Friday, August 16, 2024

কুরআনের আয়াত বা সাধারণ আরবি অক্ষর দ্বারা ক্যালিগ্রাফি সংক্রান্ত জরুরি কয়েকটি বিধান

 প্রশ্ন: কুরআনের আয়াত কিংবা আরবি হরফ দ্বারা রাস্তার দেওয়ালে ক্যালিগ্রাফি করার বিধান কী? অনুরূপভাবে ঘর ডেকোরেশনের উদ্দেশ্যে কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি কৃত ফলক বা ক্যালেন্ডার ঝুলানোর বিধান কী?

উত্তর: রাস্তা, মসজিদ বা বাড়ির দেওয়াল, প্রাচীর ইত্যাদির সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্দেশ্যে কুরআনের আয়াত দ্বারা ক্যালিগ্রাফি করা জায়েজ নেই। অনুরূপভাবে ঘর ডেকোরেশনের উদ্দেশ্যে কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি সম্বলিত ফলক ঝুলানোও জায়েজ নয়। সর্বনিম্ন তা অ পছন্দনীয় কাজ। কারণ আল্লাহ তাআলা ঘরবাড়ি বা দেওয়ালের ডেকোরেশন বা শোভা বর্ধনের উদ্দেশ্যে কুরআন নাজিল করেননি। সুতরাং তা কুরআনকে অপাত্রে ব্যবহার করার অন্তর্ভুক্ত।

❑ কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য:

কুরআন হলো, মানবজাতির গাইডবুক ও সংবিধান। মহান আল্লাহ তা নাজিল করেছেন এ জন্য যে, মানুষ কুরআন তিলাওয়াত করবে, কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং তদনুযায়ী আমল করবে। তৎসঙ্গে কুরআনের বিধানাবলীকে মানুষ তাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনীতি ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটাবে।

এ মর্মে কুরআন-হাদিসে পর্যাপ্ত বক্তব্য এসেছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি আয়াত ও হাদিস পেশ করা হলো:

✪ এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, (হে নবি আপনি বলুন যে),

وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ-‏ وَأَنْ أَتْلُوَ الْقُرْآنَ

“আমি আরও আদিষ্ট হয়েছি যেন আমি মুসলিমদের (আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণকারীদের) দলভুক্ত হই এবং যেন আমি কুরআন তিলাওয়াত করি।” [সূরা নামল: ৯১-৯২]

✪ আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ

“আর আপনার নিকট পাঠিয়েছি উপদেশ গ্রন্থ (কুরআন) যেন আপনি মানুষের কাছে সুস্পষ্টভাবে তা বিবৃত করে দেন, যা তাদের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে। হয়ত এতে তারা চিন্তা-ভাবনা করবে।” [সূরা আনআম: ৪৪]

✪ তিনি আরও বলেন,

أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ

“তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?” [সূরা মোহাম্মাদ: ২৪]

তিনি আরও বলেন,

‏ وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ

“আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে। অতএব কোন চিন্তাশীল আছে কি? ” [সূরা কামার: ১৭]

✪ কুরআনের পরিচয় বিষয়ে আল্লাহ বলেছেন,

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ
‘রমজান মাস; যে মাসে মানুষের পথ নির্দেশনা এবং সঠিক পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও (সত্য-মিথ্যার মাঝে) পার্থক্য নিরূপণকারী হিসেবে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।” [সূরা বাকরা: ১৮৫]

✪ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ».

“আমি তোমাদের মাঝে দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি, তোমরা বিভ্রান্ত হবে না যতদিন এ দুটি আঁকড়ে থাকবে। আল্লাহর কিতাব (কুরআন) এবং তাঁর নবির সুন্নাহ (হাদিস)।” [মুয়াত্তা মালিক : ৩৩৩৮]

এ ছাড়া বহু আয়াত ও হাদিসে কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য বিবৃত হয়েছে। তাই আমাদের কর্তব্য, কুরআনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত না হওয়া এবং কুরআনকে অপাত্রে ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।

❑ কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার থেকে বিরত থাকা আবশ্যক কেন?

আমাদের অজানা নয় যে, কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি করতে কুরআনের অক্ষরগুলোকে আঁকাবাঁকা করে বিভিন্ন ফন্ট ব্যবহার করে উপর-নিচ করে সাজানো হয়। একটা অক্ষর আরেক অক্ষরের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। তাতে বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করে ডিজাইন করা হয়। ফলে কুরআনের অক্ষরগুলো স্পষ্টভাবে বুঝা যায় না। ফলে মানুষের তা ভুল পড়ার আশঙ্কা থাকে। অথবা আদৌ পড়া সম্ভব হয় না। কারণ এখানে মানুষকে কুরআন শেখানো বা কুরআনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া উদ্দেশ্য থাকে না। বরং উদ্দেশ্য থাকে শৈল্পিক ভাবে ঘর বা দেওয়ালের শোভা বর্দ্ধন।

অনেকেই কুরআনের আয়াত দ্বারা ডিজাইন কৃত ক্যালিগ্রাফির ফলক বা ক্যালেন্ডার ঘরে ঝুলিয়ে রাখে অথবা সাধারণভাবে বিশেষ কোনও সূরা বা আয়াত সম্বলিত ফলক ঘরে ঝুলিয়ে রাখে ডেকোরেশনের উদ্দেশ্য নয় বরং বরকতের আশায় বা বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে। কেউ আবার জিন-শয়তানেরে উপদ্রব, জাদু, বদনজর, অসুখ-বিসুখ, চুরি-ডাকাতি, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে। এমন উদ্দেশ্য থাকলে তা হবে জঘন্য বিদআত। কেননা, ঘরে কুরআন-হাদিসে এমন কোনও নির্দেশনা আসেনি। আ সালাফ তথা সাহাবি ও তাদের একনিষ্ঠ অনুসারী তাবেয়ীদের থেকে এমন কোনও বিষয় পাওয়া যায় না।

আবার অনেকে কুরআনের আয়াতকে এমনভাবে ডিজাইন করে যা দেখতে কোনও মানুষ, ঘোড়া, বা বিভিন্ন পশু-পাখির সাদৃশ্য মনে হয়। এমনটি করা আরও বেশি গর্হিত কাজ ও হারাম।
এগুলো সব নিঃসন্দেহে কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য পরিপন্থী কাজ। সুতরাং আল্লাহর কালামকে এহেন কাজে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।

❑ এ বিষয়ে কতিপয় বিজ্ঞ আলেমের ফতোয়া:

◆ হানাফি মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহ. বিখ্যাত ফতোয়ে শামীতে লিখেছেন,

“وتُكره كتابة القرآن، وأسماء الله تعالى على الدرهم، والمحاريب، والجدران، وما يُفرش، والله تعالى أعلم”

“কুরআনের আয়াত এবং আল্লাহর নামসমূহ দেরহাম, মেহরাব, দেওয়ালে ও আসবাব-পত্রের উপর লেখা মাকরুহ বা অ পছন্দনীয় কাজ। আল্লাহ ভালো জানেন। ” [ফাতাওয়ে শামী: ১/১৭৯]

◆ শাফেয়ী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম শরফুদ্দিন আন নওয়াবি রাহ. বলেছেন,

مذهبنا أنه يُكره نقش الحيطان والثياب بالقرآن، وبأسماء الله تعالى”

“আমাদের মাজহাব হল, কুরআনের আয়াত বা আল্লাহ তায়ালার নাম দ্বারা দেওয়াল বা কাপড়ের উপর নকশা করা মাকরূহ।” [তিবইয়ান: ৮৯ ও ৯৭]

◆ কুরআনের আয়াত দিয়ে ডেকোরেশন করার বিধান প্রসঙ্গে ইমাম নাসির উদ্দিন আলবানি রাহ. বলেন,

هذا التعليق (الديكورات في البيوت بآيات قرآنية) غير مشروع -أما الذين يصنعونها فهم لا يعملون عمالاً مشروعا ، لأن القرآن ما نزل لتزيين الجدر ، وإنما لتعمير القلوب لما فيها من الحكمة والموعظة الحسنة

“ডেকোরেশন বা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য কুরআনের আয়াত লটকানো শরিয়ত সিদ্ধ নয়। যারা এমন কাজ করে তারা শরিয়ত সম্মত কাজ করে না। কারণ কুরআন দেওয়াল সাজানোর জন্য অবতীর্ণ হয়নি; বরং কুরআনে যে প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশ আছে তার মাধ্যমে সুসংহত অন্তর নির্মাণ করার জন্য এসেছে।” [তুরাসুল আলবানী ফিল ফিকহ, ১৭/৭১৬, ফাতাওয়ায়ে আলবানী ৪৩৫, al-fatawa]

❑ কুরআন ও আল্লাহর নাম ছাড়া কেবল আরবি অক্ষর বা আরবি সাধারণ আরবি বাক্য দ্বারা ক্যালিগ্রাফি:

কুরআনের আয়াত ছাড়া সাধারণ আরবি অক্ষর, আরবি কবিতা, প্রবাদ বাক্য, কারো উক্তি, এমনকি হাদিস দ্বারা ক্যালিগ্রাফি করতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু সতর্ক হতে হবে, হাদিস বা আল্লাহ-রসুলের নাম সম্বলিত কোন বাক্য এমন স্থানে ক্যালিগ্রাফি করা জায়েজ নেই যেখানে তাদের সম্মানহানি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে করা হলে, তা নানাভাবে সম্মানহানি ঘটে।
পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে, অন্যের ঘরের দেওয়ালে এসব ক্যালিগ্রাফি করতে হলে মালিকের অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অনুমতি ছাড়া করা বৈধ নয়।

➤ উল্লেখ্য যে, কুরআনে বিশেষ কোনও আয়াত বা হাদিস যদি বৈঠকখানা, ঘর, অফিস, ব্যাংক, সম্মানহানি ঘটবে না এমন নিরাপদ স্থানে দেওয়ালে স্পষ্টভাবে লেখা হয় মানুষের কাছে কুরআন-হাদিসের মর্মবাণীকে পৌঁছিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাহলে তাতে কোনও সমস্যা নেই। অনুরূপ বাড়িতে বাচ্চাদেরকে শেখানোর উদ্দেশ্য থাকে তাহলে তাতেও কোনও সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। আল্লাহু আলাম।▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate