Tuesday, December 2, 2025

যদি কোন ব্যক্তি সুদকে হালাল মনে করে তাহলে শরিয়তে তার বিধান কী

 ভূমিকা:পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর ইসলামে সুদ সম্পূর্ণরূপে হারাম—এ বিষয়টি কুরআন, সহীহ হাদীস এবং উম্মাহর সর্বসম্মত মত (ইজমা‘) দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। অতএব, কেউ যদি ইজমার ভিত্তিতে সাব্যস্ত সুদের এই হারাম হওয়াকে অস্বীকার করে বা সুদকে হালাল মনে করে, তবে সে গুরুতর ভ্রান্তিতে পতিত হবে এবং ইসলামের দৃষ্টিতে কাফির গণ্য হবে।কারণ মূলনীতি হলো: যে ব্যক্তি এমন কোনো স্বীকৃত বিষয় অস্বীকার করে, যার ওপর উলামাদের স্পষ্ট ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—সে ব্যক্তি ইসলামের পরিসীমার বাইরে চলে যায়।

.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:إن الإيمان بوجوب الواجبات الظاهرة المتواترة ، وتحريم المحرمات الظاهرة المتواترة هو من أعظم أصول الإيمان ، وقواعد الدين ، والجاحد لها كافر بالاتفاق”নিশ্চিতভাবে সুপ্রমাণিত (মুতাওয়াতির) প্রকাশ্য ফরজ কাজগুলো আবশ্যিক বলে বিশ্বাস করা, এবং নিশ্চিতভাবে সুপ্রমাণিত (মুতাওয়াতির) প্রকাশ্য হারাম কাজগুলো নিষিদ্ধ বলে বিশ্বাস করা হলো ঈমানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভিত্তি এবং দ্বীনের মূলনীতিসমূহের অন্যতম। আর যে ব্যক্তি এগুলোকে অস্বীকার করে, সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফের (অবিশ্বাসী)।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ৪৯৭)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন:ومن اعتقد حل شيء أجمع على تحريمه وظهر حكمه بين المسلمين وزالت الشبهة فيه للنصوص الواردة فيه كلحم الخنزير والزنى وأشباه ذلك مما لا خلاف فيه كَفَر “যে এমন কোনো জিনিসকে হালাল মনে করে, যার হারাম হওয়ায় উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং মুসলিমদের মধ্যে যার হুকুম স্পষ্টভাবে প্রচলিত, যার ব্যাপারে কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট দলিলের কারণে কোনো সন্দেহ-সংশয় অবশিষ্ট নেই যেমন শূকরের মাংস, ব্যভিচার এবং এ ধরনের যেসব বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই সে কাফের।”(ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খন্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ২৭৬)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:
فَأَمَّا الْيَوْم وَقَدْ شَاعَ دِينُ الْإِسْلَام وَاسْتَفَاضَ فِي الْمُسْلِمِينَ عِلْمُ وُجُوب الزَّكَاة حَتَّى عَرَفَهَا الْخَاصّ وَالْعَامّ , وَاشْتَرَكَ فِيهِ الْعَالِم وَالْجَاهِل , فَلَا يُعْذَر أَحَد بِتَأْوِيلِ يَتَأَوَّلهُ فِي إِنْكَارهَا . وَكَذَلِكَ الْأَمْر فِي كُلّ مَنْ أَنْكَرَ شَيْئًا مِمَّا أَجْمَعَتْ الْأُمَّة عَلَيْهِ مِنْ أُمُور الدِّين إِذَا كَانَ عِلْمه مُنْتَشِرًا كَالصَّلَوَاتِ الْخَمْس وَصَوْم شَهْر رَمَضَان وَالاغْتِسَال مِنْ الْجَنَابَة وَتَحْرِيم الزِّنَا وَالْخَمْر وَنِكَاح ذَوَات الْمَحَارِم وَنَحْوهَا مِنْ الْأَحْكَام إِلَّا أَنْ يَكُون رَجُلًا حَدِيث عَهْدٍ بِالْإِسْلَامِ وَلَا يَعْرِف حُدُوده فَإِنَّهُ إِذَا أَنْكَرَ شَيْئًا مِنْهَا جَهْلًا بِهِ لَمْ يَكْفُر . . . فَأَمَّا مَا كَانَ الْإِجْمَاع فِيهِ مَعْلُومًا مِنْ طَرِيق عِلْم الْخَاصَّة كَتَحْرِيمِ نِكَاح الْمَرْأَة عَلَى عَمَّتهَا وَخَالَتهَا , وَأَنَّ الْقَاتِل عَمْدًا لَا يَرِث وَأَنَّ لِلْجَدَّةِ السُّدُس , وَمَا أَشْبَهَ ذَلِكَ مِنْ الْأَحْكَام فَإِنَّ مَنْ أَنْكَرَهَا لا يَكْفُر , بَلْ يُعْذَر فِيهَا لِعَدَمِ اِسْتِفَاضَة عِلْمهَا فِي الْعَامَّة”
“কিন্তু বর্তমানে, যখন ইসলামের দীন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মুসলমানদের মধ্যে যাকাতের আবশ্যকতা সংক্রান্ত জ্ঞান এতোটা প্রচলিত হয়েছে যে,তা আলেমদের মতো সাধারণ লোকও তা জানে,আর শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলের মধ্যেই এর জ্ঞান বিদ্যমান, তখন কেউ যদি যাকাত অস্বীকার করে, তবে তার ভ্রান্ত ব্যাখ্যার (তা’বীল-এর) অজুহাতে তাকে ক্ষমা করা হবে না।আর ঠিক একই বিধান প্রযোজ্য হবে সেইসব ক্ষেত্রে, যা দীনের এমন বিষয় যার উপর উম্মাহর ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত এবং যার জ্ঞান মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। যেমন: পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রমযান মাসের সিয়াম (রোজা),জানাবাত (নাপাকি) থেকে গোসল, যিনা (ব্যভিচার) ও মদ হারাম হওয়া, মাহরাম (রক্ত সম্পর্কীয়) নারীর সাথে বিবাহ হারাম হওয়া এবং এ ধরনের অন্যান্য বিধান। যদি কেউ এগুলো অস্বীকার করে, তবে সে কাফের গণ্য হবে।তবে, যদি কোনো ব্যক্তি সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণ করে এবং সে ইসলামের বিধানাবলী সম্পর্কে অবহিত না থাকে, তবে অজ্ঞতার কারণে সে যদি এর কোনো একটি অস্বীকার করে, তবে সে কাফের হবে না…কিন্তু যেসব বিষয়ে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অথচ সেই ইজমার জ্ঞান শুধুমাত্র নির্দিষ্ট আলিমদের মাধ্যমেই জানা যায় (অর্থাৎ,সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নয়), যেমন: কোনো নারীকে তার ফুফু বা খালার উপরে বিবাহ করা হারাম হওয়া,ইচ্ছাকৃত হত্যাকারী উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া; এবং দাদি (বা নানি)-এর জন্য সুদুস (এক-ষষ্ঠাংশ) অংশ নির্ধারিত হওয়া—এরকম অন্যান্য বিধানাবলী যদি কেউ অস্বীকার করে, তবে সে কাফির হবে না। বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে এর জ্ঞান ব্যাপকভাবে প্রচলিত না হওয়ার কারণে এক্ষেত্রে তার ওজর গ্রহণযোগ্য হবে।”(ইসলাম সাওয়াল জবাব ফাতওয়া নং-২২৩৩৯)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
حكم الربا : أنه محرم بالقرآن والسنة وإجماع المسلمين. ومرتبته : أنه من كبائر الذنوب ؛ لأن الله تعالى قال : (ومن عاد فأولئك أصحاب النار هم فيها خالدون) ، وقال تعالى : (فإن لم تفعلوا فأذنوا بحرب من الله ورسوله) ؛ ولأن الرسول صلى الله عليه وسلم ” لعن آكل الربا وموكله وشاهديه وكاتبه ” فهو من أعظم الكبائر. وهو مجمع على تحريمه ، ولهذا من أنكر تحريمه ممن عاش في بيئة مسلمة فإنه مرتد ؛ لأن هذا من المحرمات الظاهرة المجمع عليها.ولكن إذا قلنا هذا ، هل معناه أن العلماء أجمعوا على كل صورة ؟ الجواب : لا ، فقد وقع خلاف في بعض الصور ، وهذا مثل ما قلنا في أن الزكاة واجبة بالإجماع ، ومع ذلك ليس الإجماع على كل صورة ، فاختلفوا في الإبل والبقر العوامل ( التي تستخدم في الحرث والسقي ) ، واختلفوا في الحلي وما أشبه ذلك ، لكن في الجملة العلماء مجمعون على أن الربا حرام بل من كبائر الذنوب )
“রিবার (সুদ) বিধান: এর হুকুম হলো এটি কুরআন, সুন্নাহ এবং মুসলিমদের ঐকমত্য (ইজমা) দ্বারা হারাম।এর অপরাধের স্তর হলো এটি কবীরা গুনাহসমূহের (বড় গুনাহ) অন্তর্ভুক্ত। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন:”…আর যে পুনরায় তা করবে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী থাকবে।” এবং তিনি (আল্লাহ) আরো বলেছেন:”যদি তোমরা তা না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা জেনে রাখো।”আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘সুদখোর, সুদদাতা, এর সাক্ষীদ্বয় এবং এর লেখক সবার ওপর লা‘নত (অভিসম্পাত) করেছেন।’ সুতরাং এটি সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহসমূহের অন্যতম।রিবার হারাম হওয়াতে সর্বসম্মত ঐকমত্য (ইজমা) রয়েছে। এ কারণেই যে ব্যক্তি মুসলিম পরিবেশে বসবাস করেও রিবার হারাম হওয়াকে অস্বীকার করে, সে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) বলে গণ্য হবে। কারণ এটি এমন প্রকাশ্য হারাম বিষয়গুলোর অন্যতম, যার ওপর উম্মাহর ইজমা রয়েছে।তবে আমরা যখন এ কথা বলি, এর অর্থ কি এই যে উলামারা রিবার প্রতিটি স্বতন্ত্র রূপ (ছবি) সম্পর্কে সর্বসম্মত? উত্তর হলো: না। কিছু কিছু রূপ নিয়ে মতভেদ হয়েছে। এটি সেই উদাহরণের মতো, যেখানে আমরা বলি যাকাত ওয়াজিব (ফরজ) হওয়াতে ইজমা রয়েছে, কিন্তু সব বিস্তারিত বিষয়ে ঐকমত্য নেই। যেমন: উলামারা হালচাষ ও পানি সেচের কাজে ব্যবহৃত উট ও গরু (যাকে ‘আওয়ামিল’ বলা হয়) এবং গয়না (হুলী) ইত্যাদির ওপর যাকাত আছে কি না, সে বিষয়ে মতভেদ করেছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে উলামারা সর্বসম্মত যে রিবা হারাম, বরং তা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।”(ইমাম ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি, খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৮৭)
.
অতএব উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, যে ব্যক্তি রিবা (সুদ) হারাম—এই প্রতিষ্ঠিত বিধানকে অস্বীকার করবে, সে কুফরির মধ্যে পড়বে; কারণ রিবার নিষিদ্ধতা সম্পর্কে কোরআন ও সহীহ হাদিসে বহু স্পষ্ট, চূড়ান্ত দলিল রয়েছে এবং এ বিষয়ে উলামাদের সুপরিচিত ও অবিচল সর্বসম্মত ঐক্যমত্যও প্রতিষ্ঠিত।কিন্তু কেউ যদি রিবার এমন কোনো ধরন বা শাখার নিষিদ্ধতাকে অস্বীকার করে, যা নিয়ে উলামাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে অথবা যার হারাম হওয়া বিষয়ে স্পষ্ট ইজমা প্রমাণিত নয়—তাহলে তাকে কাফির গণ্য করা হবে না। বরং তার অবস্থার দিকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা হবে:যদি সে ইজতিহাদকারী হয়, তবে তার ইজতিহাদের জন্য সে সওয়াব পেতে পারে;যদি সে অজ্ঞতার কারণে ভুল করে থাকে, তবে তা ক্ষমাযোগ্য হতে পারে;আর যদি সে নফসের খেয়াল-খুশির অনুসরণে এটিকে হালাল বলে মনে করে, তবে সে ফাসিক (পাপাচারী) হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। আর আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর প্রতি শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন। আমীন!!
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate