Friday, August 16, 2024

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার অপরিহার্যতা এবং নির্মানের ভয়াবহতা

 ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার অপরিহার্যতা, নির্মানের ভয়াবহতা এবং কীর্তিমান সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য

:الحمد لله والصلاه والسلام على رسول الله -اما بعد

নিম্নে সংক্ষিপ্ত পরিসরে ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার অপরিহার্যতা, নির্মানের ভয়াবহতা এবং কীর্তিমান সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

❑ ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার অপরিহার্যতা এবং তা নির্মানের ভয়াবহতা:

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ, পশুপাখি ইত্যাদি প্রাণীর প্রতিমা, মূর্তি, প্রতিকৃতি, প্রতিমূর্তি ও ভাস্কর্য তৈরি বা নির্মাণ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কোথাও নির্মান করা হলে সেগুলো ভেঙ্গে ফেলা অপরিহার্য। কারণ বহু হাদিসে প্রাণীর মূর্তি, প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার এবং ছবি মুছে ফেলার নির্দেশ এসেছে।

➧ নিম্নে এ সংক্রান্ত কতিপয় হাদিস তুলে ধরা হল:

◈ বিশিষ্ট তাবেয়ী আবুল হাইয়াজ আসাদি রাহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলি রা. আমাকে বললেন, আমি কি তোমাকে ঐ কাজে দায়িত্বশীল হিসেবে প্রেরণ করব যে কাজে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করে ছিলেন? কাজটা হলো,

لاَ تَدَعَ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَهُ وَلاَ تِمْثَالاً إِلاَّ طَمَسْتَهُ ‏

“যে কোনও সুউচ্চ কবরকে ভেঙ্গে মাটি বরাবর করা আর কোন প্রতিকৃতিকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না।” [সহিহ মুসলিম, হা/৯৬৯]

◈ সহিহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় রয়েছে:

وَلاَ صُورَةً إِلاَّ طَمَسْتَهَا

“আর কোনও (প্রাণীর) ছবিকে না মুছা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না।”

◈ মুসলিম রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা (বিশিষ্ট তাবেয়ী) মাসরুকের সাথে ইয়াসার ইবনে নুমাইরের ঘরে ছিলাম। মাসরুক ইয়াসারের ঘরের আঙিনায় কতগুলো মূর্তি দেখতে পেয়ে বললেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. থেকে শুনেছি এবং তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছেন যে,

إِنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ القِيَامَةِ المُصَوِّرُونَ

“(কিয়ামতের দিন) মানুষের মধ্যে সব থেকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে (প্রাণির) ছবি অঙ্কন কারীদেরকে।” [মুসলিম ৩৭/২৬, হা/ ২১০৯, আহমদ ৩৫৫৮] আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪১৩]

◈ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

مَنْ صَوَّرَ صُورةً فِي الدُّنْيَا كُلِّفَ أنْ يَنْفُخَ فِيهَا الرُّوحَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلَيْسَ بِنَافخٍ

“যে ব্যক্তি (প্রাণির) ছবি তৈরি করে, তাকে কিয়ামতের দিন তাতে জীবন দানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হবে কিন্তু সে সক্ষম হবে না।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]

◈ আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

إِنَّ الَّذِينَ يَصْنَعُونَ هَذِهِ الصُّوَرَ يُعَذَّبُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُقَالُ لَهُمْ أَحْيُوا مَا خَلَقْتُمْ

“যারা এ জাতীয় (প্রাণীর) ছবি তৈরি করে, কিয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। তাদের বলা হবে: “তোমরা যা বানিয়েছিলে তাতে জীবন দাও।” [মুসলিম ৩৭/২৬, হা/ ২১০৮] আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫১৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪১৪]

◈ ঘরে মানুষ, ছোট বাচ্চা, পশু-পাখি ইত্যাদি প্রাণীর ছবি টাঙ্গিয়ে রাখা হলে ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না:

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু তালহা রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«لَا تَدْخُلُ الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ كَلْبٌ، وَلَا صُورَةٌ

“ঐ ঘরে (রহমতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না, যে ঘরে কুকুর অথবা (প্রাণীর) ছবি থাকে।” [সুনানে নাসায়ী, অধ্যায়: সাজসজ্জা, পরিচ্ছেদ: ছবি, হা/৫৩৪৭-সনদ সহিহ)
অন্য একটি সহিহ বর্ণনায় ছবির স্থানে تَمَاثِيلَ ভাস্কর্য-এর কথা এসেছে। প্রাগুক্ত, হা/৫৩৪৮]

◈ সম্মানিত ব্যক্তিদের মূর্তি-প্রতিকৃতি ভাস্কর্য ইত্যাদি নির্মাণ শিরকের মাধ্যম:

আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ঘৃণিত ও বড় পাপ শিরকের উৎপত্তি ঘটেছিলো নূহ আলাইহিস সালাম এর যুগের পাঁচজন সৎ ও সম্মানিত লোকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নিমিত্তে তাদের প্রতিকৃতি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। প্রথম পর্যায়ে সেগুলোর পূজা-অর্চনা করা না হলেও যুগের বিবর্তনে মানুষ এ সকল সম্মানিত লোকদের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে। অবশেষে সেগুলো মূর্খরা পূজা করতে শুরু করে।
উক্ত পাঁচ ব্যক্তির নাম এবং কিভাবে তাদের মূর্তি/প্রতিকৃতি নির্মাণ করার পর তাতে শ্রদ্ধা প্রদর্শনে বাড়াবাড়ি করার মাধ্যমে শিরকের উৎপত্তি হয়েছিলো সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন সূরা নূহ-এর ২৩ নং আয়াতের অর্থ এবং তার তাফসির।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়, সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন বা তাদের স্মৃতিকে মানুষের হৃদয়ে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে তাদের প্রতিমা, মূর্তি, প্রতিমূর্তি, প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য ঘরের দেয়ালে, রাস্তার মোড়ে, চৌরাস্তার মাঝখানে, স্কুলের মাঠ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর বা অন্য কোনও স্থানে অংকন, নির্মাণ বা স্থাপন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম। এর মাধ্যমে মূলত কাল পরিক্রমায় আগামী প্রজন্মের সামনে শিরকের দরজা উন্মুক্ত করা হয় যেমনটি পূর্ব যুগে ঘটেছিল।

◯ জ্ঞাতব্য:

– এ দায়িত্ব প্রধানত: সরকার বা প্রশাসনের; সাধারণ জনগণের নয়। বিশৃঙ্খলাতার আশঙ্কা থাকলে সাধারণ জনগণ এমন কাজ থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু এমন সম্ভাবনা না থাকলে সাধারণ জনগণও তা করতে পারে।

– মুসলিম দেশে বসবাসকারী অমুসলিমদের পূজামণ্ডপে তাদের দেবদেবীর মূর্তি এ নির্দেশের বাইরে। অর্থাৎ হিন্দুদের দেবদেবীর মূর্তি ভাঙ্গা ইসলাম সমর্থন করে না।

❑ ইসলামে কি সকল প্রকার ভাস্কর্য নিষিদ্ধ?

ইসলামের দৃষ্টিতে শিল্পকর্ম হিসেবে সকল প্রকার ভাস্কর্য তৈরি নিষিদ্ধ নয়। কেবল মানুষ, জীবজন্তু, পশুপাখি ইত্যাদি প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ বা তৈরি নিষিদ্ধ।

কেউ চাইলে জড়পদার্থ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গাছ, লতাপাতা, ফল, ফুল, আকাশ, সাগর, নদী, পাহাড়, বন-বনানী, ঘর-বাড়ি ইত্যাদির ছবি, দৃষ্টি নন্দন প্রতিকৃতি, শৈল্পিক ভাস্কর্য ইত্যাদি তৈরি করতে পারে। কারণ সে ব্যাপারে ইসলামে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।

❑ ভাস্কর্য বা মূর্তি নির্মাণের মাধ্যমে সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এর পরিবর্তে তাদেরকে অপমান করা হয়:

একথা কারো অজানা নয় যে, উন্মুক্ত স্থানে নির্মিত ভাস্কর্যের উপরে পাখ-পাখালি মল-মূত্র ত্যাগ করে, কুকুর, বিড়াল, শৃগাল ইত্যাদি সেগুলোর গায়ে পেশাব করে এবং নানা ময়লা-আবর্জনা পড়ে সেগুলো নোংরা হয়ে যায়।

সুতরাং এ সকল সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্য এর থেকে অবমাননাকর আর কী হতে পারে?

শুধু তাই নয় আমরা জানি, সময়ের আবর্তে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বা আদর্শিক পরিবর্তনের ফলে অনেক সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত মূর্তি বা ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং নানাভাবে সেগুলোকে অপমান করা হয়। যেমনটি বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটতে দেখা গেছে।

সুতরাং এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে এ সকল সম্মানিত ব্যক্তিদের মানহানি ও অবমাননার ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হয়।

❑ আমরা কীভাবে মৃত সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করব?

মূলত মানুষ তাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও কল্যাণকর কর্মের দ্বারা মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকে এবং শ্রদ্ধার আসনে আসীন হয়ে থাকে। এর থেকেও বড় কথা হলো, ইমানদার ব্যক্তিগণ মানবতার স্বার্থে তাদের নিঃস্বার্থ অবদানের কারণে মানুষের ভালোবাসা কুড়ানোর পাশাপাশি আখিরাতে মহান আল্লাহর কাছে পুরস্কৃত হয়। সুতরাং আমরা ইমানদার কীর্তিমান ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করব, আল্লাহ যেন তাদেরকে ক্ষমা করেন, তাদের কবরকে শান্তিময় করেন, তাদের মর্যাদা উন্নীত করেন এবং আখিরাতের চির শান্তির নীড় জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।
দুআ ছাড়া আর কী করা যেতে পারে?

– এ সকল কীর্তিমান এবং দেশ ও মানবতার স্বার্থে জীবন উৎসর্গকারী ব্যক্তিদেরকে মানুষের স্মৃতিপটে ধরে রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ভবন বা রাস্তাঘাটের নামকরণ করা।

– তাদের গৌরবময় ইতিহাস ও জীবনের ভাল দিকগুলো মানুষের মাঝে আলোচনা-পর্যালোচনা করা।

– তাদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
– আমাদের আগামী প্রজন্ম শিক্ষার্থীদের নিকট তাদের আদর্শিক সুন্দর দিকগুলো এবং তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, গৌরব গাঁথা এবং রেখে যাওয়া অবদানগুলো তুলে ধরা। যেন তারা সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয় এবং জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
– তাদের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে হাসপাতাল ও দুস্থ মানবতার স্বার্থে’ কল্যাণ ট্রাস্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা।

– তাদের পক্ষ থেকে দান-সদকা করা।

– তাদের পক্ষ থেকে হজ ও ওমরা সম্পাদন করা ইত্যাদি।

পরিশেষে বলব, ইসলামের এই নিষিদ্ধ বিষয়টিকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক বা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা সঙ্গত নয় এবং এমন কিছু করা উচিত নয় যা,‌ তাদের জন্য কোনও কল্যাণ বয়ে আনবে না।

বরং আমাদের কর্তব্য, তাদেরকে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন এবং এমন কিছু করা যাতে তারা আখিরাতে শান্তিতে থাকেন এবং মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় বেঁচে থাকেন চিরকাল।
আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
রাণীশংকৈল, ঠাকুরগাঁও।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate