Saturday, November 15, 2025

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরআন তিলাওয়াত করা বা কবরের পাশে কুরআন পড়ার শরয়ি হুকুম কী

 প্রশ্ন: মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরআন তিলাওয়াত করা বা কবরের পাশে কুরআন পড়ার শরয়ি হুকুম কী? এ তিলাওয়াতের সওয়াব কি মৃতের কাছে পৌঁছে?

▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের শহর-গ্রাম সর্বত্র মৃত ব্যক্তিদের জন্য যে ইবাদতগুলো চালু রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো—মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত করা এবং সেই তিলাওয়াতের সওয়াব তাদের উদ্দেশ্যে দান বা কবরে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু এ ধরনের প্রথার পক্ষে স্পষ্ট কোনো ইসলামিক দলিল রয়েছে কি না, তা অনেক সময় যাচাই-বাছাই করা হয় না।জেনে রাখুন, ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হলো—সকল ইবাদত কেবল তওফিফিয়ায় বা কুরআন ও সুন্নাহর প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। একজন প্রকৃত ইমানদারের কর্তব্য হলো দলিলের অনুসরণ করা, নতুন উদ্ভাবন করা নয়। ইসলামে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কিংবা তার কবরের পাশে কুরআন তিলাওয়াত করলে সেই তিলাওয়াতের সওয়াব মৃতের কাছে পৌঁছে কি না—এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে দুটি মত রয়েছে:
.
▪️প্রথম মত: মৃতের পক্ষ থেকে সম্পাদিত সব নেক আমলের সওয়াব তার কাছে পৌঁছে যায়। এতে কুরআন তিলাওয়াত, রোযা, সালাত এবং অন্যান্য সকল ইবাদতই অন্তর্ভুক্ত।এটি হানাফী ও হাম্বলী মাযহাবের বিখ্যাত মত, আর শাফেয়ী মাযহাবের কিছু আলেমও এ মতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।এ মতের সমর্থনে তারা দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) তার সহীহ বুখারীতে:بَاب مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ نَذْرٌ”মানত আদায় না করে কেউ যদি মারা যায়।” নামে অধ্যায় রচনা করে বলেন;وَأَمَرَ ابْنُ عُمَرَ امْرَأَةً جَعَلَتْ أُمُّهَا عَلَى نَفْسِهَا صَلاَةً بِقُبَاءٍ فَقَالَ صَلِّي عَنْهَا وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ نَحْوَهُ”ইবনু ‘উমার (রাঃ) এক মহিলাকে আদেশ করেছিলেন যার মা কুবার মসজিদে সালাত আদায় করবে বলে মানত করেছিল। তিনি তাকে বলেছিলেন, তার পক্ষ থেকে সালাত আদায় করতে। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-ও এরকম বর্ণনা করেছেন।”(সহীহ বুখারী অধ্যায়: ৮৩/৩০ হা/৬৬৯৮)
.
আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ,গ্রন্থে এসেছে;اختلف العلماء في قراءة القرآن للميت وإهداء ثوابها له، فذهب الحنفية والحنابلة إلى جواز قراءة القرآن للميت وإهداء ثوابها له، قال ابن عابدين نقلا عن البدائع: ولا فرق بين أن يكون المجعول له ميتا أو حيا، والظاهر أنه لا فرق بين أن ينوي به عند الفعل للغير أو يفعله لنفسه ثم بعد ذلك يجعل ثوابه لغيره، وقال الإمام أحمد: الميت يصل إليه كل شيء من الخير، للنصوص الواردة فيه، ولأن الناس يجتمعون في كل مصر ويقرؤون يهدون لموتاهم من غير نكير فكان إجماعا، قاله البهوتي من الحنابلة.”মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত করা এবং তার সওয়াব তাকে উৎসর্গ করার বিষয়ে আলেমগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।হানাফি ও হাম্বলি মাযহাবের ফকীহগণ বলেন—মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত করা এবং তার সওয়াব তাকে ইহসান (উৎসর্গ) করা জায়েয ও গ্রহণযোগ্য। ইবনু ‘আবিদীন (রহিমাহুল্লাহ) আল-বাদায়েউস-সানায়ি‘ থেকে বর্ণনা করেছেন: “যার প্রতি সওয়াব পৌঁছানো উদ্দেশ্য, সে মৃত হোক বা জীবিত তাতে কোনো পার্থক্য নেই। বাহ্যিকভাবে দেখা যায়, কাজটি অন্যের জন্য নিয়ত করে করা বা প্রথমে নিজের জন্য করে পরে তার সওয়াব অন্যকে পৌঁছে দেওয়া — উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।”ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:“নেক আমলের সবকিছুই মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যায়, কারণ এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নস (প্রমাণ) বিদ্যমান। তাছাড়া, মানুষ প্রত্যেক শহরে তাদের মৃতদের জন্য একত্র হয়, কুরআন পাঠ করে এবং তাদের সওয়াব উৎসর্গ করে থাকে— অথচ কেউ এর বিরোধিতা করে না।সুতরাং এটি এক প্রকারের ঐকমত্য (ইজমা‘) বলে গণ্য হয়েছে।”এই বক্তব্যটি হাম্বলী আলেম আল-বুহূতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দ্বারাও বর্ণিত হয়েছে।”(আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ; খণ্ড: ৩৩; পৃষ্ঠা: ৬০)
.
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী’ হানাফি (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:১০১৬ হি:মতান্তরে ১০১০ হি:] বলেন;وفي الهداية: مذهب أهل السنة والجماعة أن الإنسان له أن يجعل ثواب عمله لغيره: صلاة. أو صوماً، أو صدقة، أو غيرها. يعني قراءة قرآن، وأذكار، وأدعية”আল-হিদায়া গ্রন্থে বলা হয়েছে: আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব হলো—মানুষ তার নিজের আমলের সওয়াব অন্য কাউকে দান করতে পারে; তা সালাত (নামায) হোক, সাওম (রোযা) হোক, সাদাকা (দান) হোক কিংবা অন্য কোনো ইবাদত হোক—যেমন কুরআন তিলাওয়াত, যিকর ও দোআ ইত্যাদি।”(ফাতহু বাবিল ইনায়াহ বি শারহিন নিকায়াহ” খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৪০; এবং হাশিয়াতু ইবনে আবিদীন; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৫৯৫)।
.
প্রিয় পাঠক! যদিও এই মতের পক্ষে কিছু আলেম রয়েছেন, তবে দলিলের দিক থেকে এটি দূর্বল মত। কারণ এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো সুস্পষ্ট সহিহ বর্ণনা নেই। এছাড়াও, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হামজা রাদিয়াল্লাহু আনহু, তাঁর স্ত্রী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা এবং তাঁর তিন কন্যা, যারা তাঁর জীবদ্দশায় মারা গিয়েছিলেন, তিনি তাঁদেরকে উৎসর্গ করে কোরআন তেলাওয়াত, কোরবানি, রোজা বা সালাত ইত্যাদি কিছুই আদায় করেননি। একইভাবে, সাহাবায়ে কেরামদের কারও কাছ থেকেও এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়নি।সুতরাং যদি এটি শরীয়তসম্মত হতো, তবে তাঁরা অবশ্যই এ কাজটি করতেন। শরীয়তের দৃষ্টিতে যা বৈধ এবং যার সওয়াব মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছায়, তা হলো: হজ্ব, ওমরাহ, ওয়াজিব রোজা, সাদকা (দান) এবং দোয়া।
.
▪️দ্বিতীয় মত: মৃত ব্যক্তির কাছে কোনো নেক আমলের সওয়াব পৌঁছায় না; কেবল সেই আমলগুলো ব্যতীত, যেগুলোর বিষয়ে শরিয়তের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ বিদ্যমান। এটি শাফেয়ী, এবং মালেকি মাজহাবের প্রসিদ্ধ মত।bআর দলিলের আলোকে এটাই অধিকতর সঠিক এবং শক্তিশালী (রাজেহ) মত।কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা হামজা (রাদিয়াল্লাহু আনহু), তাঁর মহীয়সী স্ত্রী খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এবং তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করা তিন কন্যার কারও জন্যই তিনি (ﷺ) কুরআন তিলাওয়াত করেননি, কোরবানি দেননি, রোজা রাখেননি বা তাদের পক্ষ থেকে সালাত আদায় করেননি—এমন কোনো প্রমাণ সহিহ সূত্রে বর্ণিত নেই। সাহাবায়ে কেরামের কারও থেকেও এরকম কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় না।অতএব, যদি এ ধরনের আমল শরিয়তে বৈধ ও প্রমাণিত হতো, তবে নিশ্চয়ই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবাগণ আমাদের আগে তা করতেন। তবে শরয়ি দলিল দ্বারা যা ব্যতিক্রম হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এবং যার সওয়াব মৃত ব্যক্তির নিকট পৌঁছে যায়, তা হলো—হজ্ব, ওমরাহ, ওয়াজিব রোজা, দান-সদকা ও তাদের জন্য দোয়া এবং তাদের ঋণ পরিশোধ করা ইত্যাদি।
.
এই মতের পক্ষে প্রমাণ হলো আল্লাহ তাআলার বাণী:وَ اَنۡ لَّیۡسَ لِلۡاِنۡسَانِ اِلَّا مَا سَعٰی “আর মানুষ যা চেষ্টা করে, তা ছাড়া তার জন্য আর কিছুই নেই।”(সূরা আন-নাজম: ৩৯) এবং রাসূল (ﷺ)-বানী: প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যখন মানুষ মারা যায় তখন তার আমল স্থগিত হয়ে যায়; তবে তিনটি আমল ছাড়া: সদকায়ে জারিয়া, এমন জ্ঞান যা থেকে মানুষ উপকৃত হয় কিংবা নেক সন্তান যে তার তার জন্য দোয়া করে।”(সহিহ মুসলিম হা/১৬৩১)
.
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহ্‌ তাআলা বান্দার মর্যাদা উন্নীত করেন। তখন বান্দা বলে, এই মর্যাদা আমি কিভাবে পেলাম? তখন আল্লাহ্‌ বলেন: তোমার জন্য তোমার সন্তানের দোয়ার কারণে।” (তাবারানীর ‘আদ-দোয়া’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৩৭৫), হাইছামী তাঁর ‘মাজমাউয যাওয়ায়েদ’ গ্রন্থে (১০/২৩৪) হাদিসটিকে ‘বায্‌যার’’এর বর্ণনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বাইহাকী তাঁর ‘আস-সুনানুল কুবরা’ গ্রন্থে (৭/৭৮) হাদিসটি সংকলন করেছেন] ইমাম যাহাবী তাঁর ‘আল-মুহায্‌যাব’’গ্রন্থে (৫/২৬৫০) বলেন: হাদিসটির সনদ শক্তিশালী। হাইছামী বলেন: সনদের বর্ণনাকারীগণ সকলে সহিহ হাদিসের বর্ণনাকারী; শুধু আসেম বিন বাহদালা ব্যতীত। তিনি ‘হাসান’ হাদিসের রাবী।
.
হাফেজ ইবনে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) আল্লাহর বাণী: (وأن ليس للإنسان إلا ما سعى) অর্থ:”আর এই যে, মানুষ তাই পায় যা সে চেষ্টা করে”(সূরা নাজম:৩৯) এর তাফসিরে তিনি বলেন: “ومن هذه الآية استنبط الشافعي ومن تبعه أن القراءة لا يصل إهداء ثوابها إلى الموتى ؛ لأنه ليس من عملهم ولا كسبهم ، ولهذا لم يندب إليه رسول الله صلى الله عليه وسلم أمته ولا حثهم عليه، ولا أرشدهم إليه بنص ولا إيماء ، ولم ينقل عن أحد من الصحابة رضي الله عنهم ، ولو كان خيراً لسبقونا إليه وباب القربات يقتصر فيه على النصوص ، ولا يتصرف فيه بأنواع الأقيسة والآراء ، فأما الدعاء والصدقة ، فذاك مجمع على وصولها ومنصوصٌ من الشارع عليها “এই আয়াত থেকে ইমাম আশ-শাফেয়ী (রহিমাহুল্লাহ) এবং তাঁর অনুসারীগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, কুরআন তিলাওয়াতের সওয়াব মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পৌঁছানো বৈধ নয়; কারণ এটি মৃত ব্যক্তির নিজস্ব কর্ম বা অর্জন নয়। এই কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে এর জন্য উৎসাহিত করেননি; তাদেরকে এর প্রতি আহ্বান জানাননি; না কোনো স্পষ্ট বাণীতে, না কোনো ইঙ্গিতপূর্ণভাবে। এমনকি সাহাবিদের কারো পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কিছুই বর্ণিত হয়নি।আর যদি এটি কল্যাণকর (সুন্নাত ও নেক কাজের) অন্তর্ভুক্ত হতো, তবে নিশ্চয়ই সাহাবাগণ আমাদের আগে তা করতেন।কারণ,‘নৈকট্য ও ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো—এগুলো কেবল শরয়ি দলিলের উপর নির্ভরশীল; এখানে কিয়াস (তুলনামূলক যুক্তি) বা ব্যক্তিগত মতামতের কোনো অবকাশ নেই। তবে দো‘আ ও সদকা (দান)-এর সওয়াব পৌঁছানো বিষয়ে উম্মতের মধ্যে সর্বসম্মতি (ইজমা‘) রয়েছে, এবং শরিয়ত প্রণেতা (রাসূলুল্লাহ ﷺ) এ বিষয়ে স্পষ্ট দলিল দ্বারা তা অনুমোদন করেছেন।”।”(তাফসিরে ইবনু কাসীর; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৫৮)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,طبعة دار إحياء التراث العربي، بيروت: “وأما قراءة القرآن: فالمشهور من مذهب الشافعي أنه لا يصل ثوابها إلى الميت “কুরআন তেলাওয়াতের বিষয়ে ইমাম শাফেয়ী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মাজহাবে প্রচলিত মত হলো, মৃত ব্যক্তির কাছে এর সওয়াব পৌঁছায় না।”(ইমাম নববী; শারহু সহীহ মুসলিম; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৯০)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে মা-এর জন্য কুরআন তেলাওয়াত ও সাদকার সওয়াব জীবিত বা মৃত অবস্থায় দান করার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বলেন:
أما قراءة القرآن فقد اختلف العلماء في وصول ثوابها إلى الميت على قولين لأهل العلم ، والأرجح أنها لا تصل لعدم الدليل ؛ لأن الرسول صلى الله عليه وسلم لم يفعلها لأمواته من المسلمين كبناته اللاتي مُتْن في حياته عليه الصلاة والسلام ، ولم يفعلها الصحابة رضي الله عنهم وأرضاهم فيما علمنا ، فالأولى للمؤمن أن يترك ذلك ولا يقرأ للموتى ولا للأحياء ولا يصلي لهم ، وهكذا التطوع بالصوم عنهم ؛ لأن ذلك كله لا دليل عليه ، والأصل في العبادات التوقيف إلا ما ثبت عن الله سبحانه أو عن رسوله صلى الله عليه وسلم شرعيته . أما الصدقة فتنفع الحي والميت بإجماع المسلمين ، وهكذا الدعاء ينفع الحي والميت بإجماع المسلمين ، فالحي لا شك أنه ينتفع بالصدقة منه ومن غيره وينتفع بالدعاء ، فالذي يدعو لوالديه وهم أحياء ينتفعون بدعائه ، وهكذا الصدقة عنهم وهم أحياء تنفعهم ، وهكذا الحج عنهم إذا كانوا عاجزين لكبر أو مرض لا يرجى برؤه فإنه ينفعهم ذلك ، ولهذا ثبت عنه صلى الله عليه وسلم : أن امرأة قالت يا رسول الله إن فريضة الله في الحج أدركت أبي شيخا كبيرا لا يثبت على الراحلة أفأحج عنه ؟ قال: ” حجي عنه” وجاءه رجل آخر فقال : يا رسول الله إن أبي شيخ كبير لا يستطيع الحج ولا الظعن أفأحج عنه وأعتمر ؟ قال:” حج عن أبيك واعتمر” فهذا يدل على أن الحج عن الميت أو الحي العاجز لكبر سنه أو المرأة العاجزة لكبر سنها جائز ، فالصدقة والدعاء والحج عن الميت أو العمرة عنه، وكذلك عن العاجز كل هذا ينفعه عند جميع أهل العلم، وهكذا الصوم عن الميت إذا كان عليه صوم واجب سواء كان عن نذر أو كفارة أو عن صوم رمضان لعموم قوله صلى الله عليه وسلم : ” من مات وعليه صيام صام عنه وليه” متفق على صحته ، ولأحاديثٍ أخرى في المعنى ، لكن من تأخر في صوم رمضان بعذر شرعي كمرض أو سفر ثم مات قبل أن يتمكن من القضاء فلا قضاء عنه ولا إطعام ؛ لكونه معذورا اهـ .
“কুরআন তেলাওয়াতের সওয়াব মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো নিয়ে আলেমদের মধ্যে দুটি মত রয়েছে।তবে অধিকতর সঠিক মত হলো, তা পৌঁছায় না, কারণ এর কোনো দলিল নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মৃত মুসলিম স্বজনদের জন্য (যেমন তাঁর কন্যাগণ যারা তাঁর জীবদ্দশায় মারা গিয়েছিলেন) এটি করেননি, এবং আমাদের জানামতে সাহাবায়ে কেরামও তা করেননি। তাই একজন মুমিনের জন্য উত্তম হলো, এ কাজ থেকে বিরত থাকা; মৃত বা জীবিত কারও জন্য কুরআন তেলাওয়াত করা কিংবা সালাত আদায় না করা। অনুরূপভাবে, তাদের পক্ষ থেকে নফল রোজা রাখাও প্রমাণিত নয়; কারণ এর কোনো শরয়ি দলিল নেই।ইবাদতের মূলনীতি হলো ‘তাওক্বীফ’ (যা আল্লাহ বা তাঁর রাসূল দ্বারা প্রমাণিত), শুধুমাত্র আল্লাহ বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রমাণিত বিষয় ছাড়া। তবে সাদকা (দান) সর্বসম্মতভাবে জীবিত ও মৃত উভয়ের জন্য উপকারী, তেমনি দোয়াও সর্বসম্মতভাবে জীবিত ও মৃত উভয়ের জন্য উপকারী। জীবিত ব্যক্তি নিঃসন্দেহে তার নিজের বা অন্যের সাদকা এবং দোয়া দ্বারা উপকৃত হয়। যে ব্যক্তি তার জীবিত পিতামাতার জন্য দোয়া করে, তারা তার দোয়ায় উপকৃত হয়, এবং তাদের জন্য সাদকাও তাদের উপকার করে। অনুরূপভাবে, বার্ধক্য বা আরোগ্যহীন রোগের কারণে অক্ষম হলে তাদের পক্ষ থেকে হজ্ব করাও তাদের উপকার করে। এ কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক মহিলা এসে বলেছিলেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরযকৃত হজ্ব আমার বৃদ্ধ পিতার উপর এমন অবস্থায় এসেছে যে তিনি সওয়ারীর উপর স্থির থাকতে পারেন না। আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে হজ করতে পারি?’ তিনি বললেন: ‘তুমি তাঁর পক্ষ থেকে হজ্ব করো।’ অন্য একজন লোক এসে বললেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতা খুবই বৃদ্ধ, তিনি হজ্ব ও সওয়ারী বহন করতে পারেন না। আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে হজ ও ওমরাহ করতে পারি?’ তিনি বললেন: ‘তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ্ব ও ওমরাহ করো।’এটি প্রমাণ করে যে, মৃত বা বার্ধক্যজনিত অক্ষম জীবিত পুরুষ বা নারীর পক্ষ থেকে হজ করা বৈধ। সুতরাং সাদকা, দো‘আ, মৃত বা অক্ষমের পক্ষ থেকে হজ্ব ও ওমরাহ এ সবই আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে তাদের উপকার করে।অনুরূপভাবে, যদি মৃত ব্যক্তির ওপর কোনো ওয়াজিব রোযা বাকি থাকে—তা মানত, কাফফারা বা রমজানের কাজা যাই হোক—তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ হাদীসের কারণে তার অভিভাবক তার পক্ষ থেকে রোযা রাখবে: “যে ব্যক্তি মারা গেল এবং তার ওপর রোযা বাকি ছিল, তার অভিভাবক যেন তার পক্ষ থেকে রোযা রাখে।(সহীহ মুত্তাফাক আলাইহ)।তবে যদি কেউ অসুস্থতা বা সফরের মতো শরয়ি ওজরের কারণে রমজানের রোযা বিলম্বিত করে এবং কাজা করার সুযোগ পাওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করে, তবে তার পক্ষ থেকে কাজা বা ফিদিয়া কিছুই দিতে হবে না, কারণ সে ওজরযুক্ত অবস্থায় মারা গেছে।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৪৬)
.
তবে হা, মৃত ব্যক্তির উপকারে আসে দান-সদকা, দো‘আ তার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ কিংবা হজ্ব উমরাহ ইত্যাদি তা হোক উত্তরাধিকারী কিংবা পরের পক্ষ থেকে। নাইলুল মাআবির বি শারহি দালিলিত তালিব’ গ্রন্থে এসেছে-وكلَّ قربةٍ فَعَلَها مسلمٌ ، وجعَلَ ثوابَها لمسلمٍ ، حيٍّ أو ميّتٍ : حصَل له ثوابُها ، ولو جَهِلَ الجاعلُ من جعلَه لهُ ، كالدعاءِ إجماعاً ، والاستغفارِ”জীবিত বা মৃত মুসলমানের জন্য যদি কোন মুসলিম নেক কাজ করে এর সওয়াব উৎসর্গ করে মুসলিম সে সওয়াব পাবে। যদিও সে মুসলিম না জানে কে তার জন্য নেক কাজটি করল। এমন নেক কাজের মধ্যে রয়েছে- দুআ ও ইসতিগফার।”(নাইলুল মাআবির বি শারহি দালিলিত তালিব খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৩৭)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: একজন মানুষ কি তার মাল দান করে সেই দানের সওয়াব অন্য কারো সাথে ভাগ করতে পারে?
তিনি উত্তর দিলেন:يجوز أن يتصدق الشخص بالمال وينويها لأبيه وأمه وأخيه ، ومن شاء من المسلمين ، لأن الأجر كثير ، فالصدقة إذا كانت خالصة لله تعالى ومن كسب طيب تضاعف أضعافاً كثيرة ، كما قال اله تعالى : ( مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ) البقرة/261. وكان النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يضحي بالشاة الواحدة عنه وعن أهل بيته “একজন মানুষ তার ধন-সম্পদ দিয়ে দান করতে পারে এবং তা উদ্দেশ্য করতে পারে তার বাবা-মা, ভাই এবং ইচ্ছেমতো মুসলিমদের জন্য। কারণ সওয়াব অনেক বেশি। দান যদি পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ তাআলার জন্য হয় এবং সৎভাবে অর্জিত অর্থ থেকে করা হয়, তাহলে তা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন,”যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশ শস্যদানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ”।(সূরা বাকারা: ২৬১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ছাগল কুরবানি করতেন নিজের জন্য এবং নিজের পরিবারের জন্য।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ২৪৯)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:الصدقة تقبل وتنفع ، عن الأب والأم وعن غيرهما ، فالصدقة فيها خير كثير عن الحي والميت
“পিতামাতার জন্য বা অপর কারো জন্য সদকা করলে কবুল হয় এবং উপকার দেয়। অতএব জীবিত মৃত উভয়ের জন্য সদকার মধ্যে বহু কল্যাণ রয়েছে। সমাপ্ত নুরুন (১৪/৩০৩) আলাদ দারব থেকে]
.
পরিশেষে আমরা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন, আপনাকে বাবার ভালবাসার কারণে উত্তম প্রতিদান দেন এবং আপনার বাবাকে ক্ষমা করে দেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)এর কিছু নাসীহাহ।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate