লাত অবস্থায় এদিক সেদিক লক্ষ্য করা
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্বলাত- এর অংশবিশেষশায়খ মুযাফফর বিন মুহসিন
অনেক মুছল্লী তার স্বলাতে স্থির থাকে না। অমনোযোগী হয়ে এদিক সেদিক তাকানোর বদ অভ্যাস আছে। এটা মূলতঃ শয়তানের প্রলোভন।[1] ফলে স্বলাতে একাগ্রতা থাকে না। আল্লাহ তা‘আলা এ ধরনের মুছল্লীর প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন না। স্বলাত অবস্থায় এদিক
عَنْ أَبِىْ ذَرٍّ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ لَا يَزَالُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ مُقْبِلًا عَلَى الْعَبْدِ وَهُوَ فِىْ صَلَاتِهِ مَا لَمْ يَلْتَفِتْ فَإِذَا الْتَفَتَ انْصَرَفَ عَنْهُ.
আবু যার (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, বান্দা স্বলাতে থাকা অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা তার দিকে সর্বদা তাকিয়ে থাকেন, যতক্ষণ সে এদিক সেদিক না তাকায়। যখন অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরায়, আল্লাহ তাঁর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন।[2]
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ أَمَرَنِىْ رَسُوْلُ اللهِ بِثَلاَثٍ وَنَهَانِى عَنْ ثَلاَثٍ وَنَهَانِى عَنْ نَقْرَةٍ كَنَقْرَةِ الدِّيْكِ وَإِقْعَاءٍ كَإِقْعَاءِ الْكَلْبِ وَالْتِفَاتٍ كَالْتِفَاتِ الثَّعْلَبِ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) আমাকে তিনটি বিষয়ে নির্দেশ দান করেছেন এবং তিনটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। আমাকে মোরগের মত ঠোকরাতে, কুকুরের মত বসতে এবং শিয়ালের মত এদিক সেদিক তাকাতে নিষেধ করেছেন।[3] অতএব স্বলাতের মধ্যে সর্বদা সিজদার স্থানে বা তার কাছাকাছি দৃষ্টি রাখবে।[4]
✔ (১০) রুকূ থেকে উঠার পর পুনরায় হাত বাঁধা : রুকূ হতে উঠার পর অনেকে হাত কিছুক্ষণ খাড়াভাবে ধরে রাখে। উক্ত আমলের পক্ষে কোন দলীল নেই। কেউ আবার পুনরায় বুকে হাত বাঁধে। শায়খ বিন বায এবং মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) উক্ত মর্মে ফৎওয়া প্রদান করেছেন। তবে তারা শাব্দিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন।[1] কারণ উক্ত আমলের পক্ষে শাব্দিক ব্যাখ্যা ছাড়া স্পষ্ট কোন দলীল নেই। উক্ত দাবীর মূল দলীলগুলো নিম্নরূপ :
✔ (أ) عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ كَانَ النَّاسُ يُؤْمَرُوْنَ أَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ الْيَدَ الْيُمْنَى عَلَى ذِرَاعِهِ الْيُسْرَى فِي الصَّلَاةِ قَالَ أَبُوْ حَازِمٍ لَا أَعْلَمُهُ إِلَّا يَنْمِىْ ذَلِكَ إِلَى النَّبِيِّ .
(ক) সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন, লোকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হত, মুছল্লী যেন ‘স্বলাতের মধ্যে তার ডান হাত বাম হাতের বাহুর উপর রাখে’। আবু হাযেম বলেন, এটা রাসূল (ﷺ)-এর দিকেই ইঙ্গিত করা হত বলে আমি জানি।[2] ইমাম বুখারী (রহঃ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন,بَابُ وَضْعِ الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى ‘ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা অনুচ্ছেদ’।[3]
(ب) عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ وَائِلٍ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ إِذَا كَانَ قَائِمًا فِى الصَّلاَةِ قَبَضَ بِيَمِيْنِهِ عَلَى شِمَالِهِ.
(খ) আলক্বামা ইবনু ওয়ায়েল থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে দেখেছি, যখন তিনি স্বলাতের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় থাকতেন, তখন ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরে রাখতেন’।[4] ইমাম নাসাঈ অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَابُ وَضْعِ الْيَمِيْنِ عَلَى الشِّمَالِ فِى الصَّلاَةِ ‘স্বলাতের মধ্যে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা অনুচ্ছেদ’।
(ج) عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَ رَأَيْتُ النَّبِىَّ حِيْنَ كَبَّرَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ حِذَاءَ أُذُنَيْهِ ثُمَّ حِيْنَ رَكَعَ ثُمَّ حِيْنَ قَالَ سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ رَفَعَ يَدَيْهِ وَرَأَيْتُهُ مُمْسِكاً يَمِيْنَهُ عَلَى شِمَالِهِ فِى الصَّلاَةِ فَلَمَّا جَلَسَ حَلَّقَ بِالْوُسْطَى وَالإِبْهَامِ وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَوَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى فَخِذِهِ الْيُمْنَى وَوَضَعَ يَدَهُ الْيُسْرَى عَلَى فَخِذِهِ الْيُسْرَى.
(গ) ওয়ায়েল ইবনু হুজর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ﷺ)-কে দেখেছি, যখন তিনি তাকবীর দিতেন তখন কান বরাবর দুই হাত উত্তোলন করতেন। যখন রুকূ করতেন এবং ‘সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলতেন, তখন দুই হাত উত্তোলন করতেন। আর আমি তাঁকে স্বলাতের মধ্যে ডান দিয়ে বাম হাত ধরা অবস্থায় দেখেছি। আর যখন তিনি বসতেন তখন মধ্যমা ও বৃদ্ধা আঙ্গুল দ্বারা মোট পাকাতেন এবং শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন। তিনি ডান হাত ডান উরুর উপর এবং বাম হাত বাম উরুর উপর রাখতেন।[5]
পর্যালোচনা : মৌলিক দলীল হিসাবে উক্ত তিনটি হাদীছ পেশ করা হয়। বিশেষ করে মুসনাদে আহমাদের হাদীছটি। যদিও এ ধরনের হাদীছ আরো আছে। ‘স্বলাতের মধ্যে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা’ অংশটুকু দ্বারা রুকূর আগে এবং পরে দাঁড়ানো অবস্থায় হাত বাঁধার জন্য ব্যাপক ভিত্তিক অর্থ নেয়া হয়। অথচ এর উদ্দেশ্য যে তাকবীরে তাহরীমা বলার পর হাত বাঁধা তা স্পষ্ট।
(ক) ইমাম বুখারী (রহঃ) সহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ স্বলাতের ধারাবাহিক বর্ণনায় এভাবেই উল্লেখ করেছেন। এই হাদীছগুলো দ্বারা রুকূর পরের অবস্থা বুঝানোর জন্য কেউ পেশ করেননি। তাছাড়া রুকূর আগে এবং পরে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা এটাও কেউ বলেননি। বরং স্বলাতের শুরুতে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর বাঁধার কথা উল্লেখ করেছেন।
(খ) মুসনাদে আহমাদের হাদীছটি জোরালভাবে পেশ করার মধ্যে কোন উপকারিতা নেই। কারণ বর্ণনার ধারাটা কেবল আগে পরে হয়েছে। সরাসরি ধারাবাহিক অর্থ নিলে দেখা যাবে, তিনি রুকূর আগে হাত বাঁধেননি, রুকূর পরে বেঁধেছেন। অনুরূপ আগে আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করেছেন, পরে উরুর উপর হাত রেখেছেন। এ ধরনের অর্থ নিলে সবই উল্টা হয়ে যাবে। সুতরাং উক্ত হাদীছ দিয়ে দলীল পেশ করার কোন সুযোগ নেই।
(গ) দাঁড়ানো অবস্থায় যদি ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা শর্ত হয় তবে রুকূর পর কুনূতে নাযেলার সময় কী করণীয়? কারণ তখন তো দুই হাত মুখ বরাবর তুলে দু‘আ করতে হয়।[6] অনুরূপ রুকূর আগেও কুনূতে বিতর পড়ার সময় হাত তুলার প্রমাণ আছে।[7] তাই হাত বেঁধেই রাখতে হবে এমনটি নয়। নির্দিষ্ট হাদীছ আসলে সেভাবেই আমল করতে হবে। মূলতঃ উক্ত হাদীছগুলো রুকূর আগে বুকে হাত বাঁধার হাদীছ। রুকূর পর হাত ছেড়ে দিতে হবে। কারণ স্বলাতের প্রত্যেক আহকামের ব্যাপারে একাধিক দলীল মওজুদ থাকলেও রুকূর পর পুনরায় হাত বাঁধার ব্যাপারে স্পষ্ট কোন দলীল নেই। যদিও রুকূর পর রাসূল (ﷺ) কান বা কাঁধ বরাবর হাত উঠাতেন মর্মে শত শত স্পষ্ট হাদীছ রয়েছে। কিন্তু পুনরায় হাত বাঁধার বিষয়টি কোন হাদীছে বর্ণিত হয়নি। বরং হাত ছেড়ে দেওয়ার পক্ষেই হাদীছের দলীল শক্তিশালী। আবু হুমায়েদ সায়েদী (রাঃ) ১০ জন ছাহাবীর সামনে রাসূল (ﷺ)-এর স্বলাতের বাস্তব নমুনা যে হাদীছে প্রদর্শন করেছিলেন এবং সত্যায়ন প্রাপ্ত হয়েছিলেন, সে হাদীছে বলা হয়েছে- فَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ اسْتَوَى حَتَّى يَعُوْدَ كُلُّ فَقَارٍ مَكَانَهُ.
‘তিনি রুকূ থেকে মাথা উঠিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন এমনভাবে যে, মেরুদন্ডের জোড় সমূহ স্ব স্ব স্থানে ফিরে আসে’।[8] অনুরূপভাবে স্বলাতে ভুলকারী ব্যক্তিকে রাসূল (ﷺ) যা শিক্ষা দিয়েছিলে সেখানে এসেছে, حَتَّى تَرْجِعَ الْعِظَامُ إِلَى مَفَاصِلِهَا ‘যতক্ষণ না হাড় সমূহ স্ব স্ব জোড়ে ফিরে আসে’।[9]
উক্ত হাদীছ দু’টিতে নির্দিষ্ট করে রুকূর পরের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। শরীরের হাড়ের জোড় সমূহ স্ব স্ব স্থানে ফিরে গেলে রুকূর পর দাঁড়ানো অবস্থায় হাতকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দিতে হবে। অন্যথা হাতের অস্থির জোড় স্ব স্ব স্থানে ফিরে যাবে না। আর পুনরায় হাত বাঁধাটা হাতের স্বাভাবিক অবস্থা নয়।
(ঘ) উক্ত আম হাদীছ দ্বারা পূর্বের কেউ রুকূ থেকে উঠার পর হাত বাঁধার দলীল পেশ করেননি। যদিও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর ছেলে ছালেহ তার পিতার পক্ষ থেকে বলেছেন, ‘মুছল্লী চাইলে রুকূ থেকে উঠার পরে তার দুই হাত ছেড়েও দিতে পারে বাঁধতেও পারে’।[10] যদিও এটা তার ব্যক্তিগত মত। এরপরও তাতে কোন দলীল নেই। কারণ রুকূর আগেও এমনটি করা প্রমাণিত হবে, যা সুন্নাত বিরোধী। মূলকথা পূর্ববর্তী মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামের কাছে এটি পরিচিত নয়। এ জন্য শায়খ আলবানী ‘ভ্রষ্ট বিদ‘আত’ বলেছেন।[11] অতএব কেবল শাব্দিক ব্যাখ্যা নয়, স্পষ্ট দলীলের দিকে ফিরে যাওয়া উচিত।
✔ (১১) সিজদায় যাওয়ার সময় আগে মাটিতে হাঁটু রাখা ও হাঁটুর উপর ভর দিয়ে উঠা :
সিজদায় যাওয়ার সময় আগে মাটিতে হাত রাখাই সুন্নাত। আগে হাঁটু রাখার পক্ষে যে কয়টি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা যঈফ।
✔ (أ) عَنْ وَائِلٍ بْنِ حُجْرٍ قَالَ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ إِذَا سَجَدَ وَضَعَ رُكْبَتَيْهِ قَبْلَ يَدَيْهِ وَإِذَا نَهَضَ رَفَعَ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ.
(ক) ওয়াইল ইবনু হুজর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন সিজদা করতেন, তখন তাকে দেখেছি তিনি দুই হাত রাখার আগে দুই হাঁটু রাখতেন এবং যখন তিনি উঠতেন, তখন হাঁটুর আগে দুই হাত উঠাতেন।[1]
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ। ইমাম তিরমিযী বলেন, উক্ত হাদীছের সনদে শারীক নামক এক ব্যক্তি রয়েছে, সে দুর্বল রাবী। সে এককভাবে এটি বর্ণনা করেছে। ইমাম দারাকুৎনী বলেন, ‘শারীক নামক রাবী এককভাবে এই হাদীছ বর্ণনা করেছে, যা নির্ভরযোগ্য নয়’।[2] শায়খ আলবানীও যঈফ বলেছেন।[3]
✔ (ب) عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ قَالَ إِذَا سَجَدَ أَحَدُكُمْ فَلْيَبْدَأْ بِرُكْبَتَيْهِ قَبْلَ يَدَيْهِ وَلاَ يَبْرُكْ بُرُوْكَ الْجَمَلِ.
(খ) আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, যখন তোমাদের কেউ সিজদা দিবে তখন সে যেন দুই হাত দেওয়ার পূর্বে দুই হাঁটু দিয়ে শুরু করে। উট যেভাবে বসে সেভাবে যেন না বসে।[4]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। এর সনদে আব্দুল্লাহ ইবনু সাঈদ নামে এক ব্যক্তি রয়েছে, সে অত্যন্ত দুর্বল। ইবনু সাঈদ বলেন, ইবনু ফাল্লাস বলেন, সে সহিহ হাদীছের বিরোধী হাদীছ বর্ণনাকারী, পরিত্যক্ত রাবী। ইমাম দারাকুৎনী বলেন, সে পরিত্যক্ত, হাদীছ জালকারী।[5]
✔ (ج) عَنْ سَعَدِ بْنِ أَبِىْ وَقَّاصٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنَّا نَضَعُ الْيَدَيْنِ قَبْلَ الرُّكْبَتَيْنِ فَأُمِرْنَا بِالرُّكْبَتَيْنِ قَبْلَ الْيَدَيْنِ.
(গ) সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেন, আমরা দুই হাঁটুর পূর্বে দুই হাত রাখতাম। অতঃপর আমাদেরকে দুই হাতের পূর্বে দুই হাঁটু রাখার নির্দেশ দেওয়া হল।[6]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। এর সনদে ইবরাহীম এবং তার পিতা ইসমাঈল রয়েছে। তারা নিতান্তই যঈফ রাবী। ইবনু হাজার আসক্বালানী তাদেরকে পরিত্যক্ত রাবী বলেছেন।[7]
✔ (د) قَالَ إِبْرَاهِيْمُ النّخْعِىْ حَفِظَ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّهُ كَانَتْ رُكْبَتَاهُ تَقَعُ إِلَى الْأَرْضِ قَبْلَ يَدَيْهِ.
(ঘ) ইবরাহীম নাখঈ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি মাটিতে দুই হাত রাখার আগে দুই হাঁটু রাখতেন।[8]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। এর সনদে হাজ্জাজ বিন আরত্বাহ নামে একজন যঈফ রাবী আছে।[9]
(ه) عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ يَضَعُ رُكْبَتَيْهِ إِذَا سَجَدَ قَبْلَ يَدَيْهِ وَرَفَعَ يَدَيْهِ إِذِا رَفَعَ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ.
✔ (ঙ) ইবনু ওমর (রাঃ) যখন সিজদা করতেন, তখন দুই হাত রাখার আগে দুই হাঁটু রাখতেন এবং যখন তিনি দাঁড়াতেন, তখন দুই হাঁটুর পূর্বে দুই হাত উঠাতেন।[10]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি দুর্বল। এর সনদে ইবনু আবী লায়লা নামে রাবী আছে। সে যঈফ। স্মৃতি শক্তি দুর্বল।[11] তাছাড়া সহিহ হাদীছের বিরোধী। যেমন-
عَنِ بْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّهُ كَانَ إِذَا سَجَدَ بَدَأَ بِوَضْعِ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ وَكاَنَ يَقُوْلُ كَانَ النَّبِىُّ يَصْنَعُ ذَلِكَ.
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন সিজদা করতেন, তখন দুই হাঁটু রাখার পূর্বে আগে দুই হাত রাখতেন। আর তিনি বলতেন, নবী (ﷺ) এমনটি করতেন।[12] ইমাম হাকেম, যাহাবী, মারূযী, আলবানী, প্রমুখ মুহাদ্দিছ উক্ত হাদীছকে সহিহ বলেছেন।[13]
✔ আগে হাত রাখার সহিহ হাদীছ সমূহ :
✔ সুন্নাত হল সিজদায় যাওয়ার সময় আগে মাটিতে হাত রাখা। উক্ত মর্মে অনেক সহিহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِذَا سَجَدَ أَحَدُكُمْ فَلاَ يَبْرُكْ كَمَا يَبْرُكُ الْبَعِيْرُ وَلْيَضَعْ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন সিজদা করবে, তখন যেন উটের শয়নের মত না করে। সে যেন দুই হাঁটুর আগে দুই হাত রাখে’।[1]
উক্ত হাদীছ সম্পর্কে আব্দুল হক আল-আশবীলী বলেন, পূর্বের হাদীছের চেয়ে এই হাদীছের সনদ অধিক উত্তম।[2] অন্যত্র তিনি এই হাদীছকে সহিহ বলেছেন।[3] শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এর সনদ সহিহ।[4] ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, وَ هُوَ أَقْوَى مِنْ حَدِيْثِ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ ‘এই হাদীছ ওয়ায়েল ইবনু হুজুরের হাদীছের চেয়ে অধিক শক্তিশালী’। অতঃপর তিনি বলেন, فَإِنَّ لِلْأَوَّلِ شَاهِدًا مِنْ حَدِيْثِ ابْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ صَحَّحَهُ اِبْنُ خُزَيْمَةَ وَذَكَرَهُ اَلْبُخَارِيُّ مُعَلَّقًا مَوْقُوفًا ‘প্রথম হাদীছের জন্য ইবনু ওমর (রাঃ)-এর হাদীছটি সাক্ষী, যাকে ইবনু খুযায়মাহ সহিহ বলেছেন এবং ইমাম বুখারী (রহঃ) তা‘লীকসূত্রে মওকূফ হিসাবে বর্ণনা করেছেন’।[5]
উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদীছ সম্পর্কে আবু সুলাইমান আল-খত্বীব বলেন, এই হাদীছের চেয়ে ওয়ায়েল বিন হুজরের হাদীছ অধিক প্রামাণ্য। মানসূখও বলা হয়।[6] এর জবাবে শায়খ আলবানী বলেন,
هَذَا أَبْعَدُ مَا يَكُوْنُ عَنِ الصَّوَابِ مِنْ وَجْهَيْنِ الْأَوَّلُ أَنَّ هَذَا إِسْنَادَهُ صَحِيْحٌ وَحَدِيْثُ وَائِلٍ ضَعِيْفٌ كَمَا عَلَّقْتُ الثَّانِىْ أَنَّ هَذَا قَوْلٌ وَذَاكَ فِعْلٌ وَالْقَوْلُ مُقَدَّمٌ عَلَى الْفِعْلِ عِنْدَ التَّعَارُضِ وَوَجْهٌ ثَالِثٌ وَهُوَ أَنَّ لَهُ شَاهِدًا مِنْ فِعْلِهِ .
‘দুই দিক থেকে উক্ত কথা সত্য থেকে বহু দূরে। প্রথমতঃ এই হাদীছের সনদ সহিহ আর ওয়ায়েলের হাদীছ যঈফ। দ্বিতীয়তঃ এটা রাসূলের কথা আর ঐটা কাজ। আর বিরোধের সময় কাজের উপর কথা প্রাধান্য পায়। তৃতীয়তঃ রাসূল (ﷺ)-এর কাজও তার সাক্ষী হিসাবে বর্ণিত হয়েছে’।[7]
অনুরূপভাবে আগ হাঁটু রাখার পক্ষে যাদুল মা‘আদের মধ্যে হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) যে সমস্ত বর্ণনা পেশ করেছেন, তার ভাষ্যকার শু‘আয়েব আরনাঊত্ব ও আব্দুল কাদের আরনাঊত্ব সেগুলোর পর্যালোচনা করে মন্তব্য করেন যে, লেখকের সকল দলীল তাঁর বিপক্ষে গেছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত আগে হাত রাখার হাদীছ নিঃসন্দেহে সহিহ এবং ওয়ায়েল বিন হুজর (রাঃ) বর্ণিত আগে হাঁটু রাখার হাদীছ যঈফ।[8]
✔ হাঁটুর ব্যাখ্যা : অনেকে উক্ত হাদীছের প্রথম অংশকে দ্বিতীয় অংশের বিরোধী মনে করেছেন। কারণ উটের বসা গরু-ছাগলের বসার মতই। চতুষ্পদ জন্তুর সামনের দু’টিকে হাত ও পেছনের দু’টিকে পা বলা হয়। উট বসার সময় প্রথমে হাত বসায়। অথচ হাদীছের প্রথম অংশে উটের মত বসতে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ রুকূ থেকে সিজদায় যাওয়ার সময় প্রথমে হাত রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু হাদীছের শেষ অংশে প্রথমে হাত রাখতে বলা হয়েছে। তাই হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) সহ অনেকে প্রথমে হাঁটু রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
কিন্তু উক্ত যুক্তি সঠিক নয়। কারণ চতুষ্পদ জন্তুর হাতেই হাঁটু। যার প্রমাণে সহিহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আবুবকর (রাঃ) হিজরতের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে মদীনার দিকে রওয়ানা হন, তখন কুরাইশ নেতারা রাসূল (ﷺ)-কে হত্যা করতে পারলে একশত উট দেওয়ার পুরস্কার ঘোষণা দেয়। এই পুরস্কারের লোভে সুরাকাহ বিন জু‘শুম ঘোড়া ছুটিয়ে যখন রাসূল (ﷺ)-এর নিকটবর্তী হল, তখন সে বলে যে, سَاخَتْ يَدَا فَرَسِىْ فِي الأَرْضِ حَتَّى بَلَغَتَا الرُّكْبَتَيْنِ ‘আমার ঘোড়ার হাত দু’টি হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে দেবে গেল’।[9]
ইমাম ত্বাহাবী বলেন, إَِنَّ الْبَعِيْرَ رُكْبَتَاهُ فِىْ يَدَيْهِ وَكَذَلِكَ فِىْ سَائِرِ الْبَهَائِمِ وَبَنُو آدَمَ لَيْسُوْا كَذَلِكَ ‘নিশ্চয় উটের দুই হাঁটু হল দুই হাতে। অনুরূপ প্রত্যেক চতুষ্পদ জন্তুরই তাই। আদম সন্তান তাদের মত নয়।[10] জাহেয বলেন, চতুষ্পদ জন্তুর হাঁটু হল হাতে এবং মানুষের হাঁটু হল পায়ে।[11]
অতএব উট ও অন্যান্য চতুষ্পদ জন্তুর হাতেই হাঁটু। তাই রাসূল (ﷺ) সিজদায় যাওয়ার সময় উটের মত প্রথমে হাঁটু না দিয়ে হাত রাখার নির্দেশ দান করেছেন। তাছাড়া নিম্নের হাদীছ দ্বারাও আগে হাত রাখার আমল স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় :
عَنِ بْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا أَنَّهُ كَانَ إِذَا سَجَدَ بَدَأَ بِوَضْعِ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ وَكاَنَ يَقُوْلُ كَانَ النَّبِىُّ يَصْنَعُ ذَلِكَ.
ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন সিজদা করতেন, তখন দুই হাঁটু রাখার পূর্বে আগে দুই হাত রাখতেন। আর তিনি বলতেন, নবী (ﷺ) এমনটি করতেন।[12] অতএব উটের হাঁটুর ব্যাখ্যা না করলেও চলে। দলীলের সামনে আত্মসমর্পণ করলেই মতানৈক্য দূরিভূত হয়।
উল্লেখ্য যে, অনেকে আগে হাঁটু রাখার আমলের পক্ষেই অবস্থান নেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সিজদায় যাওয়ার সময় আগে হাত রাখেন এবং উঠার সময় হাতের উপর ভর দিয়ে উঠেন। ইমাম আওযাঈ বলেন, আমি লোকদেরকে পেয়েছি এই অবস্থায় যে, তারা তাদের হাতকে হাঁটুর পূর্বে রাখত।[13] ইবনু হাযম আগে হাত রাখাকে ফরয ও অপরিহার্য বলেছেন।[14]
No comments:
Post a Comment