সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিকুলের প্রতিপালনকারী। ছালাত ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর, যিনি নবী ও রাসূলকুলের শ্রেষ্ঠ। সেই সঙ্গে ছালাত ও সালাম তাঁর পরিবার ও ছাহাবীগণের উপর।
দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কাজে মঙ্গল লাভ ও অমঙ্গল প্রতিহত করতে আন্তরিকভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করাকে তাওয়াক্কুল বলে’।
আল্লাহর উপর ভরসা মানব জীবনে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্তর। এর প্রভাব-প্রতিপত্তিও সুদূরপ্রসারী। ঈমানের যেসব বিষয় ফরয বা আবশ্যকীয়, এটি তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দয়াময় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে যে সকল আমল ও ইবাদত রয়েছে তন্মধ্যে এটি উত্তম। আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতিদানে তাওয়াক্কুলের মত উঁচু স্তর দ্বিতীয়টি মেলে না। কেননা যাবতীয় কাজ আল্লাহর উপর ভরসা ও তাঁর সাহায্য ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়।
তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা মুমিনের অন্যতম গুণও বটে। এ মর্মে আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ- ‘মুমিনতো তারাই যাদের হৃদয় কম্পিত হয়, যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং তাঁর আয়াত তাদের নিকট তেলাওয়াত করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপরেই নির্ভর করে’ (আনফাল ২)। তিনি আরো বলেন, الَّذِينَ آمَنُوْا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ ‘যারা ঈমান আনে ও তাদের প্রতিপালকেরই উপর নির্ভর করে’ (নাহল ৯৯; শূরা ৩৬)।
অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেন, الَّذِيْنَ صَبَرُوْا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ ‘যারা ধৈর্য ধারণ করে এবং তাদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’ (নাহল ৪২; আনকাবূত ৫৯)। অন্য আয়াতে তিনি আরো বলেন, وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ- ‘মুমিনদের জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিৎ’ (ইবরাহীম ১১)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ- ‘যখন তুমি কোন কাজের সিদ্ধান্ত কর, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর’ (আলে ইমরান ১৫৯)। তিনি আরো বলেন, وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ- ‘যে আল্লাহর উপর ভরসা করে আললাহই তার জন্য যথেষ্ট’ (তালাক্ব ৩)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَمَا تَوْفِيقِي إِلَّا بِاللهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ ‘আল্লাহ ছাড়া আমার কোন ক্ষমতা নেই। আমি তার উপর ভরসা রাখি, আমি তার নিকট ফিরে যাব (হূদ ৮৮)।
উপরোক্ত আয়াত সমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহর উপর নির্ভর করা। ইবাদত-বন্দেগী, তাসবীহ-তাহলীল, যিকর-আযকার ইত্যাদির পাশাপাশি ধৈর্য ধারণ করে হালাল-হারাম বেছে চলা আবশ্যক। সেই সাথে পাপকাজ থেকে বেঁচে থেকে তাক্বওয়া ও তাওয়াক্কুল অবলম্বন করতে হবে। অন্তরে আল্লাহভীতি না থাকলে মানুষ যে কোন পাপে লিপ্ত হতে পারে। অপরপক্ষে তাওয়াক্কুল মানুষকে অন্যায় পন্থায় অর্থ উপার্জনের প্রচেষ্টা থেকে বিরত রাখে এবং মানুষকে অনেক বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে।
আবু বকর ছিদ্দীক (রাঃ)-কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا ‘আপনি চিন্তা করবেন না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে রয়েছেন’ (তওবা ৪০)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, فَلَمَّا تَرَاءَى الْجَمْعَانِ قَالَ أَصْحَابُ مُوسَى إِنَّا لَمُدْرَكُونَ، قَالَ كَلَّا إِنَّ مَعِيَ رَبِّي سَيَهْدِينِ، فَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى أَنِ اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْبَحْرَ فَانْفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرْقٍ كَالطَّوْدِ الْعَظِيمِ ‘তারপর উভয় দল যখন মুখোমুখী হল, তখন মূসার সাথীরা চিৎকার করে বলে উঠল, আমরাতো বন্দী হয়ে গেলাম। মূসা (আঃ) বললেন, কখনো নয়, নিশ্চয়ই আমার সাথে রয়েছেন, আমার প্রতিপালক। তিনি আমাকে পথ দেখাবেন। তখন আল্লাহ বলেন, আমি মূসাকে অহি-র মাধ্যমে বললাম, সাগরের উপর আপনার লাঠি মারুন। সহসা সাগর বিদীর্ণ হল এবং তার প্রতি অংশ এক একটি বিরাট পাহাড়ের আকার ধারণ করল’ (শু‘আরা ৬১-৬৩)। এ আয়াতে বাহ্যিকভাবে তাঁদের বাঁচার কোন পথ ছিল না। কারণ ডানে-বামে পিছনে শত্রুদল। আর সামনে সাগর। এরপরেও মূসা (আঃ) আল্লাহর উপর দৃঢ় ভরসা রেখে বলছেন, কখনো নয়, অসম্ভব হতেই পারে না। ফেরাউন আমাকে ধরতে পারবে না। কারণ নিশ্চয়ই আমার সাথে আমার প্রতিপালক রয়েছেন। তিনি আমাকে বাঁচার পথ দেখাবেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে,رَبِّ ابْنِ لِي عِنْدَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ ‘ফেরাউনের স্ত্রী (আছীয়া) বলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার জন্য তোমার জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ কর এবং আমাকে ফেরাউন ও তার কর্ম হতে রক্ষা কর। আর অত্যাচারী লোকদের কবল হতে আমাকে বাঁচাও’ (তাহরীম ১১)।
আল্লাহর উপর তার ভরসা কেমন ছিল এবং তার ঈমানী দৃঢ়তা কতটা মযবুত ছিল, তা এ ঘটনা থেকে সহজেই অনুমেয়। তিনি পৃথিবীতে থেকেই জান্নাতে তার জন্য একটি ঘর নির্মাণের জন্য আল্লাহর নিকট জোরাল দাবী জানান।
জিবরাঈল (আঃ) যখন মানুষের রূপ ধরে মারিয়ামের কাছে প্রবেশ করলেন, তখন মারিয়াম বললেন, قَالَتْ إِنِّي أَعُوذُ بِالرَّحْمَنِ مِنْكَ إِنْ كُنْتَ تَقِيًّا নিশ্চয়ই আমি রহমানের নিকট তোমার থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। যদি তুমি পরহেজগার হও’ (মারিয়াম ১৮)। এ আয়াতটি মারিয়ামের আল্লাহর উপর ভরসার প্রমাণ বহন করে। তিনি নিজেকে রহমানের সাহায্যে বাঁচাতে চাইলেন।
No comments:
Post a Comment