাওয়ার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। দু‘আ চাওয়ার নিয়ম হল- কোন সমস্যায় পড়লে বা রোগাক্রান্ত হলে এলাকার জীবিত পরহেযগার, দ্বীনদার, হক্বপন্থী আলেমের কাছে গিয়ে দু‘আর জন্য আবেদন করা। তখন তিনি প্রয়োজনে ওযূ করে ক্বিবলামুখী হয়ে হাত তুলে তার জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করবেন। ছাহাবায়ে কেরাম উক্ত পদ্ধতিতে দু‘আ চাইতেন।
আউত্বাসের যুদ্ধে আবু আমেরকে তীর লাগলে তিনি স্বীয় ভাতিজা আবু মূসার মাধ্যমে বলে পাঠান যে, তুমি আমার পক্ষ থেকে রাসূল (ﷺ)-কে সালাম পৌঁছে দিবে এবং আমার জন্য ক্ষমা চাইতে বলবে। অতঃপর তাঁর কাছে বলা হল। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন,
دَعَا النَّبِىُّ بِمَاءٍ فَتَوَضَّأَ ثُمَّ رَفَعَ يَدَيْهِ فَقَالَ اللهُمَّ اغْفِرْ لِعُبَيْدٍ أَبِىْ عَامِرٍ وَرَأَيْتُ بَيَاضَ إِبْطَيْهِ ثُمَّ قَالَ اللهُمَّ اجْعَلْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَوْقَ كَثِيْرٍ مِنْ خَلْقِكَ مِنَ النَّاسِ.
নবী করীম (ﷺ) পানি চাইলেন এবং ওযূ করলেন। অতঃপর দু’হাত তুলে দু‘আ করলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ! আবু আমের উবাইদকে ক্ষমা করে দিন। (রাবী বলেন) এ সময়ে আমি তাঁর বগলের শুভ্রতা দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ! ক্বিয়ামতের দিন আপনি তাকে আপনার সৃষ্টি মানুষের অনেকের ঊর্ধ্বে করে দিন’।[1]
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَدِمَ الطُّفَيْلُ بْنُ عَمْرِو الدَّوْسِى عَلَى رَسُوْلِ اللهِ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ دَوْسًا قَدْ عَصَتْ وَأَبَتْ فَادْعُ اللهَ عَلَيْهَا فَاسْتَقْبَلَ رَسُوْلُ اللهِ الْقِبْلَةَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ فَظَنَّ النَّاسُ أَنَّهُ يَدْعُوْ عَلَيْهِمْ فَقَالَ اللهُمَّ! اهْدِ دَوْسًا وَائْتِ بِهِمْ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা তুফাইল ইবনু আমর রাসূল (ﷺ)-এর কাছে গিয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! দাউস গোত্র অবাধ্য ও অবশীভূত হয়ে গেছে, আপনি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে বদ দু’আ করুন। তখন রাসূল (ﷺ) ক্বিবলামুখী হলেন এবং দু’হাত তুললেন। লোকেরা ধারণা করল যে, তিনি তাদের বিরুদ্ধে বদ দু‘আ করবেন। কিন্তু তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আপনি দাউস গোত্রকে হেদায়াত দান করুন এবং তাদেরকে সঠিক পথ দেখান’।[2]
দ্বিতীয়তঃ সবার কাছে দু‘আ চাইতে পারে। তখন সকলে নিজ নিজ ঐ ব্যক্তির জন্য দু‘আ করবে। তা স্বলাতের মধ্যে হোক বা স্বলাতের বাইরে হোক। ইমামও কারো পক্ষে থেকে সবার নিকট দু‘আ চাইতে পারেন যাতে সকলে নিজ নিজ তার জন্য দু‘আ করে। ইমাম জুম‘আর দিন তার জন্য খুৎবায় দু‘আ করতে পারেন আর বাকীরা আমীন আমীন বলতে পারে।[3]
✔ (১৬) জুম‘আর দিন চুপ থেকে খুৎবা শুনলে ৭ কোটি ৭ লক্ষ ৭০ হাযার নেকী হবে :
জুম‘আর দিন বাড়ি থেকে ওযূ করে মসজিদে গিয়ে স্বলাতের শেষ পর্যন্ত চুপ করে বসে থাকলে উক্ত ছওয়াব পাওয়া যাবে মর্মে কোন দলীল পাওয়া যায় না। উক্ত ফযীলত মিথ্যা ও কাল্পনিক। তবে জুম‘আর দিন মসজিদে গিয়ে সাধ্য অনুযায়ী স্বলাত আদায় করে খুৎবার শেষ পর্যন্ত চুপ থাকার ফযীলত সহিহ হাদীছ সমূহে পাওয়া যায়।
عَنْ أَوْسِ بْنِ أَوْسٍ فَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُولُ مَنْ غَسَّلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَاغْتَسَلَ ثُمَّ بَكَّرَ وَابْتَكَرَ وَمَشَى وَلَمْ يَرْكَبْ وَدَنَا مِنَ الإِمَامِ فَاسْتَمَعَ وَلَمْ يَلْغُ كَانَ لَهُ بِكُلِّ خُطْوَةٍ عَمَلُ سَنَةٍ أَجْرُ صِيَامِهَا وَقِيَامِهَا.
আউস ইবনু আউস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি জুম‘আর দিন কাপড় ধৌত করবে ও গোসল করবে এবং সকাল সকাল প্রস্ত্ততি নিবে ও সওয়ার না হয়ে পায়ে হেঁটে মসজিদে যাবে অতঃপর ইমামের কাছাকাছি বসবে এবং মনোযোগ দিয়ে খুৎবা শ্রবণ করবে ও অনর্থক কোন কাজ করবে না, তার জন্য প্রত্যেক ধাপে এক বছরের নফল ছিয়াম ও এক বছরের নফল স্বলাতের ছওয়াব হবে।[1]
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ قَالَ مَنِ اغْتَسَلَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَصَلَّى مَا قُدِّرَ لَهُ ثُمَّ أَنْصَتَ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ خُطْبَتِهِ ثُمَّ يُصَلِّيَ مَعَهُ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الْأُخْرَى وَفَضْلُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘কেউ যদি জুম‘আর দিন গোসল করে মসজিদে আসে এবং সম্ভবপর কিছু স্বলাত আদায় করতঃ খুৎবা শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকে, অতঃপর ইমামের সাথে স্বলাত আদায় করে তাহলে তার দু’জুম‘আর মধ্যেকার গোনাহ সমূহ মাফ করে দেওয়া হবে এবং আরো তিন দিন বেশী ক্ষমা করা হবে’।[2]
✔ (১৭) জুম‘আর দিন আছর স্বলাতের পর ৮০ বার দরূদ পড়া :
✔ عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ صَلَّى عَلَىَّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ ثَمَانِيْنَ مَرَّةً غَفَرَ اللهُ لَهُ ذُنُوْبَ ثَمَانِيْنَ عَامًا فَقِيْلَ لَهُ وَكَيْفَ الصَّلاَةُ عَلَيْكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ تَقُوْلُ اللهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَنَبِيِّكَ وَرَسُوْلِكَ النَّبِىِّ الْأُمِّىِّ وَتَعْقُدُ وَاحِدًا.
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি জুম‘আর দিনে আমার উপর ৮০ বার দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ তার ৮০ বছরের পাপ ক্ষমা করে দিবেন। জিজ্ঞেস করা হল, কিভাবে আপনার প্রতি দরূদ পাঠ করতে হবে? তিনি বললেন, তুমি একাকী বসে বলবে, হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর রহমত বর্ষণ করুন, যিনি আপনার বান্দা, আপনার নবী ও আপনার নিরক্ষর রাসূল (ﷺ)।
তাহক্বীক্ব : উক্ত বর্ণনা মিথ্যা। এর সনদে ওয়াহাব ইবনু দাঊদ ইবনু সুলায়মান যারীর নামে মিথ্যুক রাবী আছে।[1]
উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন বইয়ে লেখা আছে, জুম‘আর দিন আছর স্বলাতান্তে উক্ত স্থানে বসে ‘আল্লাহুম্মা ছাল্লি‘আলা মুহাম্মাদিন নাবিয়্যিল উম্মী ওয়া ‘আলা আলিহী ওয়া সাল্লিম তাসলীমা’ এ দরূদটি ৮০ বার পাঠ করলে আল্লাহ ৮০ বছরের ছগীরা গোনাহ মাফ করে দেন এবং তার আমলনামায় ৮০ বছরের নফল ইবাদতের ছওয়াব লিপিবদ্ধ করেন। এগুলো বানোয়াট গালগল্প মাত্র।
[1]. সিলসিলা যঈফা হা/২১৫।
✔ (১৮) জুম‘আর দিন কবর যিয়ারত করা :
✔ কবর যিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট কোন দিন নির্ধারণ করা যাবে না। যেকোন দিন যেকোন সময় কবর যিয়ারত করতে পারে। শুধু জুম‘আর দিন কবর যিয়ারত করা সম্পর্কে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা জাল। যেমন-
عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ النُّعْمَانِ يَرْفَعُ الْحَدِيْثَ إِلَى النَّبِيِّ قَالَ مَنْ زَارَ قَبْرَ أَبَوَيْهِ أَوْ أَحَدَهُمَا فِي كُلِّ جُمُعَةٍ غُفِرَ لَهُ وَكُتِبَ بَرًّا.
মুহাম্মাদ ইবনু নু‘মান (রহঃ) নবী করীম (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক জুম‘আর দিন তার মাতা-পিতার অথবা তাদের কোন একজনের কবর যিয়ারত করবে, তাকে মাফ করে দেওয়া হবে এবং মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহারকারী বলে লেখা হবে।[1]
তাহক্বীক্ব : জাল। এর সনদে মুহাম্মাদ ইবনু নু‘মান নামের রাবী অপরিচিত। এছাড়া ইয়াহইয়া নামের রাবী মিথ্যুক। তার বর্ণিত হাদীছগুলো জাল।[2]
✔ (১৯) জুম‘আতুল বিদা পালন করা :
✔ রামাযানের শেষ জুম‘আকে ‘জুম‘আতুল বিদা’ বলা হয়। অথচ শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই। উক্ত মর্মে যে কথা প্রচলিত আছে তা ডাহা মিথ্যা।
مَنْ قَضَى صَلَوَاتٍ مِنَ الْفَرَائِضِ فِىْ أَخِرِ جُمُعَةٍ مِنْ رَمَضَانَ كَانَ ذَلِكَ جَابِرًا لِكُلِّ صَلاَةٍ فَائِتَةٍ مِنْ عُمْرِهِ إِلَى سَبْعِيْنَ سَنَةً.
যে ব্যক্তি রামাযান মাসের শেষ জুম‘আয় ক্বাযা স্বলাতগুলো আদায় করবে, তার জীবনের ৭০ বছরের ছুটে যাওয়া প্রত্যেক স্বলাতের ক্ষতি পূরণের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।[1]
তাহক্বীক্ব : মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) বলেন,
بَاطِلٌ قَطْعِيًّا لِأَنَّهُ مُنَاقِضٌ لِلْإِجْمَاعِ عَلَى أَنَّ شَيْئًا مِنَ الْعِبَادَاتِ لاَ يَقُوْمُ مَقَامَ فَائِتَةِ سَنَوَاتٍ ثُمَّ لاَ عِبْرَةَ بِنَقْلِ صَاحِبِ النِّهَايَةِ وَلاَ بَقِيَةَ شُرَّاحِ الْهِدَايَةِ لِأَنَّهُمْ لَيْسُوْا مِنَ الْمُحَدِّثِيْنَ وَلاَ أَسْنَدُوا الْحَدِيْثَ إِلَى أَحَدٍ مِنَ الْمُخَرِّجِيْنَ.
‘এটি চূড়ান্ত মিথ্যা কথা। এটা ইজমার বিরোধী। কারণ কোন ইবাদত বিগত বছরের ছুটে যাওয়া বিষয়ের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। অতঃপর ছাহেবে ‘নেহায়া’র এই বর্ণনা উল্লেখ করার মধ্যে কোন উপদেশ নেই। অনুরূপ হেদায়ার ভাষ্যকারদের মধ্যেও যের নেই। কারণ তারা মুহাদ্দিছদের অন্তর্ভুক্ত নন। এমনকি তারা এই হাদীছকে হাদীছের কোন সনদ বিশ্লেষণকারীর দিকে সম্বন্ধ করেননি।[2]
✔ مَنْ صَلَّى فِىْ آخِرِ جُمُعَةٍ مِنْ رَمَضَانَ الْخَمْسَ الصَّلَوَاتِ الْمَفْرُوْضَةَ فِى الْيَوْمِ وَاللَّيْلَةِ قَضَتْ عَنْهُ مَا أَخَلَّ بِهِ مِنْ صَلاَةِ سَنَتِهِ.
যে ব্যক্তি রামাযান মাসের শেষ জুম‘আয় দিনে রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয স্বলাত আদায় করবে তার ঐ বছরের (ত্রুটি মুক্ত) ফওত হয়ে যাওয়া স্বলাতের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।[3]
তাহক্বীক্ব : উক্ত বর্ণনা সম্পর্কে ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন,
هَذَا مَوْضُوْعٌ لاَ إِشْكاَلَ فِيْهِ وَلَمْ أَجِدْهُ فِىْ شَيْءٍ مِنَ الْكُتُبِ الَّتِىْ جَمَعَ مُصَنِّفُوْهَا فِيْهَا الْأَحَادِيْثَ الْمَوْضُوْعَةَ وَلَكِنَّهُ اشْتُهِرَ عِنْدَ جَمَاعَةٍ مِنَ الْمُتَفَقِّهَةِ بِمَدِيْنَةِ صَنْعَاءَ فِىْ عَصْرِنَا هَذَا وَصَارَ كَثِيْرٌ مِنْهُمْ يَفْعَلُوْنَ ذَلِكَ وَلاَ أَدْرِىْ مَنْ وَضَعَهُ لَهُمْ فَقَبَّحَ اللهُ الْكَذَّابِيْنَ.
‘এটা যে জাল তাতে কোন জটিলতা নেই। লেখকগণ জাল হাদীছের গ্রন্থে যে সমস্ত হাদীছ জমা করেছেন সেই গ্রন্থ সমূহের মধ্যে আমি এই বর্ণনা পায়নি। তবে মদীনার ছান‘আ অঞ্চলের ফক্বীহ শ্রেণীর লোকের মাঝে এটি খুব প্রসিদ্ধ। আর এটা বহু মানুষ আমলও করে থাকে। আমি জানি না কোন্ ব্যক্তি তাদের জন্য এটি জাল করেছে। তাই আল্লাহ মিথ্যুকদের উপর গযব বর্ষণ করুন।[4]
সুধী পাঠক! সম্পূর্ণ একটি মিথ্যা ও উদ্ভট বিষয়কে নিয়ে সারা বিশ্বে ‘জুম‘আতুল বিদা’ পালন করা হয়। ঐ দিন মুছল্লীরা মসজিদে মসজিদে এত ভীড় জমায় তা কল্পনা করা যায় না। ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও আলেমগণ যদি শরী‘আতের দোহায় দিয়ে প্রচারণা চালান, তবে তাদের অবস্থা কী হবে? সাধারণ শিক্ষিত মানুষগুলোও এই মিথ্যা স্রোতে ভেসে যান। যাচাইয়ের কোন প্রয়োজন মনে করেন না।
>>>কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ Hadithonlinebd.com<<<
No comments:
Post a Comment