Tuesday, December 2, 2025

দুধ দিয়ে গোসল নিছক কুসংস্কার পূর্ণ কাজ এবং অপচয়ের শামিল

 আমাদের দেশে কেউ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে, কেউ রোগ থেকে মুক্ত হয়ে আর কেউ ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে দুধ দিয়ে গোসল করে করে। কেউ নতুন বিয়ে করে দুধ দিয়ে গোসল করে, আবার কেউ বউ তালাকের পরে দুধ দিয়ে গোসল করে। কেউ নির্বাচনে জয়লাভ করে আবার কেউ বা কেউ রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিয়ে দুধ দিয়ে গোসল করে!! এরকম নানা ধরণের সংবাদ আমরা প্রায়শই দেখি। এসব খবরে নেট দুনিয়া সয়লাব। কিন্তু এসব কারণে-অকারণে দুধ দিয়ে গোসল করার আদৌ কি কোনও ভিত্তি আছে নাকি এটা শুধুই আবেগ? প্রকৃতপক্ষে দুধ দিয়ে গোসল করার রীতি হিন্দুদের থেকে এসেছে। কিন্তু দুঃখ জনক বিষয় হল, দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে এবং বিধর্মীদের অন্ধ অনুকরণে ফলে এই জঘন্য প্রথা মুসলিমদের মধ্যেও প্রবেশ করেছে এবং অনেক নামধারী মুসলিম দেখাদেখি এই প্রথা পালন করে চলেছে।

❑ দুধ দিয়ে গোসল করার প্রথা কোথা থেকে এলো?
ভারতীয় উপমহাদেশে দুধকে পবিত্র উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। বৈদিক যুগ থেকেই এটি নানা আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হিন্দু ধর্মের মন্দির চর্চায় দেবমূর্তি বা প্রতীককে পবিত্র তরল (দুধ, পানি, ঘি, মধু ইত্যাদি) দিয়ে স্নান করানো বা ‘অভিষেক’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় রীতি। বিশেষত শিবলিঙ্গে দুধ ঢালা পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে করা হয়। দুধকে ‘সত্ত্ব’ গুণ বা শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। জন্মাষ্টমী, মহা শিবরাত্রি, উপনয়ন, বিবাহ বা রাজ্যাভিষেকের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে দুধ দিয়ে স্নান করানো হতো। এটি পাপমোচন, আত্মশুদ্ধি এবং রাজাকে ‘দেব-মানব’ হিসেবে তুলে ধরার প্রতীক ছিল।
❑ দুধের পুষ্টিগুণ এবং দুধ দিয়ে গোসল করার ব্যাপারে ইসলামের বিধান:
নিঃসন্দেহে দুধ আল্লাহ তাআলার একটি বড় নেয়ামত। এটি মানব দেহের জন্য অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর একটি খাদ্য এবং পানীয় দ্রব্য। এতে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, খনিজ লবণ এবং পানি—এই ছয়টি উপাদানের প্রায় সঠিক অনুপাত থাকে। তাই একে একটি সুষম এবং আদর্শ খাদ্য বলা হয়ে থাকে। সুতরাং সঠিক নিয়মে তা গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা শারীরিকভাবে অনেক উপকৃত হতে পারি। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য চর্চা ছাড়া বিশেষ কোনো উপলক্ষে দুধ দিয়ে গোসল করার কোনও ভিত্তি নাই। বরং তা অত্যন্ত জঘন্য কুসংস্কার ও মূর্খতা সুলভ কাজ বলে বিবেচিত। পাশাপাশি এটি অকাজে সম্পদ নষ্ট করা এবং আল্লাহর নেয়ামতের অপচয় হিসেবে পরিগণিত। অমুসলিমদের অন্ধ অনুকরণ তো বটেই যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সুতরাং কোনও মুসলিমের জন্য এমন কাজ করা জায়েজ নাই।
🔹নিম্নে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে দুধ দিয়ে গোসল করার বিধান তুলে ধরা হল:
পূর্বোল্লিখিত উদ্দেশ্যে দুধ দিয়ে গোসল করা অর্থ অপচয়ের শামিল। আর কুরআনে একাধিক স্থানে অর্থ অপচয়ের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা কঠিন এসেছে। যেমন:
✪ ১. আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
“তোমরা খাও ও পান করো। তবে অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয় কারীদের ভালোবাসেন না।”[সুরা আরাফ: ৩১]
✪ ২. আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَآتِ ذَا الْقُرْبَىٰ حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا
“আর আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরকে। আর কোনোভাবেই অপব্যয় করো না।” [সুরা বনি ইসরাইল: ২৬]
✪ ৩. অপচয় কারী শয়তানের ভাই: আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ
“নিশ্চয়ই যারা অপচয় করে, তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার রবের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।” [সুরা বনি ইসরাইল: ২৭]
❑ ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ মোচন, আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং জীবনের দুঃখ-কষ্টের অবসান কিংবা আনন্দময় পরিস্থিতিতে কী করণীয়?
ইসলাম পাপ মোচন, আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং জীবনের দুঃখ-কষ্টের অবসান কিংবা আনন্দঘন আবেগময় পরিস্থিতিতে কী করণীয় তার সঠিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। আমাদের কর্তব্য, ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় কাজ করা এবং সব ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও মূর্খতা সুলভ কার্যক্রম এবং অন্য ধর্মের অন্ধ অনুকরণ থেকে দূরে থাকা।
❁ ১. মানুষ শয়তানের প্ররোচনা, কু প্রবৃত্তির তাড়না বা অজ্ঞতা বশত ভুল কাজ করতে পারে। কিন্তু যখন সে ভুল বুঝতে পারবে তখন তার জন্য করণীয় হল উক্ত পাপ বা ভুল কাজটি ছেড়ে দেওয়া। অতঃপর লজ্জিত অন্তরে আল্লাহর কাছে তওবা-ইস্তিগফার করা বা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ভবিষ্যতে আর কখনো এমন কর্মে লিপ্ত না হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করা। তৎসঙ্গে ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।
কেউ যদি গুনাহ ও আল্লাহর নাফরমানি মূলক কর্ম পরিত্যাগ পূর্বক খাঁটি অন্তরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা না করে তাহলে এক মণ দুধ কেন দুধের নদীতে ডুব দিয়ে গোসল করলেও তার গুনাহ মোচন হবে না।
❁ ২. অনুরূপভাবে জীবনে আনন্দ দায়ক কোনও কিছু ঘটলে করণীয় হল, আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ
“তোমরা যদি কৃতজ্ঞ হও তবে আমি তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।” [সূরা ইবরাহিম: ৭]
কৃতজ্ঞতা আদায়ের অন্তর্ভুক্ত হল, মুখে আল হামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য) পাঠ করার পাশাপাশি একটি সেজদায়ে শোকর দেওয়া। এটাই সুন্নত সম্মত আমল। (শুকরিয়ার দু রাকাত নামাজ পড়ার ভিত্তি নাই)।
❑ সৌন্দর্য চর্চায় দুধের ব্যবহার কি জায়েজ?
কেউ যদি কেবল সৌন্দর্য চর্চার উদ্দেশ্যে দুধ ব্যবহার করে তাহলে তাতে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনও সমস্যা নেই। কেননা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে দুধ ত্বকের জন্য উপকারী। দুধে থাকা প্রোটিন, ভিটামিন ‘এ’ এবং ‘ডি’ ত্বককে মসৃণ করে এবং রোদে পোড়া ভাব দূর করতে সাহায্য করে। দুধ ত্বকের মৃত কোষ দূর করতে সাহায্য করে। প্রাচীনকালে রোমানরা ত্বক কোমল রাখতে দুধ মিশ্রিত পানিতে গোসল করতেন এবং মিশরের রানি ক্লিওপেট্রাও এর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। অ্যালোভেরা মিশিয়ে গোসল করলে আরও বেশি উপকার পাওয়া যায়। আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরণের কুসংস্কার ও অজ্ঞতা সুলভ কার্যক্রম এবং অন্ধ অনুকরণ থেকে হেফাজত করুন এবং ইসলাম নির্দেশিত পথে চলার তওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate