Saturday, August 30, 2025

ইসলাম এবং মৌলবাদ একটি ভুল ধারণার অপনোদন

 প্রশ্ন: মৌলবাদী কাদেরকে বলা হয়? আমরা নিজেদেরকে ‘মৌলবাদী মুসলিম’ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মাধ্যমে গর্ববোধ করতে পারি কি? দয়া করে জানাবেন ইনশাআল্লাহ।

উত্তর: প্রশ্নের আলোকে মৌলবাদ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো:
❑ মৌলবাদ কী?
মৌলবাদ (Fundamentalism) হলো, একটি মতাদর্শ যেখানে কোনও (মানব রচিত বা বিকৃত) ধর্ম, বিশ্বাস বা রাজনৈতিক মতবাদের আদি বা মূল নীতিগুলোকে কঠোরভাবে আঁকড়ে ধরা হয়। এই মতাদর্শীরা সাধারণত নিজেদের বিশ্বাসকে চূড়ান্ত সত্য মনে করে এবং তা জোর করে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে চরম পন্থা গ্রহণে, এমনকি রক্তের বন্য বইয়ে দিতে পিছুপা হয় না।
❑ মৌলবাদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো:
১. আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বিরোধিতা: মৌলবাদীরা প্রায়শই নতুন জ্ঞান, বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদী চিন্তাধারার বিরোধিতা করে।
২. নিজ বিশ্বাসে প্রচণ্ড গোঁড়ামি: তারা নিজেদের বিশ্বাসে এতটাই অবিচল থাকে যে, অন্য কোনও দৃষ্টিভঙ্গি বা মতকে গ্রহণ করতে চায় না।
৩. হিংস্রতা ও উগ্রতার আশ্রয়: নিজ বিশ্বাস ও ধারণাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে তারা কখনো কখনো হিংস্রতা বা উগ্রতার আশ্রয় নেয়।
সুতরাং এই অর্থে মৌলবাদ অবশ্যই নিন্দনীয়।
❑ মৌলবাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: খ্রিস্টধর্মের সাথে সম্পর্ক।
ঐতিহাসিকভাবে, মৌলবাদ শব্দটি খ্রিস্টধর্মের সাথে প্রাথমিকভাবে সম্পর্কিত। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৪৫৩ সালে তুর্কিরা গ্রিক-রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল দখলের পর ইউরোপে রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়। গ্রিক পণ্ডিতরা ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাবে আলোকিত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েন এবং এর ফলেই পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানমনস্ক এক নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। এই জাগরণের যারা বিরোধিতা করেছিল, যারা বিজ্ঞান বিরোধী অন্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, তাদেরকেই তখন “মৌলবাদী” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সে সময় পাদ্রিদের দেওয়া আজগুবি ও বিজ্ঞান বিরোধী বক্তব্য প্রকট হয়ে ধরা পড়তো। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিওদের মতো বহু বিজ্ঞানীকে এই বিজ্ঞান বিরোধী মৌলবাদীদের হাতে শাস্তি পেতে হয়েছে। এরাই তখন বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতদের কাছে “Fundamentalism” এর ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তবে মৌলবাদ কেবল ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস (যেমন: ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ইত্যাদি), রাজনৈতিক মতবাদ (যেমন: Communism বা সমাজতন্ত্র, Secularism বা ধর্মনিরপেক্ষতা, Nationalism বা জাতীয়তাবাদ, Racism বা বর্ণবাদ ইত্যাদি) এবং অন্যান্য আদর্শিক ক্ষেত্রেও দেখা যেতে পারে।
❑ ইসলাম ও মৌলবাদ: একটি ভুল ধারণা।
বর্তমানে যারা প্রকৃত ইসলামকে দৃঢ়ভাবে মেনে চলেন, তাদেরকে অনেকে “মৌলবাদী” বলে আখ্যায়িত করে থাকে, যা সম্পূর্ণ ভুল। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামের সাথে মৌলবাদের কোনও সম্পর্ক নেই। প্রকৃত মুসলিম বা কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী কখনো মৌলবাদী হতে পারে না।
কারণ- ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ, সচল, উদার এবং আধুনিক জীবন বিধান। এটি মহান স্রষ্টা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত একটি মহান দ্বীন (জীবনাদর্শ) এবং মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান এতে বিদ্যমান। ইসলাম সর্বকালে পৃথিবীর সকল জাতি-গোষ্ঠীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য এবং এটি মানুষের ইচ্ছামতো পরিবর্তন-পরিবর্ধন গ্রহণ করে না।
✪ ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের মূল ভিত্তিগুলো মৌলবাদের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক:
১. জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহ: ইসলাম আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে সর্বদা উৎসাহিত করে। এখানে মূর্খতা ও অজ্ঞতা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
২. উদার দৃষ্টিভঙ্গি: ইসলাম অন্য ধর্ম ও আদর্শের ব্যাপারে উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। ইসলামে জোর করে কারো ওপর ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ।
৩. অমুসলিমদের অধিকার: ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা (কিছু শর্ত সাপেক্ষে) স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের সুবিধা পায়।
৪. উগ্রতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা: যারা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জিহাদের নামে অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করে বা নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি করে, ইসলাম তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর। খারেজি সম্প্রদায়ের কার্যক্রম এর একটি উদাহরণ।
৫. ক্ষমা ও সহনশীলতা: ইসলাম প্রতিশোধের চেয়ে ক্ষমার নীতিকে উৎসাহিত করে।
৬. সামাজিক সহাবস্থান: ইসলাম সমাজের মানুষের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক সহাবস্থানে উৎসাহিত করে। পরিবার, সমাজ থেকে পালিয়ে বৈরাগ্য বাদ গ্রহণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ।
৭. মানবিক জীবন ব্যবস্থা: ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা (প্রাইভেসি), প্রয়োজন এবং জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান দিয়েছে। বিয়ে-শাদি, খাদ্য-পানীয়, পোশাক, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে চমৎকার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
৮. উগ্রতা ও নির্মমতার নিন্দা: ইসলামে উগ্রতা, কঠোরতা, নির্মমতা, প্রতিহিংসা ইত্যাদি অত্যন্ত নিন্দনীয়।
৯. কুসংস্কার বর্জন: ইসলাম জ্ঞান-প্রজ্ঞা, যুক্তি ইত্যাদিকে মূল্যায়ন করে এবং কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত অন্ধ বিশ্বাসকে পরিপূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
১০. মানবতা ও পরোপকার: ইসলাম পরোপকার, অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, মানবিক কাজ ইত্যাদিকে অত্যন্ত মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে আখ্যা দেয়।
১১. যুদ্ধের মানবিক বিধান: ইসলাম যুদ্ধের ক্ষেত্রেও মানবিক বিধান দিয়েছে। যুদ্ধরত নয় এমন বৃদ্ধ, নারী ও শিশুকে হত্যা না করা, ফসল ও ফলের গাছ নষ্ট না করা, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ইত্যাদির ক্ষতি সাধন না করা ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।
মোটকথা, ইসলাম মৌলবাদী ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা প্রকৃত ইসলাম পালন মানুষকে আরও মানবিক, উদার, সৃজনশীল, সভ্য, শালীন এবং উন্নত করে তোলে। এবং ইসলামের নামে বাড়াবাড়ি, সীমা লঙ্ঘন এবং অজ্ঞতা সুলভ কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate