Friday, January 10, 2025

রজব মাস সম্পর্কিত কতিপয় জাল ও জঈফ হাদিস

 রজব মাস সম্পর্কে আমাদের সমাজে লোকমুখে, ইন্টারনেটে বা বিভিন্ন ইসলামিক বই-পুস্তকে অনেক হাদিস প্রচলিত রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে কিছু হাদিস মুহাদ্দিসদের মানদণ্ডে সহিহ নয় আর কিছু হাদিস এমন রয়েছে যেগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।

এ ধরণের কতিপয় হাদিস সম্পর্কে নিম্নে পর্যালোচনা পেশ করা হলো:

🚫 ক. রজব মাস সম্পর্কে কয়েকটি দুর্বল হাদিস:

● ১. “জান্নাতে একটি নহর আছে যাকে বলা হয় রজব। যার পানি দুধের চেয়ে সাদা, মধুর চেয়েও মিষ্টি। যে ব্যক্তি রজব মাসে একদিন রোজা রাখবে তাকে সেই নহরের পানি পান করতে দেয়া হবে।”

ইবনে হাজার রহ. বলেন, হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, আবুল কাসেম আত তাইমী তার আত তারগীব ওয়াত তারহীব কিতাবে, হাফেয আসপাহানী ফাযলুস সিয়াম কিতাবে, বাইহাকী, ফাযায়েলুল আওকাত কিতাবে, ইবনে শাহীন আত তারগীব ওয়াত তারহীব কিতাবে।

এ হাদিসটি দুর্বল। ইবনুল জাওযী ইলালুল মুতানাহিয়া গ্রন্থে বলেন, এ হাদিসের বর্ণনা সূত্রে একাধিক অজ্ঞাত রাবি রয়েছে। তাই এ হাদিসের সনদ দুর্বল। তবে বানোয়াট বলার মত পরিস্থিতি নেই। এর আরও কয়েকটি সূত্র রয়েছে কিন্তু সেগুলোতেও একাধিক অজ্ঞাত বর্ণনাকারী রয়েছে। [দ্রষ্টব্য: তাবয়ীনুল আজাব (পৃষ্ঠা নং ৯, ১০ ও ১১), আল ইলালুল মুতানাহিয়া, (২য় খণ্ড, ৬৫ পৃষ্ঠা)।]

● ২. “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শাবানা ও বাল্লিগনা রমজান।”

“হে আল্লাহ তুমি রজব ও শাবানে আমাদেরকে বরকত দাও। আর আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও।” [মুসনাদ আহমাদ ১/২৫৯]

হাদিসটি দুর্বল।

এ হাদিসের সনদে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যার নাম যায়েদাহ বিন আবুর রিকাদ। তার ব্যাপারে ইমাম বুখারী রহ. বলেন, মুনকারুল হাদিস। ইমাম নাসাঈ তার সুনান গ্রন্থে তার নিকট থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করার পর বলেন, চিনি না এই ব্যক্তি কে? আর তিনি তার যুয়াফা কিতাবে বলেন, মুনকারুল হাদিস। কুনা গ্রন্থে বলেন, “তিনি নির্ভরযোগ্য নন। ইবনে হিব্বান বলেন, তার বর্ণিত কোন হাদিসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। দ্রষ্টব্য: তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী ফযলি রাজাব, ১২ পৃষ্ঠা। আয যুয়াফাউল কাবীর (২/৮১) তাহযীবুত তাহযীব (৩/৩০)

● ৩. “রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাজানের পরে রজব ও শাবান ছাড়া অন্য কোন মাসে রোজা রাখেননি।” [বাইহাকী]

হাফেয ইবনে হাজার বলেন, উক্ত হাদিসটি মুনকার। কারণে, এর সনদের ইউসুফ বিন আতিয়া নামক একজন রাবি রয়েছে। সে খুব দুর্বল। [তাবয়ীনুল আজাব ১২ পৃষ্ঠা]

🚫 খ. রজব মাস সম্পর্কে কয়েকটি জাল হাদিস:

● ১. রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস এবং রমজান আমার উম্মতের মাস।”

এটি জাল হাদিস।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, উক্ত হাদিসটি বর্ণনাকারীদের মধ্যে আবু বকর আন নাক্কাশ নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। সে কুরআনের মুফাসসির। কিন্তু লোকটি জাল হাদিস রচনাকারী এবং চরম মিথ্যাবাদী দাজ্জাল। ইবনে দেহিয়া বলেন, এই হাদিসটি জাল। (তাবয়ীনুল আজব, ১৩-১৫ পৃষ্ঠা) এছাড়াও উক্ত হাদিসকে জাল বলে চিহ্নিত করেছেন ইবনু জাওযী তার আল মাওযূয়াত কিতাবে (২/২০৫-২০৬) এবং ইমাম সানয়ানী মাওযূআত কিতাবে (৬১ পৃষ্ঠা) এবং সূয়ূতী তার আল লাআলী আল মাসনূআহ কিতাবে (২/১১৪)।

● ২. কুরআনের মর্যাদা সকল জিকির-আজকারের উপর যেমন রজব মাসের মর্যাদা অন্যান্য মাসের উপর তেমন।”

হাদিসটি বানোয়াট।

ইবনে হাজার আসকালানী উক্ত হাদিসটি বর্ণনা করার পর বলেন, এই হাদিসটি সনদের রাবিগণ সবাই নির্ভরযোগ্য একজন ছাড়া। তার নাম হল, সিকতী। আর এ লোকটিই হল বিপদ। কেননা, সে একজন বিখ্যাত জাল হাদিস রচনাকারী। (তাবয়ীনুল আজাব: ১৭ পৃষ্ঠা)

● ৩. রজব মাসে যে ব্যক্তি তিনটি রোজা রাখবে আল্লাহ তাআলা তার আমলনামায় একমাস রোজা রাখার সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন, আর যে ব্যক্তি সাতটি রোজা রাখবে আল্লাহ তাআলা তার জন্য জাহান্নামের সাতটি দরজা বন্ধ করে দিবেন।”

হাদিসটি জাল।

এটিকে জাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ইবনু জাওযী আল মাওযূয়াত কিতাবে (২/২০৬), সূয়ূতী আল লাআলী আল মাসনূআহ কিতাবে (২/১১৫), শাওকানী আল ফাওয়ায়েদুল মাজমুয়াহ কিতাবে (১০০ পৃষ্ঠা, হাদিস নং ২২৮) এবং তাবয়ীনুল আজাব কিতাবে (১৮ পৃষ্ঠা)।

● ৪. “যে ব্যক্তি রজবের প্রথম তারিখে মাগরিব নামাজ আদায় করত: বিশ রাকাত নামাজ পড়বে, প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা এবং সূরা ইখলাস একবার করে পড়বে এবং প্রতি দু রাকাত পরপর সালাম ফিরিয়ে মোট দশ সালামে বিশ রাকাত পূর্ণ করবে তোমরা কি জানেন তার সওয়াব কি?…তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা তাকে হেফাজত করবেন এবং তার পরিবার, সম্পত্তি ও সন্তান-সন্ততীকে হেফাজত করবেন, কবরের আজাব থেকে রক্ষা করবেন এবং বিনা হিসেব ও বিনা শাস্তিতে বিদ্যুৎ গতিতে পুলসিরাত পার করাবেন।”

এটি একটি বানোয়াট হাদিস।

[দ্রষ্টব্য: ইবনুল জাউযী তার মাওযূয়াত (২/১২৩), তাবয়ীনুল আজাব (২০ পৃষ্ঠা), আল ফাওয়াইদুল মাজমূয়াহ (৪৭পৃষ্ঠা, জাল হাদিস নং ১৪৪)]

● ৫. “যে ব্যক্তি রজব মাসে রোজা রাখবে এবং চার রাকাত নামাজ পড়বে সে জান্নাতে তার নির্ধারিত আসন না দেখে মৃত্যু বরণ করবে না।”

হাদিসটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন ইবনুল জাওযী আল মাওযূয়াত কিতাবে (২/১২৪), শাওকানী আল ফাওয়ায়েদুল মাজমুয়াহ কিতাবে (৪৭ পৃষ্ঠা) এবং তাবয়ীনুল আজাব, (২১ পৃষ্ঠা)।
▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬
‘আলবিদা আল হাউলিয়া’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল। (লিসান্স,মদীনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব।।

No comments:

Post a Comment

Translate