Monday, September 29, 2025

মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত সালাত আদায় না করা পর্যন্ত বসা নিষিদ্ধ

 হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে প্রবেশকারী ব্যক্তিকে দুই রাকাত সালাত আদায় করার আগে বসতে নিষেধ করেছেন।

নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمْ الْمَسْجِدَ فَلَا يَجْلِسْ حَتَّى يُصَلِّيَ رَكْعَتَيْنِ”
“যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন সে যেন দুই রাকাত সালাত আদায় না করা পর্যন্ত না বসে।” [সহিহ মুসলিম, হা/৭১৪]
বরং নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমার দিন খুতবা দেওয়ার সময় এক ব্যক্তিকে দেখলেন যে, সে বসে পড়ছে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন,
“أَصَلَّيْتَ؟
‘তুমি কি সালাত আদায় করেছ?’
সে বলল, ‘না।’
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
“قُمْ فَصَلِّ رَكْعَتَيْنِ وَتَجَوَّزْ فِيهِمَا
‘তুমি ওঠো এবং দ্রুত দুই রাকাত সালাত আদায় করো।’ [সহিহ মুসলিম]
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বসার বা খুতবা শোনার অনুমতি দেননি যতক্ষণ না সে দুই রাকাত সালাত আদায় করে। তবে তিনি তাকে দ্রুত সালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে সে খুতবা শুনতে পারে। কারণ খুতবা শোনা ওয়াজিব।
এ কারণেই যদি কোনো ব্যক্তি অন্যের সাথে কথা বলে- এমনকি সৎ কাজের আদেশও দেয় তবে সে জুমার প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“إِذَا قُلْتَ لِصَاحِبِكَ أَنْصِتْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالْإِمَامُ يَخْطُبُ فَقَدْ أَلْغَوْتَ”
“যখন তুমি তোমার সঙ্গীকে জুমার দিন ইমাম খুতবা দেওয়ার সময় ‘চুপ করো’ বলবে, তখন তুমি অনর্থক কাজ করলে।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]
সুতরাং যখনই তোমাদের কেউ দিনের বা রাতের যে কোনো সময় মসজিদে প্রবেশ করবে তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ পালনার্থে এবং তার নিষেধ থেকে বিরত থাকার জন্য দুই রাকাত সালাত আদায় না করে বসবে না।
-আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ.
শাইখের বক্তব্যের ভিডিও (বাংলা ক্যাপশন সহ)
ভিডিও বক্তব্য থেকে অনুবাদ:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।

ইসলামের দৃষ্টিতে পিটি করা কি জায়েজ

 প্রশ্ন: ইসলামের দৃষ্টিতে পিটি (PT) করা কি জায়েজ?

উত্তর: পিটি (PT) শব্দটি ফিজিক্যাল ট্রেনিং (Physical Training)-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। যার আরেক নাম, শরীর চর্চা (Physical Exercise)।
এটি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণত শিক্ষার্থীদের শারীরিক সক্ষমতা, সুস্থতা, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি, সুশৃঙ্খলার অনুশীলন ইত্যাদি উদ্দেশ্যে একটি স্বতন্ত্র ক্লাস বা বিষয় হিসাবে গণ্য করা হয়। এই ক্লাসে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ব্যায়াম, খেলাধুলা এবং শারীরিক কার্যকলাপ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সুস্থ ও সক্রিয় জীবনযাপনের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে তা নাজায়েজ নয়। তবে অবশ্যই কতিপয় শর্তসাপেক্ষে। যেমন:
১. প্রাপ্ত বয়স্ক ছাত্র-ছাত্রী একসাথে ব্যায়াম, খেলাধুলা বা পিটি করা জায়েজ নেই। বরং ছাত্র ও ছাত্রীরা পৃথক পৃথক স্থানে তা করতে পারে।
২. প্রাপ্ত বয়স্ক বা কিছুটা বড় বুঝমান ছাত্রীরা স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষিত স্থানে পোশাকের শালীনতা বজায় রেখে তা করতে পারে। সেক্ষেত্রে কোনও পুরুষ শিক্ষার্থী, কর্মচারী, এমনকি পুরুষ প্রশিক্ষকও থাকতে পারবে না।
ইসলামি স্কলারগণ বলেছেন.
وممارسة الفتيات البالغات الرياضة، بحيث يراهن المعلم، أو الطلبة الذكور البالغون؛ قد تكون فيها مخالفة للشرع، الذي أمر النساء بالستر، ونهى عن كل ما يثير الفتنة، ويحرك الشهوة
“প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের খেলাধুলা বা পিটিতে অংশগ্রহণ—যেখানে তাদেরকে পুরুষ শিক্ষক কিংবা বয়ঃপ্রাপ্ত ছাত্ররা দেখে—এ ধরনের কর্মকাণ্ড শরিয়তের বিরোধী হতে পারে। কারণ শরিয়ত নারীদের পরিপূর্ণ পর্দা বজায় রাখার আদেশ দিয়েছে এবং যে কোনও ফিতনা ও কামনা-বাসনা উসকে দেয়—এমন বিষয় থেকে বিরত থাকতে বলেছে।” [ইসলাম ওয়েব]
৩. পিটি করার সময় মিউজিক ব্যবহার করা জায়েজ নেই। কেননা ইসলামে মিউজিক সর্বাবস্থায় হারাম।
৪. শারীরিক কসরত, ভার উত্তোলন, দৌড়াদৌড়ি বা খেলাধুলার ক্ষেত্রে এমন কিছু কার্যক্রম করা যাবে না যা শিক্ষার্থীদের শারীরিক বা মানসিক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়।
৫. শিক্ষার্থীদের পোশাক-আশাক এত টাইট-ফিট হওয়া যাবে না যাতে তাদের শারীরিক অবকাঠামো ফুটে উঠে বা এত পাতলা ফিনফিনে পোশাক পরিধান করা যাবে না যাতে তার চামড়া দেখা যায়।
৬. এমন পোশাক পরিধান করা জায়েজ নাই যাতে সতর (শরীরের যে অঙ্গটা ঢেকে রাখা আবশ্যক) তা অনাবৃত হয়ে যায়।
৭. শারীরিক কসরতের ক্ষেত্রে কাফেরদের সাদৃশ্য হয় এমন কোন কিছু করা যাবে না। যেমন: প্রশিক্ষকের সামনে মাথা নত করে বাউ করা।
৮. সর্বাবস্থায় শরয়ি পর্দা লঙ্ঘন করা হারাম।
৯. প্রশিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করা জায়েজ নাই।
১০. পিটি বা শরীর চর্চা করতে গিয়ে যেন কোনোভাবেই সালাত ত্যাগ, ছেলেদের মসজিদে জামাত ত্যাগ, রোজা ভঙ্গ করার মত বিষয়গুলো না ঘটে।
১১. মুসলিমদের জন্য এমন কোন উৎসব বা উপলক্ষে প্যারেড বা কুচকাওয়াজ করা জায়েজ নাই যা ইসলামি শরিয়তে অনুমদতি নয়।
মোটকথা, শারীরিক সুস্থতার উদ্দেশ্যে শারীরিক কসরত, শরীর চর্চা, ব্যায়াম, পিটি, প্যারেড ইত্যাদি করা জায়েজ যদি ইসলামের সীমারেখার মধ্যে থেকে তা করা হয়। অন্যথায় তা হারাম।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

ক্ষমতার লোভ এবং দায়িত্বে অবহেলার কঠিন পরিণতি

 আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إنَّكُمْ سَتَحْرِصُونَ علَى الإمارَةِ، وسَتَكُونُ نَدامَةً يَومَ القِيامَةِ، فَنِعْمَ المُرْضِعَةُ وبِئْسَتِ الفاطِمَةُ.
“তোমরা অবশ্যই নেতৃত্বের প্রতি আগ্রহী হবে, অথচ তা হবে অনুতাপ ও আফসোসের কারণ। কতই না উত্তম তার দুধপানের সময়টা, আর কতই না নিকৃষ্ট তার দুধ ছাড়ানোর সময়টা।” [সহিহ বুখারি, হা/৭১৪৮]
❑ হাদিসের ব্যাখ্যা:
এই হাদিসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নেতৃত্ব বা পদ-পদবির আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে উম্মাহকে সতর্ক করেছেন।
✪ ক. “তোমরা অবশ্যই নেতৃত্বের প্রতি আগ্রহী হবে”:
এই বাক্যটি মানুষের সহজাত দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করে, যে মানুষ ক্ষমতা, সম্মান এবং প্রভাবের প্রতি সহজে আকৃষ্ট হয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই ভবিষ্যৎবাণী বর্তমানে আমাদের সমাজের বাস্তবতায় প্রমাণিত।
✪ খ. “অথচ তা হবে অনুতাপ ও আফসোসের কারণ”:
এই নেতৃত্ব যখন একজন ব্যক্তির ওপর অর্পিত হয় তখন তার দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। সে যদি ইনসাফ প্রতিষ্ঠা না করে বা জনগণের অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে এর জন্য কঠিন জবাবদিহি করতে হবে। এই জবাবদিহির ভয়ে এবং দায়বদ্ধতার কারণে তা অনুতাপ ও আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
✪ গ. “কতই না উত্তম তার দুধপানের সময়টা”:
এর দ্বারা নেতৃত্বের প্রাথমিক পর্যায়কে বোঝানো হয়েছে। যখন একজন ব্যক্তি পদ বা ক্ষমতা লাভ করে তখন সে সম্মান, প্রতিপত্তি ও জাগতিক সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করে। এই সময়টা একজন নবজাতকের মায়ের দুধ পানের মতোই সুস্বাদু ও আরামদায়ক মনে হয়।
✪ ঘ. “আর কতই না নিকৃষ্ট তার দুধ ছাড়ানোর সময়টা”:
এর দ্বারা নেতৃত্বের শেষ পরিণতিকে বোঝানো হয়েছে। দুধ ছাড়ানোর সময় যেমন শিশু কষ্ট পায় ঠিক তেমনি ক্ষমতা হারানোর পর বা কিয়ামতের দিন যখন এই নেতৃত্বের হিসাব দিতে হবে তখন সেই কষ্ট ও অনুতাপ হবে অত্যন্ত কঠিন। ওই দিন সমস্ত ক্ষমতা ও সম্মান বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং এর কারণে সৃষ্ট পাপের বোঝা তাকে বহন করতে হবে।
আমাদের দেশের বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার মসনদে থাকা লোকগুলোর করুণ পরিণতি দেখলে এই হাদিসের প্রকৃত মমার্থ উপলব্ধি করা সহজ হয়ে যায়।
➧ এই হাদিসের মূল শিক্ষা হলো:
মুসলিমদের উচিত নয়, কোনো পদের জন্য লালায়িত হওয়া। বরং যদি কোনো দায়িত্ব অর্পিত হয়, তবে তা সততা ও ইনসাফের সাথে পালন করা উচিত, যেন কিয়ামতের দিনের অনুতাপ থেকে বাঁচা যায়।
❑ আদ দুরার ওয়েব সাইটে এই হাদিসের ব্যাখ্যায় লেখা হয়েছে:
– মানুষের নেতা হওয়া বা তাদের ওপর কর্তৃত্ব করা আসলে একটা দায়িত্ব। এর মানে হলো, পবিত্র শরিয়াহ অনুযায়ী মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং তাদের সব বিষয় ভালোভাবে দেখাশোনা করা। নেতৃত্ব মানে মানুষের ওপর অহংকার বা জোর খাটানো নয়, যেমনটা অনেক নেতা করে থাকে। তারা মানুষের অধিকার ভুলে যায় এবং নেতৃত্বকে নিজেদের জন্য সুযোগ আর আরাম-আয়েশের মাধ্যম মনে করে। এমন সব নেতাদের জন্য তাদের এই নেতৃত্ব কিয়ামতের দিন চরম কষ্ট আর অপমানের কারণ হবে।
– আর এই হাদিসে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা অবশ্যই নেতৃত্বের প্রতি আগ্রহী হবে”। এর মানে হলো, ভবিষ্যতে এমন একটা সময় আসবে, যখন মানুষ যেকোনো পদের জন্য লোভ করবে। কিন্তু এই পদ তাদের জন্য লজ্জা ও আফসোসের কারণ হবে যদি তারা এর দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করে। বরং যদি তারা জুলুম করে, অহংকার ও দাপট দেখায়, তবে দুনিয়াতে এই পদ তাদের সম্মান ও মর্যাদা দিলেও কিয়ামতের দিন তা তাদের জন্য অপমান আর লাঞ্ছনার কারণ হবে।
– এ কারণেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কতই না উত্তম তার দুধপানের সময়টা আর কতই না নিকৃষ্ট তার দুধ ছাড়ানোর সময়টা।” এর শুরুটা দুনিয়াতে সবার কাছে অনেক ভালো ও প্রিয় মনে হয়। তখন নেতা সেই শিশুর মতো হয় যাকে তার মা পুষ্টি দেয়। (আর তা হলো এই ক্ষমতা বা নেতৃত্ব) কিন্তু কিয়ামতের দিন এর পরিণতি হবে খুবই খারাপ। এর ফল হবে নিন্দনীয়। এমনকি দুনিয়াতেও এর ফল খারাপ হতে পারে, যেমন—ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া বা হত্যা করা।
❑ এই হাদিস থেকে আমরা যা শিখতে পারি:
➧ ক. নেতা হওয়ার জন্য লোভ করা খারাপ।
➧ খ. যারা মানুষের দায়িত্ব নিয়ে তাদের অধিকার পূরণ করে না তাদের পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হবে তা এখানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে।
[dorar]
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

খাবার শেষে হাতের আঙ্গুল ও প্লেট বা পাত্র চেটে খাওয়া এবং প্লেট ধুয়ে পানি পান করা

 খাবার শেষে হাতের আঙ্গুল, প্লেট বা পাত্র চেটে খাওয়া এবং প্লেট ধুয়ে পানি পান করা: কোনটা সুন্নত আর কোনটা সুন্নত নয়। খাবারের পর হাতের আঙ্গুল এবং প্লেট চেটেপুটে পরিস্কার করে খাওয়া সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। তবে খাওয়ার পর প্লেট বা খাবারের পাত্র ধুয়ে পানি পান করা সুন্নত নয় যা আমাদের সমাজের কিছু মানুষ ধারণা করে থাকে। কেননা এ বিষয়ে কোনও হাদিস সাব্যস্ত হয়নি।

◈ খাবারের পর হাতের আঙ্গুল এবং প্লেট বা খাবার পাত্র চেটেপুটে পরিস্কার করে খাওয়া সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। এ মর্মে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
প্রখ্যাত সাহাবি জাবের রা. হতে বর্ণিত,
أنَّ رَسُول الله ﷺ أَمَرَ بِلَعْقِ الأَصَابِعِ وَالصَّحْفَةِ، وَقَالَ: «إنَّكُمْ لا تَدْرونَ في أَيِّها البَرَكَةُ»
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (খাবার পর) আঙ্গুলগুলো ও বাসন চেটে খাওয়ার আদেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘‘এগুলোর কোনটিতে বরকত আছে তা তোমরা জান না।’’ [সহিহ মুসলিম, হা/২০৩৩]
জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত অপর হাদিসে এসেছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا أَكَلَ أَحَدُكُمْ فَلَا يَمْسَحْ أَصَابِعَهُ حَتَّى يَلْعَقَهَا فَإِنَّهُ لَا يَدْرِي فِي أَيِّ طَعَامِهِ كَانَتِ الْبَرَكَةُ»
‘‘যখন তোমাদের খাবার খাবে আঙ্গুল চেঁটে না খেয়ে হাত মুছবেনা। কেননা তোমরা জান না যে, কোন খাবারে বরকত আছে।’’ [মুসলিম, হা/২০৩৩]
◈ অনুরূপভাবে খাবার মাটিতে পড়ে গেলে তা তুলে পরিষ্কার করে খাওয়াও সুন্নাহ:
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إنَّ الشَّيْطَانَ يَحْضُرُ أَحَدَكُمْ عِنْدَ كُلِّ شَيْءٍ مِنْ شَأْنِهِ ، حَتَّى يَحْضُرَهُ عِنْدَ طَعَامِهِ ، فَإِذَا سَقَطَتْ مِنْ أَحَدِكُمْ اللُّقْمَةُ فَلْيُمِطْ مَا كَانَ بِهَا مِنْ أَذًى ثُمَّ ليَأْكُلْهَا وَلَا يَدَعْهَا لِلشَّيْطَانِ ، فَإِذَا فَرَغَ فَلْيَلْعَقْ أَصَابِعَهُ ؛ فَإِنَّهُ لَا يَدْرِي فِي أَيِّ طَعَامِهِ تَكُونُ الْبَرَكَةُ
‘‘নিশ্চয় শয়তান তোমাদের কারো নিকট তার প্রত্যেক কাজে হাজির হয়। এমনকি সে তার খাবার সময়েও হাজির হয়। সুতরাং যখন তোমাদের মধ্যে কারো খাবারে লোকমা (গ্রাস) পড়ে যাবে তখন তাতে যে ময়লা থাকে তা পরিষ্কার করে খেয়ে নেয় এবং তা শয়তানের জন্য না ছাড়ে।’’ [সহীহ মুসলিম, হা/২০৩৩]
◈ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন,
إذَا سَقَطَتْ لُقْمَةُ أَحَدِكُمْ فَلْيُمِطْ عَنْهَا الأذَى وَلْيَأْكُلْهَا، وَلَا يَدَعْهَا لِلشَّيْطَانِ، وَأَمَرَنَا أَنْ نَسْلُتَ القَصْعَةَ، قالَ: فإنَّكُمْ لا تَدْرُونَ في أَيِّ طَعَامِكُمُ البَرَكَةُ
“যদি তোমাদের কারো হাত থেকে খাবারের লোকমা পড়ে যায় তাহলে ময়লা পরিষ্কার করে তা খেয়ে নাও। শয়তানের জন্য তা ফেলে রেখো না। তিনি প্লেট বা পাত্র ভালোভাবে মুছে পরিষ্কার করতেও বলেছেন। কারণ তিনি বলেছেন, তোমরা জানো না, তোমাদের কোন খাবারের অংশে বরকত আছে।” [সহিহ মুসলিম, হা/২০৩৪]
❑ আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল ইবনে উসাইমিন (রহ.) খাবারের আদব সম্পর্কে বলেছেন:
“খাবারের আদবগুলোর মধ্যে একটি হলো, যদি খাবারের কোনো অংশ মাটিতে পড়ে যায় তবে তা ফেলে রাখা যাবে না। কারণ শয়তান মানুষের সব কাজে তার সাথে উপস্থিত থাকে। যদি কোনো ব্যক্তি এই কাজটি করে,তবে সে তিনটি বড় উপকার লাভ করে:
১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ পালন করা হয়: এটি তাঁর আদেশ পালনের একটি অংশ।
২. আল্লাহর প্রতি বিনয় প্রকাশ করা হয়: এটি আল্লাহর প্রতি বিনয় ও নম্রতা প্রকাশের একটি উপায়।
৩. শয়তানকে বঞ্চিত করা হয়: শয়তান যাতে সেই খাবার খেতে না পারে সে জন্য তাকে বঞ্চিত করা হয়।
এই তিনটি উপকার হাসিল করার জন্য খাবারের পড়ে যাওয়া অংশ উঠিয়ে পরিষ্কার করে খেয়ে নেওয়া উচিত।” [শারহ রিয়াদুস সালিহিন, ১/৪৫৯]
তাই আমাদের কতর্ব্য, সুন্নাহ অনুযায়ী খাবার শেষে হাতের আঙ্গুল ও প্লেট চেটেপুটে পরিস্কার করে খাওয়া। কিন্তু যেহেতু খবারের প্লেট ধুয়ে পানি খাওয়ার নির্দেশনার ব্যাপারে কোন হাদিস পাওয়া যায়নি তাই দলিল ছাড়া তা সুন্নত বলার সুযোগ নাই। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
(লিসান্স, মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়), দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

পৃথিবীর গোলাকার হওয়ার ব্যাপারে যেসব আয়াত এসেছে এবং পৃথিবী সমতল হওয়ার ব্যাপারে যেসব আয়াত এসেছে এ দুটির মাঝে কি কোনো বিরোধ আছে

 ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর, পৃথিবী গোলাকার না সমতল—এটি এমন একটি বিষয়, যার ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহতে কোনো স্পষ্ট ও চূড়ান্ত বক্তব্য পাওয়া যায় না। যদি এ বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকত, তবে মুসলিম হিসেবে তা মেনে নেওয়া আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য হতো। বাস্তবে পক্ষে-বিপক্ষে যা কিছু বলা হচ্ছে, সবই গবেষণা ও অনুমাননির্ভর। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই গবেষণার আমাদের ঈমান-আমল বা দৈনন্দিন জীবনে আসলেই কোনো উপকারিতা আছে কি? আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামগ্রিক উম্মাহর জীবনে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যেগুলোর ওপর মনোযোগ দেওয়া অনেক বেশি জরুরি। সেসব বিষয় জীবনমান উন্নত করতে পারে এবং বাস্তব সমস্যার সমাধান দিতে পারে। অন্যদিকে, পৃথিবী গোলাকার না সমতল—এটি ঈমান বা আকীদার কোনো বিষয় নয়। ফলে এই বিতর্কের কোনো বাস্তব প্রভাব নেই আমাদের ঈমান, আমল কিংবা দুনিয়াবি জীবনে।এটি যে আক্বীদাগত মাসালা নয় সেই বিষয়ে ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহ যে বিষয়ে নীরব থেকেছে, সে বিষয়ে নীরব থাকা-ই ঈমানের সৌন্দর্য।মহান আল্লাহর বহু হুকুম আহকাম ও রাসূল (ﷺ) -এর বহু দিক-নির্দেশনা এখনো আমাদের অজ্ঞাত বা অল্প জানা, যেগুলো আয়ত্ত করা আমাদের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। সুতরাং মহাজ্ঞানী আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) যখন পৃথিবী গোলাকার নাকি সমতল সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু বলেননি, তখন রাসূল (ﷺ)-এর উম্মত হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো—এ নিয়ে বাড়াবাড়ি বা অকারণে বিতর্ক থেকে বিরত থাকা। কেননা,যদি সত্যিই এ তথ্য আমাদের জন্য জরুরী হতো, তবে নিশ্চয়ই রাসূল (ﷺ) তা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতেন।কারন রাসূল (ﷺ) বলেছেন,مَا تَرَكْتُ شَيْئًا مِمَّا أَمَرَكُمُ اللهُ بِهِ إِلاَّ وَقَدْ أَمَرْتُكُمْ بِهِ وَلاَ تَرَكْتُ شَيْئًا مِمَّا نَهَاكُمُ اللهُ عَنْهُ إِلاَّ وَقَدْ نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ- ‘”আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন এমন কোন জিনিসই আমি (বর্ণনা করতে) ছাড়িনি। আর আমি তার হুকুম তোমাদেরকে অবশ্যই দিয়েছি। আর আমি এমন কোন জিনিসই ছাড়িনি যা আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছেন। কিন্তু আমি তোমাদেরকে তা অবশ্যই নিষেধ করেছি”।(মুসনাদ আহমদ ১৭১৭৪; তাবরাবী কাবীর হা/১৬৪৭; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৮০৩; আস-সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/১৩৮২৫)

.
তবে যেহেতু বর্তমানে পৃথিবী গোলাকার না সমতল—এ প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু আবেগপ্রবণ তরুণ ফেসবুকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে এবং সম্মানিত আলেমদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করছে। তাই এই বিষয়ে প্রসিদ্ধ আলেমদের বক্তব্য তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি।
.
বিশুদ্ধ আকিদা মানহাজে প্রসিদ্ধ অনেক আলেম পৃথিবীর গোলাকার হওয়ার বিষয়ে সর্বসম্মত মত (ইজমা) উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) ইমাম আবুল হুসাইন ইবনুল মুনাদী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন:“ইমাম আবুল হুসাইন আহমদ ইবনে জাফর ইবনুল মুনাদী (রাহিমাহুল্লাহ)—যিনি ইসলামি জ্ঞানের বহু শাখা ও গ্রন্থ রচনায় অনন্য কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বালের অনুসারী দ্বিতীয় প্রজন্মের বিশিষ্ট আলেমদের অন্তর্ভুক্ত—তিনি বলেছেন:
لا خلاف بين العلماء أن السماء على مثال الكرة …..
قال : وكذلك أجمعوا على أن الأرض بجميع حركاتها من البر والبحر مثل الكرة . قال : ويدل عليه أن الشمس والقمر والكواكب لا يوجد طلوعها وغروبها على جميع من في نواحي الأرض في وقت واحد ، بل على المشرق قبل المغرب “
“আলেমদের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই যে আসমান গোলকের মতো। তিনি আরও বলেন: আলেমগণ এ বিষয়েও ঐক্যমত্যে পৌঁছেছেন যে স্থল ও সমুদ্রসহ সমগ্র পৃথিবীও গোলাকার। এর প্রমাণ হলো এই যে, সূর্য, চন্দ্র এবং অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের উদয় ও অস্ত যাওয়া পৃথিবীর সব অঞ্চলে একই সময়ে ঘটে না,বরং প্রথমে পূর্বে উদয় হয়, তারপর ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে সরে যায়।”(ইবনু তাইমিয়া মাজমূ‘ আল-ফাতাওয়া; খণ্ড; ২৫; পৃষ্ঠা; ১৯৫)
.
পৃথিবী গোলাকার এই বিষয়ে ইবনু ইবন হাযম রাহিমাহুল্লাহসহ বহু সংখ্যক আলেম দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহর বানী:یُكَوِّرُ الَّیۡلَ عَلَی النَّهَارِ وَ یُكَوِّرُ النَّهَارَ عَلَی الَّیۡلِ “তিনি রাত দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাতকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা”।(সুরা যুমার: ৫) তবে সাধারণ মানুষের চোখে পৃথিবী সমতল দেখায়, কারণ এর আকার অনেক বড়। এর গোলাকার আকৃতি স্বল্প দূরত্ব থেকে বোঝা যায় না। তাই দেখার দিক থেকে এটি সমতল, কিন্তু সামগ্রিকভাবে এটি গোলাকার।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: পৃথিবী কি গোলাকার নাকি সমতল?
তাঁরা জবাবে বলেন:الأرض كروية الكل مسطحة الجزء “
“পৃথিবী সামগ্রিকভাবে গোলাকার,কিন্তু এর অংশবিশেষ সমতল।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ২৬; পৃষ্ঠা: ৪১৪)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:لو قال قائل: إن الله عز وجل أخبر أن الأرض قد سطحت، قال: ( وإلى الأرض كيف سطحت) الغاشية/ 20 ، ونحن نشاهد أن الأرض مكورة ، فكيف يكون خبره خلاف الواقع ؟ فجوابه : أن الآية لا تخالف الواقع ، ولكن فهمه خاطئ إما لقصوره أو تقصيره ، فالأرض مكورة مسطحة ، وذلك لأنها مستديرة ، ولكن لكبر حجمها لا تظهر استدارتها ، وحينئذ يكون الخطأ في فهمه، حيث ظن أن كونها قد سطحت مخالف لكونها كروية “যদি কেউ বলে যে, আল্লাহ তা’আলা জানিয়েছেন যে পৃথিবী সমতল করা হয়েছে, যেমন তিনি বলেছেন: ‘এবং পৃথিবীর দিকে যে, কীভাবে তা সমতল করা হয়েছে?’ (সূরা আল-গাশিয়াহ;২০)। কিন্তু আমরা তো দেখছি পৃথিবী গোলাকার, তাহলে কি আল্লাহ তাআলার বানী বাস্তবের বিপরীত? এর উত্তর হলো: আয়াতটি বাস্তবতার বিপরীত নয়। বরং তার বোঝায় ভুল রয়েছে, হয়তো তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে কিংবা ত্রুটির কারণে। পৃথিবী গোলাকার এবং সমতল উভয়ই। কারণ এটি গোলাকার হলেও এর বিশাল আকারের কারণে এর গোলাকার ভাব প্রকাশ পায় না। এই পরিস্থিতিতে, তার বোঝার ভুল হয়, যখন সে মনে করে যে এর সমতল হওয়া এর গোলাকার হওয়ার বিপরীত।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৬৪৪) অর্থাৎ,কোরআনের আয়াতসমূহের মাঝে কোনো ধরনের বিরোধ নেই। বাস্তবতাও এটাই যে পৃথিবী মূলত গোলাকার, তবে তার বিশালত্বের কারণে মানুষের চোখে সমতল মনে হয়।”
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: দু’জন মানুষ আসমান ও জমিনের আকৃতি নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হলো। তাদের একজন বলল, “ আসমান এবং পৃথিবী উভয়ই গোলাকার।” আরেকজন এ কথাটিকে অস্বীকার করে বলল, “এর কোনো ভিত্তি নেই” এবং সে তা প্রত্যাখ্যান করল। এ ক্ষেত্রে সঠিক অভিমত কোনটি?
তিনি উত্তরে বলেন:
السموات مستديرة عند علماء المسلمين ، وقد حكى إجماع المسلمين على ذلك غير واحد من العلماء أئمة الإسلام : مثل أبي الحسين أحمد بن جعفر بن المنادي أحد الأعيان الكبار من الطبقة الثانية من أصحاب الإمام أحمد وله نحو أربعمائة مصنف ، وحكى الإجماع على ذلك الإمام أبو محمد بن حزم وأبو الفرج بن الجوزي ، وروى العلماء ذلك بالأسانيد المعروفة عن الصحابة والتابعين ، وذكروا ذلك من كتاب الله وسنة رسوله ، وبسطوا القول في ذلك بالدلائل السمعية ، وإن كان قد أقيم على ذلك أيضا دلائل حسابية ، ولا أعلم في علماء المسلمين المعروفين من أنكر ذلك ، إلا فرقة يسيرة من أهل الجدل لما ناظروا المنجمين قالوا على سبيل التجويز : يجوز أن تكون مربعة أو مسدسة أو غير ذلك ، ولم ينفوا أن تكون مستديرة ، لكن جوزوا ضد ذلك ، وما علمت من قال إنها غير مستديرة – وجزم بذلك – إلا من لا يؤبه له من الجهال
…”মুসলিম আলেমদের মতে আকাশমণ্ডলী গোলাকার। এবং মুসলিমদের এ বিষয়ে ঐকমত্য আছে বলে একাধিক ইসলামের ইমাম শ্রেণির আলেম বর্ণনা করেছেন। যেমন: আবুল হুসাইন আহমদ ইবনে জাফর ইবনুল মুনাদী (রাহিমাহুল্লাহ)., যিনি ইমাম আহমদের শিষ্যদের দ্বিতীয় স্তরের প্রখ্যাত শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একজন, এবং প্রায় চারশোটি গ্রন্থ রচনা করেছেন—তিনি এ ব্যাপারে ইজমা বর্ণনা করেছেন। তেমনিভাবে ইমাম আবু মুহাম্মদ ইবনু হাযম (রাহিমাহুল্লাহ) ও আবুল ফারজ ইবনুল জাওযীও এ (ইজমা) ঐকমত্য উল্লেখ করেছেন। আলেমগণ পরিচিত সনদসমূহের মাধ্যমে সাহাবা ও তাবেঈন থেকে এই বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। তারা কিতাবুল্লাহ (কুরআন) এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ থেকে এর প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন এবং শ্রুতিমূলক দলিল দ্বারা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যদিও এর ওপর গণিতভিত্তিক প্রমাণও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুসলিম আলেমদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কারও পক্ষ থেকে আমি কখনো এ বিষয়ে অস্বীকৃতি পাইনি। শুধুমাত্র কিছুসংখ্যক তর্কবিদ ছাড়া,যখন তারা জ্যোতিবিদদের সাথে বিতর্ক করার সময় বলেছিল যে, এটি বর্গাকার বা ষড়ভুজাকার কিংবা অন্য যেকোনো আকারের হতে পারে।তারা এর গোলাকার হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেননি, বরং এর বিপরীত সম্ভাবনা তুলে ধরেছিলেন মাত্র। আর আমি কাউকে জানি না, যে নিশ্চিতভাবে বলেছে আকাশ গোলাকার নয়—শুধুমাত্র সেই অজ্ঞ লোকেরা ছাড়া, যাদের মতামতের কোনো মূল্য নেই।”(ইবনু তাইমিয়া মাজমূ‘ আল-ফাতাওয়া; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৫৮৬)
.
আবু মুহাম্মদ ইবনে হাযম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:مطلب بيان كروية الأرض :قال أبو محمد وهذا حين نأخذ إن شاء الله تعالى في ذكر بعض ما اعترضوا به ، وذلك أنهم قالوا : إن البراهين قد صحت بأن الأرض كروية ، والعامة تقول غير ذلك ، وجوابنا وبالله تعالى التوفيق : أن أحداً من أئمة المسلمين المستحقين لاسم الإمامة بالعلم رضي الله عنهم لم ينكروا تكوير الأرض ، ولا يحفظ لأحد منهم في دفعه كلمة ، بل البراهين من القرآن والسنة قد جاءت بتكويرها … ” وساق جملة من الأدلة على ذلك”পৃথিবীর গোলাকারত্ব প্রমাণের প্রসঙ্গ: আবু মুহাম্মদ বলেন:এবার আমরা, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায়, তাদের কিছু আপত্তির জবাব শুরু করছি। তারা বলেছে: প্রমাণ দ্বারা নিশ্চিত হয়েছে যে পৃথিবী গোলাকার, অথচ সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করে। আমাদের উত্তর,(আল্লাহ তাআলার সাহায্যে),হলো এই যে: মুসলিম আলিমদের মধ্যে যারা ইমামতের প্রকৃত মর্যাদার অধিকারী, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন—তাদের কারো কাছ থেকেই পৃথিবীর গোলাকারত্ব অস্বীকার করা শোনা যায়নি। বরং এ বিষয়ে তাদের কাছ থেকে একটি শব্দও বর্ণিত হয়নি যা এর বিরোধিতা করে। বরং কুরআন ও সুন্নাহ থেকেই এর গোলাকারত্বের পক্ষে স্পষ্ট প্রমাণ এসেছে।”এরপর তিনি এ বিষয়ে বেশ কিছু দলিল উপস্থাপন করেছেন।(আল-ফাসল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল; খণ্ড: ২: পৃষ্ঠা: ৭৮)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
الأرض كروية بدلالة القرآن ، والواقع ، وكلام أهل العلم ، أما دلالة القرآن ، فإن الله تعالى يقول : ( يُكَوِّرُ اللَّيْلَ عَلَى النَّهَارِ وَيُكَوِّرُ النَّهَارَ عَلَى اللَّيْلِ ) ، والتكوير جعل الشيء كالكور ، مثل كور العمامة ، ومن المعلوم أن الليل والنهار يتعاقبان على الأرض ، وهذا يقتضي أن تكون الأرض كروية ؛ لأنك إذا كورت شيئاً على شيء ، وكانت الأرض هي التي يتكور عليها هذا الأمر لزم أن تكون الأرض التي يتكور عليها هذا الشيء كروية .
وأما دلالة الواقع فإن هذا قد ثبت ، فإن الرجل إذا طار من جدة مثلاً متجهاً إلي الغرب خرج إلى جدة من الناحية الشرقية إذا كان على خط مستقيم ، وهذا شيء لا يختلف فيه اثنان .
وأما كلام أهل العلم فإنهم ذكروا أنه لو مات رجل بالمشرق عند غروب الشمس ، ومات آخر بالمغرب عند غروب الشمس ، وبينهما مسافة ، فإن من مات بالمغرب عند غروب الشمس يرث من مات بالمشرق عند غروب الشمس إذا كان من ورثته ، فدل هذا على أن الأرض كروية ، لأنها لو كانت الأرض سطحية لزم أن يكون غروب الشمس عنها من جميع الجهات في آن واحد ، وإذا تقرر ذلك فإنه لا يمكن لأحد إنكاره ، ولا يشكل على هذا قوله تعالى : ( أَفَلا يَنْظُرُونَ إِلَى الإِبِلِ كَيْفَ خُلِقَتْ . وَإِلَى السَّمَاءِ كَيْفَ رُفِعَتْ . وَإِلَى الْجِبَالِ كَيْفَ نُصِبَتْ . وَإِلَى الأَرْضِ كَيْفَ سُطِحَتْ ) لأن الأرض كبيرة الحجم ، وظهور كرويتها لا يكون في المسافات القريبة ، فهي بحسب النظر مسطحة سطحاً لا تجد فيها شيئاً يوجب القلق على السكون عليها ، ولا ينافي ذلك أن تكون كروية ، لأن جسمها كبير جداً ، ولكن مع هذا ذكروا أنها ليست كروية متساوية الأطراف ، بل إنها منبعجة نحو الشمال والجنوب ، فهم يقولون : إنها بيضاوية ، أي على شكل البيضة في انبعاجها شمالاً وجنوباً “
কুরআন, বাস্তবতা এবং আলেমদের বাণী এ তিন দিক থেকেই পৃথিবীর গোলাকারত্ব প্রমাণিত। কুরআনের প্রমাণ হলো: আল্লাহ তাআলা বলেন,তিনি রাত দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাতকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা”।(সূরা যুমার: ৫)।‌আর তাকভীর (التكوير) শব্দের অর্থ হলো কোনো জিনিসকে গোল করে জড়িয়ে দেওয়া; যেমন—পাগড়ি জড়ানোর সময় কাপড়কে গোল করে পেঁচানো হয়। এখন এটা তো জানা কথা যে রাত-দিন পৃথিবীর উপর পর্যায়ক্রমে আসে। এটি অবশ্যই প্রমাণ করে যে পৃথিবী গোলাকার। কারণ, তুমি যদি কোনো কিছুর উপর অন্য কিছু জড়াও, আর পৃথিবীই যেটির উপর এই জড়ানো হয়, তাহলে অবশ্যই পৃথিবী গোলাকারই হবে।
.
বাস্তবতার প্রমাণ হলো—এটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয়। যেমন: যদি কেউ জেদ্দা থেকে পশ্চিমমুখী হয়ে সোজা উড়ে যায়, তবে সে আবার পূর্ব দিক থেকে জেদ্দায় প্রবেশ করবে। এ ব্যাপারে দু’জন মানুষের মধ্যেও কোনো মতভেদ নেই। অর্থাৎ, আলেমদের ঐকমত্য, কুরআন ও সুন্নাহর দলিল, এবং বাস্তবতা সবই প্রমাণ করে যে পৃথিবী আসলেই গোলাকার।
.
আলেমদের বক্তব্যের প্রমাণ হলো—তারা উল্লেখ করেছেন: যদি কোনো ব্যক্তি পূর্বাঞ্চলে সূর্যাস্তের সময় মারা যায়, এবং আরেকজন পশ্চিমাঞ্চলে সূর্যাস্তের সময় মারা যায়—যাদের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব রয়েছে—তাহলে পশ্চিমে সূর্যাস্তের সময় যে মারা গেছে, সে পূর্বে সূর্যাস্তের সময় মারা যাওয়া ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হবে যদি সে তার ওয়ারিস হয়ে থাকে। এটি প্রমাণ করে যে পৃথিবী গোলাকার। কারণ পৃথিবী যদি সমতল হতো, তবে অবশ্যই সব প্রান্তে সূর্যাস্ত একই সময়ে ঘটতো।এটি নিশ্চিত হওয়ার পর আর কেউ এর অস্বীকার করতে পারবে না। আর এ বিষয়ে আল্লাহর এ বাণী কোনো সংশয় তৈরি করে না: আল্লাহ তাআলা বলেন:তারা কি উটের দিকে তাকায় না, কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে? এবং আসমানের দিকে, কিভাবে তা ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়েছে? আর পাহাড়ের দিকে তাকায় না, কীভাবে তাকে স্থাপন করা হয়েছে? আর পৃথিবীর দিকে তাকায় না, কীভাবে তাকে বিস্তৃত করা হয়েছে?”(সূরা গাশিয়াহ: ১৭-২০) কারণ,পৃথিবী আকারে অতি বিশাল। এর গোলাকারত্ব কাছাকাছি দূরত্বে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে না। এজন্য মানুষের চোখে এটি সমতল মনে হয়। সমতল মানে—এখানে এমন কোনো উঁচুনিচু বা ঢেউ নেই, যা এর উপর বসবাসকে কষ্টকর বা অস্বস্তিকর করে তোলে। তবে এর দ্বারা পৃথিবীর গোলাকারত্ব অস্বীকার করা হয় না। কেননা এর দেহ (আকার) খুবই বিশাল। তবে আলেমরা এটাও উল্লেখ করেছেন যে, পৃথিবী একেবারে নিখুঁতভাবে গোলাকার নয়; বরং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে কিছুটা চ্যাপ্টা। এজন্য তারা বলেন: এটি ডিম্বাকৃতি। অর্থাৎ ডিমের মতো, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে কিছুটা চ্যাপ্টা। (ইবনু উসাইমীন; ফাতাওয়া নূরুন আলা আদ দারব; ইবনু উসাইমীন;মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ১৯৫)
.
পৃথিবী গোলাকার নাকি সমতল যারা এই বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে তাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে শাইখ গুনাইমান শারহু ফাতহুল মাজীদ এ বলেন:
بعض الناس قد يقول قولا يظنه حقا، ويصر عليه، ويزعم أن القرآن يدل على ذلك، ولما يتثبت بعد من صحة ما فهم، فيكون في هذا فتنة له، ولغيره. فمثلا الذي يقول: إن القمر في السماء، وإنه ملاصق لها! وقد شاهد الناس، أو المختصون بهذا، بعد القمر عن السماء، وأنه إلى الأرض أقرب منها إلى السماء بكثير جدا، فإذا ما سمع خبراء الفلك، وعلماء الكواكب التفسير السابق المدعم بالأدلة – كما يزعم صاحبه- ظنوا أن القرآن يخالف الواقع، والحقائق العلمية، وما كان كذلك فلا يكون صحيحا. كما أنه وجد -مثلا- من يقول: بأن الأرض مسطحة، وليست كروية، مستدلا على ذلك بقول الله جل وعلا: {أفلا ينظرون إلى الإبل كيف خلقت … وإلى الأرض كيف سطحت} [الغاشية:17 – 20]، وقال في الآية الأخرى: {والأرض بعد ذلك دحاها} [النازعات:30] وما أشبه ذلك، فإذا سمع الإنسان الذي يعرف كروية الأرض، وليس عنده في ذلك شك، فإنه سينسب الخطأ إلى القرآن، وسيقول: هذا دليل على أن القرآن ليس صحيحا، ولو كان صحيحا ما كان مخالفا للواقع، فيكون فتنة له، ولهذا لا يجوز للإنسان أن يتكلم بالشيء الذي لا يعرفه، بل يجب أن يكون كلامه عن علم ومعرفة، وألا يقول على الله جل وعلا شيئا لا يعرف حقيقته. اهـ. وأما وجه الخطأ في الاستدلال السابق، فبينه كثير من أهل العلم.
قال العلامة الطاهر بن عاشور في (التحرير والتنوير): المد: البسط، أي بسطنا الأرض فلم تكن مجموع نتوءات؛ إذ لو كانت كذلك، لكان المشي عليها مرهقا. والمراد: بسط سطح الأرض، وليس المراد وصف حجم الأرض؛ لأن ذلك لا تدركه المشاهدة، ولم ينظر فيه المخاطبون نظر التأمل، فيستدل عليهم بما لا يعلمونه، فلا يعتبر في سياق الاستدلال على القدرة على خلق الأمور العظيمة، ولا في سياق الامتنان بما في ذلك الدليل من نعمة، فلا علاقة لهذه الآية بقضية كروية الأرض. اهـ.
“কিছু মানুষ এমন কথা বলে যেটিকে সে নিজে সঠিক মনে করে, তারপর সে সেটার ওপর একগুঁয়েমি ধরে বসে এবং দাবি করে যে কুরআন তার কথার পক্ষে প্রমাণ দেয়। অথচ সে এখনো যাচাই-পরীক্ষা করেনি তার এই বোঝাটা আসলেই সঠিক কি না। এর ফলে সে নিজেও ফিতনায় পড়ে এবং অন্যদের জন্যও ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন—কেউ যদি বলে: চাঁদ আকাশের ভেতরে আছে এবং সেটি আকাশের সাথেই লেগে আছে! অথচ মানুষ এবং বিশেষজ্ঞরা দেখেছে যে চাঁদ আসলে আকাশ থেকে অনেক দূরে, বরং পৃথিবীর তুলনায় আকাশের চেয়ে অনেক কাছাকাছি। তখন জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা যদি এই ধরনের আগের কোনো তাফসীর শুনে—যার লেখক দলীল-প্রমাণ দিয়ে দাবি করছে যে এটি সত্য—তাহলে তারা ভেবে বসতে পারে যে কুরআন বাস্তবতার বিরোধিতা করছে এবং বৈজ্ঞানিক সত্যকে অস্বীকার করছে। অথচ বাস্তবে কুরআন এমন কিছু বলে না। আবার যেমন—কেউ কেউ বলে: পৃথিবী সমতল, গোলাকার নয়। প্রমাণ হিসেবে তারা পড়ে শোনায় আল্লাহর বাণী:“তারা কি উটের দিকে লক্ষ্য করে না, কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে … আর পৃথিবীর দিকে লক্ষ্য করে না, কিভাবে তা বিছানো হয়েছে” (সূরা আল-গাশিয়াহ: ১৭–২০)। আবার তিনি বলেনঃ “এরপর পৃথিবীকে তিনি প্রসারিত করেছেন” (সূরা আন-নাযিআত: ৩০)। ইত্যাদি। তখন যে ব্যক্তি পৃথিবীর গোলাকারত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত, সে এই দাবিকে কুরআনের ভুল মনে করবে এবং বলতে পারে: এটা প্রমাণ করে যে কুরআন সত্য নয়;(নাউজুবিল্লাহ) যদি সত্য হতো তবে এটি বাস্তবতার বিরোধিতা করত না। ফলে এ ধরনের দাবি তার জন্য ফিতনায় পরিণত হয়। এই কারণেই মানুষের উচিত নয় এমন বিষয়ে কথা বলা, যা সে জানে না। বরং জ্ঞান ও দলীলের ভিত্তিতেই কথা বলা জরুরি, এবং আল্লাহ সম্পর্কে এমন কিছু বলা যাবে না যার বাস্তবতা সম্পর্কে সে অবগত নয়।এ ধরনের ভুল ব্যাখ্যা বহু আলেম স্পষ্টভাবে খণ্ডন করেছেন। যেমন আল্লামা তাহির ইবনু আশুর (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর আত-তাহরীর ওয়াত-তানওয়ীর তাফসীরে বলেছেন: “আল-মাদ্দ” শব্দের অর্থ হলো প্রসারিত করা। অর্থাৎ, আমরা জমিনকে এমনভাবে প্রসারিত করেছি যে তা কেবল উঁচু-নিচু পাহাড়-পর্বতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়নি। কারণ যদি এমন হতো তবে এর ওপর চলাফেরা করা মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যেত। সুতরাং এর অর্থ হলো জমিনের পৃষ্ঠতলকে প্রসারিত করা, আর এখানে উদ্দেশ্য জমিনের আকার বা আকৃতি বর্ণনা করা নয়। কেননা, জমিনের প্রকৃত আকার মানুষের দৃষ্টিসীমায় ধরা পড়ে না, এবং সম্বোধিতরা এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনাও করতো না। তাই আল্লাহ তাদের এমন প্রমাণে আবদ্ধ করেননি যা তারা জানে না।”(গৃহীত: ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-২৯৮০৩৩)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে আপনারা জেনে নিলেন যে পৃথিবীর গোলাকার হওয়া, ডিম্বাকৃতির মতো হওয়ার পরিপন্থী নয়। বরং বাতিল কথা হলো এই দাবি করা যে পৃথিবী সমতল—যেমনটা চার্চ/গির্জা কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করত। এজন্য তারা এমন আলেমদের প্রতি ক্রুদ্ধ ছিল, যারা পৃথিবীর গোলাকার হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করত; তাদেরকে অভিশাপ দিত এবং আগুনে দগ্ধ করত।”(বিস্তারিত জানতে দেখুন: আল-ইলমানিয়্যাহ: নাশআতুহা ওয়াতাতাওরুহা: ১/১৩০)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

Wednesday, September 17, 2025

ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলাদের জন্য নাসিং পেশায় কাজ করার বিধান

 প্রশ্ন: নার্সিং পেশা কী মেয়েদের জন্য জায়েজ? আমার ভাই নেই।আর আব্বুর অবস্থা মোটামুটি আলহামদুলিল্লাহ। তো আমি চাচ্ছি জব করতে। আব্বুর বয়সও দিন দিন বাড়ছে। আমি পরিবারের বড় মেয়ে।

উত্তর: ইসলামে নার্সিং পেশায় বাধা নেই। তবে এর জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে।‌ ইসলামের নীতি হল, পুরুষ নার্স পুরুষ রোগীদের সেবা করবে আর নারী নার্স নারী রোগীদের সেবা করবে। বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া এর ব্যতিক্রম করা জায়েজ নেই। এই ক্ষেত্রে কতিপয় বিধান মেনে চলা অপরিহার্য। যথা:
১. নারী নার্সের জন্য মুখমণ্ডল সহ পূর্ণ পর্দা রক্ষা করা।
২. বিপরীত লিঙ্গের শরীর স্পর্শ না করা। বিশেষ দরকারে হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করে করবে।
৩. এক্ষেত্রে রোগীর শরীরের ঠিক অতটুকু স্থান স্পর্শ করবে যেটুকু না হলেই নয়। ‌
৪. একান্ত জরুরি স্থান ব্যতিরেকে রোগীর শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ না দেখা।
৫. ল্যাবরেটরি, এক্সরে রুমে বা অন্য কোথাও বিপরীত লিঙ্গের রোগীর সাথে নির্জনে অবস্থান না করা। এক্ষেত্রে রোগীর সাথে স্বামী/স্ত্রী বাবা/মা, ভাই/বোন ইত্যাদি কোন মাহরাম ব্যক্তি থাকা আবশ্যক।
৬. রোগীর সাথে চিকিৎসা সেবা বা রোগ সংক্রান্ত জরুরি কথাবার্তা ছাড়া অন্যান্য অন্য কোন কথা না বলা।
কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যদি এমন পরিবেশ না পাওয়া যায় যেখানে এ সকল বিধি-বিধান মেনে চলা সম্ভব নয় অথবা কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয় না তাহলে অনতিবিলম্বে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে অন্যত্র হালাল ভাবে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করতে হবে।
পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য রিজিকের পথ খোলা রয়েছে। কেউ যদি আল্লাহকে ভয় করে তাহলে আল্লাহ তাকে উত্তম পন্থায় ব্যবস্থা করে দিবেন ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তৌফিক দান করুন। আমিন।
উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

কবরে কিছু মৃতদেহ অক্ষত থাকার ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক ও ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা

 প্রশ্ন: কিছু মৃতদেহ কবর দেওয়ার অনেক দিন পরও পচে না। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন। এতে করে কী কোনভাবে প্রমাণ হয় যে, সে ব্যক্তি আল্লাহর ওলি ছিলেন? দয়া করে জানাবেন ইনশাআল্লাহ।

উত্তর: সাধারণত মৃতদেহ কবরস্থ করার কয়েক দিনের মধ্যেই পচন শুরু হয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মৃতদেহটি দীর্ঘদিন পরও অক্ষত অবস্থায় আছে। এর পেছনের কারণগুলো বৈজ্ঞানিক ও ইসলামি উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়।
❑ বৈজ্ঞানিক কারণ:
❖ ক. মৃতদেহের পচন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যা মূলত অণুজীবের ক্রিয়াকলাপ, এনজাইমের নিঃসরণ এবং বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল। কিছু বিশেষ পরিস্থিতি এই প্রক্রিয়াকে ধীর বা বন্ধ করে দিতে পারে।
❖ খ. মাটির ধরন এবং পরিবেশ: অত্যন্ত শুষ্ক, শীতল বা কম অক্সিজেনের পরিবেশে মৃতদেহের পচন ধীর হয়। উদাহরণস্বরূপ: যদি কবরের মাটি খুব বালুকাময় ও শুষ্ক হয়, অথবা তাপমাত্রা খুব কম থাকে (যেমন: বরফাবৃত অঞ্চলে), তাহলে অণুজীবের কার্যকলাপ কমে যায়। ফলে পচন বিলম্বিত হয়।
❖ গ. বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ: যদি মৃতদেহটি কোনোভাবে বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ, যেমন ফরমালডিহাইড বা অন্যান্য প্রিজারভেটিভের সংস্পর্শে থাকে তাহলে পচন প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থগিত থাকতে পারে।
❖ ঘ. মমিফিকেশন: নির্দিষ্ট কিছু মাটির গঠন বা পরিবেশগত কারণে মৃতদেহ প্রাকৃতিকভাবেই মমিতে পরিণত হতে পারে। এক্ষেত্রে দেহের জলীয় অংশ দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
❖ ঙ. হিমায়িত অবস্থা: যদি কোনো মৃতদেহ হিমায়িত পরিবেশে থাকে তাহলে পচন কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। কারণ এই তাপমাত্রায় ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীব নিষ্ক্রিয় থাকে।
❑ ইসলামি দৃষ্টিকোণ:
ইসলামি আকিদা অনুযায়ী, মৃতদেহ পচে না-এমন ঘটনাকে অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহর কুদরত বা অলৌকিক ক্ষমতা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
❖ নবী-রসুলগণ: হাদিসে বলা হয়েছে যে, নবী ও রসুলদের মৃতদেহ মাটির ওপর হারাম করা হয়েছে। অর্থাৎ মাটি তাঁদের দেহ ভক্ষণ করে না। এই কারণে তাঁদের মৃতদেহ অক্ষত থাকে। এই প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إنَّ اللَّهَ عزَّ وجلَّ حرَّمَ علَى الأرضِ أجسادَ الأنبياءِ
“আল্লাহ তাআলা নবীদের দেহ মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন।” [সহিহ সুনানে আবু দাউদ, হা/১০৪৭]
❖ আল্লাহর ওলি বা বুজুর্গ: যদিও নবী-রসুলদের মতো তাঁদের মৃতদেহ অক্ষত থাকার বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো বর্ণনা নেই। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে তাঁর কোনো প্রিয় বান্দার মৃতদেহও অক্ষত থাকতে পারে। তবে এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। কোনো সাধারণ নিয়ম নয়।
❑ এটি আল্লাহর ওলি হওয়ার প্রমাণ কিনা?
কোনো মৃতদেহ অক্ষত থাকলেই সে ব্যক্তি আল্লাহর ওলি বা বুজুর্গ ছিল-এমনটা বিশ্বাস করা ঠিক নয়। কারণ:
– অনেক সময় দেখা গেছে যে, দ্বীনের দিক থেকে খারাপ বা পাপী ব্যক্তির মৃতদেহও প্রাকৃতিক বা বৈজ্ঞানিক কারণে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর ফলে শুধুমাত্র মৃতদেহ অক্ষত থাকাটা কোনো ব্যক্তির ধার্মিকতা বা আল্লাহর নৈকট্যের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
– কুরআন ও হাদিসে এমন কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই যে, কোনো ওলি বা বুজুর্গের লাশ কবরে অক্ষত থাকবে। তাই এমন বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি নেই।
– ইমানি পরীক্ষা: এই ধরনের ঘটনাকে ইমানের পরীক্ষা হিসেবে দেখা যেতে পারে। যারা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিরক, বিদআত বা বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয় তারা ভুল পথে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে যারা এই ধরনের ঘটনাকে আল্লাহর ক্ষমতা হিসেবে স্বীকার করে এবং সঠিক ইসলামি শিক্ষার উপর অটল থাকে তারাই সঠিক পথের অনুসারী।
সুতরাং কোনো মৃতদেহ অক্ষত থাকলেই সে ব্যক্তি আল্লাহর ওলি ছিলেন বলে বিশ্বাস করা শরিয়তসম্মত নয়। এটি প্রাকৃতিক বা বৈজ্ঞানিক কারণের জন্যও হতে পারে। অথবা এটি আল্লাহর কুদরতের একটি নিদর্শন হতে পারে। তবে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাড়াবাড়ি বা কুসংস্কার ছড়ানো থেকে বিরত থাকা উচিত। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

সালাতে ইমামের অনুসরণের বিধান

 প্রশ্ন: সালাতে ইমামের অনুসরণের বিধান কী? ইমামের থেকে আগে রুকু বা সিজদা করা অথবা ইমামের অনুসরণে বিলম্ব করা হলে তার হুকুম কী?

▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর ইমাম শব্দের অর্থ নেতা। তিনি মাননীয় ও অনুসরণীয়। সালাত আদায়ে তিনি নেতৃত্ব দেন। সকল শ্রেণীর মুসল্লী তার নেতৃত্বে সালাতে রুকু সিজদা আদায় করেন, উঠেন ও বসেন। তার তাকবীর ধ্বনি শুনে সকলে তার অনুকরণ ও অনুসরণ করেন, কেউই তা লঙ্ঘন করে না। ইমামের এরূপ অনুসরণই হলো ইক্তিদা। ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সালাতে ইমামের অনুসরণ করা ওয়াজিব।কারন রাসূল (ﷺ) বলেছেন, إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ “ইমাম নিযুক্ত করা হয়, কেবল তাঁকে অনুসরণ করার জন্য”।(সহীহ বুখারী হা/৩৭৮) এখানে ইমামের অনুসরণ করার অর্থ হলো,ইমাম কোনো কাজ শেষ করার পরপরই মুক্তাদির সেই কাজটি শুরু করা।(বিস্তারিত জানতে দেখুন; হাশিয়াতু ইবনে কাসিম খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২৮৫; ইবনু উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৬৯; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৪৪৫৮) অপর হাদিসে এসেছে,প্রখ্যাত সাহাবী আনাস (রাঃ) বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে সালাত আদায় করালেন। সালাত শেষে তিনি (ﷺ) আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলেন এবং বললেন, হে লোক সকল! আমি তোমাদের ইমাম। তাই তোমরা রুকু করার সময়, সাজদাহ্‌ করার সময়, দাঁড়াবার সময়, সালাম ফিরাবার সময় আমার আগে যাবে না, আমি নিশ্চয়ই তোমাদেরকে আমার সম্মুখ দিয়ে পেছন দিক দিয়ে দেখে থাকি।(সহীহ মুসলিম হা/৪২৬ মিশকাত হা/১১৩৭) এ ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কঠোরতা আরোপ করেছেন। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,”যে তার মাথা ইমামের পূর্বেই উত্তোলন করে সে কি ভয় করে না যে, আল্লাহ তার মাথাকে গাধার মাথাতে অথবা গাধার আকৃতিতে পরিনত করে দিবেন।”(সহীহ মুসলিম হা/৪২৭) এছাড়াও ইমাম কোনো রুকনে পৌঁছে যাওয়ার আগে মুক্তাদী সেই রুকন শুরু করবেন না। ইমাম মাটিতে তার কপাল রাখার আগে মুক্তাদী তার পিঠ ঝোঁকানো শুরু করবে না। আল-বারা ইবনে আযিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন: “যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলতেন তখনও আমাদের কেউ পিঠ ঝোঁকাত না যতক্ষণ না নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় লুটিয়ে পড়তেন। তারপরে আমরা সিজদায় লুটিয়ে পড়তাম।”(সহিহ বুখারী হা/৬৯০; সহিহ মুসলিম হা/৪৭৪)
.
দ্বিতীয়ত: ইমামের সাথে মুক্তাদীর অবস্থাসমূহ:
.
শরীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা ভাবনা করলে ইমামের সাথে মুক্তাদীর সর্বমোট চারটি অবস্থা হতে পারে;
(১). ইমামের আগে করা।
(২). ইমাম থেকে পিছিয়ে থাকা।
(৩). ইমামের সাথে সাথে করা।
(৪). ইমামের পরপর করা।
.
এবার আমরা প্রত্যেকটি অবস্থার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেখব:
.
▪️এক: ইমামের আগে করা: অর্থাৎ মুক্তাদী নামাযের কোনো রুকনের ক্ষেত্রে ইমামের তুলনায় এগিয়ে গিয়ে করা। যেমন: ইমামের আগে সিজদা দেয়া কিংবা সিজদা থেকে ওঠা কিংবা রুকু দেয়া কিংবা রুকু থেকে ওঠা। এমনটি করা হারাম। এর দলীল হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “তোমরা রুকু করো না যতক্ষণ না ইমাম রুকুতে যায়। তোমরা সিজদা করো না যতক্ষণ না ইমাম সিজদায় যায়।”(সহীহ মুসলিম হা/৪২৬) আর নিষেধাজ্ঞার মূল হুকুম হলো হারাম হওয়া। বরং কেউ যদি বলে: এটি কবীরা গুনাহ তাহলে সেটি বাড়িয়ে বলা হবে না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি ইমামের আগে মাথা তোলে তার কি ভয় হয় না যে, মহান আল্লাহ তার মাথা গাধার মাথায় পরিবর্তন করে দিবেন অথবা তার আকৃতিকে গাধার আকৃতি বানিয়ে দিবেন!”(সহীহ বুখারী হা/৬৯১) এটি শাস্তির হুমকি। আর শাস্তির হুমকি দেয়া কবীরা গুনাহ হওয়ার আলামত।
.
যে ব্যক্তি নামাযের কার্যাবলি ইমামের আগে করে তার নামাযের হুকুম: যদি মুক্তাদী জেনে-বুঝে স্মরণ থাকা অবস্থায় ইমামের আগে কোনো আমল করে তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি না জেনে কিংবা ভুলে গিয়ে করে তাহলে তার নামায সঠিক হবে। তবে যদি ইমাম তাকে সংশ্লিষ্ট আমলে পাওয়ার আগে তার ওজর দূর হয়ে যায় তাহলে তার জন্য ফিরে যাওয়া ও ইমামের আগে কৃত আমলটি ইমামের অনুসরণে করা আবশ্যক হবে। যদি সে জেনে ও স্মরণে থাকা সত্ত্বেও এমনটি না করে, তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। অন্যথায় বাতিল হবে না।
.
▪️দুই: ইমাম থেকে পিছিয়ে থাকা: ইমামের তুলনায় আমলে পিছিয়ে থাকা দুই প্রকার:
.
(১). ওজরের কারণে পিছিয়ে থাকা।
(২). ওজর ছাড়া পিছিয়ে থাকা।
.
প্রথম প্রকার হলো: ওজরের কারণে পিছিয়ে থাকা। এমন ব্যক্তি যে অংশটুকুতে পিছিয়ে ছিল সে অংশ সম্পন্ন করে ইমামের অনুসরণ করবে; এতে কোনো সমস্যা নেই। এমনকি যদি পূর্ণ এক বা দুই রুকনও হয়ে থাকে। যদি কোনো ব্যক্তি ভুলে যায় বা উদাসীন হয়ে পড়ে কিংবা ইমামের আওয়াজ শুনতে না পায় এবং ইমাম এক বা দুই রুকন এগিয়ে যায়, তাহলে সে যেগুলোতে পিছিয়ে পড়েছে সেগুলো আদায় করে ইমামের অনুসরণ করবে। তবে যদি ইমাম সে যেই আমলে আছে সেই আমলে চলে আসে তাহলে সে পিছিয়ে পড়া আমলগুলো না করে বরং ইমামের সাথে থাকবে। এভাবে ইমামের দুই রাকাত থেকে তার এক রাকাত নামায শুদ্ধ হবে; অর্থাৎ যে রাকাতে সে পিছিয়ে পড়েছিল সেই রাকাত এবং ইমাম যেই রাকাতে পৌঁছেছে সেই রাকাত মিলে। এর উদাহরণ হলো:
এক লোক ইমামের সাথে নামায পড়ছে। ইমাম রুকু দিয়েছে, রুকু থেকে উঠেছে, সিজদা দিয়েছে, বসেছে, দ্বিতীয় সিজদা দিয়ে আবার দাঁড়িয়েছে, কিন্তু লোকটি কেবল দ্বিতীয় রাকাতে এসে ইমামের তাকবীর ধ্বনি শুনতে পেয়েছে। যেমন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে এমনটি হতে পারে। আমরা ধরে নিই এটি জুমার নামাযে ঘটেছে। সে ইমামের সূরা ফাতিহার তেলাওয়াত শুনতেছিল এর মধ্যে বিদ্যুত চলে যায়। ইমাম প্রথম রাকাত শেষ করে দাঁড়িয়ে গেল। এদিকে মুক্তাদী ভাবছে ইমাম প্রথম রাকাতের রুকু এখনো দেয়নি। মুক্তাদী ইমামকে সূরা গাশিয়া পড়তে শুনল। আমরা বলব: আপনি ইমামের সাথেই থাকবেন। ইমামের দ্বিতীয় রাকাত আপনার প্রথম রাকাতের বাকি অংশ হিসেবে গণ্য হবে। ইমাম যখন সালাম ফিরাবেন তখন আপনি দ্বিতীয় রাকাত সম্পন্ন করবেন। আলেমরা বলেন: এভাবে মুক্তাদীর এক রাকাত হবে যা ইমামের দুই রাকাত দ্বারা গঠিত। কারণ সে ইমামকে প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় রাকাতে অনুসরণ করেছে। আর যদি ইমাম তার স্থানে পৌঁছানোর আগে সে নিজের পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি বুঝতে পারে তাহলে সে সেই আমলগুলো আদায় করে ইমামের অনুসরণ করবে। এর উদাহরণ হলো:
এক লোক ইমামের সাথে নামাযে দাঁড়িয়েছে। ইমাম রুকু দিয়েছে কিন্তু সে শুনতে পায়নি। তারপর যখন ইমাম ‘সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলেছে তখন সেটা শুনতে পেয়েছে। এমন ব্যক্তিকে আমরা বলব: আপনি রুকু দিয়ে রুকু থেকে উঠুন এবং ইমামের অনুসরণ করুন। আপনি রাকাতটি পেয়েছেন বলে গণ্য হবে। কারণ এখানে আপনি ওজরের কারণে পিছিয়ে পড়েছেন।
.
দ্বিতীয় প্রকার হলো ওজর ছাড়া পিছিয়ে পড়া। এটি হতে পারে কোন রুকনের মধ্যে পিছিয়ে পড়া কিংবা এক রুকন পিছিয়ে পড়া। রুকনের মধ্যে পিছিয়ে পড়ার অর্থ হলো আপনি ইমামকে অনুসরণে পিছিয়ে পড়েছেন, কিন্তু ইমাম যেই রুকনে চলে গেছেন আপনি তাকে সেখানে গিয়ে ধরতে পারবেন। যেমন: ইমাম রুকু দিয়ে ফেলেছেন, অথচ আপনার সূরা পড়ার এক বা দুই আয়াত বাকি। আপনি দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং সূরার বাকি অংশ শেষ করে তারপর রুকুতে গেলেন এবং ইমামকে রুকুতে পেলেন। এখানে রাকাতটি সঠিক হল। কিন্তু কাজটি সুন্নাহর খেলাফ। কারণ শরয়ি পদ্ধতি হলো ইমাম যখন রুকুতে পৌছেঁ যাবেন তখনই আপনি রুকু শুরু করে দিবেন। আপনি পিছিয়ে থাকবেন না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “ইমাম যখন রুকুতে যাবে তখন তোমরা রুকু করো।” আর এক রুকন পিছিয়ে পড়া বলতে উদ্দেশ্য হলো: ইমাম আপনার এক রুকন সামনে চলে যাওয়া। অর্থাৎ আপনি রুকু করার আগে তিনি রুকু করে উঠে গেছেন। ফকীহরা বলেন: যদি আপনি রুকুতে পিছিয়ে পড়েন তাহলে আপনার নামায বাতিল হয়ে যাবে, যেমনিভাবে আপনি আগে রুকুতে গেলে আপনার নামায বাতিল হয়ে যাবে। আর যদি সিজদায় যেতে বিলম্ব করেন, তাহলে ফকীহদের মতে আপনার নামায সঠিক হবে। কারণ এটি রুকু ছাড়া অন্য রুকনে পিছিয়ে পড়া। তবে অগ্রগণ্য মত হচ্ছে: কোনো ওজর ছাড়া যদি কেউ এক রুকন পিছিয়ে যায় তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। হোক সেটা রুকু কিংবা রুকু ছাড়া অন্য কিছু। সুতরাং ইমাম যদি প্রথম সিজদা থেকে মাথা তুলে আর মুক্তাদী সিজদায় দোয়া করতে থাকে, তারপর ইমাম দ্বিতীয় সিজদায় চলে যায় তাহলে মুক্তাদীর নামায বাতিল হয়ে যাবে। কারণ মুক্তাদী এক রুকন পিছিয়ে পড়েছে। যদি ইমাম তার থেকে এক রুকন এগিয়ে যায় তাহলে অনুসরণ কোথায় হলো?
.
▪️তিন: ইমামের সাথে সাথে করা: সাথে সাথে করা কথার ক্ষেত্রে বা কাজের ক্ষেত্রে হতে পারে। তাই সাথে সাথে করা দুই প্রকার:
.
প্রথম প্রকার: নামাযের কথাগুলো ইমামের সাথে সাথে করা। শুধু তাকবীরে তাহরীমা ও সালামের ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো কথা ইমামের সাথে সাথে করলে নামাযের ক্ষতি হবে না। তাকবীরে তাহরীমা: ইমাম তাকবীরে তাহরীমা বলা শেষ করার আগে যদি আপনি তাকবীরে তাহরীমা বলেন তাহলে আপনার নামায হবে না। ইমাম তাকবীরে তাহরীমা পুরোপুরি সমাপ্ত করার পরই কেবল আপনি তাকবীরে তাহরীমা বলবেন।আর সালামের ক্ষেত্রে সাথে সাথে করার ব্যাপারে আলেমরা বলেন: ইমামের সাথে সাথে প্রথম ও দ্বিতীয় সালাম ফেরানো মাকরূহ। তবে যদি ইমাম প্রথম সালাম ফেরানোর পরে আপনি প্রথম সালাম ফেরান এবং ইমাম দ্বিতীয় সালাম ফেরানোর পরে আপনি দ্বিতীয় সালাম ফেরান, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু উত্তম হলো ইমাম দুই সালাম ফেরানোর পরেই কেবল আপনি সালাম ফেরাবেন। আর বাকি কথাগুলো ইমামের সাথে একত্রে করা কিংবা আগে অথবা পরে করার মাঝে কোনো সমস্যা নেই। যদি ধরে নেওয়া হয় যে আপনি ইমামকে তাশাহ্‌হুদ পড়তে শুনলেন, আপনি তাশাহ্‌হুদ পড়তে গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে গেলেন, এতে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ তাকবীরে তাহরীমা আর সালাম ছাড়া অন্য কিছু আগে করে ফেললে এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব নেই এবং ক্ষতি হবে না। অনুরূপভাবে যদি আপনি যোহরের নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার ক্ষেত্রে ‘ওয়ালাদ্দাল্লীন’ পড়েন আর তিনি ‘ইয়্যাকা না’বূদূ ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন’ পড়েন, তাহলেও সমস্যা নেই। কারণ ইমামের জন্য কখনো কখনো যোহর ও আসরের নামাযে মুক্তাদীকে শুনিয়ে শুনিয়ে তেলাওয়াত করা শরিয়তসম্মত; যেমনটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো করতেন।
.
দ্বিতীয় প্রকার: নামাযের কাজগুলো ইমামের সাথে সাথে করা করা। এটি মাকরূহ। এ প্রকারের উদাহরণ হলো: যখন ইমাম রুকুর জন্য আল্লাহু আকবার বলে মাথা নোয়ানো শুরু করবে তখন আপনি ও ইমাম একসাথে মাথা নোয়ালেন। এটি মাকরূহ। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “ইমাম যখন রুকুতে যাবে তখন তোমরা রুকু করবে। ইমাম রুকুতে না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা রুকু করবে না।” সিজদার ক্ষেত্রে ইমাম যখন সিজদার জন্য তাকবীর দিল তখন আপনিও সিজদা দিলেন এবং আপনি ও ইমাম একসাথে জমিনে মাথা রাখলেন। এটাও মাকরূহ। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন: “ইমাম সিজদায় না যাওয়া পর্যন্ত তোমরা সিজদা করো না।”
.
▪️চার: ইমামের পরপর করা: পরপর করাই সুন্নাহ। এর অর্থ হলো: ইমাম নামাযের কাজ শুরু করার সাথে সাথে মুক্তাদী নামাযের কাজ শুরু করা। কিন্তু সাথে সাথে নয়।
উদাহরণস্বরূপ: ইমাম রুকুতে যাওয়ার পরপর আপনি রুকুতে যাবেন, যদিও আপনি মুস্তাহাব ক্বিরাত শেষ করেননি, যদিও আপনার এক আয়াত পড়া বাকি রয়ে গেছে। কারণ এটি পূর্ণ করতে গেলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন। এমতাবস্থায় আপনি আয়াতটি পূর্ণ করবেন না।সিজদার ক্ষেত্রে: ইমাম সিজদা থেকে উঠে গেলে আপনি ইমামের অনুসরণে উঠে যাবেন। সিজদায় থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া করার চেয়ে ইমামের অনুসরণ করা উত্তম। কারণ আপনার নামায ইমামের সাথে সম্পৃক্ত এবং আপনি এখন আপনার ইমামের অনুসরণ করতে আদিষ্ট।”(ঈষৎ পরিবর্তিত ও সমাপ্ত পুরো ফাতওয়াটি জানতে দেখুন ইবনু উসাইমীন আশ-শারহুল মুমতি‘, আলা জাদিল মুস্তাকনি খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৭৫; গৃহীত ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৩৭৯০)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Translate