Friday, January 10, 2025

অবৈধ পন্থায় প্রবাসে বসবাস ও কাজ করার বিধান এবং এর ক্ষতিকর দিক সমূহ

 প্রশ্ন: অবৈধ হিসাবে প্রবাসে বসবাসকারী অনেক ঋণগ্রস্ত ভাই রয়েছেন যাদের দেশে এসে জীবন ধারণের কোন ব্যবস্থা নেই। তাদের ক্ষেত্রে অবৈধভাবে প্রবাসে থেকে অর্থ উপার্জন করা কি হালাল হবে?

উত্তর: ইসলামে প্রবাসে বসবাস ও কাজ করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে অনেকেই বিভিন্ন কারণে দেশের বাইরে চলে যান। কিন্তু অনেকে সেখানে গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করে ও অর্থ উপার্জন করে।

ইসলাম শরিয়ত এই বিষয়ে কী নির্দেশনা দেয় তা জানা অত্যন্ত জরুরি। নিম্নে এ বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

❑ অবৈধ পন্থায় প্রবাস: ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি

অবৈধ পন্থায় প্রবাস বলতে সাধারণত বোঝায়, কোনও দেশের আইন-কানুন ভঙ্গ করে বা অনুমতি ছাড়া সেখানে বসবাস করা এবং কাজ করা।

মনে রাখা কর্তব্য যে, একজন মানুষ যখন প্রবাসে যাওয়ার জন্য ভিসা গ্রহণ করে তখন সে দেশে গিয়ে সেখানকার আইন-কানুন মেনে চলার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বলে পরিগণিত হয়‌। অতএব সে আইন ও শরিয়ত উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে উক্ত দেশের প্রচলিত আইন-কানুন মেনে চলতে বাধ্য।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ

“হে ইমানদারগণ, তোমরা অঙ্গীকার (ও চুক্তিসমূহ) পূর্ণ কর।” [সূরা মায়েদা: ১]

আর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

المسلمونَ على شروطِهم

“মুসলিমগণ তাদের শর্তের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” [সহীহ আবু দাউদ, হা/৩৫৯৫] অর্থাৎ মুসলিমগণ তাদের সাথে কৃত শর্ত লঙ্ঘন করবে না।

সুতরাং প্রবাসীদের জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে সে দেশের কোনও আইন লঙ্ঘন করা জায়েজ নেই। (যদি শরিয়ত বিরোধী কোন আইন না হয়। শরিয়ত বিরোধী হলে তা মানা জায়েজ নয়)।

অতএব কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে অবৈধ ভাবে প্রবাসে বসবাস করে তাহলে সে দেশের আইনের দৃষ্টিতে যেমন অপরাধী বলে গণ্য হবে তেমনি ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতেও সে গুনাহগার হবে। তবে সে যদি হালাল কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে তাহলে হারাম নয়।

❑ ফতোয়া:
প্রশ্ন: আমি একজন মুসলিম। সুইডেনে থাকি। রাষ্ট্র থেকে ভাতা পাই। আমার বাড়ি স্কুল ও বাজার থেকে অনেক দূরে হওয়ায় আমাকে গাড়ি কিনতে হয়েছে। আমার কিছু প্রতিবেশী আমাকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য টাকা দেয়। সুইডেনের শ্রম আইন অনুযায়ী এই কাজটি অবৈধ। কারণ এটি করের বাইরে। আমার এখনও রেসিডেন্স পারমিট না থাকায় আমি এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করতে পারি না। আমার প্রশ্ন হলো, আমার এই কাজটি কি ইসলামে হারাম? কারণ এটি দেশের আইন ভঙ্গ করে। আর যদি আমি শুধুমাত্র গাড়ির বীমা, ট্যাক্স বা মেরামতের খরচ জোগাড় করার জন্য এই কাজটি করি, তাহলে কি ইসলাম অনুযায়ী এটি হারাম হবে? জাযাকাল্লাহু খাইরান।
জবাব: আলহামদুলিল্লাহ-সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক। অতঃপর-

অন্য দেশে যাওয়া মুসলমানদের উচিত, সেই দেশের আইন-কানুন মেনে চলা-সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার সময় যেগুলো মেনে চলার প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছিলো যদি না সেগুলো ইসলাম বিরোধী হয়। কেননা মুসলিমগণ চুক্তি রক্ষা করে, ওয়াদা পালনে সত্যবাদি হয় এবং আমানত যথাযথভাবে পালন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْؤولًا

“আর চুক্তি পূর্ণ কর। নিশ্চয় চুক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সূরা ইসরা, আয়াত ৩৪)।
তাই যদি কেউ এই আইন ভঙ্গ করে তাহলে সে ভুল করেছে। তবে এর মানে এই নয় যে, সে তার কাজের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ হারাম। যদি কাজটি হালাল হয় তাহলে তার বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থও হালাল। আইন ভঙ্গ করা আলাদা বিষয় আর কাজের বিনিময়ে উপার্জিত অর্থ আলাদা বিষয়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। (সংক্ষেপায়িত)
[উৎস: মিসরিয় ফতোয়া বোর্ড। ফতোয়া নাম্বার: ১৩১৩, ২০২২ সন]

❑ অবৈধ পন্থায় বিদেশে থাকার ক্ষতিকর দিক সমূহ:

প্রকৃতপক্ষে অবৈধ পন্থায় প্রবাসে বসবাসকারীগণ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকার কারণে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। যেমন:

• অনেক সময় অবৈধ পন্থায় বসবাসকারী প্রবাসীরা চুরি, ডাকাতি, নানা হারাম ব্যবসা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
• অবৈধ অভিবাসীরা অনেক সময় সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে এবং স্থানীয় জনগণের সাথে নানা ধরণের সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে পারে।
• তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লুকোচুরির আশ্রয় নেওয়ার কারণে ইসলামি শিক্ষা ও ইসলামি পরিবেশ থেকে দূরে থাকে। যার ফলে তারা বিভিন্ন ধরণের পাপাচার ও অন্যায়-অপকর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়ে।
• তারা আইন ও প্রশাসনের ধরাছোঁয়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। ফলে তাদের মধ্যে সবসময় একটা অপরাধ বোধ কাজ করে এবং তারা হীনমন্যতায় ভুগে।

• তারা বৈধ পন্থায় দেশে টাকা পাঠাতে পারে না। যার কারণে তারা সাধারণত: হুন্ডির আশ্রয় গ্রহণ করে। অথচ তা সে যে দেশে বসবাস করছে এবং নিজ দেশ উভয় দেশেই নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
• অবৈধ প্রবাসীরা যে কোনও সময় সে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সে নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি তার স্ত্রী-পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (আল্লাহ হেফাজত করুন। আমিন)

❑ কেউ যদি পরিস্থিতির শিকার হয়ে কিংবা অনিচ্ছা বশতঃ প্রবাসে অবৈধ হয়ে যায় তাহলে তার করণীয়:

কোন ব্যক্তি যদি তার ইচ্ছার বাইরে বা পরিস্থিতির শিকার হয়ছ প্রবাসে ‘অবৈধ’ হয়ে যায় তাহলে সে নিজ দেশে ফিরে আসার জন্য সে উক্ত দেশে নিয়োজিত দূতাবাস/কনস্যুলেটের মাধ্যমে আইনানুগ পন্থায় চেষ্টা করবে। এ সময় তার জীবন ধারণ এবং দেশে ফেরত আসার খরচ যোগানের জন্য সে সতর্কতার সাথে যেকোনো হালাল কাজ করতে পারে। কেননা এটা অপারগ অবস্থা। অপারগ অবস্থায় শরিয়তের ছাড় রয়েছে। ইসলামি ফিকাহের একটি প্রসিদ্ধ মূলনীতি হল,

الضرورة تبيح المحظورات

“জরুরত নিষিদ্ধ জিনিসকে বৈধ করে দেয়।” যেমন প্রচণ্ড ক্ষুধায় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য শূকর বা মরা প্রাণীর গোস্ত খাওয়া। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে সে দেশে অবৈধ পন্থায় জীবন-যাপন করা ও অর্থ উপার্জন অব্যাহত রাখা জায়েজ নাই।

➤ উল্লেখ্য যে,
– একজন মুসলিম কোন অমুসলিম দেশে যাওয়ার আগে সে কোন শরিয়ত বিরোধী কোন আইন মানার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। এমনটি হলে (বিশেষ কারণ ছাড়া) সে দেশে ভ্রমণ করা বা গমন করা জায়েজ নেই।
– অজ্ঞতাবশত সেখানে যাওয়ার পরে শরিয়ত বিরোধী আইন মানতে বাধ্য হতে হলে যথাসম্ভব দ্রুত সেখান থেকে দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করা অপরিহার্য।
– অমুসলিম দেশে কোন কারণে যাওয়া জায়েজ আর কোন কারণে জায়েজ নয় এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আলেমদের ফতোয়া গ্রহণ করা উচিৎ। আল্লাহু আলাম।
উত্তর প্রদানে :
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate