নিঃসন্দেহে কুরআনের একাধিক আয়াত এবং বহু বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা সু প্রামাণিত যে, কুরবানি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, মর্যাদাপূর্ণ আল্লাহর ইবাদত এবং তাঁর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। এটি ইবরাহীম আলাইহি সালাম এর সুন্নত যা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে বাস্তবায়ন করেছেন, তাঁর উম্মতের জন্য শরিয়ত সম্মত করেছেন এবং যুগ-যুগান্তরে সাহাবি, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুসলিমগণ আমল করেছেন। আল হামদুলিল্লাহ।
তবে কুরবানির ফযিলতে বেশ কিছু হাদিস বক্তাদের মুখে শোনা যায় বা কুরবানি সংক্রান্ত বই-পুস্তকে পাওয়া যায়। কিন্তু এ সংক্রান্ত হাদিসগুলো একটি সহিহ নয়।
নিম্নে শাইখ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম এর লেখা ‘কুরবানির মাসায়েল’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে কুরবানির ফযিলত সংক্রান্ত প্রচলিত ১২টি জঈফ ও জাল হাদিস মুহাদ্দিসগণের পর্যালোচনা সহ তুলে ধরা হল:
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, “কুরবানি করার ফযিলতে অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোর একটিও বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত হয়নি বরং তার সবগুলোই জঈফ (দুর্বল) অথবা মউযূ (জাল)। (ফাতহুল বারী)
মালিকী মাজহাবের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইমাম ইবনুল আরবি রহ. বলেন,
ليس في فضل الأضحية حديث صحيح وقد روى الناس فيها عجائب لم تصح منها :إنها مطاياكم إلى الجنة – (عارضة الأحوذي شرح جامع الترمذي 6/288)
“কুরবানির ফযিলতে একটিও সহিহ হাদিস নেই। তবে মানুষ এ সম্পর্কে অনেক আজগুবি হাদিস বর্ণনা করেছে যা মোটেও সহিহ নয়। সে সব আজগুবি হাদিসের মধ্যে অন্যতম হল এই কথাটি:
((إنها مطاياكم إلى الجنة))
“উহা তোমাদের জান্নাতে যাওয়ার বাহন স্বরূপ।”(দ্র: তিরমিযীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ আরেযাতুল আহওয়াযী ৬/২৮৮)
নিম্নে কুরবানির ফযিলত সংক্রান্ত হাদিসগুলো পর্যালোচনা সহ পরিবেশিত হল:
◈ ১ নং হাদিস:
“আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, নবী বলেন, “কুরবানির দিনে কোন আদম সন্তান কুরবানির পশুর খুন ঝরানোর চেয়ে মহান আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় আমল করে না। সে কিয়ামত দিবসে উক্ত পশুর শিং, খুর, লোম প্রভৃতি নিয়ে উপস্থিত হবে এবং তার খুন জমিনে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর নির্ধারিত মর্যাদার স্থানে পতিত হয়। অতএব, তোমরা প্রফুল্ল চিত্তে কুরবানি কর।” (ইবনে মাজাহ, হা/৩১২৬, তিরমিযী, হা/১৪৯৩, হাকেম৪ /২২১-২২২ দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যাহঃ)
➧ মন্তব্য: হাদিসটি জঈফ। কারণ, হাদিসটি র সনদে কয়েকটি দোষ আছে। যেমন:
● ১) উক্ত হাদিসের সনদে আব্দুল্লাহ বিন নাফে নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। তার স্মৃতি শক্তিতে দুর্বলতা ছিল।
● ২) হাদিসটি র সনদে আবুল মুসান্না নামক আরেকজন রাবী (বর্ণনা কারী) রয়েছে তার আসল নাম হল সুলাইমান বিন ইয়াজিদ। তিনি অত্যন্ত দুর্বল ও বাজে। (দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যা)
● ৩) উক্ত হাদিসের প্রায় অনুরূপ হাদিস ইমাম আব্দুর বাযযাক তার মুসান্নাফ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। (হা/৮১৬৭) উক্ত হাদিসটি র সনদেও আবু সাঈদ শামী নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে তিনি একজন ‘পরিত্যক্ত’ রাবি। (দ্রঃ প্রাগুক্ত)
◈ ২ নং হাদিস:
عن زيد بن أرقم قال قال أصحاب رسول الله: يارسول الله ماهذه الأضاحي؟ قال: سنة أبيكم إبراهيم قالوا: فما لنا فيها؟ قال: بكل شعرة حسنة، قالوا: فالصوف يارسول الله؟! قال بكل شعرة من الصوف حسنة
“যায়েদ বিন আরকাম রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! এই কুরবানির পশুগুলির তাৎপর্য কি? (কেন আমরা এগুলো জবেহ করে থাকি?) তিনি বললেন: “ইহা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নত।” তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, এতে আমাদের কী সওয়াব রয়েছে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে।” তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, পশমের মধ্যে যে ছোট ছোট লোম রয়েছে ওগুলোরও কি বিনিময় তাই? নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “ছোট ছোট প্রতিটি লোমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে।” (ইবনে মাজাহ্, হা/৩১২৭, আহমদ (৪/৩৬৮), ইবনে হিব্বান ফিল মাজরুহীন (৩/৫৫))
➧ মন্তব্য: হাদিসটি জঈফ। কারণ, এ হাদিসটি র সনদে আবু দাউদ আল আম্মী নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। তার প্রকৃত নাম হল, নুফাই ইবনুল হারিস। সে মুহাদ্দিসগণের নিকট ‘পরিত্যক্ত’ রাবি। এতে আরও একজন রাবি রয়েছে তার নাম হল আয়েযুল্লাহ, সে ‘জঈফ’ রাবি।
◈ ৩ নং হাদিস:
عن أبي سعيد الخدري قال قال رسوالله صلى الله عليه وسلم لفاطمة عليها الصلاة والسلام!)) قومي إلى أضحيتك فاشهديها فإن لك بأول قطرة تقطر من دمها يغفر لك ماسلف من ذنوب، قالت: يارسول الله! هذا لنا أهل البيت خاصة أو لنا وللمسلمين عامة؟ قال: لنا وللمسلمين عامة (رواه الحاكم 4/222 والبزار مع كشف الأستار2/59)
আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতেমা রা. কে বললেন, “(হে ফাতেমা!) তুমি তোমার কুরবানির পশুর নিকট (জবেহ কালীন) দাঁড়াও এবং উপস্থিত থাক। কারণ তার প্রথম ফোটা খুন (জমিনে) পড়ার সাথে সাথে তোমার অতীতের গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে।”
➧ মন্তব্য: হাদিসটি জঈফ। কারণ,এর সনদে আব্দুল হামীদ নামে একজন রাবি রয়েছে যে জঈফ। আরেকটি কারণ হল, এর সনদে আতিয়া আল আওফী নামে আরেকজন রাবি রয়েছে সেও জঈফ এবং মুদাল্লিস। আবু হাতিম তার ইলাল (علل) গ্রন্থে (হা/৩৮) বলেন, “এটি একটি ‘মুনকার’ হাদিস।” (দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যাহঃ ১০)
◈ ৪ নং হাদিস:
عن علي رضى الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لفاطمة: يا فاطمة فاشهدي أضحيتك أما إن لك بأول قطرة من دمها مغفرة لكل ذنب أما إنه يجاء بها يوم القيامة بلحومها ودمائها سبعين ضعفا حتى توضع في ميزانك
আলি রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন: “হে ফাতেমা! তুমি তোমার কুরবানির পশুর নিকট জবেহ করার সময় উপস্থিত থাকিও। জেনে রেখ, ঐ পশুর রক্তের প্রথম ফোটা (মাটিতে) পড়ার সাথে সাথে তোমার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। জেনে রেখ! কিয়ামত দিবসে কুরবানির ঐ পশুগুলোকে রক্ত, মাংস সহ সত্তরগুণ বৃদ্ধি করে নিয়ে আসা হবে এবং তোমার দাঁড়িপাল্লায় তা রাখা হবে।” [বায়হাকী (৯/২৮৩) আবদুবনু হুমাইদ (৭/৮)]
➧ মন্তব্য:
◈ ৫ নং হাদিস:
عن على عن النبي صلى الله عليه وسلم : ))ياأيها الناس ضحوا واحتسبوا بدمائها وإن الدم وإن وقع في الأرض فإنه يقع في حرز الله عزو جل (رواه الطيالسي برقم 8315 ،والطبراني في الأوسط وفيه موسى بن زكريا وعمرو بن الحصين العقيلي وهما متروكان ، انظر: فقه الأضحية ومجمع الزوائد4/17)
আলি রা. হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, (তিনি বলেন) “হে মানব মণ্ডলী, তোমরা কুরবানি কর এবং তার খুনকে সওয়াব লাভের মাধ্যম মনে কর। নিশ্চয়ই কুরবানির পশুর খুন জমিনে পতিত হলে তা আল্লাহর হেফাজতে চলে যায়।” [আবু দাউদ তায়ালেসী, হা ৮৩১৫]
➧ মন্তব্য: হাদিসটি র সনদে মুসা বিন যাকারিযা এবং আমর ইবনুল হুসাইন রয়েছে। তারা উভয়ে ‘পরিত্যক্ত’ রাবি।
◈ ৬ নং হাদিস:
عن عبد الله ابن عباس رضى الله عنهما قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ماأنفقت الورق في شيئ أحب إلى الله من نحر ينحر يوم عيد (رواه الطبراني(১১/১৭) والدارقطني )৪/২৮২( والشجري في الأمالي )২/৭৯-৮০( وفي إسناده إبراهيم بن يزيد الخوزي وهو متروك ، انظر: فقه الأضحي)
“আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “চাঁদি (টাকা-পয়সা) যেসব ক্ষেত্রে খরচ করা হয় তার মধ্যে আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয় হল কুরবানি যা ঈদের দিনে যবেহ করা (তাবারানী ১১/১৭) দারাকুতনী ৪/২৮২ প্রভৃতি।
➧ মন্তব্য: উক্ত হাদিসটি জঈফ। কারণ হাদিসটি র সনদে ইবরাহীম বিন ইয়াজিদ আল খোযী নামক একজন পরিত্যক্ত রাবি রয়েছে।
◈ ৭ নং হাদিস:
عن الحسين بن علي قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ((من ضحى طيبة بها نفسه محتسبا لأضحيته كانت له حجابا من النار ( رواه الطبراني ৩/ ৮৪، وفي إسناده : أبو داود النخعي (سليمان بن عمرو وهو كذاب
◈ ৮ নং হাদিস:
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানির দিন বললেন, “কোন অদম সন্তান এই দিনে (কুরবানির) খুন প্রবাহিত করার চেয়ে অধিক সৎ আমল করে না। তবে ছিন্ন আত্মীয়তা সম্পর্ককে আবার অবিচ্ছিন্ন করার কথা ভিন্ন। (তাবারানী ১১/৩২)
➧ মন্তব্য: হাদিসটি জঈফ। কারণ,
◈ ৯ নং হাদিস:
عن أبي هريرة عن النبي قال: استفرهوا ضحاياكم فإنها مطاياكم على الصراط – رواه الديلمي في مسند الفردوس 1/25( وهوحديث ضعيف جدا ، انظر : فقه الأضحية )
আবু হুরাইরা রা. নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “তোমরা তোমাদের কুরবানির পশুগুলো শক্তিশালী ও মোটা-তাজা দেখে নির্বাচন কর। কারণ এগুলো তোমাদের পুলসিরাতের উপর চড়ে যাওয়ার বাহন হবে।” (দাইলামী-মুসনাদুল ফিরদউস ১/৮৫)
◈ ১০ নং হাদিস:
◈ ১১ নং হাদিস:
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে লোক সকল, আপনারা কুরবানি করুন এবং তা খুশী মনে করুন। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছি যে, “যদি কোন ব্যক্তি তার কুরবানির পশু সহ কিবলা মুখী হয় (এবং জবেহ করে) তাহলে তার রক্ত, শিং এবং লোম নেকিতে পরিণত করে কিয়ামত দিবসে তার দাঁড়িপাল্লায় উপস্থিত করা হবে। কুরবানির পশুর খুন যদিও তা মাটিতে পড়ে কিন্তু তা প্রকৃত অর্থে আল্লাহর হেফাজতে পড়ে। তিনিই এর প্রতিদান তাকে কিয়ামত দিবসে প্রদান করবেন।” (কিতাবুত তামহীদ এর বরাতে তাফসীরুল কুরতুবী)
➧ মন্তব্য: উক্ত হাদিসটির সনদও জঈফ।
◈ ১২ নং হাদিস:
ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি ছাড়া এমন কোন খরচ নেই যা আল্লাহর নিকট কুরবানির পশুর খুন ঝরানোর চেয়ে উত্তম হতে পারে।” (তাফসীরুল কুরতুবী)।
➧ মন্তব্য: আবু ওমার ইবনে আব্দুল বার বলেন, “এ হাদিসটি ইমাম মালিকের সূত্রে বর্ণিত একটি ‘গারীব’ হাদিস” (দ্র: প্রাগুক্ত)।
কুরবানির ফযিলতে খাস কোন সহিহ বা হাসান হাদিস না থাকলেও নিম্ন বর্ণিত হাদিস দ্বারা পরোক্ষভাবে তার কিছু ফযিলত প্রমাণিত হয়। হাদিসটি হল:
যেহেতু কুরবানি করা ১০ যিলহাজ্জের অন্যতম একটি করণীয়। কাজেই সাধারণভাবে কুরবানিরও ফযিলত এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়। আল্লাহু আলাম।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: যঈফ বা দুর্বল হাদিস অনুযায়ী আমল করা যায় কি না সে বিষয়ে জানতে চাইলে দয়া করে এই পোস্টটি পড়ুন:
No comments:
Post a Comment