নাভীর নীচে বনাম বুকের উপর হাত বাঁধার হাদীস
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্বলাত- এর অংশবিশেষশায়খ মুযাফফর বিন মুহসিন
সহিহ হাদীছের দাবী হল বুকের উপর হাত বেঁধে স্বলাত আদায় করা। নাভীর নীচে হাত বেঁধে স্বলাত আদায় করার পক্ষে কোন সহিহ হাদীছ নেই। এর পক্ষে যত হাদীছ বর্ণিত হয়েছে সবই ত্রুটিপূর্ণ।
✔ (১) عَنْ أَبِىْ جُحَيْفَةَ أَنَّ عَلِيًّا رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ مِنْ السُّنَّةِ وَضْعُ الْكَفِّ عَلَى الْكَفِّ فِي الصَّلَاةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
(১) আবু জুহায়ফাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, আলী (রাঃ) বলেছেন, সুন্নাত হল স্বলাতের মধ্যে নাভীর নীচে হাতের পাতার উপর হাতের পাতা রাখা।[1] নাভীর নীচে বনাম বুকের উপর
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি নিতান্তই যঈফ। উক্ত সনদে আব্দুর রহমান ইবনু ইসহাক নামে একজন রাবী আছে। সে সকল মুহাদ্দিছের ঐকমত্যে যঈফ।[2] ইমাম বায়হাক্বী বলেন, ‘উক্ত হাদীছের সনদ সহিহ বলে প্রমাণিত হয়নি। আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক্ব একাকী এটা বর্ণনা করেছে। সে পরিত্যক্ত রাবী।[3] আল্লামা আইনী হানাফী (মৃঃ ৮৫৫ হিঃ) বলেন, ‘এর সনদ সহিহ নয়’।[4] ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২) বলেন, এর সনদ যঈফ’।[5] শায়খ আলবানীও যঈফ বলেছেন।[6]
✔ (২) عَنْ أَبِىْ وَائِلٍ قَالَ قَالَ أَبُوْ هُرَيْرَةَ أَخْذُ الْأَكُفِّ عَلَى الْأَكُفِّ فِى الصَّلَاةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
(২) আবী ওয়ায়েল (রাঃ) বলেন, আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেছেন, স্বলাতের মধ্যে এক হাত আরেক হাতের উপর রেখে নাভীর নীচে রাখবে।[7]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি নিতান্তই যঈফ। ইমাম আবুদাঊদ বলেন, سَمِعْتُ أَحْمَدَ بْنَ حَنْبَلٍ يُضَعِّفُ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ إِسْحَقَ الْكُوْفِيَّ ‘আমি আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, আব্দুর রহমান ইবনু ইসহাক্ব যঈফ’।[8] ইবনু আব্দিল বার্র এই হাদীছকে যঈফ বলেছেন।[9] শায়খ আলবানীও যঈফ বলেছেন।[10]
✔ (৩) عَنْ أَنَسٍ قَالَ ثَلاَثٌ مِنْ أَخْلاَقِ النُّبُوَّةِ تَعَجُّلُ الْإِفْطاَرِ وَتَأْخِيْرُ السَّحُوْرِ وَوَضْعُ الْيَدِ الْيُمْنىَ عَلَى الْيَدِ الْيُسْرَى فِى الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
(৩) আনাস (রাঃ) বলেন, তিনটি জিনিস নবীদের চরিত্র। (ক) দ্রুত ইফতার করা (খ) দেরীতে সাহারী করা এবং (গ) স্বলাতের মধ্যে ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে নাভীর নীচে রাখা।[11]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। মুহাদ্দিছ যাকারিয়া বিন গোলাম কাদের বলেন, ‘এই শব্দে কেউ কোন সনদ উল্লেখ করেননি’।[12] মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, ‘আমি এই হাদীছের সনদ সম্পর্কে অবগত নই’।[13] উক্ত বর্ণনা সম্পর্কে না জেনেই অনেক লেখক তা দলীল হিসাবে পেশ করেছেন। নিঃসন্দেহে এটি দুঃখজনক।[14] অবশ্য এ মর্মে বর্ণিত সহিহ হাদীছে ‘নাভীর নীচে’ অংশটুকু নেই।[15]
✔ (৪) عَنْ وَائِلِ ابْنِ حُجْرٍ فِىْ صِفَةِ صَلاَةِ رَسُوْلِ اللهِ قَالَ رَأَيْتُ النَّبِىَّ يَضَعُ يَمِيْنَهُ عَلَى شِمَالِهِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
(৪) ওয়াইল ইবনু হুজর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্বলাতের পদ্ধতির ব্যাপারে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে নাভীর নীচে রাখতে দেখেছি।[16]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। ‘নাভীর নীচে’ কথাটুকু হাদীছে নেই। সুতরাং এই অংশটুকু জাল করা হয়েছে। শায়খ মুহাম্মাদ হায়াত সিন্দী বলেন, زِيَادَةُ تَحْتَ السُّرَّةِ نَظْرٌ بَلْ هِىَ غَلَطٌ مَنْشَؤُهُ السَّهْوُ فَإِنِّىْ رَاجَعْتُ نُسْخَةً صَحِيْحَةً مِنَ الْمُصَنِّفِ فَرَأَيْتُ فِيْهَا هَذَا الْحَدِيْثَ بِهَذَا السَّنَدِ وَبِهَذِهِ الْأَلْفَاظِ إِلاَّ أَنَّهُ لَيْسَ فِيْهَا تَحْتَ السُّرَّةِ ‘নাভীর নীচে’ এই অতিরিক্ত অংশ ত্রুটিপূর্ণ। বরং তা স্পষ্ট ভুল। মূলেই ভুল রয়েছে। আমি সংকলকের মূল কপি দেখেছি। সেখানে এই সনদ ও শব্দগুলো দেখেছি। কিন্তু তার মধ্যে ‘নাভীর নীচে’ অংশটুকু নেই’।[17]
জ্ঞাতব্য : উক্ত বর্ণনা ভিত্তিহীন হলেও মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বার নামে ‘মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে’ বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাকে বিশুদ্ধ বলা হয়েছে।[18] যার ভিত্তি নেই তাকে বিশুদ্ধ বলার উদ্দেশ্য কি? মড়ার উপর খাড়ার ঘা?
✔ (৫) إِنَّ النَّبِىَّ قَالَ إِنَّ مِنَ السُّنَّةِ وَضْعُ الْيُمْنىَ عَلَى الشِّمَالِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
(৫) নবী করীম (ﷺ) বলেন, সুন্নাত হল বাম হাতের উপর ডান হাত রেখে নাভীর নীচে রাখা।[19]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি মিথ্যা ও বানোয়াট। কারণ উক্ত মর্মে রাসূল (ﷺ) থেকে কোন বর্ণনা নেই। মদীনা পাবলিকেশান্স থেকে প্রকাশিত ‘হানাফীদের কয়েকটি জরুরী মাসায়েল’ নামক বইয়ে উক্ত শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে।[20]
বিশেষ সর্তকতা : কুদূরী ও হেদায়া কিতাবে বলা হয়েছে, وَيَعْتَمِدُ بِيَدِهِ الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى تَحْتَ السُّرَّةِ ‘এবং ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে নাভীর নীচে রাখবে’।[21] অতঃপর হেদায়া কিতাবে দলীল হিসাবে পেশ করা হয়েছে, ‘কারণ রাসূল (ﷺ)-এর কথা হল, لِقَوْلِهِ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ إنَّ مِنَ السُّنَّةِ وَضْعَ الْيَمِيْنِ عَلَى الشِّمَالِ تَحْتَ السُّرَّةِ ‘নিশ্চয় ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে নাভীর নীচে রাখা সুন্নাত’।[22] অথচ উক্ত বর্ণনার কোন ভিত্তি নেই।
সুধী পাঠক! হানাফী মাযহাবের সর্বাধিক অনুসরণীয় কিতাবে যদি এভাবে রাসূল (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা বর্ণনা মিশ্রিত করা হয়, তাহলে মানুষ সত্যের সন্ধান পাবে কোথায়?
✔ (৬) عَنِ ابْنِ جَرِيْرٍ الضَّبِّيِّ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ رَأَيْتُ عَلِيًّا رَضِيَ اللهُ عَنْهُ يُمْسِكُ شِمَالَهُ بِيَمِيْنِهِ عَلَى الرُّسْغِ فَوْقَ السُّرَّةِ.
(৬) গাযওয়ান ইবনু জারীর তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমি আলী (রাঃ)-কে ডান হাত দ্বারা বাম হাতকে কব্জির উপর রেখে নাভীর উপর বাঁধতে দেখেছি।[23]
তাহক্বীক্ব : সনদ যঈফ।[24] ইমাম আবুদাঊদ বলেন, وَرُوِيَ عَنْ سَعِيْدِ بْنِ جُبَيْرٍ فَوْقَ السُّرَّةِ قَالَ أَبُوْ مِجْلَزٍ تَحْتَ السُّرَّةِ وَرُوِيَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ وَلَيْسَ بِالْقَوِيِّ. ‘সাঈদ ইবনে জুবাইর-এর পক্ষ থেকে বর্ণনা করা হয়েছে- নাভীর উপরে হাত রাখতেন। আর আবু মিজলায বলেছেন, নাভীর নীচে হাত রাখতেন। অনুরূপ আবু হুরায়রা থেকেও বর্ণিত হয়েছে। তবে কোনটিই নির্ভরযোগ্য নয়’।[25]
✔ (৭) عَنِ الحَجَّاجِ بْنِ حَسَّانَ قَالَ سَمِعْتُ أَبَا مِجْلَزٍ أَوْ سَأَلْتُهُ قَالَ قُلْتُ كَيْفَ أَصْنَعُ؟ قَالَ يَضَعُ بَاطِنَ كَفِّ يَمِيْنِهِ عَلَى ظَاهِرِ كَفِّ شِمَالِهِ وَيَجْعَلُهَا أَسْفَلَ مِنَ السُّرَّةِ.
(৭) হাজ্জাজ ইবনু হাস্সান বলেছেন, আমি আবু মিজলাযকে বলতে শুনেছি অথবা তাকে প্রশ্ন করেছি, আমি কিভাবে হাত রাখব? তিনি বললেন, ডান হাতের পেট বাম হাতের পিঠের উপর রাখবে এবং একেবারে নাভীর নীচে রাখবে।[26]
তাহক্বীক্ব : উক্ত বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এর সনদ বিচ্ছিন্ন।[27] যদিও কেউ তাকে ‘সুন্দর সনদ’ বলে মন্তব্য করেছেন।[28] কিন্তু সহিহ হাদীছের বিরোধী হলে কিভাবে তাকে সুন্দর সনদ বলা যায়? [29]
✔ (8) عَنْ أَبِى الزُّبَيْرِ قَالَ أَمَرَنِىْ عَطَاءٌ أَنْ أَسْأَلَ سَعِيْدًا أَيْنَ تَكُوْنُ الْيَدَانِ فِى الصَّلاَةِ؟ فَوْقَ السُّرَّةِ أَوْ أَسْفَلَ مِنَ السُّرَّةِ؟ فَسَأَلْتُهُ فَقَالَ فَوْقَ السُّرَّةِ.
(৮) যুবাইর বলেন, আত্বা আমাকে বললেন, আমি যেন সাঈদ ইবনু জুবাইরকে জিজ্ঞেস করি, স্বলাতের মধ্যে দুই হাত কোথায় থাকবে? নাভীর উপরে না নাভীর নীচে? অতঃপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, নাভীর উপরে।[30]
তাহক্বীক্ব : সনদ যঈফ। এর সনদে ইয়াহইয়া ইবনু আবী তালেব ও যায়েদ ইবনু হুবাব নামে রাবী আছে, তারা ত্রুটিপূর্ণ।[31] মূলতঃ পরবর্তীতে এই বর্ণনার মাঝে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।[32]
(9) قاَلَ عَبْدُ اللهِ رَأَيْتُ أَبِىْ إِذَا صَلَّى وَضَعَ يَدَيْهِ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَوْقَ السُّرَّةِ.
✔ (৯) আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদ (রহঃ) বলেন, আমি আমার আববাকে দেখেছি যে, তিনি যখন স্বলাত আদায় করতেন তখন তিনি তার এক হাত অপর হাতের উপর স্থাপন করে নাভীর উপরে রাখতেন।[33]
তাহক্বীক্ব : ইমাম আহমাদ (রহঃ) নাভীর নীচে হাত বাঁধার বর্ণনাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেমন ইমাম আবুদাঊদ বলেন, سَمِعْتُ أَحْمَدَ بْنَ حَنْبَلٍ يُضَعِّفُ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ إِسْحَقَ الْكُوفِيَّ ‘আমি আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, আব্দুর রহমান ইবনু ইসহাক্ব যঈফ’।[34] সুতরাং উক্ত বর্ণনার দিকে ভ্রুক্ষেপ করার প্রশ্নই উঠে না। তাছাড়া ইমাম নববী ও আলবানী গ্রহণ করেননি।[35] ইমাম আহমাদ সম্পর্কে নাভীর নীচে ও উপরে দুই ধরনের কথা এসেছে। মূলতঃ তা সন্দেহ যুক্ত। যেমনটি দাবী করেছেন কাযী আবু ইয়ালা আল-ফার্র।[36] সুতরাং তার পক্ষ থেকে বুকের উপর হাত বাঁধাই প্রমাণিত হয়। যাকে ইমাম আবুদাঊদ সহিহ বলেছেন।[37]
✔ বিভ্রান্তি থেকে সাবধান :
বাজারে প্রচলিত ‘স্বলাত শিক্ষা’ বইগুলোতে উক্ত যঈফ, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বর্ণনা দ্বারা নাভীর নীচে হাত বাঁধার দলীল পেশ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে মাওলানা আব্দুল মতিন প্রণীত ‘দলিলসহ স্বলাতের মাসায়েল’ একটি। উক্ত লেখক শুধু বানোয়াট বর্ণনাই পেশ করেননি, বরং রীতি মত সহিহ হাদীছের অপব্যাখ্যা করে রাসূল (ﷺ)-এর আমলকে যবাই করে নিজেদেরকে ‘প্রকৃত আহলে হাদীস’ বলে দাবী করেছেন।[38] কথায় বলে ‘অন্ধ ছেলের নাম পদ্মলোচন’। কারণ অন্ধ মাযহাবের মরণ ফাঁদে পড়ে কেউ আহলেহাদীছ পরিচয় ব্যক্ত করতে পারে না। এ জন্য ‘আহলেহাদীছ’ পরিচয় দেয়ার সাহস হয় না।
✔ বুকের উপর হাত বাঁধার সহিহ হাদীছ সমূহ :
রাসূল (ﷺ) সর্বদা বুকের উপর হাত বেঁধে স্বলাত আদায় করতেন। উক্ত মর্মে একাধিক সহিহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি পেশ করা হল :
(1) عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ كَانَ النَّاسُ يُؤْمَرُوْنَ أَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ الْيَدَ الْيُمْنَى عَلَى ذِرَاعِهِ الْيُسْرَى فِي الصَّلَاةِ قَالَ أَبُوْ حَازِمٍ لَا أَعْلَمُهُ إِلَّا يَنْمِىْ ذَلِكَ إِلَى النَّبِيِّ
(১) সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন, লোকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হত, মুছল্লী যেন স্বলাতের মধ্যে তার ডান হাত বাম হাতের বাহুর উপর রাখে। আবু হাযেম বলেন, এটা রাসূল (ﷺ)-এর দিকেই ইঙ্গিত করা হত বলে আমি জানি।[1]
ইমাম বুখারী (রহঃ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَابُ وَضْعِ الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى ‘স্বলাতের মধ্যে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা অনুচ্ছেদ’।[2] উল্লেখ্য যে, ইমাম নববী (রহঃ) নিম্নোক্ত মর্মে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন- ‘তাকবীরে তাহরীমার পর ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে বুকের নীচে নাভীর উপরে রাখা’।[3] অথচ হাদীছে ‘বুকের নীচে নাভীর উপরে’ কথাটুকু নেই। মূলতঃ পুরো ডান হাতের উপর বাম হাত রাখলে বুকের উপরই চলে যায়। যেমন উক্ত হাদীছ উল্লেখ করে শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন,
وَمِثْلُهُ حَدِيْثُ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ كَانَ يَضَعُ الْيُمْنىَ عَلَى ظَهْرِ كَفِّهِ الْيُسْرَى وَالرُّسْغِ وَ السَّاعِدِ رَوَاهُ أَبُوْدَاؤُدَ وَ النَّسَائِىُّ بِسَنَدِ صَحِيْحٍ وَ هَذِهِ الْكَيْفِيّةُ نَسْتَلْزِمُ أَنْ يَّكُوْنَ الْوَضْعُ عَلَى الصَّدْرِ إِذَا أَنْتَ تَأَمَّلْتَ ذَلِكَ وَعَمِلْتَ بِهَا فَجَرِّبْ إِنْ شِئْتَ وَ مِمَّا يَنْبَغِىْ أَنْ يَّعْلَمَ أَنَّهُ لَمْ يَصِحُّ عَنْهُ الْوَضْعُ عَلَى غَيْرِ الصَّدْرِ كَحَدِيْثِ وَ السُّنَّةُ وَضْعُ الْكَفِّ فِى الصَّلاَةِ تَحْتَ السُّرَّةِ.
‘অনুরূপ ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) ডান হাত বাম হাতের পাতা, হাত ও বাহুর উপর রাখতেন। যা সহিহ সনদে আবুদাঊদ ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন। এই পদ্ধতিই আমাদের জন্য অপরিহার্য করে যে হাত রাখতে হবে বুকের উপর। যদি আপনি এটা বুঝেন এবং এর প্রতি আমল করেন। অতএব আপনি চাইলে যাচাই করতে পারেন। আর এ সম্পর্কে যা জানা উচিত তা হল, বুকের উপর ছাড়া অন্যত্র হাত বাঁধার বিষয়টি রাসূল (ﷺ) থেকে সহিহ হিসাবে সাব্যস্ত হয়নি। যেমন একটি হাদীছ, ‘সুন্নাত হল স্বলাতের মধ্যে নাভীর নীচে হাতের পাতা রাখা’ (এই বর্ণনা সঠিক নয়)।[4]
বিশেষ জ্ঞাতব্য : সুধী পাঠক! সহিহ বুখারীতে বর্ণিত উক্ত হাদীছের অনুবাদ করতে গিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুবাদে ‘ডান হাত বাম হাতের কবজির উপরে’ মর্মে অনুবাদ করা হয়েছে।[5] আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত বুখারীতেও একই অনুবাদ করা হয়েছে।[6] অথচ ইসলমিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত একই খন্ডের মধ্যে অন্যত্র এর অর্থ করা হয়েছে ‘বাহু’।[7] কিন্তু ‘বাহু’ আর ‘কব্জি’ কি এক বস্ত্ত? সব হাদীছ গ্রন্থে ‘যিরা’ অর্থ ‘বাহু’ করা হয়েছে। যেমন রাসূল (ﷺ) ওযূ করার সময় মুখমন্ডল ধৌত করার পর বাহুর উপর পানি ঢালতেন।[8] এছাড়া আরবী কোন অভিধানে ‘যিরা’ শব্দের অর্থ ‘কব্জি’ করা হয়নি। অতএব কোন সন্দেহ নেই যে, নাভীর নীচে হাত বাঁধার ত্রুটিপূর্ণ আমলকে প্রমাণ করার জন্যই উক্ত কারচুপি করা হয়েছে। অথচ অন্যত্র সহিহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) তাঁর ডান হাতটি বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর উপর রাখতেন, যা পূর্বে আলবানীর আলোচনায় পেশ করা হয়েছে।
(2) عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَ لَأَنْظُرَنَّ إِلَى صَلاَةِ رَسُوْلِ اللهِ كَيْفَ يُصَلِّى فَنَظَرْتُ إِلَيْهِ فَقَامَ فَكَبَّرَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ حَتَّى حَاذَتَا بِأُذُنَيْهِ ثُمَّ وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى كَفِّهِ الْيُسْرَى وَالرُّسْغِ وَالسَّاعِدِ فَلَمَّا أَرَادَ أَنْ يَرْكَعَ رَفَعَ يَدَيْهِ مِثْلَهَا …
(২) ওয়ায়েল ইবনু হুজর (রাঃ) বলেন, আমি অবশ্যই রাসূল (ﷺ)-এর স্বলাতের দিকে লক্ষ্য করতাম, তিনি কিভাবে স্বলাত আদায় করেন। আমি তাঁর দিকে লক্ষ্য করতাম যে, তিনি স্বলাতে দাঁড়াতেন অতঃপর তাকবীর দিতেন এবং কান বরাবর দুই হাত উত্তোলন করতেন। তারপর তাঁর ডান হাত বাম হাতের পাতা, কব্জি ও বাহুর উপর রাখতেন। অতঃপর যখন তিনি রুকূ করার ইচ্ছা করতেন তখন অনুরূপ দুই হাত উত্তোলন করতেন…।[9]
উল্লেখ্য যে, ‘মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে’ বইটিতে উক্ত হাদীছটির পূর্ণ অর্থ করা হয়নি; বরং অর্থ গোপন করা হয়েছে।[10] তাছাড়া ভারতীয় ছাপা আবুদাঊদে অর্থ পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে দুইটি শব্দে ভুল হরকত দেয়া হয়েছে।[11]
সুধী পাঠক! উক্ত হাদীছ প্রমাণ করে যে, রাসূল (ﷺ) ডান হাতটি পুরো বাম হাতের উপর রাখতেন। এমতাবস্থায় হাত নাভীর নীচে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এইভাবে হাত রেখে নাভীর নীচে স্থাপন করতে চাইলে মাজা বাঁকা করে নাভীর নীচে হাত নিয়ে যেতে হবে, যা উচিত নয়। আমরা এবার দেখব রাসূল (ﷺ) তাঁর দুই হাত কোথায় স্থাপন করতেন।
(3) عَنْ طَاوُسٍ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ يَضَعُ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى يَدِهِ الْيُسْرَى ثُمَّ يَشُدُّ بَيْنَهُمَا عَلَى صَدْرِهِ وَهُوَ فِي الصَّلَاةِ.
(৩) ত্বাঊস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) স্বলাতের মধ্যে তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর রাখতেন এবং উভয় হাত বুকের উপর শক্ত করে ধরে রাখতেন।[12]
যরূরী জ্ঞাতব্য : ভারতীয় ছাপা আবুদাঊদে হাত বাঁধা সংক্রান্ত একটি হাদীছও উল্লেখিত হয়নি। এর কারণ সম্পূর্ণ অজানা। তবে ইমাম আবুদাঊদ নাভীর নীচে হাত বাঁধা সম্পর্কে বর্ণিত বর্ণনাগুলোকে যঈফ বলেছেন। আর বুকের উপর হাত বাঁধার হাদীছটিকে সহিহ হিসাবে পেশ করতে চেয়েছেন। কারণ উক্ত হাদীছ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি। সে জন্যই হয়ত কোন হাদীছই উল্লেখ করা হয়নি।[13]
উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদীছকে অনেকে নিজস্ব গোঁড়ামী ও ব্যক্তিত্বের বলে যঈফ বলে প্রত্যাখ্যান করতে চান। মুহাদ্দিছগণের মন্তব্যের তোয়াক্কা করেন না। নিজেকে শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ বলে পরিচয় দিতে চান। অথচ আলবানী উক্ত হাদীছ উল্লেখ করে বলেন, رَوَاهُ أَبُوْ دَاوُدَ بِإِسْنَادٍ صَحِيْحٍ عَنْهُ ‘আবুদাঊদ ত্বাঊস থেকে এই হাদীছকে সহিহ সনদে বর্ণনা করেছেন’। অতঃপর তিনি অন্যের দাবী খন্ডন করে বলেন,
وَهُوَ وَإِنْ كَانَ مُرْسَلاً فَهُوَ حُجَّةٌ عِنْدَ جَمِيْعِ الْعُلَمَاءِ عَلَى اخْتِلاَفِ مَذَاهِبِهِمْ فِى الْمُرْسَلِ لِأَنَّهُ صَحِيْحُ السَّنَدِ إِلَى الْمُرْسَلِ وَقَدْ جاَءَ مَوْصُوْلاً مِنْ طُرُقٍ كَمَا أَشَرْنَا إِلَيْهِ آنِفًا فَكاَنَ حُجَّةً عِنْدَ الْجَمِيْعِ.
‘ত্বাউস যদিও মুরসাল রাবী তবুও তিনি সকল মুহাদ্দিছের নিকট দলীলযোগ্য। কারণ তিনি মুরসাল হলেও সনদের জন্য সহিহ। তাছাড়াও এই হাদীছ মারফূ‘ হিসাবে অনেকগুলো সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। যেমনটি আমি এই মাত্রই উল্লেখ করলাম। অতএব তা সকল মুহাদ্দিছের নিকট দলীলযোগ্য।[14] এছাড়াও এই হাদীছকে আলবানী সহিহ আবুদাঊদে উল্লেখ করেছেন।[15]
(৪) عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ رضي الله عنه قَالَ صَلَّيْتُ مَعَ اَلنَّبِيِّ فَوَضَعَ يَدَهُ اَلْيُمْنَى عَلَى يَدِهِ اَلْيُسْرَى عَلَى صَدْرِهِ.
(৪) ওয়াইল ইবনু হুজর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-এর সাথে স্বলাত আদায় করেছি। তিনি তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর স্থাপন করে বুকের উপর রাখতেন।[16] উক্ত হাদীছের টীকায় শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন,
إِسْنَادُهُ ضَعِيْفٌ لِأَنَّ مُؤَمَّلاً وَهُوَ ابْنُ إِسْمَاعِيْلَ سَيِّئُ الْحِفْظِ لَكِنَّ الْحَدِيْثَ صَحِيْحٌ جَاءَ مِنْ طُرُقٍ أُخْرَى بِمَعْنَاهُ وَفِى الْوَضْعِ عَلَى الصَّدْرِ أَحَادِيْثُ تَشْهَدُ لَهُ.
‘এর সনদ যঈফ। কারণ তা ত্রুটিপূর্ণ। আর তিনি হলেন ইবনু ইসমাঈ। তার স্মৃতি শক্তি দুর্বল। তবে হাদীছ সহিহ। এই হাদীছ অন্য সূত্রে একই অর্থে বর্ণিত হয়েছে। বুকের উপর হাত রাখার আরো যে হাদীছগুলো আছে, সেগুলো এর জন্য সাক্ষ্য প্রদান করে’। ইমাম শাওকানী উক্ত হাদীছ সম্পর্কে বলেন, وَ لاَشَيْءَ فِى اْلبَابِ أَصَحُّ مِنْ حَدِيْثِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ الْمَذْكُوْرِ فِىْ صَحِيْحِ ابْنِ خُزَيْمَةَ ‘হাত বাঁধা সম্পর্কে সহিহ ইবনু খুযায়মাতে ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) বর্ণিত হাদীছের চেয়ে বিশুদ্ধ কোন হাদীছ আর নেই’।[17] তাছাড়া একই রাবী থেকে অন্যত্র সহিহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
(5) عَنْ قَبِيْصَةَ بْنِ هُلْبٍ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ رَأَيْتُ النَّبِىَّ يَنْصَرِفُ عَنْ يَمِيْنِهِ وَعَنْ يَسَارِهِ وَرَأَيْتُهُ قَالَ يَضَعُ هَذِهِ عَلَى صَدْرِهِ وَضَعَ يَحْيَى الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى فَوْقَ الْمِفْصَلِ.
(৫) ক্বাবীছাহ বিন হুলব তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তার পিতা বলেছেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে ডান ও বামে ফিরতে দেখেছি এবং হাতকে বুকের উপর রাখার কথা বলতে শুনেছি। অতঃপর ইয়াহইয়া ডান হাত বাম হাতের কব্জির উপর রাখেন।[18]
উল্লেখ্য যে, কেউ কেউ উক্ত হাদীছকে ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন। কিন্তু তাদের দাবী সঠিক নয়। কারণ রাবী ক্বাবীছার ব্যাপারে কথা থাকলেও এর পক্ষে অনেক সাক্ষী রয়েছে। ফলে তা হাসান।[19]
(6) عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ الله عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا أَنْ نُعَجِّلَ إِفْطَارَنَا وَأَنْ نُؤَخِّرَ سَحُوْرَنَا وَنَضَعَ أَيْمَانَنَا عَلَى شَمَائِلِنَا فِي الصَّلاَةِ.
(৬) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, নিশ্চয় আমরা নবীদের দল। আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- আমরা যেন দ্রুত ইফতার করি এবং দেরিতে সাহারী করি। আর স্বলাতের মধ্যে আমাদের ডান হাত বাম হাতের উপর যেন রাখি।[20]
✔ ইমাম তিরমিযী ও ইবনু কুদামার মন্তব্য এবং পর্যালোচনা :
উপরের আলোচনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) বুকের উপর হাত বেঁধে স্বলাত আদায় করতেন। কিন্তু কোন কোন মনীষী দুই ধরনের আমলের প্রতি শীথিলতা প্রদর্শন করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বাম হাতের উপর ডান হাত রাখার একটি হাদীছ বর্ণনা করার পর বলেন, وَرَأَى بَعْضُهُمْ أَنْ يَضَعَهُمَا فَوْقَ السُّرَّةِ وَرَأَى بَعْضُهُمْ أَنْ يَضَعَهُمَا تَحْتَ السُّرَّةِ وَكُلُّ ذَلِكَ وَاسِعٌ عِنْدَهُمْ ‘তাদের কেউ মনে করেন দুই হাত নাভীর উপর রাখবে। আবার কেউ মনে করেন নাভীর নীচে রাখবে। তাদের নিকটে উভয় আমলের ব্যাপারে প্রশস্ততা রয়েছে।[1] ইবনু কুদামাও অনুরূপ বলেছেন।[2]
পর্যালোচনা : উপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসূল (ﷺ) বুকের উপর হাত রেখে স্বলাত আদায় করেছেন। সুতরাং অন্য কারো আমল ও কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই। তবে ইমাম তিরমিযী (রহঃ) যেমন অন্যের ব্যক্তিগত আমলের কথা বর্ণনা করেছেন, তেমনি ইবনু কুদামাও কেবল হাম্বলী মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করেছেন। যা পাঠকের সামনে পরিষ্কার।
✔ হাত বাঁধার বিশেষ পদ্ধতি বানোয়াট :
হাত বাঁধার জন্য সমাজে যে বিশেষ পদ্ধতি চালু আছে তা কল্পিত ও উদ্ভট। যেমন- মাওলানা মুহিউদ্দীন খান লিখেছেন, ‘হাত বাঁধার নিয়ম হলো পুরুষেরা বাম হাতের তালু নাভীর নিচে রাখবে এবং ডান হাতের তালু বাম হাতের তালুর পিঠের ওপর স্থাপন করে কনিষ্ঠা আঙ্গুল এবং বৃদ্ধা আঙ্গুল দ্বারা বাম হাতের কব্জি ধরবে, অনামিকা, মধ্যমা এবং শাহাদাত আঙ্গুল লম্বাভাবে বাম হাতের কব্জির ওপরে বিছানো থাকবে’।[1] তবে মাওলানা কোন প্রমাণ পেশ করেননি। মূলতঃ উক্ত পদ্ধতি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
No comments:
Post a Comment