Tuesday, December 2, 2025

অবৈধ পন্থায় প্রবাসে বসবাস করা এবং কাজ করার বিধান

 প্রশ্ন: অবৈধ হিসাবে প্রবাসে বসবাসকারী অনেক ঋণগ্রস্ত ভাই রয়েছেন যাদের দেশে এসে জীবন ধারণের কোন ব্যবস্থা নেই। তাদের ক্ষেত্রে অবৈধভাবে প্রবাসে থেকে অর্থ উপার্জন করা কি হালাল হবে?

উত্তর: একজন মানুষ যখন প্রবাসে যাওয়ার জন্য ভিসা গ্রহণ করে তখন সে দেশে গিয়ে সেখানকার আইন-কানুন মেনে চলার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বলে পরিগণিত হয়‌। অতএব সে আইন ও শরিয়ত উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে উক্ত দেশের প্রচলিত আইন-কানুন মেনে চলতে বাধ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা অঙ্গীকার (ও চুক্তিসমূহ) পূর্ণ কর।” [সূরা মায়েদা: ১]
আর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
المسلمونَ على شروطِهم
“মুসলিমগণ তাদের শর্তের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” [সহীহ আবু দাউদ, হা/৩৫৯৫] অর্থাৎ মুসলিমগণ তাদের সাথে কৃত শর্ত লঙ্ঘন করবে না।
সুতরাং প্রবাসীদের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সে দেশের কোনো আইন লঙ্ঘন করা জায়েজ নেই। (যদি শরিয়ত বিরোধী কোন আইন না হয়। তবে শরিয়ত বিরোধী আইন হলে তা মানা জায়েজ নয়)।
অতএব কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অবৈধ ভাবে প্রবাসে বসবাস করে তাহলে সে দেশের আইনের দৃষ্টিতে যেমন অপরাধী বলে গণ্য হবে তেমনি শরিয়তের দৃষ্টিতেও সে গুনাহগার হবে।
তবে হ্যাঁ, কোন ব্যক্তি যদি তার ইচ্ছার বাইরে কোন কারণে ‘অবৈধ’ হয়ে যায় তাহলে সে দেশে ফিরে আসার জন্য আইনানুগ পন্থায় চেষ্টা করবে। এ সময় তার জীবন ধারণ এবং দেশে ফেরত আসার খরচ যোগানের জন্য সে যেকোনো হালাল কাজ করতে পারে। কেননা এটা অপারগ অবস্থা। অপারগ অবস্থায় শরিয়তের ছাড় রয়েছে। ইসলামি ফিকহের একটি প্রসিদ্ধ মূলনীতি হলো,
الضرورة تبيح المحظورات
“জরুরত নিষিদ্ধ জিনিসকে বৈধ করে দেয়।” যেমন প্রচণ্ড ক্ষুধায় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য শূকর বা মরা প্রাণীর গোস্ত খাওয়া।
উল্লেখ্য যে, কোন অমুসলিম দেশে যাওয়ার আগে সেখানে কোন শরিয়ত বিরোধী কোন আইন মানার ব্যাপারে সে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। এমনটি হলে (বিশেষ কারণ ছাড়া) সে দেশে ভ্রমণ করা বা গমন করা জায়েজ নেই। অজ্ঞতাবশত সেখানে যাওয়ার পরে শরিয়ত বিরোধী আইন মানতে বাধ্য হতে হলে যথাসম্ভব দ্রুত সেখান থেকে দেশে ফিরে আসা অপরিহার্য। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

মাইজভান্ডারি দরবার শরীফ এই গুলো কি সহীহ

 প্রশ্ন: “মাইজভান্ডারি দরবার শরীফ” এই গুলো কি সহীহ ?

উত্তর: পাক-ভারত উপমহাদেশ সহ পৃথিবীতে এমন কোন পীরের দরবার বা খানকা নেই যেখানে বিদআতি বা শিরকি কার্যক্রম সংঘটিত না হয়। কোথাও কম কোথাও বেশি। বরং এগুলোই শিরক, বিদআত, কুসংস্কার, জাল-জয়ীফ হাদিস, আজগুবি কিচ্ছা-কাহিনী ইত্যাদির উৎপাদন ও পরিচর্যা কেন্দ্র। এরাই সমাজে ধর্মের নামে অধর্ম বিস্তারের কাজ করে থাকে। এরাই অজ্ঞ ও ধর্মভীরু মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে দ্বীনের অপব্যাখ্যা ও বিকৃতি সাধনের পাশাপাশি মানুষের অর্থ সম্পদ লুণ্ঠন এবং ধর্ম ব্যবসা পরিচালনা করে। এই সকল শয়তানের আখড়াগুলোর বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের সচেতন হওয়া আবশ্যক। এগুলোর পরিবর্তে আমাদের উচিত, তাওহিদ ও সুন্নাহর জ্ঞান সমৃদ্ধ ও বিশুদ্ধ আকিদার ধারক ও বাহক বিজ্ঞ আলেমদের শরণাপন্ন হওয়া, তাদের নিকট থেকে কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক সঠিক জ্ঞান অর্জন করে আমল করার পথ নির্দেশনা লাভ করা, দ্বীন সম্পর্কে কোন কিছু না জানলে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে সঠিক করণীয় বর্জনীয় সম্পর্কে জেনে নেওয়া।
মহান আল্লাহ তৌফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

পুরুষের অনুপস্থিতে কি মহিলা নবজাতক শিশুর কানে আযান দিতে পারে

 আসলে নব জাতকের কানে আজান দেয়া বৈধ না কি অবৈধ -এ বিষয়টিই দ্বিমত পূর্ণ। কেননা এ মর্মে হাদিসগুলো সহিহ-জঈফ হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের মাঝে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়।

যাহোক, তবে আযান দেয়ার হাদিসগুলোকে অনেক মুহাদ্দিস সহীহ বলেছেন আর যুগে যুগে মুসলিমদের মাঝে এই আমল চলে আসছে। সুতরাং নব জাতক শিশুর কানে আযান দেয়া জায়েজ রয়েছে-এটাই অধিক গ্রহণযোগ্য মত। তবে এ আজান দিবে পুরুষ। পুরুষের অনুপস্থিতিতে মহিলা আযান দিতে পারবে কি না এ বিষয়টিও মতানৈক্য পূর্ণ। এ মতানৈক্যের কারণ হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবীদের যুগে মহিলা কর্তৃক শিশুর নিকট আযান দেয়ার ব্যাপারে কোন হাদিস পাওয়া যায় না। এই কারণে অনেক আলেম বলেন, মহিলারা আযান দিতে পারবে না। তারা আরেকটি কারণ বলেন, আযান মূলত: পুরুষদের বৈশিষ্ট্য। চাই তা নামাযের জন্য হোক অথবা অন্য কারণে হোক, কেবল পুরুষরাই আজান দিবে; মহিলারা নয়। আরেকদল আলেম বলেন, এখানে আজান দেয়ার উদ্দেশ্য, শিশুর কানে আল্লাহর বড়ত্ব ও তাওহিদের বাণী পৌঁছে দেয়া। সুতরাং নারী বা পুরুষ যেই হোক আজান দিলে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়ে যায়। সুতরাং কোন কারণে পুরুষের আজান দেয়া অসম্ভব হলে যদি মহিলা নবজাতক শিশুর কানে আজান দেয় তাহলে তা যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। তবে এ আজান দিতে হবে নিচু স্বরে যেন তার আওয়াজ পরপুরুষ না শুনে। আল্লাহু আলাম।
-الله أعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

দুধ দিয়ে গোসল নিছক কুসংস্কার পূর্ণ কাজ এবং অপচয়ের শামিল

 আমাদের দেশে কেউ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে, কেউ রোগ থেকে মুক্ত হয়ে আর কেউ ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে দুধ দিয়ে গোসল করে করে। কেউ নতুন বিয়ে করে দুধ দিয়ে গোসল করে, আবার কেউ বউ তালাকের পরে দুধ দিয়ে গোসল করে। কেউ নির্বাচনে জয়লাভ করে আবার কেউ বা কেউ রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিয়ে দুধ দিয়ে গোসল করে!! এরকম নানা ধরণের সংবাদ আমরা প্রায়শই দেখি। এসব খবরে নেট দুনিয়া সয়লাব। কিন্তু এসব কারণে-অকারণে দুধ দিয়ে গোসল করার আদৌ কি কোনও ভিত্তি আছে নাকি এটা শুধুই আবেগ? প্রকৃতপক্ষে দুধ দিয়ে গোসল করার রীতি হিন্দুদের থেকে এসেছে। কিন্তু দুঃখ জনক বিষয় হল, দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে এবং বিধর্মীদের অন্ধ অনুকরণে ফলে এই জঘন্য প্রথা মুসলিমদের মধ্যেও প্রবেশ করেছে এবং অনেক নামধারী মুসলিম দেখাদেখি এই প্রথা পালন করে চলেছে।

❑ দুধ দিয়ে গোসল করার প্রথা কোথা থেকে এলো?
ভারতীয় উপমহাদেশে দুধকে পবিত্র উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। বৈদিক যুগ থেকেই এটি নানা আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হিন্দু ধর্মের মন্দির চর্চায় দেবমূর্তি বা প্রতীককে পবিত্র তরল (দুধ, পানি, ঘি, মধু ইত্যাদি) দিয়ে স্নান করানো বা ‘অভিষেক’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় রীতি। বিশেষত শিবলিঙ্গে দুধ ঢালা পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে করা হয়। দুধকে ‘সত্ত্ব’ গুণ বা শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। জন্মাষ্টমী, মহা শিবরাত্রি, উপনয়ন, বিবাহ বা রাজ্যাভিষেকের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে দুধ দিয়ে স্নান করানো হতো। এটি পাপমোচন, আত্মশুদ্ধি এবং রাজাকে ‘দেব-মানব’ হিসেবে তুলে ধরার প্রতীক ছিল।
❑ দুধের পুষ্টিগুণ এবং দুধ দিয়ে গোসল করার ব্যাপারে ইসলামের বিধান:
নিঃসন্দেহে দুধ আল্লাহ তাআলার একটি বড় নেয়ামত। এটি মানব দেহের জন্য অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর একটি খাদ্য এবং পানীয় দ্রব্য। এতে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, খনিজ লবণ এবং পানি—এই ছয়টি উপাদানের প্রায় সঠিক অনুপাত থাকে। তাই একে একটি সুষম এবং আদর্শ খাদ্য বলা হয়ে থাকে। সুতরাং সঠিক নিয়মে তা গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা শারীরিকভাবে অনেক উপকৃত হতে পারি। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য চর্চা ছাড়া বিশেষ কোনো উপলক্ষে দুধ দিয়ে গোসল করার কোনও ভিত্তি নাই। বরং তা অত্যন্ত জঘন্য কুসংস্কার ও মূর্খতা সুলভ কাজ বলে বিবেচিত। পাশাপাশি এটি অকাজে সম্পদ নষ্ট করা এবং আল্লাহর নেয়ামতের অপচয় হিসেবে পরিগণিত। অমুসলিমদের অন্ধ অনুকরণ তো বটেই যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সুতরাং কোনও মুসলিমের জন্য এমন কাজ করা জায়েজ নাই।
🔹নিম্নে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে দুধ দিয়ে গোসল করার বিধান তুলে ধরা হল:
পূর্বোল্লিখিত উদ্দেশ্যে দুধ দিয়ে গোসল করা অর্থ অপচয়ের শামিল। আর কুরআনে একাধিক স্থানে অর্থ অপচয়ের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা কঠিন এসেছে। যেমন:
✪ ১. আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
“তোমরা খাও ও পান করো। তবে অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয় কারীদের ভালোবাসেন না।”[সুরা আরাফ: ৩১]
✪ ২. আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَآتِ ذَا الْقُرْبَىٰ حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا
“আর আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরকে। আর কোনোভাবেই অপব্যয় করো না।” [সুরা বনি ইসরাইল: ২৬]
✪ ৩. অপচয় কারী শয়তানের ভাই: আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ
“নিশ্চয়ই যারা অপচয় করে, তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার রবের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।” [সুরা বনি ইসরাইল: ২৭]
❑ ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ মোচন, আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং জীবনের দুঃখ-কষ্টের অবসান কিংবা আনন্দময় পরিস্থিতিতে কী করণীয়?
ইসলাম পাপ মোচন, আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং জীবনের দুঃখ-কষ্টের অবসান কিংবা আনন্দঘন আবেগময় পরিস্থিতিতে কী করণীয় তার সঠিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। আমাদের কর্তব্য, ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় কাজ করা এবং সব ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও মূর্খতা সুলভ কার্যক্রম এবং অন্য ধর্মের অন্ধ অনুকরণ থেকে দূরে থাকা।
❁ ১. মানুষ শয়তানের প্ররোচনা, কু প্রবৃত্তির তাড়না বা অজ্ঞতা বশত ভুল কাজ করতে পারে। কিন্তু যখন সে ভুল বুঝতে পারবে তখন তার জন্য করণীয় হল উক্ত পাপ বা ভুল কাজটি ছেড়ে দেওয়া। অতঃপর লজ্জিত অন্তরে আল্লাহর কাছে তওবা-ইস্তিগফার করা বা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ভবিষ্যতে আর কখনো এমন কর্মে লিপ্ত না হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করা। তৎসঙ্গে ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।
কেউ যদি গুনাহ ও আল্লাহর নাফরমানি মূলক কর্ম পরিত্যাগ পূর্বক খাঁটি অন্তরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা না করে তাহলে এক মণ দুধ কেন দুধের নদীতে ডুব দিয়ে গোসল করলেও তার গুনাহ মোচন হবে না।
❁ ২. অনুরূপভাবে জীবনে আনন্দ দায়ক কোনও কিছু ঘটলে করণীয় হল, আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ
“তোমরা যদি কৃতজ্ঞ হও তবে আমি তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।” [সূরা ইবরাহিম: ৭]
কৃতজ্ঞতা আদায়ের অন্তর্ভুক্ত হল, মুখে আল হামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য) পাঠ করার পাশাপাশি একটি সেজদায়ে শোকর দেওয়া। এটাই সুন্নত সম্মত আমল। (শুকরিয়ার দু রাকাত নামাজ পড়ার ভিত্তি নাই)।
❑ সৌন্দর্য চর্চায় দুধের ব্যবহার কি জায়েজ?
কেউ যদি কেবল সৌন্দর্য চর্চার উদ্দেশ্যে দুধ ব্যবহার করে তাহলে তাতে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনও সমস্যা নেই। কেননা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে দুধ ত্বকের জন্য উপকারী। দুধে থাকা প্রোটিন, ভিটামিন ‘এ’ এবং ‘ডি’ ত্বককে মসৃণ করে এবং রোদে পোড়া ভাব দূর করতে সাহায্য করে। দুধ ত্বকের মৃত কোষ দূর করতে সাহায্য করে। প্রাচীনকালে রোমানরা ত্বক কোমল রাখতে দুধ মিশ্রিত পানিতে গোসল করতেন এবং মিশরের রানি ক্লিওপেট্রাও এর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। অ্যালোভেরা মিশিয়ে গোসল করলে আরও বেশি উপকার পাওয়া যায়। আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরণের কুসংস্কার ও অজ্ঞতা সুলভ কার্যক্রম এবং অন্ধ অনুকরণ থেকে হেফাজত করুন এবং ইসলাম নির্দেশিত পথে চলার তওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পেছনে বৈজ্ঞানিক এবং শারঈ কারণ

 ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর বিভিন্ন সময় ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পেছনে বৈজ্ঞানিক এবং শার’ঈ কারণ নিম্নে তুলে ধরা হলো:

▪️(১) বৈজ্ঞানিক কারণ: আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তি অনুযায়ী ভূমিকম্পের প্রধান কারণ হলো—টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া:অর্থাৎ আধুনিক বিজ্ঞান বলে,অনেক আগে পৃথিবীর সব স্থলভাগ একত্রে ছিল। পৃথিবীর উপরিভাগে কতগুলো অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত বলে ধীরে ধীরে তারা আলাদা হয়ে গেছে। এই প্লেটগুলোকেই বিজ্ঞানীরা বলেন টেকটোনিক প্লেট।পৃথিবীর উপরিভাগ কয়েকটি বিশাল টেকটোনিক প্লেট দ্বারা গঠিত, যা ম্যান্টলের (ভূ-অভ্যন্তরের গলিত ও অর্ধগলিত অংশ) উপর ধীরে ধীরে ভাসমান অবস্থায় থাকে। এই প্লেটগুলো একে অপরের সাথে ক্রমাগত নড়াচড়া করে, কিন্তু ঘর্ষণের কারণে প্রায়শই প্লেটের প্রান্তগুলো একে অপরের সাথে আটকে যায়। প্লেটগুলো আটকে গেলেও তাদের নড়াচাড়ার গতিশক্তি থেমে থাকে না, ফলে আটকে থাকা অংশে চাপ বা শক্তি জমা হতে থাকে। যখন এই সঞ্চিত চাপ শিলার ধারণক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন হঠাৎ করে শিলা ভেঙে যায় এবং প্লেটগুলো একে অপরের পাশ দিয়ে দ্রুত পিছলে যায়। শক্তির এই আকস্মিক মুক্তির ফলে ভূগর্ভে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, যা পৃথিবীর ভূত্বকের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভূমিতে কম্পন তৈরি করে।এটাই ভূমিকম্প।
.
▪️(২) শারঈ কারন: নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাঁর শার’ঈ বিধানগুলোতে যেমন পরিপূর্ণ হিকমত রাখেন, তেমনি সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্রে প্রদত্ত সিদ্ধান্তগুলোতেও রয়েছে পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা। আল্লাহ্‌র অনন্ত হিকমতের অন্যতম একটি দিক হলো, তিনি বিভিন্ন নিদর্শনের মাধ্যমে বান্দাদের প্রতি সতর্কতা, স্মরণ ও ভয়ের অনুভূতি প্রেরণ করেন।এই ধরনের নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম হলো ভূমিকম্প। এ পৃথিবীতে ভূমিকম্প আল্লাহর বড় নিদর্শনসমূহের অন্যতম একটি নিদর্শন।এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করেন; তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া,ভয় প্রদর্শন করা কিংবা তাদেরকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে। এই নিদর্শনগুলো সংঘটনকালে মানুষের কর্তব্য আল্লাহর সম্মুখে নিজের দুর্বলতা, অক্ষমতা, হীনতা ও মুখাপেক্ষিতাকে স্মরণ করা। এগুলোকে স্মরণ করে দোয়া, রোনাজারি ও নত হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া। যাতে করে আল্লাহ এই মহা বিপদ থেকে সকল মানুষকে মুক্তি দেন। ভূমিকম্প এমন একটি ঘটনা, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে কখনো সংঘটিত হয়নি। বরং ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবার এটি ঘটে উমার ইবনুল খাত্তাব রা. এর খিলাফতের সময়। তাঁর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে তিনি এ ঘটনাকে অত্যন্ত অপছন্দ করেন এবং এতে ভয় অনুভব করেন।
.
আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَا نُرْسِلُ بِالْآيَاتِ إِلَّا تَخْوِيفًا “(আসলে) আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনসমূহ পাঠাই”(সূরা ইসরা/বনী ইসরাইল: ৫৯) তিনি আরও বলেন, وَمَا نُرِيهِم مِّنْ آيَةٍ إِلَّا هِيَ أَكْبَرُ مِنْ أُخْتِهَا ۖ وَأَخَذْنَاهُم بِالْعَذَابِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ“আমি তাদেরকে যে নিদর্শনই দেখাতাম, তাই হত পূর্ববর্তী নিদর্শন অপেক্ষা বৃহৎ এবং আমি তাদেরকে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম, যাতে তারা ফিরে আসে।”(সূরা যুখরূফ: ৪৮) আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন,أَفَلَمْ يَرَوْا إِلَىٰ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُم مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ ۚ إِن نَّشَأْ نَخْسِفْ بِهِمُ الْأَرْضَ أَوْ نُسْقِطْ عَلَيْهِمْ كِسَفًا مِّنَ السَّمَاءِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّكُلِّ عَبْدٍ مُّنِيبٍ “তারা কি তাদের সামনের ও পশ্চাতের আকাশ ও পৃথিবীর প্রতি লক্ষ্য করে না? আমি ইচ্ছা করলে তাদের সহ ভূমি ধসিয়ে দেব অথবা আকাশের কোন খণ্ড তাদের উপর পতিত করব। আল্লাহ অভিমুখী প্রত্যেক বান্দার জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।”(সূরা সাবা: ৯) তিনি আরও বলেন,قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَىٰ أَن يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِّن فَوْقِكُمْ أَوْ مِن تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَكُم بَأْسَ بَعْضٍ ۗ انظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ الْآيَاتِ لَعَلَّهُمْ يَفْقَهُونَ “বল, আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম, অথবা তিনি তোমাদের দল-উপদলে বিভক্ত করে একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে সক্ষম।”(সূরা আল আনআম:৬৫) আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন,فَلَمَّاۤ أَخَذَتۡهُمُ ٱلرَّجۡفَةُ قَالَ رَبِّ لَوۡ شِئۡتَ أَهۡلَكۡتَهُم مِّن قَبۡلُ وَإِیَّـٰیَۖ أَتُهۡلِكُنَا بِمَا فَعَلَ ٱلسُّفَهَاۤءُ مِنَّاۤۖ إِنۡ هِیَ إِلَّا فِتۡنَتُكَ تُضِلُّ بِهَا مَن تَشَاۤءُ وَتَهۡدِی مَن تَشَاۤءُۖ أَنتَ وَلِیُّنَا فَٱغۡفِرۡ لَنَا وَٱرۡحَمۡنَاۖ وَأَنتَ خَیۡرُ ٱلۡغَـٰفِرِینَ”যখন তারা একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে আক্রান্ত হলো তখন মূসা বলল, “রব আমার! তুমি চাইলে তো আগেই এদেরকে ও আমাকে ধ্বংস করে দিতে পারতে। আমাদের মধ্যকার নির্বোধেরা যা করেছে, তার জন্য কি তুমি আমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে? এটি তো ছিল তোমার পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। এর মাধ্যমে তুমি যাকে চাও পথভ্রষ্ট করো, আবার যাকে চাও হিদায়াত দান করো। তুমিই তো আমাদের অভিভাবক। কাজেই আমাদের মাফ করে দাও এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করো। ক্ষমাশীলদের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ।”(সূরা আরাফ: ১৫৫)
.
নিঃসন্দেহে বর্তমানে যেসকল ভূমিকম্পগুলো ঘটছে তা মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শনগুলোর একটি যা দিয়ে তিনি তাঁর বান্দাদের ভয় দেখিয়ে থাকেন। এই ভূমিকম্প এবং অন্যান্য সকল দূর্যোগগুলো সংগঠিত হওয়ার ফলে অনেক ক্ষতি হচ্ছে, অনেকে মারা যাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে; এই দূর্যোগগুলো আসার কারণ হচ্ছে, শিরকী কার্যকলাপ (ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে মহান আল্লাহর অংশীদার বানানো) এবং মানুষের পাপ (মহান আল্লাহ যে কাজগুলো করতে নিষেধ করেছেন সে কাজগুলো করার কারণে)।উদাহরণস্বরূপ; শিরক, বিদআত, যিনা, ব্যভিচার,মদপান,হারাম ভক্ষণ, অবৈধ হত্যা ইত্যাদি।মহান আল্লাহ বলেন: “(হে মানুষ) যে বিপদ আপদই তোমাদের উপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই, এবং (তা সত্ত্বেও) আল্লাহ তাআলা তোমাদের অনেক (অপরাধ এমনিই) ক্ষমা করে দেন।” [সূরা আশ শূরা: ৩০] তিনি আরও বলেন:“যে কল্যাণই তুমি লাভ কর (না কেন, মনে রেখো), তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, আর যেটুকু অকল্যাণ তোমার উপর আসে তা আসে তোমার নিজের থেকে।” [সূরা আন নিসা : ৭৯] মহান আল্লাহ অতীত জাতীর উপর প্রেরিত আযাব সম্পর্কে বলেন: “অতঃপর এদের সবাইকে আমি (তাদের) নিজ নিজ গুণাহের কারণে পাকড়াও করেছি, এদের কারো উপর প্রচন্ড ঝড় পাঠিয়েছি (প্রচন্ড পাথরের বৃষ্টি) {যেভাবে লূত জাতির উপর প্রেরণ করা হয়েছিল}, কাউকে মহাগর্জন এসে আঘান হেনেছে {যেভাবে শুআইব (আ.) এর জাতীর উপর আঘাত হেনেছিল}, কাউকে আমি যমীনের নীচে গেড়ে দিয়েছি {যেভাবে কারুন জাতীদের উপর এসেছিল}, আবার কাউকে আমি (পানিতে) ডুবিয়ে দিয়েছি {নূহ জাতী ও ফেরাউন ও তার লোকদের কে যেভাবে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল}, (মূলত) আল্লাহ তাআলা এমন ছিলেন না যে তিনি এদের উপর যুলুম করেছেন, যুলুম তো বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর করেছে।” [সূরা আল আনকাবূত: ৪০]
.
হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন ,নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে আনছার ও মুহাজিরের দল! তোমাদেরকে পাঁচটি ব্যাপারে পরীক্ষায় ফেলে কষ্ট দেওয়া হবে। …তার পঞ্চমটি হ’ল وَمَالَمْ تَحْكُمْ اَئِمَّتُهُمْ بِكِتَابِ اللهِ وَيَتَخَيَّرُوْا مِمَّا أَنْزَلَ اللهُ إِلاَّ جَعَلَ اللهُ بَأَسَهُمْ بَيْنَهُمْ.”যখন আলেম ও শাসকগণ আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী শাসন কাঠামো পরিচালনা করবে না; বরং আল্লাহর দেওয়া বিধানের উপর নিজ ইচ্ছা প্রয়োগ করবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা মানুষের উপর দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভোগ, দুরবস্থা, দরিদ্রতা ও দুর্যোগ চাপিয়ে দিবেন”(ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯, হাদীছ হাসান) জাবির ইবনু আবদুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, এ আয়াত যখন অবতীর্ণ হলঃ “হে নবী আপনি বলে দিন তোমাদের উপর থেকে তোমাদের ওপর শাস্তি পাঠাতে তিনিই সক্ষম”-(সূরা আন’আম ৬/৬৫)। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হে আল্লাহ্! আমি আপনার সত্তার সাহায্যে আশ্রয় চাচ্ছি। আল্লাহ্ তখন বললেনঃ “কিংবা তোমাদের পায়ের নীচ হতে; তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি আপনার সত্তার সাহায্যে আশ্রয় চাচ্ছি। আল্লাহ্ বললেনঃ কিংবা তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এটি অপেক্ষাকৃত সহজ।”(সহীহ বুখারী হা/৭৪০৬) আবূল-শায়খ আল-ইস্পাহানি এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেন, “বল: আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) ” যার ব্যাখ্যা হলো, তীব্র শব্দ, পাথর অথবা ঝড়ো হাওয়া; “অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আযাব পাঠাতে সক্ষম”, যার ব্যাখ্যা হলো, ভুমিকম্প এবং ভূমি ধ্বসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া। এছাড়াও নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,”প্রচুর পরিমাণ ভূমিকম্প না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সঙ্ঘটিত হবে না” (সহীহ বুখারী, হা/১০৩৬)। অপর বর্ননায় আবু মালিক আশ‘আরী (রাঃ) বলেন,নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমার কিছু উম্মত মদ পান করবে এবং তার নাম রাখবে ভিন্ন। তাদের নেতাদেরকে গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সম্মান করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ভূমিকম্পের মাধ্যমে মাটিতেই ধসিয়ে দিবেন। আর তাদেরকে বানর ও শুকরে পরিণত করবেন”।(ইবনু মাজাহ, হা/৪০২০) একবার মদীনায় ভূমিকম্প হলে উমার (রাদিআল্লাহু আনহু) লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা কত দ্রুত নতুন নতুন অপকর্মে করে লিপ্ত হয়ে গেলে! যদি পুনরায় ভূমিকম্প হয়, তাহলে তোমাদের সাথে এখানে আমি বসবাস করবো না(ইবনু আবী শায়বাহ হা/৮৩৩৫) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বললেন,”আমার এ উম্মতের উপর আল্লাহর রহমত আছে। আখেরাতে তারা (স্থায়ী) আযাব ভোগ করবে না। বরং তাদের কাফ্ফারা এভাবে হবে যে, দুনিয়াতে তাদের শাস্তি হবে ফিতনা-ফাসাদ, ভূমিকম্প এবং হত্যা”।(আবু দাউদ হা/৪২৭৮; সহীহুল জামে হা/১৩৯৬)।
.
ইমাম ইবনু আব্দুল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:لم يأت عن النبي صلى الله عليه وسلم من وجه صحيح أن الزلزلة كانت في عصره ولا صحت عنه فيها سنة وقد كانت أول ما كانت في الإسلام على عهد عمر فأنكرها وقال أحدثتم والله لئن عادت لأخرجن من بين أظهركم”নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ভূমিকম্প ঘটেছে এ মর্মে কোনো সহিহ সূত্রে কিছুই বর্ণিত হয়নি। এ বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে কোনো সুন্নাতও প্রমাণিত নয়। ইসলামে প্রথম ভূমিকম্প ঘটে হযরত উমার রা. এর সময়। তখন তিনি এ ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং বলেন: তোমরা অবশ্যই নতুন কিছু সৃষ্টি করেছ! আল্লাহর শপথ যদি এটি আবার ঘটে, তবে আমি তোমাদের মধ্য থেকে সরে যাবো।”(আত-তামহীদ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩১৮)
.
আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, আল-মুফাসসির, আল-ফাক্বীহ,আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আবু বকর ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যা, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,
وذكر الامام أحمد عن صفية قالت: زلزلت المدينة على عهد عمر، فقال: يا أيها الناس ما أسرع ما أحدثتم لإن عادت لا تجدوني فيها, وقال كعب: إنما زلزلت الأرض إذا عمل فيها بالمعاصي فترعد فرقا من الرب عز وجل أن يطلع عليها, وكتب عمر بن عبد العزيز إلى الأمصار أما بعد: فإن هذا الرجف شيء يعاتب الله عز وجل به العباد, وقد كتبت إلى سائر الأمصار يخرجوا في يوم كذا وكذا في شهر كذا وكذا فمن كان عنده شيء فليتصدق به, فإن الله عز و جل قال: قد أفلح من تزكى وذكر اسم ربه فصلى ـ وقولوا كما قال آدم: ربنا ظلمنا أنفسنا وإن لم تغفر لنا وترحمنا لنكونن من الخاسرين ـ وقولوا كما قال نوح: وإلا تغفر لى وترحمني أكن من الخاسرين ـ وقولوا كما قال يونس: لا إله إلا أنت سبحانك إني كنت من الظالمين
“ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) সাফিয়্যাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে,উমার রা. এর যুগে মদীনায় ভূমিকম্প হয়েছিল। তখন তিনি বললেন: হে মানুষ! তোমরা কত তাড়াতাড়ি নতুন নতুন পাপ কার্য সৃষ্টি করে ফেললে! যদি আবার এমন ঘটে, তবে তোমরা আমাকে আর মদীনায় পাবে না।কা‘ব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:যখন পৃথিবীতে পাপ বাড়ে, তখনই ভূমিকম্প ঘটে। কারণ, পৃথিবী আল্লাহ্‌র ভয়ে কেঁপে ওঠে এই ভয়ে যে আল্লাহ্‌ তাআলা এসব পাপ দেখবেন। আর উমার ইবনু আব্দিল আজীজ বিভিন্ন প্রদেশে লিখে পাঠালেন: এ ভূকম্পন এমন এক বিষয়, যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের সতর্ক করেন ও তিরস্কার করেন। আমি সকল প্রদেশে লিখেছি, তারা যেন অমুক মাসের অমুক দিনে বাইরে বের হয় যার কাছে যা আছে, তা যেন সদকা করে। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ বলেন:”নিশ্চয় সে-ই সফল, যে নিজেকে পবিত্র করলো এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করলোও সালাত আদায় করলো।”তোমরা আদম (আ.)-এর মতো বলো:”হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব। নূহ (আ.)-এর মতো বলো:”আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।” ইউনুস (আ.)-এর মতো বলো:”আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আপনি পবিত্র। নিশ্চয় আমি ছিলাম জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।”(ইবনু ক্বাইয়িম, আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃষ্ঠা: ৪৭; মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২২১; গৃহীত; ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-৩৭১১৭৯)
.
কাতাদা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন: “إن الله يخوِّف الناس بما شاء من آياته لعلهم يعتبرون، أو يذَّكَّرون، أو يرجعون، ثم قال: ذُكِر لنا أن الكوفة رجفت على عهد ابن مسعود رضي الله عنه، فقال: يا أيها الناس، إن ربكم يستعتبكم فأعْتِبوه؛ أي: اطلبوا منه أن يُزِيل عَتَبَهُ، بترك الذنوب، والتوبة النصوح”আল্লাহ্‌ তাঁর ইচ্ছামতো বিভিন্ন নিদর্শনের মাধ্যমে মানুষকে ভয় দেখান যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করে, স্মরণ রাখে, অথবা ফিরে আসে (তওবা করে)।তিনি আরও বলেন:আমাদের কাছে বর্ণিত হয়েছে যে ইবনু মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর যুগে কুফা শহর কেঁপে উঠেছিল। তখন তিনি বললেন: ‘হে মানুষ! তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের থেকে ফিরে আসা (সংশোধন) চাইছেন; অতএব তোমরা তাঁর সন্তুষ্টি ফিরিয়ে আনো।’ অর্থাৎ, পাপ ত্যাগ করে এবং আন্তরিক তওবার মাধ্যমে তোমরা আল্লাহ্‌র অসন্তুষ্টি দূর করো।”(তাফসিরে তাবারী; খণ্ড: ১৭; পৃষ্ঠা: ৪৭৮)
.
সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকদের কাছে এরকম আরো অনেক ঘটনার বিবরণ রয়েছে।সুতরাং যখন কোথাও ভূমিকম্প সংগঠিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন মানুষদের উচিত মহান আল্লাহর নিকট অতি দ্রুত তওবা করা, তাঁর নিকট নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা এবং মহান আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা যেভাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূর্য গ্রহণ দেখলে বলতেন: “যদি তুমি এরকম কিছু দেখে থাক, তখন দ্রুততার সাথে মহান আল্লাহকে স্মরণ করো, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা। অতএব মুসলমানদের কর্তব্য হলো এ ধরনের (ভূমিকম্পের) নিদর্শন পতিত হলে তারা যেন দ্রুত তাওবার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার দিকে ফিরে আসে, আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট একমাত্র দ্বীন ইসলামকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরা এবং আল্লাহ তাআলা যেসব শিরকী কার্যকলাপ ও পাপ কাজ করতে নিষেধ করেছেন (যেমন: নামায পরিত্যাগ না করা, যাকাত আদায় করা থেকে বিরত না হওয়া, সুদ-ঘুষ না খাওয়া, মদ পান না করা, ব্যাভিচার না করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা না করা, গান ও বাদ্যযন্ত্র না শোনা, হারাম কাজ সমূহ ভঙ্গ না করা প্রভৃতি) তা থেকে বিরত থাকা।—এসবই আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার উপায়। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হলো: মানুষ যদি ঈমান ও তাকওয়া অবলম্বন করে, তাঁর বিধান প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে তিনি আসমান-যমীনের বরকত দান করেন; আর অমান্য করলে পাকড়াও করেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَاۤ اِلٰۤی اُمَمٍ مِّنۡ قَبۡلِكَ فَاَخَذۡنٰهُمۡ بِالۡبَاۡسَآءِ وَ الضَّرَّآءِ لَعَلَّهُمۡ یَتَضَرَّعُوۡنَ فَلَوۡلَاۤ اِذۡ جَآءَهُمۡ بَاۡسُنَا تَضَرَّعُوۡا وَ لٰكِنۡ قَسَتۡ قُلُوۡبُهُمۡ وَ زَیَّنَ لَهُمُ الشَّیۡطٰنُ مَا كَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ فَلَمَّا نَسُوۡا مَا ذُكِّرُوۡا بِهٖ فَتَحۡنَا عَلَیۡهِمۡ اَبۡوَابَ كُلِّ شَیۡءٍ ؕ حَتّٰۤی اِذَا فَرِحُوۡا بِمَاۤ اُوۡتُوۡۤا اَخَذۡنٰهُمۡ بَغۡتَۃً فَاِذَا هُمۡ مُّبۡلِسُوۡنَ“আর অবশ্যই আপনার আগে আমারা বহু জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি; অতঃপর তাদেরকে অর্থসংকট ও দুঃখ-কষ্ট দিয়ে পাকড়াও করেছি, যাতে তারা রোনাজারি করে। তাদের কাছে যখন আমার শাস্তি এসেছিল তখন তারা রোনাজারি করলো না কেন? বরং তাদের অন্তর কঠিন হয়েছিল এবং তারা যা করছিল শয়তান তা তাদের দৃষ্টিতে শোভাময় করেছিল। অতঃপর তাদেরকে যে উপদেশ করা হয়েছিল তারা যখন তা ভুলে গেল তখন আমরা তাদের জন্য প্রতিটি (আনন্দের) জিনিসের দরজা খুলে দিলাম। এভাবে তাদেরকে যা দেয়া হয়েছিল তারা যখন তা নিয়ে আনন্দিত তখন আমি অকস্মাৎ তাদেরকে পাকড়াও করি। তখনই তারা নিরাশ হয়ে যায়।”[সূরা আনআম, আয়াত: ৪২-৪৪] এ কারণে ফিকাহবিদ আলেমগণ ভূমিকম্পের সময় বেশি বেশি ইস্তিগফার করা, দোয়া করা, আল্লাহর কাছে রোনাজারি করা ও দান করাকে মুস্তাহাব বলেন। যেমনি ভাবে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময়ও এটি মুস্তাহাব।
.
আল্লামা যাকারিয়া আল-আনসারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: ويستحب لكل أحد أن يتضرع بالدعاء ونحوه عند الزلازل ونحوها من الصواعق والريح الشديدة، وأن يصلي في بيته منفردا لئلا يكون غافلا؛ لأنه صلى الله عليه وسلم كان إذا عصفت الريح قال: اللهم إني أسألك خيرها وخير ما فيها وخير ما أرسلت به، وأعوذ بك من شرها وشر ما فيها وشر ما أرسلت به. رواه مسلم”ভূমিকম্প, বজ্রপাত ও তীব্র বাতাসের সময় প্রত্যেকের জন্য মুস্তাহাব হলো: দোয়াতে মশগুল হয়ে রোনাজারি করা, ঘরে একাকী নামায আদায় করা; যাতে করে গাফেল না হয়। কেননা যখন তীব্র বাতাস বইতো তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন:اللَّهُمَّ إِنِّي أَسأَلك خَيرهَا وَخير مَا فِيهَا وَخير مَا أرْسلت بِهِ وَأَعُوذ بك من شَرها وَشر مَا فِيهَا وَشر مَا أرْسلت بِهِ “(হে আল্লাহ্‌! আমি আপনার কাছে এই বাতাসের কল্যাণ চাই, এর মধ্যে যে কল্যাণ আছে সেটা চাই এবং যে কল্যাণ দিয়ে এটাকে পাঠানো হয়ে তা চাই এবং আমি আপনার কাছে বাতাসের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই, এর মধ্যে যে অনিষ্ট অন্তর্ভুক্ত আছে তা থেকে আশ্রয় চাই এবং যে অনিষ্টসহ এটাকে পাঠানো হয়েছে তা থেকে আশ্রয় চাই)। (সহিহ মুসলিম; আসনাল মাতালিব শারহু রাওযুত তালিব; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৮৮; তুহফাতুল মুহতাজ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৬৫) আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী। আর আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর প্রতি শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার সময় আল্লাহু আকবার ও সুবহানাল্লাহ বলার বিধান

 প্রশ্ন: আমার ছোটবেলায়, আমার স্কুলে শেখানো হয়েছিল যে সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় আমাদের ‘আল্লাহু আকবার’ (আল্লাহ মহান) বলতে হবে এবং নিচে নামার সময় ‘সুবহানাল্লাহ’ (আল্লাহর মহিমা) বলতে হবে। আপনারা কি ব্যাখ্যা করতে পারেন যে ইসলামে এটি পালন করা উচিত কিনা?

উত্তর: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর রাসূলের ওপর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক। আল-বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন: “যখন আমরা উপরে উঠতাম, তখন তাকবীর (আল্লাহু আকবার) বলতাম এবং যখন আমরা নিচে নামতাম, তখন তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) বলতাম।”

আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন যে ইবনে উমর (রাঃ) তাঁকে শিখিয়েছিলেন যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কোনো সফরের উদ্দেশ্যে উটের পিঠে আরোহণ করতেন, তখন তিনি তিনবার তাকবীর বলতেন, তারপর বলতেন:

সুবহানাল্লাযী সাখ্খারা লানা হা-যা ওয়ামা কুন্না লাহু মুকরিনীন। ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লা মুনকালিবূন। আল্লাহুম্মা ইন্না নাস’আলুকা ফী সাফারিনা হা-যা আল-বিররা ওয়াত-তাক্বওয়া ওয়া মিনাল ‘আমালি মা তারদা, আল্লাহুম্মা হাওয়্যিন ‘আলাইনা সাফারানা হা-যা ওয়াত্ববি ‘আন্না বু’দাহু। আল্লাহুম্মা আনতা আস-সাহিবু ফিস-সাফারি ওয়াল-খালীয়ফাহু ফিল আহলি” (মহিমান্বিত তিনি, যিনি এটাকে আমাদের সেবায় নিয়োজিত করে দিয়েছেন, যখন আমরা নিজেরা এটাকে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলাম না, আর আমরা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালকের দিকে ফিরে যাব। হে আল্লাহ, আমরা তোমার কাছে আমাদের এই সফরে চাই নেক ও তাক্বওয়া এবং তোমার সন্তুষ্টিজনক কাজ। হে আল্লাহ, আমাদের এই সফর সহজ করে দাও এবং এর দূরত্ব আমাদের জন্য কমিয়ে দাও। হে আল্লাহ, তুমিই সফরে সঙ্গী এবং পরিবারের ওপর তত্ত্বাবধায়ক)।

আর যখন তিনি ফিরে আসতেন, তখন একই কথাগুলো বলতেন এবং এর সাথে যোগ করতেন:

আইয়িবূনা তায়িবূনা ‘আবিদূনা লি রাব্বিনা হামিদূন” (আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, অনুতপ্ত, ইবাদতকারী এবং আমাদের প্রতিপালকের প্রশংসাকারী)।

যখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর সেনাবাহিনী কোনো পাহাড়ের উপরে উঠতেন, তখন তাঁরা তাকবীর বলতেন এবং যখন নিচে নামতেন, তখন তাসবীহ বলতেন।

যেসব আলেমগণ মনে করেন যে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার ক্ষেত্রেও এটি মুস্তাহাব (প্রশংসিত), তাঁরা বলেন যে উপরে ওঠার সময় তাকবীর বলা উচিত এবং সিঁড়ি বা পাহাড়ে ওঠা একই জিনিস।

কিন্তু অন্যরা বলেন যে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময় তাকবীর বলা শরীয়তসম্মত নয়, কারণ এটি কেবল নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতেই বর্ণিত হয়েছে, যেমন ভ্রমণের সময় পাহাড় বা উঁচু স্থানে আরোহণ করা; সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার ক্ষেত্রে এমন কোনো বর্ণনা নেই, যদিও এটি তাঁদের মাঝে পরিচিত ছিল এবং তাঁরা তা করতেন (অর্থাৎ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতেন)। যদি এটি শরীয়তসম্মত হতো, তাহলে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হয়তো তা করতেন বা তাঁর সাহাবীদেরকে শিখিয়ে দিতেন, যেমন তিনি তাঁদেরকে ঘরে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়ের এবং অন্যান্য দৈনন্দিন যিকির শিখিয়েছিলেন।

এই বিষয়ে এটিই সবচেয়ে সঠিক মত।

শায়খ ইবনে উসাইমীন (রহিমাহুল্লাহ)-কে এই প্রশ্নটি করা হয়েছিল: হাদীসে আছে যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কোনো পাহাড়ে উঠতেন, তখন তাকবীর বলতেন এবং যখন কোনো উপত্যকায় নামতেন, তখন তাসবীহ বলতেন। এই তাকবীর ও তাসবীহ কি শুধু সফরের সময় প্রযোজ্য, নাকি তিনি – উদাহরণস্বরূপ – বাড়িতে দোতলা বা তিনতলায় ওঠার সময়ও তাকবীর বলতেন? আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।

তিনি উত্তর দেন:

তাঁর সফরের সময়, যখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোনো পাহাড়ে উঠতেন, তখন তাকবীর বলতেন এবং যখন কোনো উপত্যকায় নামতেন, তখন তাসবীহ বলতেন। এর কারণ হলো, যে ব্যক্তি উপরে থাকে সে অহংকারী বোধ করতে পারে এবং নিজেকে মহান ভাবতে পারে, তাই তাঁর জন্য ‘আল্লাহু আকবার’ বলে আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করা উপযুক্ত। আর যখন সে নিচে নামে, তখন সে নিম্ন স্তরে যাচ্ছে, তাই নিচে নামার সময় তাঁর জন্য আল্লাহর মহিমা কীর্তন করা উপযুক্ত। তাকবীর এবং তাসবীহ বলার প্রেক্ষাপট এটাই।

কিন্তু সুন্নাহতে সফরের বাইরে এমনটি করার কোনো বর্ণনা নেই। ইবাদতসমূহ ‘তাওক্বীফ’-এর (বর্ণিত বিষয়ের উপর সীমাবদ্ধ) উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, অর্থাৎ সেগুলোর প্রমাণ সহীহ বর্ণনার দ্বারা সীমাবদ্ধ। এর উপর ভিত্তি করে, যখন কোনো ব্যক্তি তার বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠে, তখন তাকে তাকবীর বলতে হবে না, এবং যখন সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে, তখন তাকে তাসবীহ বলতে হবে না। বরং তা শুধুমাত্র ভ্রমণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

লিক্বা’আত আল-বাব আল-মাফতুহ থেকে সমাপ্ত।

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব (IslamQA.info) ইংরেজি প্রশ্ন নং: ১৬৪৩৪০

https://islamqa.info/en/answers/164340/remembering-allah-when-climbing-and-descending-stairs

▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: আসাদ জামান।

ভূমিকম্প কিংবা আগুন সংঘটিত হলে সালাত ছেড়ে দেয়ার হুকুম কি

 পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর ভূমিকম্প,আগুন কিংবা অন্য যেকোন সমস্যার কারণে নামায ছেড়ে দেয়ার দুটি অবস্থা হতে পারে।

▪️প্রথম অবস্থা: যদি সালাতটি নফল (ঐচ্ছিক) সালাত হয়, তবে বিষয়টি সহজ। কারণ ওজর (বৈধ কারণ) ছাড়াই নফল সালাত ভেঙে দেওয়া জায়েজ, সুতরাং ওজর থাকলে তো তা আরও বেশি জায়েজ হবে। এটি হলো শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের মত এবং এটাই বিশুদ্ধ মত। এর প্রমাণ হলো: উম্মুল মু’মিনীন আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, একদিন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন। তিনি বললেন, তোমার কাছে কী (খাবার) কিছু আছে? আমি বললাম, না (কিছুতো নেই)। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তাহলে আমি (আজ) সিয়াম পালন করবো! এরপর আর একদিন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার কাছে এলেন। (জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে কী খাবার কিছু আছে?) আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের জন্য ‘হায়স’ হাদিয়্যাহ্ এসেছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আনো, আমাকে দেখাও। আমি সকাল থেকে সওম রেখেছি। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ‘হায়স’ খেয়ে নিলেন।”(সহীহ মুসলিম হা/১১৫৪, তিরমিযী হা/ ৭৩৩, নাসায়ী হা/২৩২৭,সহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/২১৪৩)
.
​আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ গ্রন্থে এসেছে:” أما قطع التطوع بعد الشروع فيه فقد اختلف الفقهاء في حكمه فقال الحنفية والمالكية: لا يجوز قطعه بعد الشروع بلا عذر كالفرض ويجب إتمامه؛ لأنه عبادة.وقال الشافعية والحنابلة: يجوز قطع التطوع، عدا الحج والعمرة، لحديث ( المتنفل أمير نفسه ) – أخرجه الترمذي من حديث أم هانئ بلفظ: ( الصائم أمير أو أمين نفسه ) -، ولكن يستحب إتمامه .أما الحج والعمرة فيجب إتمامهما، وإن فسدا إذا شرع فيهما، لأن نفلهما كفرضهما“নফল (ঐচ্ছিক) ইবাদত শুরু করার পর তা ভেঙে দেওয়ার বিধান সম্পর্কে ফকীহদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। হানাফি ও মালিকি ফকীহগণ বলেন:নফল ইবাদত শুরু করার পর কোনো ওজর (উপযুক্ত কারণ) ছাড়া তা ভঙ্গ করা বৈধ নয়; বরং ফরজ ইবাদতের মতোই তা সম্পন্ন করা আবশ্যক,কারণ এটিও একটি ইবাদত। অন্যদিকে শাফেয়ী ও হাম্বলী ফকীহগণ বলেন:হজ্ব ও ওমরাহ ছাড়া অন্যান্য নফল ইবাদত শুরু করার পর তা ভেঙে দেওয়া বৈধ। এ মতের প্রমাণ হলো রাসূল (ﷺ)-এর হাদীস: “(নফলকারীর) নিজের ব্যাপারে সে নিজেই আমির (নিজ সিদ্ধান্তের অধিকারী)”ইমাম তিরমিযী উম্মে হানী (রাঃ) থেকে “নফল রোযা পালনকারী নিজের আমানাতদার।’—এ শব্দে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।” (তিরমিযী হা/৭৩১) তবে নফল ইবাদত সম্পন্ন করে ফেলা উত্তম (মুস্তাহাব)।কিন্তু হজ্ব ও ওমরাহর ক্ষেত্রে বিধান ব্যতিক্রম;কারণ—এই দুটিতে (নফলও হোক, ফরজও হোক) একবার ইহরাম বেঁধে শুরু করলে তা নষ্ট হয়ে গেলেও সম্পন্ন করা ওয়াজিব; কেননা নফল হজ-ওমরাহর বিধানও ফরজের মতোই।”
(আল-মাউসু’আতুল-ফিকহিয়্যাহ; খণ্ড: ৩৪; পৃষ্ঠা;৫১)
.
▪️দ্বিতীয় অবস্থা: যদি সালাতটি ফরজ সালাত হয় তাহলে মূলনীতি হলো, যে ব্যক্তি ফরজ সালাত শুরু করেছে, কোনো বৈধ ওজর ছাড়া তার জন্য তা ভেঙে দেওয়া জায়েজ নয়। সুতরাং ফরজ সালাত আদায়ের সময় যদি অপ্রত্যাশিতভাবে ভূমিকম্প, অগ্নিসংযোগ বা অনুরূপ কোনো মারাত্মক দুর্যোগ শুরু হয় এবং মুসল্লির দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, এ দুর্ঘটনাতে সে আক্রান্ত হবে এবং ওই স্থান ত্যাগ করলে তিনি নিশ্চিত বিপদ থেকে রক্ষা পাবেন, তবে আত্মরক্ষার জন্য সালাত ভেঙে দেওয়া এবং দ্রুত স্থান ত্যাগ করা তাঁর কর্তব্য। এই পরিস্থিতিতে তিনি পরিবেশ ও বিপদ বিবেচনা করে, নিরাপদ স্থানে গিয়ে পরবর্তীতে তাঁর অসম্পূর্ণ সালাত পূর্ণ করবেন অথবা ছেড়ে দেবেন। তার যদি ধারণা হয় যে, সালাতের স্থানে থাকলে তার মৃত্যু হবে সেক্ষেত্রে তার জন্য সেখানে অবস্থান করা জায়েয হবে না। যদি থেকে যায় তাহলে সে যেন নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করল। তদ্রূপ অন্য কাউকে মৃত্যু থেকে বাঁচানোর জন্য নামায ছেড়ে দেয়াও তার উপর আবশ্যক; যেমন পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে, আগুনে পুড়ে যাওয়া থেকে কিংবা কূপে পড়ে যাওয়া থেকে। এ বিষয়ের মূল দলিল হল আল্লাহ্‌ তাআলার বাণী:وَلا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ “তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না। আর ভাল কাজ করো; যারা ভাল কাজ করে আল্লাহ্‌ তাদেরকেই ভালোবাসেন।”(সূরা বাক্বারা: ১৯২) এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: لَا ضَرَرَ وَلا ضِرَارَ “নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া কিংবা অন্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করা নয়”।(মুসনাদে আহমাদ ও সুনানে ইবনে মাজাহ হা/২৩৪১) এবং আলবানী হাদিসটিকে ‘সহিহ ইবনে মাজাহ’ গ্রন্থে সহিহ বলেছেন)
.
আল-মাউসু’আ আল-ফিকহিয়্যা আল-কুয়েতিয়্যা’ গ্রন্থে এসেছে:” قطع العبادة الواجبة بعد الشروع فيها ، بلا مسوغ شرعي : غير جائز باتفاق الفقهاء، لأن قطعها بلا مسوغ شرعي عبث يتنافى مع حرمة العبادة ، وورد النهي عن إفساد العبادة، قال تعالى: ( وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ ) . أما قطعها بمسوغ شرعي : فمشروع، فتقطع الصلاة لقتل حية ونحوها ، للأمر بقتلها، وخوف ضياع مال له قيمة ، له أو لغيره، ولإغاثة ملهوف، وتنبيه غافل أو نائم قصدت إليه نحو حية، ولا يمكن تنبيهه بتسبيح، ويقطع الصوم لإنقاذ غريق، وخوف على نفس، أو رضيع”ফকীহগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো যে—শার’ঈ কোনো ওজর ছাড়া শুরু করার পর কোনো ওয়াজিব ইবাদত ভঙ্গ করা বৈধ নয়। কারণ শার’ঈ ওজর ছাড়া ইবাদত ভেঙে ফেলা ইবাদতের মর্যাদা ও পবিত্রতার পরিপন্থী একটি অনর্থক কাজ; আর ইবাদত নষ্ট করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:“তোমরা নিজেদের আমলসমূহ বিনষ্ট করে দিও না।” (সূরা মুহাম্মদ: ৩৩) তবে যদি কোনো শার’ঈ কারণ উপস্থিত থাকে তবে ইবাদত ভেঙে দেওয়া বৈধ। যেমন সালাতে থাকা অবস্থায় সাপ–বিচ্ছু ইত্যাদি মেরে ফেলার প্রয়োজন হলে সালাত ভাঙা বৈধ; কারণ এ ধরনের ক্ষতিকর প্রাণী হত্যা করার নির্দেশ রয়েছে।তদ্রূপ, নিজের অথবা অন্য কারো মূল্যবান সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে, কিংবা কোনো বিপদগ্রস্থ ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে হলে, অথবা কোনো অসচেতন বা ঘুমন্ত ব্যক্তিকে সাপ-বিচ্ছুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখে তাকে সতর্ক করা প্রয়োজন হলে এবং কেবল তাসবীহ পড়া দ্বারা তাকে সতর্ক করা সম্ভব না হলে এ অবস্থায় সালাত ভেঙে সতর্ক করা বৈধ। একইভাবে, ডুবন্ত ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন্য, নিজের জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কারণে, অথবা শিশুর হিফাযতের স্বার্থে রোজা ভেঙে দেওয়া বৈধ।”(আল-মাউসু‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খণ্ড: ৩৪; পৃষ্ঠা: ৫১)
.
ইমাম আল-বাহূতী (রাহিমাহুল্লাহ) কাশশাফুল ক্বিনা গ্রন্থে বলেন:
“(ويجب رد كافر ، معصوم) بذمة أو هدنة أو أمان ، (عن بئر ونحوه) ، كحية تقصده (كـ) رد (مسلم) عن ذلك ، بجامع العصمة .(و) يجب (إنقاذ غريق ونحوه) ، كحريق ؛ (فيقطع الصلاة لذلك) ، فرضا كانت أو نفلا، وظاهره: ولو ضاق وقتها، لأنه يمكن تداركها بالقضاء، بخلاف الغريق ونحوه .(فإن أبى قطعها) ، أي الصلاة ، لإنقاذ الغريق ونحوه : أثم ، و(صحت) صلاته ، كالصلاة في عمامة حرير”
“যে কাফেরের জান নিরাপদ—যিম্মী হওয়ার কারণে, কিংবা চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কারণে কিংবা নিরাপত্তা দেয়ার কারণে তাকে কূপ ও এ জাতীয় অন্য কিছুতে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা আবশ্যক। যেমন কোন সাপ যদি তার উপর আক্রমণ করে। যেমনিভাবে কোন মুসলিমকে এসব থেকে রক্ষা করা আবশ্যক। যেহেতু উভয় প্রাণই মাসুম (নিরাপত্তাপ্রাপ্ত)। পানিতে ডুবে যাচ্ছে কিংবা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে এমন ব্যক্তিকে রক্ষা করা আবশ্যক। এর জন্য সালাত ছেড়ে দিতে হবে; সেটা ফরয সালাত হোক কিংবা নফল নামায হোক। এর প্রত্যক্ষ মর্ম হল: এমনকি যদি ওয়াক্ত একেবারে সংকীর্ণ হয়ে যায় তবুও। যেহেতু কাযা পালন করার মাধ্যমে সালাতের প্রতিকার করার সুযোগ আছে। কিন্তু পানিতে পড়ে যাওয়া ব্যক্তি কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। যদি পানিতে পড়া ব্যক্তি বা এ জাতীয় অন্য দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন্য সালাত ছেড়ে না দেয় তাহলে সে গুনাহগার হবে। তবে তার সালাত সহিহ হবে; যেমনিভাবে রেশমের পাগড়ী পরে সালাত পড়লেও সালাত শুদ্ধ হয়।”(কাশশাফুল ক্বিনা; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৮০)
.
ইবনে রজব হাম্বলি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
وقال قتادة: إن أُخذ ثُوبه : يتبع السارقَ ، ويدع الصلاة. وروى عبد الرزاق في (كتابه)، عن معمر، عن الحسن وقتادة :في رجل كان يصلي، فأشفق أن تذهب دابته ، أو أغار عليها السبع؟ قالا: ينصرف .وعن معمر، عن قتادة، قالَ: سألته، قلت: الرجل يصلي، فيرى صبياً على بئر، يتخوف أن يسقط فيها، أفينصرف؟ قال: نعم. قلت: فيرى سارقاً يريد أن يأخذ نعليه؟ قال: ينصرف .
ومذهب سفيان: إذا عرض الشيء المتفاقم، والرجل في الصلاة : ينصرف إليه . رواه عنه المعافى . وكذلك إن خشي على ماشيته السيل، أو على دابته .ومذهب مالك: من انفلتت دابته وهو يصلي؛ مشى فيما قرب، إن كانت بين يديه، أو عن يمينه أو عن يساره، وإن بعدت: طلبها، وقطع الصَّلاة. ومذهب أصحابنا: لو رأى غريقاً، أو حريقاً، أو صبيين يقتتلان، ونحو ذلك، وهو يقدر على إزالته: قطع الصلاة وأزاله .ومنهم من قيده بالنافلة. والأصح: أنه يعم الفرض وغيره. وقال أحمد – فيمن كان يلازم غريماً له، فدخلا في الصلاة، ثم فر الغريم وهو في الصلاة -: يخرج في طلبه. وقال أحمد – أيضا -: إذا رأى صبياً يقع في بئر، يقطع صلاته ويأخذه . قال بعض أصحابنا: إنما يقطع صلاته إذا احتاج إلى عمل كثير في أخذه، فإن كان العمل يسيراً لم تبطل به الصلاة. وكذا قال أبو بكر ، في الذي خرج وراء غريمه ؛ أنه يعود ، ويبني على صلاته. وحمله القاضي على أنه كان يسيراً. ويحتمل أن يقال: هو خائف على ماله، فيغتفر عمله، وإن كثر”
“ক্বাতাদাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন: যদি কেউ তার কাপড় নিয়ে যায় তাহলে সে সালাত ছেড়ে দিয়ে চোরের পিছু নিবে। আব্দুর রাজ্জাক তাঁর কিতাবে মা’মার থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি হাসান ও কাতাদা থেকে বর্ণনা করেছেন যে: এক ব্যক্তি সালাত পড়ছিল। এর মধ্যে সে তার পশুটি ছুটে চলে যাওয়ার আশংকা করলো কিংবা কোন হিংস্র জানোয়ার তার উপর আক্রমণ করার আশংকা করলো? তারা উভয়ে বলেন: সে সালাত ছেড়ে দিবে। মা’মার থেকে বর্ণিত আছে, তিনি কাতাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন: জনৈক লোক নামায পড়ছে। এর মধ্যে সে দেখতে পেল যে, একটি বাচ্চা কূপের ধারে। আশংকা হচ্ছে বাচ্চাটি কূপের মধ্যে পড়ে যাবে। সে কি সালাত ছেড়ে দিবে? তিনি বললেন: হ্যাঁ। আমি বললাম: কেউ দেখল যে, চোর তার জুতাজোড়া নিয়ে যাচ্ছে? তিনি বললেন: সালাত ছেড়ে দিবে। সুফিয়ানের মাযহাব হচ্ছে: কোন ব্যক্তি সালাতে থাকাবস্থায় যদি বিপদজনক কিছুর সম্মুখীন হোন তাহলে তিনি সালাত ছেড়ে দিবেন। এটি মুআফি তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন। অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য হবে যদি কেউ নিজের পশুপাল বা আরোহণের পশু পানির ঢলের শিকার হওয়ার আশংকা করেন। ইমাম মালেকের মাযহাব হচ্ছে: যে ব্যক্তি সালাতরত অবস্থায় তার আরোহণের পশু ছুটে গেছে; যদি তার কাছাকাছি হয় সামনের দিকে হোক, ডানে হোক বা বামে হোক সে তার দিকে হেঁটে যাবে। আর যদি দূরে হয় তাহলে সালাত ছেড়ে দিয়ে পশুর সন্ধান করবে। আমাদের মাযহাবের আলেমদের অভিমত হচ্ছে: যদি কোন লোককে ডুবে যেতে দেখে কিংবা পুড়ে যেতে দেখে কিংবা দুই বালককে মারামারি করতে দেখে ইত্যাদি এবং তার এ অনিষ্ট দূর করার সক্ষমতা থাকে তাহলে সে সালাত ছেড়ে দিবে এবং এ অনিষ্ট দূর করবে। কোন কোন আলেম এটাকে নফল সালাতের সাথে বিশিষ্ট করেছেন। সর্বাধিক সঠিক অভিমত হচ্ছে: এটি নির্বিশেষে ফরয সালাত ও অন্যান্য সালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইমাম আহমাদ বলেন: যে ব্যক্তি তার ঋণপ্রাপ্য ব্যক্তিকে অনুসরণ করেন, তারা উভয়ে সালাত শুরু করল, একটু পরে সে ব্যক্তি সালাতে থাকাবস্থায় ঋণী লোকটি পালিয়ে যেতে লাগল: তখন ঋণী লোকটিকে ধরার জন্য তিনি সালাত থেকে বেরিয়ে যাবেন। ইমাম আহমাদ আরও বলেন: যদি কেউ কোন বাচ্চাকে কূপে পড়ে যেতে দেখে তখন সালাত ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাটিকে বাঁচাবে। আমাদের কোন কোন আলেম বলেছেন: যদি বাচ্চাটিকে বাঁচাতে গিয়ে আমলে কাছির (অনেক কাজ) করতে হয় তাহলে সেক্ষেত্রে সালাত কর্তন করবে। আর যদি অল্পতে বাঁচানো যায় তাহলে এতে করে তার সালাত বাতিল হবে না। আবু বকর একই ধরণের কথা ঋণপ্রাপ্য ব্যক্তির অনুসরণে যে ব্যক্তি বেরিয়েছে তার ব্যাপারে বলেছেন যে, সে ব্যক্তি ফিরে এসে অবশিষ্ট সালাত পূর্ণ করবে। কাযী এ অভিমতকে এ অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন যে, যদি সেটা অল্প কর্ম হয়। এমন একটি ব্যাখ্যাও করা যেতে পারে যে: সে তার সম্পদের ব্যাপারে আতংকিত। তাই তার সে কর্ম অধিক হলেও সেটি মার্জনীয়।”(ইবনে রজব ‘ফাতহুল বারী’; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ৩৩৬-৩৩৭)
.
পরিশেষে, উপর্যুক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, কোনো ব্যক্তি যদি নিজের জীবননাশের আশঙ্কা করেন বা এমন কারো জীবন হুমকির মুখে পড়ে যাকে তিনি বাস্তবিকভাবে রক্ষা করতে সক্ষম তাহলে তার জন্য সালাত চালিয়ে যাওয়া বৈধ নয়। এ বিধান ফরজ সালাত হোক বা নফল উভয়ের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। অতএব এ পরিস্থিতিতে সালাত অব্যাহত রাখলে তিনি গুনাহগার হবেন। আর যদি সালাত চালিয়ে যাওয়ার কারণে তিনি নিজে মৃত্যুবরণ করেন বা আহত হন তবে তিনি নিজেকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছেন বলে গণ্য হবেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩২৬০৭০)
▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

যদি কোন ব্যক্তি সুদকে হালাল মনে করে তাহলে শরিয়তে তার বিধান কী

 ভূমিকা:পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর ইসলামে সুদ সম্পূর্ণরূপে হারাম—এ বিষয়টি কুরআন, সহীহ হাদীস এবং উম্মাহর সর্বসম্মত মত (ইজমা‘) দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। অতএব, কেউ যদি ইজমার ভিত্তিতে সাব্যস্ত সুদের এই হারাম হওয়াকে অস্বীকার করে বা সুদকে হালাল মনে করে, তবে সে গুরুতর ভ্রান্তিতে পতিত হবে এবং ইসলামের দৃষ্টিতে কাফির গণ্য হবে।কারণ মূলনীতি হলো: যে ব্যক্তি এমন কোনো স্বীকৃত বিষয় অস্বীকার করে, যার ওপর উলামাদের স্পষ্ট ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—সে ব্যক্তি ইসলামের পরিসীমার বাইরে চলে যায়।

.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:إن الإيمان بوجوب الواجبات الظاهرة المتواترة ، وتحريم المحرمات الظاهرة المتواترة هو من أعظم أصول الإيمان ، وقواعد الدين ، والجاحد لها كافر بالاتفاق”নিশ্চিতভাবে সুপ্রমাণিত (মুতাওয়াতির) প্রকাশ্য ফরজ কাজগুলো আবশ্যিক বলে বিশ্বাস করা, এবং নিশ্চিতভাবে সুপ্রমাণিত (মুতাওয়াতির) প্রকাশ্য হারাম কাজগুলো নিষিদ্ধ বলে বিশ্বাস করা হলো ঈমানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভিত্তি এবং দ্বীনের মূলনীতিসমূহের অন্যতম। আর যে ব্যক্তি এগুলোকে অস্বীকার করে, সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফের (অবিশ্বাসী)।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ৪৯৭)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন:ومن اعتقد حل شيء أجمع على تحريمه وظهر حكمه بين المسلمين وزالت الشبهة فيه للنصوص الواردة فيه كلحم الخنزير والزنى وأشباه ذلك مما لا خلاف فيه كَفَر “যে এমন কোনো জিনিসকে হালাল মনে করে, যার হারাম হওয়ায় উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং মুসলিমদের মধ্যে যার হুকুম স্পষ্টভাবে প্রচলিত, যার ব্যাপারে কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট দলিলের কারণে কোনো সন্দেহ-সংশয় অবশিষ্ট নেই যেমন শূকরের মাংস, ব্যভিচার এবং এ ধরনের যেসব বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই সে কাফের।”(ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী, খন্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ২৭৬)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:
فَأَمَّا الْيَوْم وَقَدْ شَاعَ دِينُ الْإِسْلَام وَاسْتَفَاضَ فِي الْمُسْلِمِينَ عِلْمُ وُجُوب الزَّكَاة حَتَّى عَرَفَهَا الْخَاصّ وَالْعَامّ , وَاشْتَرَكَ فِيهِ الْعَالِم وَالْجَاهِل , فَلَا يُعْذَر أَحَد بِتَأْوِيلِ يَتَأَوَّلهُ فِي إِنْكَارهَا . وَكَذَلِكَ الْأَمْر فِي كُلّ مَنْ أَنْكَرَ شَيْئًا مِمَّا أَجْمَعَتْ الْأُمَّة عَلَيْهِ مِنْ أُمُور الدِّين إِذَا كَانَ عِلْمه مُنْتَشِرًا كَالصَّلَوَاتِ الْخَمْس وَصَوْم شَهْر رَمَضَان وَالاغْتِسَال مِنْ الْجَنَابَة وَتَحْرِيم الزِّنَا وَالْخَمْر وَنِكَاح ذَوَات الْمَحَارِم وَنَحْوهَا مِنْ الْأَحْكَام إِلَّا أَنْ يَكُون رَجُلًا حَدِيث عَهْدٍ بِالْإِسْلَامِ وَلَا يَعْرِف حُدُوده فَإِنَّهُ إِذَا أَنْكَرَ شَيْئًا مِنْهَا جَهْلًا بِهِ لَمْ يَكْفُر . . . فَأَمَّا مَا كَانَ الْإِجْمَاع فِيهِ مَعْلُومًا مِنْ طَرِيق عِلْم الْخَاصَّة كَتَحْرِيمِ نِكَاح الْمَرْأَة عَلَى عَمَّتهَا وَخَالَتهَا , وَأَنَّ الْقَاتِل عَمْدًا لَا يَرِث وَأَنَّ لِلْجَدَّةِ السُّدُس , وَمَا أَشْبَهَ ذَلِكَ مِنْ الْأَحْكَام فَإِنَّ مَنْ أَنْكَرَهَا لا يَكْفُر , بَلْ يُعْذَر فِيهَا لِعَدَمِ اِسْتِفَاضَة عِلْمهَا فِي الْعَامَّة”
“কিন্তু বর্তমানে, যখন ইসলামের দীন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মুসলমানদের মধ্যে যাকাতের আবশ্যকতা সংক্রান্ত জ্ঞান এতোটা প্রচলিত হয়েছে যে,তা আলেমদের মতো সাধারণ লোকও তা জানে,আর শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলের মধ্যেই এর জ্ঞান বিদ্যমান, তখন কেউ যদি যাকাত অস্বীকার করে, তবে তার ভ্রান্ত ব্যাখ্যার (তা’বীল-এর) অজুহাতে তাকে ক্ষমা করা হবে না।আর ঠিক একই বিধান প্রযোজ্য হবে সেইসব ক্ষেত্রে, যা দীনের এমন বিষয় যার উপর উম্মাহর ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত এবং যার জ্ঞান মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। যেমন: পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রমযান মাসের সিয়াম (রোজা),জানাবাত (নাপাকি) থেকে গোসল, যিনা (ব্যভিচার) ও মদ হারাম হওয়া, মাহরাম (রক্ত সম্পর্কীয়) নারীর সাথে বিবাহ হারাম হওয়া এবং এ ধরনের অন্যান্য বিধান। যদি কেউ এগুলো অস্বীকার করে, তবে সে কাফের গণ্য হবে।তবে, যদি কোনো ব্যক্তি সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণ করে এবং সে ইসলামের বিধানাবলী সম্পর্কে অবহিত না থাকে, তবে অজ্ঞতার কারণে সে যদি এর কোনো একটি অস্বীকার করে, তবে সে কাফের হবে না…কিন্তু যেসব বিষয়ে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অথচ সেই ইজমার জ্ঞান শুধুমাত্র নির্দিষ্ট আলিমদের মাধ্যমেই জানা যায় (অর্থাৎ,সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত নয়), যেমন: কোনো নারীকে তার ফুফু বা খালার উপরে বিবাহ করা হারাম হওয়া,ইচ্ছাকৃত হত্যাকারী উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া; এবং দাদি (বা নানি)-এর জন্য সুদুস (এক-ষষ্ঠাংশ) অংশ নির্ধারিত হওয়া—এরকম অন্যান্য বিধানাবলী যদি কেউ অস্বীকার করে, তবে সে কাফির হবে না। বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে এর জ্ঞান ব্যাপকভাবে প্রচলিত না হওয়ার কারণে এক্ষেত্রে তার ওজর গ্রহণযোগ্য হবে।”(ইসলাম সাওয়াল জবাব ফাতওয়া নং-২২৩৩৯)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
حكم الربا : أنه محرم بالقرآن والسنة وإجماع المسلمين. ومرتبته : أنه من كبائر الذنوب ؛ لأن الله تعالى قال : (ومن عاد فأولئك أصحاب النار هم فيها خالدون) ، وقال تعالى : (فإن لم تفعلوا فأذنوا بحرب من الله ورسوله) ؛ ولأن الرسول صلى الله عليه وسلم ” لعن آكل الربا وموكله وشاهديه وكاتبه ” فهو من أعظم الكبائر. وهو مجمع على تحريمه ، ولهذا من أنكر تحريمه ممن عاش في بيئة مسلمة فإنه مرتد ؛ لأن هذا من المحرمات الظاهرة المجمع عليها.ولكن إذا قلنا هذا ، هل معناه أن العلماء أجمعوا على كل صورة ؟ الجواب : لا ، فقد وقع خلاف في بعض الصور ، وهذا مثل ما قلنا في أن الزكاة واجبة بالإجماع ، ومع ذلك ليس الإجماع على كل صورة ، فاختلفوا في الإبل والبقر العوامل ( التي تستخدم في الحرث والسقي ) ، واختلفوا في الحلي وما أشبه ذلك ، لكن في الجملة العلماء مجمعون على أن الربا حرام بل من كبائر الذنوب )
“রিবার (সুদ) বিধান: এর হুকুম হলো এটি কুরআন, সুন্নাহ এবং মুসলিমদের ঐকমত্য (ইজমা) দ্বারা হারাম।এর অপরাধের স্তর হলো এটি কবীরা গুনাহসমূহের (বড় গুনাহ) অন্তর্ভুক্ত। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন:”…আর যে পুনরায় তা করবে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী থাকবে।” এবং তিনি (আল্লাহ) আরো বলেছেন:”যদি তোমরা তা না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা জেনে রাখো।”আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘সুদখোর, সুদদাতা, এর সাক্ষীদ্বয় এবং এর লেখক সবার ওপর লা‘নত (অভিসম্পাত) করেছেন।’ সুতরাং এটি সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহসমূহের অন্যতম।রিবার হারাম হওয়াতে সর্বসম্মত ঐকমত্য (ইজমা) রয়েছে। এ কারণেই যে ব্যক্তি মুসলিম পরিবেশে বসবাস করেও রিবার হারাম হওয়াকে অস্বীকার করে, সে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) বলে গণ্য হবে। কারণ এটি এমন প্রকাশ্য হারাম বিষয়গুলোর অন্যতম, যার ওপর উম্মাহর ইজমা রয়েছে।তবে আমরা যখন এ কথা বলি, এর অর্থ কি এই যে উলামারা রিবার প্রতিটি স্বতন্ত্র রূপ (ছবি) সম্পর্কে সর্বসম্মত? উত্তর হলো: না। কিছু কিছু রূপ নিয়ে মতভেদ হয়েছে। এটি সেই উদাহরণের মতো, যেখানে আমরা বলি যাকাত ওয়াজিব (ফরজ) হওয়াতে ইজমা রয়েছে, কিন্তু সব বিস্তারিত বিষয়ে ঐকমত্য নেই। যেমন: উলামারা হালচাষ ও পানি সেচের কাজে ব্যবহৃত উট ও গরু (যাকে ‘আওয়ামিল’ বলা হয়) এবং গয়না (হুলী) ইত্যাদির ওপর যাকাত আছে কি না, সে বিষয়ে মতভেদ করেছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে উলামারা সর্বসম্মত যে রিবা হারাম, বরং তা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।”(ইমাম ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি, খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৩৮৭)
.
অতএব উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, যে ব্যক্তি রিবা (সুদ) হারাম—এই প্রতিষ্ঠিত বিধানকে অস্বীকার করবে, সে কুফরির মধ্যে পড়বে; কারণ রিবার নিষিদ্ধতা সম্পর্কে কোরআন ও সহীহ হাদিসে বহু স্পষ্ট, চূড়ান্ত দলিল রয়েছে এবং এ বিষয়ে উলামাদের সুপরিচিত ও অবিচল সর্বসম্মত ঐক্যমত্যও প্রতিষ্ঠিত।কিন্তু কেউ যদি রিবার এমন কোনো ধরন বা শাখার নিষিদ্ধতাকে অস্বীকার করে, যা নিয়ে উলামাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে অথবা যার হারাম হওয়া বিষয়ে স্পষ্ট ইজমা প্রমাণিত নয়—তাহলে তাকে কাফির গণ্য করা হবে না। বরং তার অবস্থার দিকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা হবে:যদি সে ইজতিহাদকারী হয়, তবে তার ইজতিহাদের জন্য সে সওয়াব পেতে পারে;যদি সে অজ্ঞতার কারণে ভুল করে থাকে, তবে তা ক্ষমাযোগ্য হতে পারে;আর যদি সে নফসের খেয়াল-খুশির অনুসরণে এটিকে হালাল বলে মনে করে, তবে সে ফাসিক (পাপাচারী) হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। আর আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর প্রতি শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন। আমীন!!
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

Translate