Saturday, August 30, 2025

মৃতকে মাটি দেওয়ার সময় কোন নির্দিষ্ট দো‘আ হাদীসে বর্ণিত হয়নি

 প্রশ্ন: মৃতকে মাটি দেওয়ার সময় “মিনহা খালাক্বনা-কুম ওয়া ফীহা নুঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা” দু’আটি পড়ার বিধান কী?

▬▬▬▬▬▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি। অতঃপর মৃতকে দাফন করার দায়িত্ব শরীয়তের দৃষ্টিতে পুরুষদের উপর ন্যস্ত। কবরের ভেতরে মাটি দেওয়ার সময় কোনো নির্দিষ্ট দো‘আ রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত হয়নি। সুতরাং সে সময় শুধু সাধারণ দো‘আ করা যাবে। আলেমদের একটি অংশের মতে, মৃতদেহ কবরস্থ করার পর সক্ষম ব্যাক্তিরা কবরের মাথার দিক থেকে দাঁড়িয়ে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তিন মুঠো মাটি কবরের উপর ছড়িয়ে দেবেন।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনু কুদামাহ; আল মুগনী; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৭২; বিন বায; মাজমূ‘ ফাতাওয়া; খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ১৯৯)।
.
আমাদের সমাজে মৃতকে কবরে শোয়ানোর সময় প্রথাগতভাবে সূরা ত্বাহা (২০: ৫৫)-এর আয়াত তিলাওয়াত করা হয়ে থাকে। এ আয়াত মৃতের কবরে মাটি দেওয়ার সময় পাঠ করা মুস্তাহাব বলে একদল আলেম মত প্রকাশ করেছেন।যেমন;শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,استحب بعض الفقهاء بعد الدفن أن يحثى على القبر ثلاث حثيات من تراب ، ويقال في الحثية الأولى :(منها خلقناكم) ، وفى الثانية (وفيها نعيدكم) ، وفى الثالثة (منها نخرجكم تارة أخرى)”কোনো কোনো ফকিহ বলেছেন, দাফনের পরে কবরে তিন মুঠ মাটি দেয়া মুস্তাহাব। প্রথম মুঠ দেয়ার সময় বলবে, مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ দ্বিতীয় মুঠ দেয়ার সময় বলবে, وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ আর তৃতীয় মুঠ দেয়ার সময় বলবে, وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى (ইমাম নববী আল মাজমু; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৯৩) এমনকি বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে দু’আটি পাঠ করা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জবাবে তিনি বলেন:هذا سنة، ويقول معه: بسم الله والله أكبر এটি একটি সুন্নাত।পাশাপাশি “বিসমিল্লাহ” এবং “আল্লাহু আকবর”ও বলা যায়।(বিন বায; মাজমু‘ ফাতাওয়া; খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ১৯৭)
.
তবে দলীল হিসেবে যে বর্ণনাটি পেশ করা হয়,সেটি সহীহ নয়।বর্ননাটি হলো—আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,لَمَّا وُضِعَتْ أُمُّ كُلْثُومٍ ابْنَةُ رَسُولِ اللهِ ﷺ فِي الْقَبْرِ ، قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ : ( مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ ، وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى )”রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কন্যা উম্মু কুলছূমকে যখন কবরে রাখা হয়, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেন, ‘মিনহা খালাক্বনা-কুম ওয়া ফীহা নুঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা’। (মুসনাদে আহমাদ হা/২২১৮৭)
.
তাহক্বীক্ব: উক্ত বর্ণনা যঈফ কিংবা জাল। কারন এর সনদে আলী ইবনু যায়েদ ইবনু জুদ‘আন ও উবায়দুল্লাহ বিন যাহর নামে দুইজন পরিত্যক্ত রাবী আছে। বর্ননাটিকে; ইবনু হাজার আসকালানী; ইমাম নববী; ইবনু মুলক্বিন; বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানী; ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহ) সহ অনেকেই এটি অত্যন্ত দূর্বল বলেছেন।(তালখীস পৃষ্ঠা: ১০২; ইমাম আলবানী; আহকামুল জানায়েয; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৫৩; টীকা দ্র:; মাসআলা নং-১০৬; দ্রষ্টব্য)।
.
হাদীসটির সমস্যার বিষয়টি নিয়ে আলেমগণ আলোচনা করেছেন এবং তিনটি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করেছেন।
প্রথমত: যে বিশদ বর্ণনা প্রশ্নে উল্লিখিত হাদীসে পাওয়া গেছে, তা সুন্নাহতে প্রতিপাদ্য হিসেবে বিদ্যমান নয়। ফলে এর মাধ্যমে কোনো শরীয়তসম্মত দলীল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়এমনকি যদি এর সনদ সহীহও হয়।”
.
দ্বিতীয়ত: এ ধরনের বিশদ বিবরণকে ফযায়েলে আমল হিসেবেও গ্রহণযোগ্য করা যায় না। কেননা দুর্বল হাদীস দ্বারা আমল করা মানে হলো কোনো একটি কাজকে শরীয়ত প্রমাণিত ইবাদত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। অথচ শরীয়তের স্বীকৃতির সর্বনিম্ন স্তরও হলো “মুস্তাহাব” বা “সুন্নত” যা শরীয়তের পাঁচটি হুকুমের একটি এবং তা কেবল সহীহ দলীল দ্বারা প্রমাণিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস কোনো কাজে আসে না এ বিষয়ে আলেমগণের মধ্যে সর্বসম্মতি রয়েছে।
.
তৃতীয়ত: আলোচ্য হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল, বরং ইবনু হিব্বান এটিকে “মাওদূ” (মনগড়া) আখ্যা দিয়েছেন। এর কারণ হলো, এটি এসেছে মুসনাদে আহমাদ (৫/২৫৪)-এ উবাইদুল্লাহ ইবনু যুহরের মাধ্যমে, আলী ইবনু ইয়াজিদের থেকে। আর এ আলী ইবনু ইয়াজিদ হচ্ছেন “ইলহানী”। ইমাম নববীর বর্ণনায় যাকে “আলী ইবনু যায়দ ইবনু জুদ‘আন” বলা হয়েছে, তা ভুল; কেননা মুসনাদে আহমাদ এর বর্ণনার সাথে তার মিল নেই। ইবনু হিব্বান বলেছেন: উবাইদুল্লাহ ইবনু যুহর, তিনি শক্তিশালী রাবিদের থেকেও মাওদূ হাদীস বর্ণনা করেন। আর যখন তিনি আলী ইবনু ইয়াজিদ থেকে বর্ণনা করেন তখন আজগুবি কথা নিয়ে আসেন। আর যখন কোনো সনদে উবাইদুল্লাহ, আলী ইবনু ইয়াজিদ এবং কাসিম আবু ‘আবদুর রহমান একসাথে হয়—তখন সেই হাদীস নিঃসন্দেহে তাদের বানানো জাল হাদীস হয়। ইবনু হাজার, তাবিয়ীনুল ‘আজব ফীমা ওয়ারাদা ফী ফাজলি রজব।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,وأما استحباب بعض المتأخرين من الفقهاء أن يقول في الحثية الأولى (منها خلقناكم) ، وفي الثانية (وفيها نعيدكم) ، وفي الثالثة (ومنها نخرجكم تارة أخرى) : فلا أصل له “কিছু পরবর্তী যুগের ফকীহগণ প্রস্তাব করেছেন যে প্রথম মুঠো মাটি নিক্ষেপের সময় বলা হবে: ‘منها خلقناكم’ (আমি তোমাদের এখান থেকেই সৃষ্টি করেছি),দ্বিতীয় মুঠো নিক্ষেপের সময় বলা হবে: ‘وفيها نعيدكم’ (আমি তোমাদের এর মধ্যেই ফিরিয়ে দেব),তৃতীয় মুঠো নিক্ষেপের সময় বলা হবে: ‘ومنها نخرجكم تارة أخرى’ (এবং আমি তোমাদের এখান থেকেই আবার একবার বের করব) তবে এ বিষয়ে শরীয়তে কোনো সঠিক দলিলভিত্তিক প্রমাণ নেই।”(ইমাম আলবানী; আহকামুল জানায়িয; পৃষ্ঠা: ১৫৩)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] প্রশ্ন করা হয়েছিল: “মৃতকে মাটিতে দাফনের সময় “মিনহা খালাক্বনা-কুম ওয়া ফীহা নুঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা” পাঠ করা বৈধ?
তিনি জবাব দিলেন:ذكر بعض أهل العلم أنه يسن أن يحثي ثلاث حثيات .وأما قول “منها خلقناكم ، وفيها نعيدكم ، ومنها نخرجكم تارة أخرى ” : فليس فيه حديث عن رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتمد عليه “
কিছু আলেম বলেন, মৃতদেহের উপর তিনবার মাটি দেওয়া সুন্নাহ। কিন্তু “মিনহা খলাক্বনা-কুম ওয়া ফীহা নুঈদুকুম ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা।” এই বাণীটি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো স্বীকৃত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।”(ইবনে উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৭; পৃষ্ঠা: ১৮৫)।
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনার আলোকে এটি স্পষ্ট হয় যে, কবরে মৃতকে দাফনের সময় কোন নির্দিষ্ট দো‘আ হাদীসে বর্ণিত হয়নি। তাই, মৃত ব্যক্তিকে কবরে শোয়ানোর সময় প্রার্থনা হিসাবে বলা যেতে পারে: “বিসমিল্লাহি ওয়া আলা মিল্লাতি রসুলিল্লাহ।” অথবা “বিসমিল্লাহি ওয়া আলা সুন্নাতি রসুলিল্লাহ।” আর মৃতের কবরে মাটি দেওয়ার সময় সাধারণভাবে শুধুমাত্র “বিসমিল্লাহ” উচ্চারণ করাটাই যথেষ্ট।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate