তাসবীহ দানা দ্বারা গণনা করা এবং ফজর, মাগরিবের পর যিকির করা
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্বলাত- এর অংশবিশেষশায়খ মুযাফফর বিন মুহসিন
সমাজে তাসবীহ দানা দিয়ে যিকির করার প্রচলন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ফরয স্বলাতের পর, হাটে-বাজারে, রাস্তায়, বাসে-ট্রেনে, অফিস-আদালতে সর্বত্র একশ্রেণীর মানুষকে তাসবীহ গণনা করতে দেখা যায়। এতে যে রিয়া সৃষ্টি হয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। অনেক মসজিদের কাতারে কাতারে রেখে দেয়া হয় কিংবা দেওয়ালে ও জালানায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাসবীহই যেন মূল ইবাদত। অথচ এর সহিহ কোন ভিত্তি নেই। উক্ত মর্মে যে সমস্ত বর্ণনা রয়েছে তার সবই জাল কিংবা যঈফ। তাসবীহ দানা দ্বারা গণনা
✔ (أ) عَنْ عَائِشَةَ بِنْتِ سَعْدِ عَنْ أَبِيهَا أَنَّهُ دَخَلَ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ عَلَى امْرَأَةٍ وَبَيْنَ يَدَيْهَا نَوًى أَوْ حَصًى تُسَبِّحُ بِهِ فَقَالَ أُخْبِرُكِ بِمَا هُوَ أَيْسَرُ عَلَيْكِ مِنْ هَذَا أَوْ أَفْضَلُ فَقَالَ سُبْحَانَ اللهِ عَدَدَ مَا خَلَقَ فِى السَّمَاءِ وَسُبْحَانَ اللهِ عَدَدَ مَا خَلَقَ فِى الأَرْضِ وَسُبْحَانَ اللهِ عَدَدَ مَا خَلَقَ بَيْنَ ذَلِكَ وَسُبْحَانَ اللهِ عَدَدَ مَا هُوَ خَالِقٌ وَاللهُ أَكْبَرُ مِثْلُ ذَلِكَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ مِثْلُ ذَلِكَ وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ مِثْلُ ذَلِكَ. وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ مِثْلُ ذَلِكَ.
(ক) আয়েশা বিনতে সা‘দ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তার পিতা রাসূল (ﷺ)-এর সাথে এক মহিলার নিকটে যান। তখন স্ত্রীলোকটির সম্মুখে কিছু খেজুরের বিচি অথবা কংকর ছিল, যার দ্বারা সে তাসবীহ গণনা করছিল। রাসূল (ﷺ) বললেন, আমি কি তোমাকে এমন কথা বলে দিব না, যা এটা অপেক্ষা অধিক সহজ বা উত্তম হবে? তা হচ্ছে- ‘সুবহা-নাল্লাহ’ অর্থাৎ, আল্লাহর পবিত্রতা যে পরিমাণ তিনি আসমানে মাখলূক সৃষ্টি করেছেন, ‘সুবহা-নাল্লাহ’ যে পরিমাণ তিনি যমীনে মাখলূক সৃষ্টি করেছেন, ‘সুবহা-নাল্লাহ’ যে পরিমাণ উভয়ের মাঝে রয়েছে এবং ‘সুবহা-নাল্লাহ’ যে পরিমাণ তিনি ভবিষ্যতে সৃষ্টি করবেন। ‘আল্লাহু আকবার’ উহার অনুরূপ, ‘আলহামদু লিল্লাহ’ উহার অনুরূপ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হু’ উহার অনুরূপ এবং লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ অনুরূপ।[1]
তাহক্বীক্ব : যঈফ। উক্ত হাদীছের সনদে খুযায়মাহ ও সাঈদ ইবনু আবী হেলাল নামে দুইজন ত্রুটিপূর্ণ রাবী আছে।[2] তাছাড়া এটি সহিহ হাদীছের বিরোধী। কারণ রাসূল (ﷺ) ডান হাতের আঙ্গুলে তাসবীহ গণনা করতেন।[3]
✔ (2) عَنْ عَلِىٍّ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ نِعْمَ الْمُذْكِرُ السُّبْحَةَ.
আলী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যে দানা দ্বারা যিকির করে সে কতইনা উত্তম! [4]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। উক্ত বর্ণনার প্রত্যেক রাবীই ত্রুটিপূর্ণ।[5] আলবানী বলেন, إِنَّ السُّبْحَةَ بِدْعَةٌ لَمْ تَكُنْ فِىْ عَهْدِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّمَا حَدَثَتْ بَعْدَهُ ‘নিশ্চয় তাসবীহ দানা বিদ‘আত। এটি রাসূল (ﷺ)-এর যুগে ছিল না। বরং তাঁর পরে সৃষ্টি হয়েছে’।[6]
✔ (3) عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ كَانَ النَّبِىُّ يُسَبِّحُ بِالْحَْصَى.
(৩) আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) কংকর দ্বারা তাসবীহ গণনা করতেন।[7]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। এর সনদে কুদামা বিন মাযঊন এবং ছালেহ ইবনু আলী নামে অভিযুক্ত রাবী আছে।[8]
ডান হাতে তাসবীহ গণনা করার হাদীছ সমূহ :
✔ (1) عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَعْقِدُ التَّسْبِيْحَ بِيَمِيْنِهِ.
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে ডান হাতে তাসবীহ গণনা করতে দেখেছি।[1]
✔ عَنْ يُسَيْرَةَ قَالَتْ قَالَ لَنَا رَسُوْلُ اللهِ عَلَيْكُنَّ بِالتَّسْبِيْحِ وَالتَّهْلِيْلِ وَالتَّقْدِيْسِ وَلاَ تَغْفُلْنَ فَتَنْسَيْنَ التَّوْحِيْدَ وَاعْقِدْنَ بِالأَنَامِلِ فَإِنَّهُنَّ مَسْئُوْلاَتٌ مُسْتَنْطَقَاتٌ.
ইউসায়রা (রাঃ) বলেন, একদা রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে বলেন, তোমরা তাসবীহ, তাহলীল এবং পবিত্রতা বর্ণনা করবে। এতে তোমরা গাফলতি কর না। কারণ তোমরা তাওয়াহ্য়ীদ ভুলে যাবে। আর তোমরা আঙ্গুলে তাসবীহ বর্ণনা করবে। সেগুলো জিজ্ঞাসিত হবে এবং কথা বলবে।[2]
অতএব ডান হাতের আঙ্গুলে তাসবীহ গণনা করতে হবে। এই আঙ্গুলই তার পক্ষে ক্বিয়ামতের দিন সাক্ষী দিবে এবং সুপারিশ করবে। কিন্তু দানা বা কংকর সাক্ষী দান করবে বলে কোন জাল হাদীছও নেই। বাজারে ‘হাযারী তাসবীহ’ নামে যে তাসবীহ প্রচলিত আছে, তাও বানোয়াট। এগুলো থেকে সকল মুসলিমকে দূরে থাকতে হবে।
বহু মসজিদে সকাল-সন্ধ্যায় বিদ‘আতী যিকিরের যে মেলা বসানো হয়, গোল হয়ে বসে মিথ্যা ও বানোয়াট কাহিনী বর্ণনা করা হয় এবং তাসবীহ দানা দ্বারা যে তাসবীহ জপা হয়, তার সাথে সুন্নাতের কোন সম্পর্ক নেই। এ সমস্ত শরী‘আত বিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ছাহাবীগণ ছিলেন খড়গহস্ত।[3]
✔ عَنِ الصَّلْتِ بْنِ بُهْرَامٍ قَالَ مَرَّ ابْنُ مَسْعُوْدٍ بِامْرَأَةٍ مَعَهَا تَسْبِيْحٌ تُسَبِّحُ بِهِ فَقَطَعَهُ وَأَلْقَاهُ ثُمَّ مَرَّ بِرَجُلٍ يُسَبِّحُ بِحَصَى فَضَرَبَهُ بِرِجْلِهِ ثُمَّ قَالَ لَقَدْ سَبَقْتُمْ! رَكِبْتُمْ بِدْعَةً ظُلْمًا! وَلَقَدْ غَلَبْتُمْ أَصْحَابَ مُحَمَّدٍ عِلْمًا!
ছালত ইবনু বুহরাম (রাঃ) বলেন, ‘ইবনু মাসঊদ (রাঃ) এক মহিলার নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কাছে দানা ছিল, যার দ্বারা ঐ মহিলা তাসবীহ গণনা করছিল। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) সেগুলো কেড়ে নিলেন এবং দূরে ফেলে দিলেন। অতঃপর একজন লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলেন সে পাথর কংকর দ্বারা তাসবীহ গণনা করছিল। ইবনু মাসঊদ তাকে নিজের পা দ্বারা লাথি মারলেন। তারপর বললেন, তোমরা অগ্রগামী হয়েছ! আর অন্ধ বিদ‘আতের উপর আরোহন করেছ! তোমরাই কি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর ছাহাবী হিসাবে ইলমের দিক থেকে বিজয়ী হয়েছ![4]
আলবানী বলেন, ‘শারঈ যিকির গণনা এটাই সুন্নাত, যা কেবল ডান হাত দিয়ে গুণতে হয়। আর বাম হাত বা দুই হাতে এক সঙ্গে কিংবা কংকর দ্বারা গণনা করা সবই সুন্নাত বিরোধী। কংকর দ্বারা ও দানা দ্বারা তাসবীহ গণনা করা বিশুদ্ধভাবে সাব্যস্ত হয়নি’।[5]
✔ (২৭) ফজর স্বলাতের পর ১৯ বার ‘বিসমিল্লাহ’ বলা :
উক্ত মর্মে সহিহ বা যঈফ সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোন হাদীছ পাওয়া যায় না। তবে ‘বিসমিল্লা-হ’-এর ফযীলত বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে একটি বক্তব্য এসেছে- ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছা পোষণ করে যে, আযাবের ১৯ জন ফেরেশতা হতে আল্লাহ তাকে পরিত্রাণ দেবেন, সে যেন ‘বিসমিল্লা-হির রহমান-নির রহীম’ পড়ে’। কারণ ‘বিসমিল্লা-হ’-তে ১৯টি বর্ণ রয়েছে। আর প্রতিটি বর্ণ তার জন্য ঢাল স্বরূপ এবং উক্ত বর্ণ তাকে আযাবের ১৯ জন ফেরেশতা হতে বাঁচাবে’। কিন্তু উক্ত বর্ণনার সহিহ কোন ভিত্তি নেই। ইবনু আত্বিয়াহ বলেন, هَذَا مِنْ مُلَحِ التَّفْسِيْرِ ‘এগুলো চটকদার তাফসীরের অন্তর্ভুক্ত’।[1]
[1]. তাফসীরে কুরতুবী ১/৯২ পৃঃ, ‘বিসমিল্লাহ’ অনুচ্ছেদ।
✔ (২৮) ফজর ও মাগরিবের পর যিকির করা :
অনেক মসজিদে একশ্রেণীর মানুষ ফজর ও মাগরিবের স্বলাতের পর গোল হয়ে বসে যিকির করে থাকে। উক্ত যিকিরের শব্দগুলোও বানোয়াট। উচ্চৈঃস্বরে যিকিরের কারণে এটা রিয়াতে পরিণত হয়েছে। ভাবখানা দেখে মনে হয় যে, তারা চিৎকার করে আল্লাহকে আসমান থেকে টেনে নামাবে। এ ধরনের যিকির সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ডাকবে বিনীতভাবে ও অতি সংগোপনে। তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পসন্দ করেন না’ (আ‘রাফ ৫৫)। অন্য আয়াতে বলেন, ‘আপনি আপনার প্রতিপালককে মনে মনে বিনয় ও ভয়-ভীতি সহকারে নীরবে সকাল-সন্ধ্যায় স্মরণ করুন’ (আ‘রাফ ২০৫)। রাসূল (ﷺ) সরবে যিকির করতে নিষেধ করেছেন।[1] উক্ত যিকিরপন্থীরা শেষে লম্বা মুনাজাত করে বিদায় নেয়। এটাও একটি বিদ‘আতী আমল। শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) এ ধরনের লোকদেরকেই ধমক দিয়েছিলেন।[2]
No comments:
Post a Comment