Saturday, August 30, 2025

শহীদ কত প্রকার এবং যে ব্যক্তি পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি কি শহীদ

 প্রশ্ন: শহীদ কত প্রকার? যে ব্যক্তি পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি কি শহীদ? হাদীসে পেটের পীড়া দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে?

▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর:
.
প্রথমত: মূলনীতি হচ্ছে, সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ’র দলিল অথবা উম্মাহ’র সর্ববাদিসম্মত মত ব্যতীত নির্দিষ্টভাবে কাউকে ‘শহিদ’ বলা বৈধ নয়। তবে যার বাহ্যিক অবস্থা ভালো, আমরা আল্লাহর কাছে তার ‘শহিদ’ হওয়ার আশা রাখব, এই আশা রাখাটাই তার মর্যাদা ও সম্মান হিসেবে যথেষ্ট। আর এ ব্যাপারে প্রকৃত জ্ঞান তার মহামহিমান্বিত স্রষ্টার নিকট রয়েছে। কিন্তু আমরা তাকে সরাসরি ‘শহিদ’ বলব না, আবার তার ব্যাপারে কুধারণাও করব না। আশা রাখার ব্যাপারটি হলো উক্ত দুই অবস্থার মধ্যবর্তী পর্যায়। কিন্তু আমরা দুনিয়ায় তার ওপর শহিদের বিধিবিধান প্রয়োগ করব। সে যদি আল্লাহ’র রাস্তায় জিহাদ করতে গিয়ে নিহত হয়, তাহলে তাকে জানাযাহ’র নামাজ ছাড়াই তার রক্তমাখা কাপড়ে দাফন করতে হবে। আর সে যদি অন্যান্য শহিদদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে তাকে গোসল করাতে হবে, কাফনের কাপড় পরাতে হবে এবং তার জনাযাহ’র নামাজ পড়তে হবে। কেননা আমরা যদি কাউকে নির্দিষ্টভাবে ‘শহিদ’ বলি, তাহলে এই সার্টিফিকেট দেওয়ার মাধ্যমে তাকে ‘বেহেশতবাসী’ বলে সার্টিফিকেট দেওয়া আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অথচ এটি আহলুস সুন্নাহ’র মানহাজ পরিপন্থি। কেননা নাবী ﷺ যে কাজের কাজিকে অথবা নির্দিষ্টভাবে যাদেরকে ‘বেহেশতবাসী’ বলেছেন, তাদেরকে ছাড়া আহলুস সুন্নাহ’র লোকেরা অন্য কাউকে জান্নাতের সার্টিফিকেট দেয় না।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইবনু ‘উসাইমীন; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১১৫-১১৭)
.
দ্বিতীয়ত: ইসলামে শহীদ তিন প্রকার:
.
প্রথমত: যুদ্ধের কারণে কাফিরের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত ব্যক্তি। এই শ্রেণীর শহীদ আখিরাতের সাওয়াবে ও দুনিয়ার বিধানে তথা তাকে গোসল না দেয়া ও তার জন্য সালাতুল জানাযা আদায় না করা উভয় ক্ষেত্রে শহীদ হিসেবে গণ্য।
দ্বিতীয়ত: এই শ্রেণীর শহীদ আখিরাতে শাহাদাতের ফযীলত বা সাওয়াবপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু দুনিয়াতে শাহীদের বিধান প্রযোজ্য হবে না। যেমন : পেটের পীড়ায় নিহত ব্যক্তি, মহামারিতে নিহত, দেয়াল চাপা পড়ে নিহত; নিজের সম্পদ হিফাযাত করতে গিয়ে নিহত ব্যক্তি যাদেরকে সহীহ হাদীস শহীদ বলে অভিহিত করেছে। এই শ্রেণীর শহীদকে গোসল দিতে হবে ও জানাযা আদায় করাতে হবে। তবে এই শহীদগণ প্রথম শ্রেণীর শহীদদের সাওয়াব লাভ করবে না।
তৃতীয়ত: যে ব্যক্তি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে গানীমাতের জন্য কাফিরদের সাথে যুদ্ধে নিহত হয়। এই ধরনের ব্যক্তিকে হাদীসে শহীদ নামে অ্যাখ্যা দিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই শ্রেণীর শাহীদের ও পর দুনিয়াতে শাহাদাতের বিধান প্রযোজ্য। সুতরাং তাকে গোসল দেয়া হয় না এবং সালাতুল জানাযা আদায় করা হয় না। আর তার জন্য আখিরাতে পূর্ণ সাওয়াব হবে না। আল্লাহ সর্বাধিক জ্ঞাত। (শারহে মুসলিম ২য় খন্ড; হা: ২২৫; মিশকাত হা/৩৫১৩)
.
যে ব্যক্তি পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করে হাদিসে তাকে শহীহ বলা হয়েছে। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করবে সে শহিদ।”(সহিহ মুসলিম হা/১৯১৫) অপর বর্ননায় উবাদাহ ইবনু সামিত (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,مَا تَعُدُّوْنَ الشَّهِيْدَ فِيْكُمْ قَالُوا الَّذِىْ يُقَاتِلُ فَيُقْتَلُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ تَعَالَى فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ شُهَدَاءَ أُمَّتِىْ إِذًا لَقَلِيْلٌ الْقَتِيْلُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى شَهِيْدٌ وَالْمَطْعُوْنُ شَهِيْدٌ وَالْمَبْطُوْنُ شَهِيْدٌ وَالْمَرْأَةُ تَمُوْتُ بِجُمْعٍ شَهِيْدٌ”তোমরা তোমাদের মধ্যে কাদেরকে শহীদ হিসাবে গণ্য করবে? ছাহাবীগণ বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে নিহত হয় সেই শহীদ। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাহলে তো আমার উম্মতের মধ্যে শহীদের সংখ্যা কম হয়ে যাবে। (আরো শহীদ আছে, তারা হল) আল্লাহ ত্বাবারাকা ওয়া তা‘আলার রাস্তায় নিহত ব্যক্তি শহীদ, প্লেগ রোগে নিহত ব্যক্তি শহীদ, পেটের পিড়ায় নিহত ব্যক্তি শহীদ ও প্রসব বেদনায় নিহত মহিলা শহীদ’ (মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৭৭২; ইবনু মাজাহ, হা/২৮০৪, সনদ সহীহ) আরেক হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরও বলেছেন;“পাঁচ ধরনের মৃত্যু শাহাদাত হিসেবে গণ্য। প্লেগ রোগে মৃত্যু, পেটের পীড়ায় মৃত্যু, পানি ডুবে মৃত্যু, কোন কিছু ধ্বসে পড়ে মৃত্যু এবং আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হওয়া।” (সহিহ বুখারি হা/২৮২৯; ও সহিহ মুসলিম হা/১৯১৫) তিনি আরো বলেন, সে ব্যক্তি কবরের ফিৎনা থেকে রক্ষা পাবে যার পেট তাকে হত্যা করেছে।(তিরমিযী হা/১০৬৪; মিশকাত হা/১৫৭৩;সহীহুত তারগীব হা/১৪১০)। উক্ত হাদীসগুলির ভিত্তিতে আলেমগন ইজতিহাদ করে বলেছেন যে, উপরোক্ত কঠিন রোগ সমূহে মারা যাওয়া ব্যক্তিরা আখেরাতে শহীদের মর্যাদা পাবে।(ফাৎহুল বারী; পৃষ্ঠা: ৬; পৃষ্ঠা: ৬৬; নববী; শারহু মুসলিম; খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৬৩; শানক্বীতী; যাদুল মুস্তাকনি খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা: ২৩৪)।
.
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] উল্লেখ করেছেন: শাস্ত্রবিদদের মতে, আল্লাহর রহমতে এমন মৃত্যুকে শুধুমাত্র শাহাদাতের শ্রেণিতে ধরা হয়, কারণ এ ধরনের মৃত্যু অত্যন্ত কষ্টদায়ক ও বেদনাদায়ক। তারা বলেন, যারা আল্লাহর পথে জিহাদের ময়দানে নিহত হয়েছেন তাদের ব্যতীত, বাকি সকলের ক্ষেত্রেই ‘শাহাদাত’ বলতে বোঝানো হয় যে আখেরাতে তাদের জন্য শহীদদের সমান প্রতিদান নির্ধারিত হয়েছে। তবে এদের জন্য পৃথিবীতে গোসল করানো এবং জানাজার নামাজ আদায় করা আবশ্যক।”(নববী শারহু সহীহ মুসলিম খণ্ড; ১৩: পৃষ্ঠা: ৬৩; ইসলাম সাওয়াল জবাব ফাতওয়া নং-২৬৬৯৮৭)
.
হাদিসে পেটের পীড়া দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে? এই মাসালায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,
” وَأَمَّا ( الْمَبْطُون ) فَهُوَ صَاحِب دَاء الْبَطْن , وَهُوَ الإِسْهَال . قَالَ الْقَاضِي : وَقِيلَ : هُوَ الَّذِي بِهِ الاسْتِسْقَاء وَانْتِفَاخ الْبَطْن , وَقِيلَ : هُوَ الَّذِي تَشْتَكِي بَطْنه , وَقِيلَ : هُوَ الَّذِي يَمُوت بِدَاءِ بَطْنه مُطْلَقًا
আল-মাবতূন (المبطون) হলেন তিনি, যিনি পেটের রোগে আক্রান্ত। আর এর দ্বারা মূলত ডায়রিয়া (আলসার) বোঝানো হয়। কাদী ইয়া‌য বলেছেন: বলা হয়েছে—তিনি হলেন সেই ব্যক্তি, যার দেহে জলবসন্ত/অতিরিক্ত পানি জমে (Ascites) পেট ফুলে গেছে। আবার কেউ বলেছেন—তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি পেটব্যথায় ভোগেন।আরও বলা হয়েছে—যে কেউ পেটের যেকোনো রোগে মারা যান, তাকেই ‘আল-মাবতূন’ বলা হয়।”
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:“ হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি পেটের রোগে মারা যায় সে শহীদ। পেটের রোগে মারা যাওয়া বলতে কী বোঝায়? এটি কি লিভার সিরোসিসে মারা যাওয়া ব্যক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করে?
জবাবে তিনি বলেন:
“المبطون قال أهل العلم : من مات بداء البطن ،والظاهر أن من جنسه من مات بالزائدة لأنها من أدواء البطن التي تميت ، ولعل من ذلك أيضاً من مات بتليف الكبد لأنها داء في البطن مميت
আল-মাবতূন সম্পর্কে আলেমগণ বলেছেন—তিনি হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি পেটের রোগে মারা যান। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, পেটের এমন রোগও এর অন্তর্ভুক্ত, যেমন এপেন্ডিসাইটিস (الزائدة – অ্যাপেন্ডিক্সের প্রদাহ); কারণ এগুলোও পেটের রোগ যা মৃত্যু ঘটাতে পারে। এর অন্তর্ভুক্ত হবেন সেই ব্যক্তিও, যিনি লিভার সিরোসিসে মারা গেছেন; কারণ সেটিও পেটের এমন একটি রোগ, যা মৃত্যুর কারণ হয়।”(ইবনু উসাইমীন, মাজাল্লাতুদ দাঈয়াহ; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯২৮২)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate