‘‘চঞ্চল ঘোড়ার লেজের মত’’
আল্ হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন্ ওয়াস্ স্বলাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিহিল কারীম। আম্মাবাদ:
অত:পর তিনি একদিন আমাদের গোলাকার হয়ে বসে থাকতে দেখে বললেন: তোমাদেরকে দলে দলে বিভক্ত অবস্থায় দেখছি কেন? অত:পর এক দিন বের হয়ে বললেন: ফেরেশতারা যেভাবে তাদের রবের নিকট সারিবদ্ধ হয় সেভাবে সারিবদ্ধ হতে তোমরা পছন্দ কর না কি? আমরা বললাম: আল্লাহর রাসূল, ফেরেশতাগণ কিভাবে তাদের রবের নিকট সারিবদ্ধ হোন? তিনি বললেন: তারা প্রথম কাতাগুলো পূরণ করেন এবং কাতারে সমান্তরাল হয়ে দাঁড়ান”। [স্বহীহ মুসলিম, অধ্যায়: স্বলাত নং ৯৬৭]
➧ হাদীসটির সাধারণ মর্মার্থ:
ইমাম নাওয়ভী এই হাদীসটিকে কেন্দ্র করে যে বাব (অনুচ্ছেদ) নির্ণয় করেছেন তা এমন: “অনুচ্ছেদ: স্বলাতে স্থির থাকার আদেশ এবং সালাম ফিরানোর সময় হাত দ্বারা ইঙ্গিত করা ও উত্তোলন করা নিষেধ এবং প্রথম কাতারগুলো পূরণ করা, সমান্তরাল হওয়া এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়া। [শারহু স্বহীহ মুসলিম নওয়াভী, ৪/৩৭২] হাদীসের বাহ্যিক শব্দগুলো দেখলে এ অর্থই বুঝা যায়- যা ইমাম নওয়াভী খুব সংক্ষিপ্তভাবে পেশ করেছেন।
➧ “চঞ্চল ঘোড়ার লেজের মত হাত উত্তোলন করো না” বলতে কী বুঝায়?
হাদীসের বাক্য দ্বারা কতিপয় লোক মত পোষণ করেছেন যে, এ দ্বারা বুঝা যায় নামাযে হাত তুলা নিষেধ। অর্থাৎ রাফউল ইয়াদাইন করা (রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে উঠার সময় এবং প্রথম তাশাহ্হুদ শেষ করে তৃতীয় রাকাআতে উঠার সময়) দুই হাত উত্তোলন করা নিষেধ। বরং তারা এমনও মত ব্যক্ত করেছেন যে, এই হাদীসটি হচ্ছে নামাযে রাফউল ইয়াদাঈন করার সম্বন্ধে নাসেখ বা রোহিতকারী হাদীস যার মাধ্যমে রাফউল ইয়াদাইনের বিধান রোহিত হয়ে যায়। তাই এখন আমাদের জানা প্রয়োজন যে, হাদীসের উক্ত বাক্য থেকে উলামাগণ কী বুঝেছেন?
ইমাম নাওয়াভী বলেন: “এখানে যে উত্তোলন করা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তা দু দিকে সালাম ফিরানোর সময় হাত তোলা সম্পর্কে। যেমনটি পরবর্তী বর্ণনা থেকে আরও স্পষ্ট হয়েছে”। [শারহু স্বহীহ মুসলিম ৪/৩৭২]
আমাদের আলোচ্য হাদীসে স্থির হওয়া ও চঞ্চল ঘোড়ার লেজের মত হাত উত্তোলন না করার যে আদেশ এসেছে তা কখন ও কোন্ স্থানে নিষেধ আর এর ব্যাখ্যা কি সে দিকেই ইমাম নওয়াভী ইঙ্গিত করে বলেন যে, এ হাদীসের পরের হাদীসে সে নিষেধাজ্ঞার বিশ্লেষণ এসেছে।
মনে রাখা ভালো, উপরোক্ত অনুচ্ছেদে ইমাম মুসলিম (রাহেমাহুল্লাহ) এই হাদীসের পরে পরেই আরও দুইটি হাদীস উল্লেখ করেছেন এবং বাকি দুটি হাদীসের বর্ণনাকারীও একই সাহাবী। তিনি হলেন: জাবির বিন সামুরাহ (রাযি:)। আমরা এখন সেই হাদীসদ্বয় পেশ করবো ইনশাআল্লাহ।
❒ ১) জাবির বিন সামুরা হতে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা যখন রাসূল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে নামায আদায় করতাম, তখন বলতাম: আস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। এসময় তিনি দু দিকে হাত ইশারা করে দেখালেন।
তখন রাসূল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “তোমরা কী কারণে চঞ্চল ঘোড়ার লেজের মত এভাবে হাত দ্বারা ইশারা করছ? তোমারা হাতগুলো উরুর উপর রাখবে অত:পর ডান ও বাম পাশের ভাইদের প্রতি সালাম দিবে-এটাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট”। [স্বহীহ মুসলিম, স্বলাত অধ্যায় হাদীস নং ৯৬৯]
❒ ২) তার পরবর্তী হাদীসটি নিম্নরূপ:
জাবির বিন সামুরা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আল্লাহর রাসূলের সাথে স্বলাত আদায় করেছি। আমরা যখন সালাম ফিরতাম তখন হাত দ্বারা ইশারা করে বলতাম: আস্ সালামুআলাইকুম। আস্ সালামুআলাইকুম। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন: কী ব্যাপার! তোমরা চঞ্চল ঘোড়ার লেজের মত এভাবে হাত দ্বারা ইশারা করছ কেন? যখন তোমাদের কেউ সালাম ফিরাবে তখন তার সাথীর দিকে মুখ ফিরাবে কিন্তু হাত দ্বারা ইশারা করবে না”। [স্বহীহ মুসলিম নং ৯৭০]
একজন সাধারণ মানুষও যদি উপরোক্ত তিনটি হাদীস পাঠ করে তাহলে সহজেই বুঝতে সক্ষম হবে যে, প্রথম হাদীসে যে হাত উঠানোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তা হল সালাম ফিরানোর সময় হাত উঠানোর ব্যাপারে। কারণ; প্রথম হাদীসটিতে নবী স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা কোন্ প্রেক্ষাপটে নিষেধ করেছেন তার বর্ণনা নেই। কিন্তু তারপরের হাদীসদ্বয়ে অর্থাৎ (৯৬৯ ও ৯৭০নং) হাদীসে এর বিশ্লেষণ এসেছে। আর এমনটাই ইমাম নাওয়াভী সহ বিভিন্ন মুহাদ্দিসগণ মনে করেছেন।
❖ এ সম্বন্ধে ইমাম বুখারীর মন্তব্য:
আউনুল মাবূদ কিতাবের গ্রন্থকার ইমাম বুখারীর উক্তি এভাবে উদ্ধৃতি টেনেছেন: ইমাম বুখারী তাঁর জুযউ রাফইল ইয়াদাঈন গ্রন্থে উক্ত হাত উত্তোলন সম্পর্কে বলেন: (এ নিষেধাজ্ঞা) তাশাহ্হুদে (সালাম ফেরানোর) সময়; কিয়ামের সময় নয়। সাহাবীগণ তাশাহ্হুদে এক অপরের প্রতি হাত তুলে সালাম করতো। তাই নবী স্বল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের এমন করতে নিষেধ করেন।
যাদের হাদীসের জ্ঞান রয়েছে তারা উক্ত হাদীস দ্বারা রুকুতে যাওয়া ও উঠার সময় রাফউল ইয়াদাঈন না করার দলীল দিতে পারে না। এটা প্রসিদ্ধ বিষয়। এতে কোনও মতভেদ নেই। যদি এমনই মনে করা হয়, তাহলে প্রথম তাকবীর ও দুই ঈদে হাত তুলাও নিষেধ হয়ে যাবে।কেননা এখানে বিশেষ ক্ষেত্রে হাত তোলার অনুমতির কথা আসে নি।সুতরাং সকল প্রকার হাত তোলা নিষেধ হয়ে যাবে।
❖ আবু দাউদের ভাষ্যকার মুহাদ্দিস ইবনু হিব্বানেরও উক্তি উদ্ধৃতি টেনে বলেন: লোকদের নামাযে সালাম ফিরানোর সময় হাত ইশারা করার পরিবর্তে স্থির থাকার আদেশ করা হয়; রুকুর সময় হাত তুলা থেকে নয়-যেটা হাদীস দ্বারা সুপ্রমাণিত। অত:পর তিনি সহীহ মুসলিমের বর্ণনার অনুরূপ একটি বর্ণনা নিয়ে আসেন।
❖ আযীমাবাদী বলেন: হাফেয ইবনু হাজর তালখীসুল হাবীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: এই বর্ণনায় বিশেষ নিয়মে বিশেষ স্থানে (অর্থাৎ রুকু করার সময় ও রুকু থেকে উঠার সময়) হাত না তোলার প্রমাণ নেই। কারণ এটি একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ বিশেষ। [আউনুল মাবূদ,৩/২১০-২১১]
অত:এব আমাদের নিকট স্পষ্ট হল যে, উপরোক্ত হাদীসে যে নামাযে স্থির থাকতে বলা হয়েছে এবং তাতে যে চঞ্চল ঘোড়ার লেজের মত হাত উঠাতে নিষেধ করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা হচ্ছে, সালাম ফিরানোর সময় হাত দ্বারা ইশারা না করা, হাত তোলার পরিবর্তে স্থিরতা অবলম্বন করা।
আর আমাদের এমন মনে করার পিছনে কারণ হচ্ছে সেই স্বহীহ মুসলিমের বর্ণনাটির পরের দুটি হাদীস, যা এ হাদীসের ব্যাখ্যা। কারণ বর্ণিত হাদীস ও পরের হাদীস দুটির বর্ণনাকারী একই সাহাবী এবং হাদীসের মতন বা মূল বক্তব্যও অভিন্ন। যে কারণে ইমাম মুসলিম উপরোক্ত তিনটি হাদীসকে একই অনুচ্ছেদে বর্ণনা করেছেন। আর এমনটিই ইমাম বুখারী, নাওয়াভী, ইবনু হিব্বান, ইবনু হাজর সহ বিশ্ব বরেণ্য মুহাদ্দিস ও উলামাগণ মনে করেন।
কিন্তু অতীব দু:খের বিষয়, কিছু লোক এমনও রয়েছে যারা কোনও এক মাযহাবের চশমা পরিধান করে থাকার কারণে এমন একটি স্পষ্ট বিধানের ব্যাখ্যা তাঁদের মাযহাবের সমর্থনে প্রদান করার চেষ্টা ইতিপূর্বে করেছে- এখনও করছে। তারা এই হাদীসটিকে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অন্য স্থানে নামাযে রাফউল ইয়াদাইন বা হাত উত্তলকে মানসূখ বা রোহিত করার পক্ষে দলীল হিসাবে ব্যবহার করছে! অথচ তা দলীল-প্রমাণের আলোকে যেমন প্রত্যাখ্যাত তেমন সুষ্ঠু বিবেকের বিবেচনায়ও আপত্তিকর। কারণ যেমন ইমাম বুখারীর উক্তি ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, এই হাদীসকে রাফউল ইয়াদাইন না করার দলীল মেনে নিলে বা রাফউল ইয়াদাইন বিষয়ে নাসেখ (রহিতকারী) মনে করলে সব ধরণের রাফউল ইয়াদাঈন রহিত হওয়া উচিৎ। কারণ তাতে কোনও এক প্রকার রাফউল ইয়াদাইন বাদ দিয়ে অন্য রাফউল ইয়াদাইনকে সাব্যস্ত করা হয়নি। অথচ হানাফীগণ প্রত্যেক নামাযের শুরুতে এবং দুই ঈদের নামাযে রাফউল ইয়াদাঈন সাব্যস্ত মনে করেন। আল্লাহু আলাম।
No comments:
Post a Comment