হযরত হূদ (আ:) জীবনি. হযরত হূদ(আলাইহিস সালাম)1.হূদ (আঃ)-এর পরিচয়2.হূদ (আঃ)-এর দাওয়াত3.কওমে ‘আদ-এর প্রতিহূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম1.হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি2.কওমে ‘আদ-এর উপরেআপতিত গযব-এর বিবরণ3.কওমে ‘আদ-এর ধ্বংসের প্রধান কারণ সমূহ4.শিক্ষণীয় বিষয় সমূহহূদ(আঃ)-এর পরিচয় :হযরত হূদ (আঃ) দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী ‘আদ জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন।আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বের প্রধান ছয়টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ-এর পরে কওমে‘আদ ছিল দ্বিতীয় জাতি। হূদ (আঃ) ছিলেন এদেরই বংশধর। ‘আদ ও ছামূদ ছিল নূহ (আঃ)-এর পুত্রসামের বংশধর এবং নূহের পঞ্চম অথবা অষ্টম অধঃস্তনপুরুষ। ইরামপুত্র ‘আদ-এর বংশধরগণ ‘আদঊলা’ বা প্রথম ‘আদ এবংঅপর পুত্রের সন্তান ছামূদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ছানী বা দ্বিতীয় ‘আদবলে খ্যাত।[1]‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রই ইরাম-এর দু’টি শাখা। সেকারণ ‘ইরাম’ কথাটি ‘আদ ওছামূদ উভয় গোত্রের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এজন্য কুরআনে কোথাও ‘আদঊলা’(নাজম ৫০)এবং কোথাও ‘ইরাম যাতিল ‘ইমাদ’(ফজর ৭)শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।‘আদসম্প্রদায়ের ১৩টি পরিবার বা গোত্র ছিল। আম্মান হ’তে শুরু করেহাযারামাউত ও ইয়ামন পর্যন্ততাদের বসতি ছিল।[2]তাদের ক্ষেত-খামারগুলো ছিল অত্যন্ত সজীব ও শস্যশ্যামল। তাদেরপ্রায় সব ধরনের বাগ-বাগিচা ছিল। তারা ছিল সুঠামদেহী ও বিরাট বপু সম্পন্ন।আল্লাহ তা‘আলাতাদের প্রতি অনুগ্রহের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বক্রবুদ্ধিরকারণে এসব নে‘মতইতাদের কাল হয়ে দাঁড়ালো। তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছিল ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করেছিল।তারা শক্তি মদমত্ত হয়ে ‘আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে’(ফুছছিলাত/হামীমসাজদাহ ১৫)বলে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে শুরু করেছিল। তারা আল্লাহর ইবাদত পরিত্যাগ করেনূহ (আঃ)-এর আমলে ফেলে আসা মূর্তিপূজার শিরক-এর পুনরায় প্রচলন ঘটালো। মাত্র কয়েকপুরুষ আগে ঘটে যাওয়া নূহের সর্বগ্রাসী প্লাবনের কথা তারা বেমালুম ভুলে গেল। ফলেআল্লাহ পাক তাদের হেদায়াতের জন্য তাদেরই মধ্য হ’তে হূদ (আঃ)-কে নবী হিসাবেপ্রেরণ করলেন। উল্লেখ্য যে, নূহের প্লাবনের পরে এরাই সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা শুরুকরে।হযরত হূদ (আঃ) ও কওমে ‘আদ সম্পর্কেপবিত্র কুরআনের ১৭টি সূরায় ৭৩টিআয়াতেবর্ণিত হয়েছে।[3]হূদ (আঃ)-এর দাওয়াত :সূরা আ‘রাফ ৬৫-৭২ আয়াতে আল্লাহ বলেন, ﻭَﺇِﻟَﻰ ﻋَﺎﺩٍﺃَﺧَﺎﻫُﻢْ ﻫُﻮْﺩﺍً ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﺍﻋْﺒُﺪُﻭﺍ ﺍﻟﻠﻪَ ﻣَﺎ ﻟَﻜُﻢ ﻣِّﻦْ ﺇِﻟَـﻪٍ ﻏَﻴْﺮُﻩُ ﺃَﻓَﻼَ ﺗَﺘَّﻘُﻮْﻥَ؟ ﻗَﺎﻝَ ﺍﻟْﻤَﻸُ ﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﻛَﻔَﺮُﻭْﺍ ﻣِﻦْﻗَﻮْﻣِﻪِ ﺇِﻧَّﺎ ﻟَﻨَﺮَﺍﻙَ ﻓِﻲْ ﺳَﻔَﺎﻫَﺔٍ ﻭِﺇِﻧَّﺎ ﻟَﻨَﻈُﻨُّﻚَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻜَﺎﺫِﺑِﻴْﻦَ، ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﻟَﻴْﺲَ ﺑِﻲْ ﺳَﻔَﺎﻫَﺔٌ ﻭَﻟَﻜِﻨِّﻲْ ﺭَﺳُﻮﻝٌ ﻣِّﻦﺭَّﺏِّ ﺍﻟْﻌَﺎﻟَﻤِﻴْﻦَ، ﺃُﺑَﻠِّﻐُﻜُﻢْ ﺭِﺳَﺎﻻﺕِ ﺭَﺑِّﻲْ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﻟَﻜُﻢْ ﻧَﺎﺻِﺢٌ ﺃَﻣِﻴْﻦٌ، ﺃَﻭَﻋَﺠِﺒْﺘُﻢْ ﺃَﻥْ ﺟَﺎﺀَﻛُﻢْ ﺫِﻛْﺮٌ ﻣِّﻦ ﺭَّﺑِّﻜُﻢْ ﻋَﻠَﻰﺭَﺟُﻞٍ ﻣِّﻨْﻜُﻢْ ﻟِﻴُﻨْﺬِﺭَﻛُﻢْ ﻭَﺍﺫْﻛُﺮُﻭْﺍ ﺇِﺫْ ﺟَﻌَﻠَﻜُﻢْ ﺧُﻠَﻔَﺎﺀَ ﻣِﻦ ﺑَﻌْﺪِ ﻗَﻮْﻡِ ﻧُﻮْﺡٍ ﻭَﺯَﺍﺩَﻛُﻢْ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺨَﻠْﻖِ ﺑَﺴْﻄَﺔً ﻓَﺎﺫْﻛُﺮُﻭْﺍﺁﻵﺀَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻟَﻌَﻠَّﻜُﻢْ ﺗُﻔْﻠِﺤُﻮْﻥَ، ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺃَﺟِﺌْﺘَﻨَﺎ ﻟِﻨَﻌْﺒُﺪَ ﺍﻟﻠّﻪَ ﻭَﺣْﺪَﻩُ ﻭَﻧَﺬَﺭَﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﻳَﻌْﺒُﺪُ ﺁﺑَﺎﺅُﻧَﺎ ﻓَﺄْﺗِﻨَﺎ ﺑِﻤَﺎ ﺗَﻌِﺪُﻧَﺎ ﺇِﻥْﻛُﻨْﺖَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴْﻦَ، ﻗَﺎﻝَ ﻗَﺪْ ﻭَﻗَﻊَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢ ﻣِّﻦ ﺭَّﺑِّﻜُﻢْ ﺭِﺟْﺲٌ ﻭَﻏَﻀَﺐٌ ﺃَﺗُﺠَﺎﺩِﻟُﻮْﻧَﻨِﻲْ ﻓِﻲْ ﺃَﺳْﻤَﺎﺀٍ ﺳَﻤَّﻴْﺘُﻤُﻮْﻫَﺎﺃَﻧﺘُﻢْ ﻭَﺁﺑَﺂﺅﻛُﻢ ﻣَّﺎ ﻧَﺰَّﻝَ ﺍﻟﻠﻪ ُﺑِﻬَﺎ ﻣِﻦْ ﺳُﻠْﻄَﺎﻥٍ ﻓَﺎﻧﺘَﻈِﺮُﻭْﺍ ﺇِﻧِّﻲْ ﻣَﻌَﻜُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟْﻤُﻨْﺘَﻈِﺮِﻳْﻦَ، ﻓَﺄَﻧﺠَﻴْﻨَﺎﻩُ ﻭَﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﻣَﻌَﻪُﺑِﺮَﺣْﻤَﺔٍ ﻣِّﻨَّﺎ ﻭَﻗَﻄَﻌْﻨَﺎ ﺩَﺍﺑِﺮَﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﻛَﺬَّﺑُﻮْﺍ ﺑِﺂﻳَﺎﺗِﻨَﺎ ﻭَﻣَﺎ ﻛَﺎﻧُﻮْﺍ ﻣُﺆْﻣِﻨِﻴْﻦَ – (ﺍﻷﻋﺮﺍﻑ ৬৫-৭২)-অনুবাদঃ আর ‘আদসম্প্রদায়ের নিকটে (আমরা প্রেরণ করেছিলাম) তাদের ভাই হূদকে। সে বলল, হে আমারসম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই।অতঃপর তোমরা কি আল্লাহভীরু হবে না?(আ‘রাফ ৭/৬৫)।‘তার সম্প্রদায়ের কাফের নেতারাবলল, আমরা তোমাকে নির্বুদ্ধিতায়লিপ্ত দেখতে পাচ্ছি এবং আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদীদেরঅন্তর্ভুক্ত মনে করি’ (৬৬)। ‘হূদ বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমার মধ্যে কোন নির্বুদ্ধিতানেই। বরং আমি বিশ্বপালকের প্রেরিত একজন রাসূল মাত্র’ (৬৭)। ‘আমি তোমাদের নিকটেপ্রতিপালকের পয়গাম সমূহ পৌঁছে দেই এবং আমি তোমাদের হিতাকাংখী ও বিশ্বস্ত’ (৬৮)।‘তোমরা কি আশ্চর্য বোধ করছ যে, তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষহ’তে তোমাদের থেকেই একজনের নিকটে অহী (যিকর) এসেছে, যাতে সেতোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করে? তোমরা স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাদেরকেকওমে নূহের পরে নেতৃত্বে অভিষিক্ত করলেন ও তোমাদেরকে বিশালবপু করেসৃষ্টিকরলেন। অতএব তোমরা আল্লাহর নে‘মত সমূহ স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকামহও’ (৬৯)। ‘তারাবলল, তুমি কি আমাদের কাছে কেবল এজন্য এসেছ যে, আমরা শুধুমাত্রআল্লাহর ইবাদত করি, আর আমাদের বাপ-দাদারা যাদের পূজা করত, তাদেরকে পরিত্যাগ করি?তাহ’লে নিয়ে এস আমাদের কাছে (সেই আযাব), যার দুঃসংবাদ তুমি আমাদের শুনাচ্ছ, যদি তুমিসত্যবাদী হও’ (৭০)। ‘হূদ বলল, তোমাদের উপরে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তেশাস্তি ও ক্রোধ অবধারিত হয়ে গেছে। তোমরা কেন আমার সাথে ঐসব নাম সম্পর্কেবিতর্ক করছ, যেগুলোর নামকরণ তোমরা ও তোমাদেরবাপ-দাদারা করেছ? ঐসবউপাস্যদেরসম্পর্কে আল্লাহ কোন প্রমাণ (সুলতান) নাযিল করেননি। অতএব অপেক্ষা কর,আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি’ (৭১)। ‘অনন্তর আমরা তাকে ও তার সাথীদেরকেস্বীয় অনুগ্রহে রক্ষা করলাম এবং যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করেছিল, তাদেরমূলোৎপাটন করে দিলাম। বস্ত্ততঃ তারা বিশ্বাসী ছিল না’(আ‘রাফ ৭/৬৫-৭২)।অতঃপর সূরা হূদ ৫০-৬০আয়াতে আল্লাহ উক্ত ঘটনা বর্ণনা করেছেননিম্নরূপেঃ ﻭَﺇِﻟَﻰ ﻋَﺎﺩٍ ﺃَﺧَﺎﻫُﻢْ ﻫُﻮﺩًﺍ ﻗَﺎﻝَ ﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِﺍﻋْﺒُﺪُﻭﺍ ﺍﻟﻠﻪَ ﻣَﺎ ﻟَﻜُﻢ ﻣِّﻦْ ﺇِﻟَﻪٍ ﻏَﻴْﺮُﻩُ ﺇِﻥْ ﺃَﻧﺘُﻢْ ﺇِﻻَّ ﻣُﻔْﺘَﺮُﻭْﻥَ، ﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﻻَ ﺃَﺳْﺄَﻟُﻜُﻢْ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﺃَﺟْﺮًﺍﺇِﻥْ ﺃَﺟْﺮِﻱَ ﺇِﻻَّ ﻋَﻠَﻰﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻓَﻄَﺮَﻧِﻲْ ﺃَﻓَﻼَ ﺗَﻌْﻘِﻠُﻮْﻥَ؟ ﻭَﻳَﺎ ﻗَﻮْﻡِ ﺍﺳْﺘَﻐْﻔِﺮُﻭْﺍ ﺭَﺑَّﻜُﻢْ ﺛُﻢَّ ﺗُﻮْﺑُﻮْﺍ ﺇِﻟَﻴْﻪِ ﻳُﺮْﺳِﻞِ ﺍﻟﺴَّﻤَﺎﺀَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢ ﻣِّﺪْﺭَﺍﺭًﺍﻭَﻳَﺰِﺩْﻛُﻢْ ﻗُﻮَّﺓًﺇِﻟَﻰ ﻗُﻮَّﺗِﻜُﻢْ ﻭَﻻَ ﺗَﺘَﻮَﻟَّﻮْﺍ ﻣُﺠْﺮِﻣِﻴْﻦَ، ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻳَﺎ ﻫُﻮْﺩُ ﻣَﺎ ﺟِﺌْﺘَﻨَﺎ ﺑِﺒَﻴِّﻨَﺔٍ ﻭَّﻣَﺎ ﻧَﺤْﻦُ ﺑِﺘَﺎﺭِﻛِﻲْ ﺁﻟِﻬَﺘِﻨَﺎ ﻋَﻦْﻗَﻮْﻟِﻚَ ﻭَﻣَﺎ ﻧَﺤْﻦُ ﻟَﻚَ ﺑِﻤُﺆْﻣِﻨِﻴْﻦَ، ﺇِﻥ ﻧَّﻘُﻮْﻝُ ﺇِﻻَّ ﺍﻋْﺘَﺮَﺍﻙَ ﺑَﻌْﺾُ ﺁﻟِﻬَﺘِﻨَﺎ ﺑِﺴُﻮْﺀٍ ﻗَﺎﻝَ ﺇِﻧِّﻲْ ﺃُﺷْﻬِﺪُ ﺍﻟﻠّﻪَ ﻭَﺍﺷْﻬَﺪُﻭْﺍﺃَﻧِّﻲْ ﺑَﺮِﻱْﺀٌ ﻣِّﻤَّﺎ ﺗُﺸْﺮِﻛُﻮْﻥَ، ﻣِﻦْ ﺩُﻭْﻧِﻪِ ﻓَﻜِﻴْﺪُﻭﻧِﻲْ ﺟَﻤِﻴْﻌًﺎ ﺛُﻢَّ ﻻَ ﺗُﻨْﻈِﺮُﻭْﻥِ، ﺇِﻧِّﻲْ ﺗَﻮَﻛَّﻠْﺖُ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟﻠﻪِ ﺭَﺑِّﻲْﻭَﺭَﺑِّﻜُﻢ ﻣَّﺎ ﻣِﻦْ ﺩَﺁﺑَّﺔٍ ﺇِﻻَّ ﻫُﻮَ ﺁﺧِﺬٌ ﺑِﻨَﺎﺻِﻴَﺘِﻬَﺎ ﺇِﻥَّ ﺭَﺑِّﻲْ ﻋَﻠَﻰ ﺻِﺮَﺍﻁٍ ﻣُّﺴْﺘَﻘِﻴْﻢٍ، ﻓَﺈِﻥْ ﺗَﻮَﻟَّﻮْﺍ ﻓَﻘَﺪْ ﺃَﺑْﻠَﻐْﺘُﻜُﻤﻤَّﺎﺃُﺭْﺳِﻠْﺖُ ﺑِﻪِ ﺇِﻟَﻴْﻜُﻢْ ﻭَﻳَﺴْﺘَﺨْﻠِﻒُ ﺭَﺑِّﻲْ ﻗَﻮْﻣًﺎ ﻏَﻴْﺮَﻛُﻢْ ﻭَﻻَ ﺗَﻀُﺮُّﻭْﻧَﻪُ ﺷَﻴْﺌًﺎ ﺇِﻥَّ ﺭَﺑِّﻲْ ﻋَﻠَﻰَ ﻛُﻞِّ ﺷَﻲْﺀٍ ﺣَﻔِﻴْﻆٌ، ﻭَﻟَﻤَّﺎﺟَﺎﺀَ ﺃَﻣْﺮُﻧَﺎ ﻧَﺠَّﻴْﻨَﺎ ﻫُﻮْﺩًﺍ ﻭَﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﺁﻣَﻨُﻮْﺍ ﻣَﻌَﻪُ ﺑِﺮَﺣْﻤَﺔٍ ﻣِّﻨَّﺎ ﻭَﻧَﺠَّﻴْﻨَﺎﻫُﻢ ﻣِّﻦْ ﻋَﺬَﺍﺏٍ ﻏَﻠِﻴْﻆٍ، ﻭَﺗِﻠْﻚَ ﻋَﺎﺩٌ ﺟَﺤَﺪُﻭْﺍﺑِﺂﻳَﺎﺕِ ﺭَﺑِّﻬِﻤْﻮَﻋَﺼَﻮْﺍ ﺭُﺳُﻠَﻪُ ﻭَﺍﺗَّﺒَﻌُﻮْﺍ ﺃَﻣْﺮَ ﻛُﻞِّ ﺟَﺒَّﺎﺭٍ ﻋَﻨِﻴْﺪٍ، ﻭَﺃُﺗْﺒِﻌُﻮْﺍ ﻓِﻲْ ﻫَﺬِﻩِ ﺍﻟﺪُّﻧْﻴَﺎ ﻟَﻌْﻨَﺔً ﻭَﻳَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻘِﻴَﺎﻣَﺔِ ﺃَﻵﺇِﻥَّ ﻋَﺎﺩًﺍ ﻛَﻔَﺮُﻭْﺍ ﺭَﺑَّﻬُﻢْ ﺃَﻵ ﺑُﻌْﺪًﺍ ﻟِّﻌَﺎﺩٍ ﻗَﻮْﻡِ ﻫُﻮْﺩٍ- )ﻫﻮﺩ ৫০-৬০(-অনুবাদঃ আর ‘আদ জাতির প্রতি (আমরা)তাদের ভাই হূদকে (প্রেরণ করেছিলাম)। সে তাদেরকে বলল, হে আমার জাতি! তোমরাআল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন মা‘বূদ নেই। বস্ত্ততঃ তোমরা সবাই এব্যাপারে মিথ্যারোপ করছ’(হূদ ১১/৫০)। ‘হে আমার জাতি! (আমার এ দাওয়াতের জন্য) আমিতোমাদের কাছে কোনরূপ বিনিময় চাই না। আমার পারিতোষিক তাঁরই কাছে রয়েছে, যিনিআমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমরা কি বুঝ না’?(৫১)। ‘হে আমার কওম! তোমরাতোমাদের পালনকর্তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাঁরই দিকে ফিরে যাও। তিনি আসমানথেকে তোমাদের উপর বারিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধিকরবেন। তোমরা অপরাধীদের ন্যায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না’(৫২)। ‘তারা বলল, হে হূদ! তুমিআমাদের কাছে কোন প্রমাণ নিয়ে আসনি, আর আমরাও তোমার কথা মত আমাদেরউপাস্যদের বর্জন করতেপারি না। বস্ত্ততঃ আমরা তোমার প্রতি বিশ্বাসী নই’(৫৩)। ‘বরং আমরাতো একথাই বলতে চাই যে, আমাদের কোন উপাস্য-দেবতা (তোমার অবিশ্বাসের ফলেক্রুদ্ধ হয়ে) তোমার উপরে অশুভ আছর করেছেন। হূদ বলল, আমি আল্লাহকে সাক্ষীরাখছি, আর তোমরাও সাক্ষী থাক যে, তাদের থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত, যাদেরকেতোমরা শরীক করে থাক’(৫৪)‘তাঁকে ছাড়া। অতঃপর তোমরা সবাই মিলে আমার অনিষ্ট করারপ্রয়াস চালাও এবং আমাকে কোনরূপ অবকাশ দিয়ো না’(৫৫)। ‘আমি আল্লাহর উপরে ভরসাকরেছি। যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা। ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণীনেই, যা তাঁর আয়ত্তাধীন নয়। আমার পালনকর্তা সরল পথে আছেন’ (অর্থাৎসরল পথেরপথিকগণের সাথে আছেন)’(৫৬)। ‘এরপরেও যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে (জেনেরেখ যে,) আমি তোমাদের নিকটে পৌঁছে দিয়েছিযা নিয়ে আমি তোমাদের নিকটেপ্রেরিত হয়েছি। আমার প্রভু অন্যকোন জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন, তখনতোমরা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা প্রতিটি বস্ত্তরহেফাযতকারী’(৫৭)। ‘অতঃপর যখন আমাদের আদেশ (গযব) উপস্থিত হ’ল, তখন আমরা নিজঅনুগ্রহে হূদ ও তার সাথী ঈমানদারগণকে মুক্ত করি এবং তাদেরকে এক কঠিন আযাব থেকেরক্ষা করি’(৫৮)। ‘এরা ছিল ‘আদ জাতি। যারা তাদের পালনকর্তার আয়াত সমূহকে (নিদর্শন সমূহকে)অস্বীকার করেছিল ও তাদের নিকটে প্রেরিত রাসূলগণের অবাধ্যতা করেছিল এবং তারাউদ্ধত ও হঠকারী ব্যক্তিদের আদেশ পালন করেছিল’(৫৯)। ‘এ দুনিয়ায় তাদের পিছেপিছেঅভিসম্পাৎ রয়েছে এবং রয়েছে ক্বিয়ামতের দিনেও। জেনে রেখ ‘আদ জাতিতাদের পালনকর্তার সাথে কুফরী করেছে। জেনে রেখ হূদের কওম ‘আদ জাতির জন্যঅভিসম্পাৎ’(হূদ ১১/৫০-৬০)।হূদ (আঃ) তাঁর জাতিকে তাদের বিলাসোপকরণ ও অন্যায় আচরণসম্পর্কে সতর্ক করেন এবং এতদসত্ত্বেও তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ সমূহস্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, যেমন সূরা শো‘আরায় ১২৮-১৩৯ আয়াতে বর্ণিতহয়েছে, ﺃَﺗَﺒْﻨُﻮْﻥَ ﺑِﻜُﻞِّ ﺭِﻳْﻊٍ ﺁﻳَﺔً ﺗَﻌْﺒَﺜُﻮْﻥَ، ﻭَﺗَﺘَّﺨِﺬُﻭْﻥَ ﻣَﺼَﺎﻧِﻊَ ﻟَﻌَﻠَّﻜُﻢْ ﺗَﺨْﻠُﺪُﻭْﻥَ، ﻭَﺇِﺫَﺍ ﺑَﻄَﺸْﺘُﻢْ ﺑَﻄَﺸْﺘُﻢْﺟَﺒَّﺎﺭِﻳْﻦَ، ﻓَﺎﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟﻠﻪَ ﻭَﺃَﻃِﻴْﻌُﻮْﻥِ، ﻭَﺍﺗَّﻘُﻮﺍ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﺃَﻣَﺪَّﻛُﻢْ ﺑِﻤَﺎ ﺗَﻌْﻠَﻤُﻮْﻥَ، ﺃَﻣَﺪَّﻛُﻢْ ﺑِﺄَﻧْﻌَﺎﻡٍ ﻭَّﺑَﻨِﻴْﻦَ، ﻭَﺟَﻨَّﺎﺕٍﻭَّﻋُﻴُﻮْﻥٍ، ﺇِﻧِّﻲْ ﺃَﺧَﺎﻑُ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻋَﺬَﺍﺏَ ﻳَﻮْﻡٍ ﻋَﻈِﻴْﻢٍ، ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺳَﻮَﺍﺀٌ ﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ﺃَﻭَﻋَﻈْﺖَ ﺃَﻡْ ﻟَﻢْ ﺗَﻜُﻦ ﻣِّﻦَ ﺍﻟْﻮَﺍﻋِﻈِﻴْﻦَ،ﺇِﻥْ ﻫَﺬَﺍ ﺇِﻻَّ ﺧُﻠُﻖُ ﺍﻟْﺄَﻭَّﻟِﻴْﻦَ، ﻭَﻣَﺎ ﻧَﺤْﻦُ ﺑِﻤُﻌَﺬَّﺑِﻴْﻦَ، ﻓَﻜَﺬَّﺑُﻮْﻩُ ﻓَﺄَﻫْﻠَﻜْﻨَﺎﻫُﻢْ ﺇِﻥَّ ﻓِﻲْ ﺫَﻟِﻚَ ﻟَﺂﻳَﺔً ﻭَّﻣَﺎ ﻛَﺎﻥَ ﺃَﻛْﺜَﺮُﻫُﻢﻣُّﺆْﻣِﻨِﻴْﻦَ – ) ﺍﻟﺸﻌﺮﺍﺀ ১২৮-১৩৯(-অনুবাদঃ ‘তোমরা কি প্রতিটি উঁচু স্থানে অযথা নিদর্শন নির্মাণ করছ(২৬/১২৮)? (যেমন সুউচ্চ টাওয়ার, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি)। ‘এবং তোমরা বড় বড় প্রাসাদসমূহ নির্মাণ করছ, যেন তোমরা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে’ (১২৯)? (যেমন ধনীব্যক্তিরা দেশে ও বিদেশে বিনা প্রয়োজনে বড় বড় বাড়ী করে থাকে)। ‘এছাড়া যখনতোমরা কাউকে আঘাত হানো, তখন নিষ্ঠুর-যালেমদের মত আঘাত হেনে থাক(১৩০)’ (বিভিন্ন দেশে পুলিশী নির্যাতনের বিষয়টি স্মরণযোগ্য)। ‘অতএব তোমরাআল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর (১৩১)’। ‘তোমরা ভয় কর সেই মহান সত্তাকে, যিনিতোমাদেরকে সাহায্য করেছেন ঐসব বস্ত্ত দ্বারা যা তোমরা জানো’ (১৩২)। ‘তিনিতোমাদের সাহায্য করেছেন গবাদি পশু ও সন্তানাদি দ্বারা (১৩৩)’ ‘এবং উদ্যান ও ঝরণা সমূহ দ্বারা(১৩৪)’। (অতঃপর হূদ (আঃ) কঠিন আযাবের ভয় দেখিয়ে বললেন,) ‘আমি তোমাদের জন্যমহাদিবসের শাস্তির আশংকা করছি’ (১৩৫)। জবাবে কওমের নেতারা বলল, ‘তুমি উপদেশ দাও বা নাদাও সবই আমাদের জন্য সমান’ (১৩৬)। ‘তোমার এসব কথাবার্তা পূর্ববর্তী লোকদেররীতি-অভ্যাস বৈ কিছু নয়’ (১৩৭)। ‘আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হব না’ (১৩৮)। (আল্লাহ বলেন,) ‘অতঃপর(এভাবে) তারা তাদের নবীকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করল। ফলে আমরাও তাদেরকে ধ্বংস করেদিলাম। এর মধ্যে (শিক্ষণীয়) নিদর্শন রয়েছে। বস্ত্ততঃ তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী ছিলনা’(শো‘আরা ২৬/১২৮-১৩৯)।সূরা হা-মীম সাজদার ১৪-১৬ আয়াতে ‘আদ জাতির অলীক দাবী,অযথা দম্ভ ও তাদের উপরে আপতিত শাস্তির বর্ণনা সমূহ এসেছে এভাবে,… ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻟَﻮْ ﺷَﺂﺀَ ﺭَﺑُّﻨَﺎﻟَﺄَﻧْﺰَﻝَ ﻣَﻶﺋِﻜَﺔً ﻓَﺈِﻧَّﺎ ﺑِﻤَﺎ ﺃُﺭْﺳِﻠْﺘُﻢْ ﺑِﻪِ ﻛَﺎﻓِﺮُﻭْﻥَ، ﻓَﺄَﻣَّﺎ ﻋَﺎﺩٌ ﻓَﺎﺳْﺘَﻜْﺒَﺮُﻭْﺍ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺄَﺭْﺽِ ﺑِﻐَﻴْﺮِ ﺍﻟْﺤَﻖِّ ﻭَﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻣَﻦْ ﺃَﺷَﺪُّﻣِﻨَّﺎ ﻗُﻮَّﺓً ﺃَﻭَﻟَﻢْ ﻳَﺮَﻭْﺍ ﺃَﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﺧَﻠَﻘَﻬُﻢْ ﻫُﻮَ ﺃَﺷَﺪُّ ﻣِﻨْﻬُﻢْ ﻗُﻮَّﺓً ﻭَﻛَﺎﻧُﻮْﺍ ﺑِﺂﻳَﺎﺗِﻨَﺎﻳَﺠْﺤَﺪُﻭْﻥَ، ﻓَﺄَﺭْﺳَﻠْﻨَﺎ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْﺭِﻳْﺤًﺎ ﺻَﺮْﺻَﺮًﺍ ﻓِﻲْ ﺃَﻳَّﺎﻡٍ ﻧَّﺤِﺴَﺎﺕٍ ﻟِّﻨُﺬِﻳْﻘَﻬُﻢْ ﻋَﺬَﺍﺏَ ﺍﻟْﺨِﺰْﻱِ ﻓِﻲ ﺍﻟْﺤَﻴَﺎﺓِ ﺍﻟﺪُّﻧْﻴَﺎ ﻭَﻟَﻌَﺬَﺍﺏُ ﺍﻟْﺂﺧِﺮَﺓِ ﺃَﺧْﺰَﻯ ﻭَﻫُﻢْ ﻻَﻳُﻨْﺼَﺮُﻭْﻥَ – )ﺣﻢ ﺍﻟﺴﺠﺪﺓ ১৪-১৬(-‘…তারা (‘আদ ও ছামূদের লোকেরা) বলেছিল, আমাদের প্রভুইচ্ছা করলে অবশ্যই ফেরেশতা পাঠাতেন। অতএব আমরা তোমাদের আনীত বিষয় অমান্যকরলাম’ (৪১/১৪)। ‘অতঃপর ‘আদ-এর লোকেরা পৃথিবীতে অযথা অহংকার করল এবং বলল,আমাদের চেয়েঅধিক শক্তিধর কে আছে? তারা কি লক্ষ্য করেনি যে, যে আল্লাহতাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিধর? বস্ত্ততঃ তারা আমাদের নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করত’ (১৫)। ‘অতঃপর আমরা তাদের উপরে প্রেরণ করলাম ঝঞ্ঝাবায়ু বেশকয়েকটি অশুভ দিনে, যাতে তাদেরকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনার কিছু আযাব আস্বাদনকরানো যায়। আর পরকালের আযাব তো আরও লাঞ্ছনাকর। যেদিন তারা কোনরূপসাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’(ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৪-১৬)।সূরা আহক্বাফ ২১-২৬ আয়াতে উক্তআযাবের ধরন বর্ণিত হয়েছে এভাবে, যেমন আল্লাহ বলেন, ﻭَﺍﺫْﻛُﺮْ ﺃَﺧَﺎ ﻋَﺎﺩٍ ﺇِﺫْ ﺃَﻧﺬَﺭَ ﻗَﻮْﻣَﻪُﺑِﺎﻟْﺄَﺣْﻘَﺎﻑِ ﻭَﻗَﺪْ ﺧَﻠَﺖْ ﺍﻟﻨُّﺬُﺭُ ﻣِﻦ ﺑَﻴْﻦِ ﻳَﺪَﻳْﻪِ ﻭَﻣِﻦْ ﺧَﻠْﻔِﻪِ ﺃَﻻَّ ﺗَﻌْﺒُﺪُﻭْﺍ ﺇِﻻَّ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﺇِﻧِّﻲْ ﺃَﺧَﺎﻑُ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻋَﺬَﺍﺏَﻳَﻮْﻣٍﻌَﻈِﻴْﻢٍ، ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺃَﺟِﺌْﺘَﻨَﺎ ﻟِﺘَﺄْﻓِﻜَﻨَﺎ ﻋَﻦْ ﺁﻟِﻬَﺘِﻨَﺎ ﻓَﺄْﺗِﻨَﺎ ﺑِﻤَﺎ ﺗَﻌِﺪُﻧَﺎ ﺇِﻥْ ﻛُﻨْﺖَ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺼَّﺎﺩِﻗِﻴْﻦَ، ﻗَﺎﻟَﺈِﻧَّﻤَﺎ ﺍﻟْﻌِﻠْﻢُ ﻋِﻨﺪَﺍﻟﻠَّﻪِ ﻭَﺃُﺑَﻠِّﻐُﻜُﻢ ﻣَّﺎ ﺃُﺭْﺳِﻠْﺖُ ﺑِﻪِ ﻭَﻟَﻜِﻨِّﻲْ ﺃَﺭَﺍﻛُﻢْ ﻗَﻮْﻣﺎً ﺗَﺠْﻬَﻠُﻮْﻥَ، ﻓَﻠَﻤَّﺎ ﺭَﺃَﻭْﻩُ ﻋَﺎﺭِﺿﺎً ﻣُّﺴْﺘَﻘْﺒِﻞَ ﺃَﻭْﺩِﻳَﺘِﻬِﻢْ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻫَﺬَﺍﻋَﺎﺭِﺽٌ ﻣُّﻤْﻄِﺮُﻧَﺎ ﺑَﻞْ ﻫُﻮَ ﻣَﺎ ﺍﺳْﺘَﻌْﺠَﻠْﺘُﻢْ ﺑِﻪِ ﺭِﻳْﺢٌ ﻓِﻴﻬَﺎ ﻋَﺬَﺍﺏٌ ﺃَﻟِﻴْﻢٌ، ﺗُﺪَﻣِّﺮُ ﻛُﻞَّ ﺷَﻲْﺀٍ ﺑِﺄَﻣْﺮِ ﺭَﺑِّﻬَﺎ ﻓَﺄَﺻْﺒَﺤُﻮْﺍ ﻻَﻳُﺮَﻯ ﺇِﻻَّ ﻣَﺴَﺎﻛِﻨُﻬُﻢْ ﻛَﺬَﻟِﻚَ ﻧَﺠْﺰِﻱ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡَ ﺍﻟْﻤُﺠْﺮِﻣِﻴْﻦَ، ﻭَﻟَﻘَﺪْ ﻣَﻜَّﻨَّﺎﻫُﻢْ ﻓِﻴْﻤَﺎ ﺇِﻥ ﻣَّﻜَّﻨَّﺎﻛُﻢْ ﻓِﻴْﻪِ ﻭَﺟَﻌَﻠْﻨَﺎ ﻟَﻬُﻢْ ﺳَﻤْﻌﺎًﻭَّﺃَﺑْﺼَﺎﺭﺍً ﻭَّﺃَﻓْﺌِﺪَﺓً ﻓَﻤَﺎ ﺃَﻏْﻨَﻰ ﻋَﻨْﻬُﻢْ ﺳَﻤْﻌُﻬُﻢْ ﻭَﻻَ ﺃَﺑْﺼَﺎﺭُﻫُﻢْ ﻭَﻻَ ﺃَﻓْﺌِﺪَﺗُﻬُﻢ ﻣِّﻦْ ﺷَﻲْﺀٍ ﺇِﺫْ ﻛَﺎﻧُﻮْﺍ ﻳَﺠْﺤَﺪُﻭﻥَ ﺑِﺂﻳَﺎﺕِﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﺣَﺎﻕَ ﺑِﻬِﻢ ﻣَّﺎ ﻛَﺎﻧُﻮْﺍ ﺑِﻪِ ﻳَﺴْﺘَﻬْﺰِﺀُﻭْﻥَ – )ﺍﻷﺣﻘﺎﻑ ২১-২৬(-‘আর তুমি ‘আদ-এর ভাই (হূদ)-এর কথাবর্ণনা কর, যখন সে তার কওমকে বালুকাময় উঁচু উপত্যকায় সতর্ক করে বলেছিল, অথচ তারপূর্বে ও পরে অনেক সতর্ককারী গত হয়েছিল, (এই মর্মে যে,) তোমরা আল্লাহব্যতীত অন্য কারু ইবাদত কর না। আমি তোমাদের জন্য এক মহাদিবসের শাস্তির আশংকাকরছি’(আহক্বাফ ৪৬/২১)। ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদেরকে আমাদের উপাস্য সমূহ থেকেফিরিয়ে রাখতে আগমন করেছ? তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক, তবে আমাদেরকে যেশাস্তির ভয় দেখাচ্ছ, তা নিয়ে আস দেখি?’(২২)। হূদ বলল, এ জ্ঞান তো স্রেফ আল্লাহরকাছেই রয়েছে। আমি যে বিষয় নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তা তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েথাকি। কিন্তু আমি দেখছি তোমরা এক মূর্খ সম্প্রদায়’(২৩)। অতঃপর তারা যখন শাস্তিকেমেঘরূপে তাদের উপত্যকা সমূহের অভিমুখী দেখল, তখন বলল, এতো মেঘ,আমাদেরকেবৃষ্টি দেবে। (হূদ বললেন) বরং এটা সেই বস্ত্ত, যা তোমরা তাড়াতাড়িচেয়েছিলে। এটা এমন বায়ু, যার মধ্যে রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’(২৪)। ‘সে তার প্রভুরআদেশে সবকিছুকে ধ্বংস করে দেবে। অতঃপর ভোর বেলায় তারাএমন অবস্থা প্রাপ্তহ’ল যে, শূন্য বাস্ত্তভিটাগুলি ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হ’ল না। আমরা অপরাধী সম্প্রদায়কেএমনি করেই শাস্তি দিয়ে থাকি’(২৫)। ‘আমরা তাদেরকে এমন সব বিষয়ে ক্ষমতা দিয়েছিলাম,যেসব বিষয়ে তোমাদের ক্ষমতা দেইনি। আমরা তাদের দিয়েছিলাম কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয়।কিন্তু সেসব কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় তাদের কোন কাজে আসল না, যখন তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করল এবং সেই শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করল, যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপকরত’(আহক্বাফ ৪৬/২১-২৬)।উক্ত বিষয়ে সূরা হা-ক্বক্বাহ ৭-৮আয়াতে আল্লাহ বলেন, ﺳَﺨَّﺮَﻫَﺎﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﺳَﺒْﻊَ ﻟَﻴَﺎﻝٍ ﻭَﺛَﻤَﺎﻧِﻴَﺔَ ﺃَﻳَّﺎﻡٍ ﺣُﺴُﻮْﻣًﺎ ﻓَﺘَﺮَﻯ ﺍﻟْﻘَﻮْﻡَ ﻓِﻴْﻬَﺎ ﺻَﺮْﻋَﻰ ﻛَﺄَﻧَّﻬُﻢْ ﺃَﻋْﺠَﺎﺯُ ﻧَﺨْﻞٍ ﺧَﺎﻭِﻳَﺔٍ- ﻓَﻬَﻞْ ﺗَﺮَﻯﻟَﻬُﻤﻤِّﻦ ﺑَﺎﻗِﻴَﺔ؟- ) ﺍﻟﺤﺎﻗﺔ ৭-৮(-‘তাদের উপরে প্রচন্ড ঝঞ্ঝাবায়ু প্রবাহিত হয়েছিল সাত রাত্রি ওআট দিবস ব্যাপী অবিরতভাবে। (হে মুহাম্মাদ!) তুমি দেখলে দেখতে পেতে যে, তারাঅসার খর্জুর কান্ডের ন্যায় ভূপাতিত হয়ে রয়েছে’ (৭)। ‘তুমি (এখন) তাদের কোন অস্তিত্বদেখতে পাও কি’?(হা-ক্বক্বাহ ৬৯/৭-৮)।সূরা ফাজ্র ৬-৮ আয়াতে ‘আদ বংশের শৌর্য-বীর্যসম্বন্ধে আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে শুনিয়ে বলেন, ﺍَﻟَﻢْ ﺗَﺮَﻛَﻴْﻒَ ﻓَﻌَﻞَ ﺭَﺑُّﻚَ ﺑِﻌَﺎﺩٍ، ﺍِﺭَﻡَ ﺫَﺍﺕِﺍﻟْﻌِﻤَﺎﺩِ، ﺍﻟَّﺘِﻰْ ﻟَﻢْ ﻳُﺨْﻠَﻖْ ﻣِﺜْﻠُﻬَﺎ ﻓِﻰ ﺍﻟْﺒِﻼَﺩِ -‘আপনি কি জানেন না আপনার প্রভু কিরূপ আচরণকরেছিলেন ‘আদে ইরম (প্রথম ‘আদ) গোত্রের সাথে’?(ফজর ৬)‘যারা ছিল উঁচুস্তম্ভসমূহের মালিক (৭)। ‘এবং যাদের সমান কাউকে জনপদ সমূহে সৃষ্টি করা হয়নি’(ফাজ্র৮৯/৬-৮)।কওমে ‘আদ-এর প্রতি হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম :কওমে নূহের প্রতি হযরতনূহ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারমর্ম এবং কওমে ‘আদ-এর প্রতি হযরত হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতেরসারমর্ম প্রায় একই। হযরত হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের সারকথাগুলি সূরা হূদ-এর ৫০, ৫১ ও ৫২ আয়াতেআল্লাহ বর্ণনা করেছেন, যা এক কথায় বলা যায়- তাওহীদ, তাবলীগ ও ইস্তেগফার। প্রথমেতিনি নিজ কওমকে তাদের কল্পিত উপাস্যদের ছেড়ে একক উপাস্য আল্লাহর দিকে ফিরেআসার ও একনিষ্ঠভাবে তাঁর প্রতি ইবাদতের আহবান জানান, যাকে বলা হয় ‘তাওহীদে ইবাদত’।অতঃপর তিনি জনজীবনকে শিরকের আবিলতা ও নানাবিধ কুসংস্কারের পংকিলতা হ’তে মুক্ত করারজন্য নিঃস্বার্থভাবে দাওয়াত দিতে থাকেন এবং তাদের নিকট আল্লাহর বিধানসমূহ পৌঁছে দিতেথাকেন। তাঁর এই দাওয়াত ও তাবলীগ ছিল নিরন্তর ও অবিরত ধারায় এবং যাবতীয় বস্ত্তগতস্বার্থের ঊর্ধ্বে। অতঃপর তিনি জনগণকে নিজেদের কুফরী, শেরেকী ও অন্যান্যকবীরা গোনাহ সমূহ হ’তে তওবা করার ও আল্লাহর নিকটে একান্তভাবে ক্ষমা প্রার্থনারআহবান জানান।উপরোক্ত তিনটি বিষয়ে সকল নবীই দাওয়াত দিয়েছেন। মূলতঃ উপরোক্ততিনটি বিষয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছেমানুষের ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি। মানুষযখনই নিজেদের কল্পিত দেব-দেবী ও মূর্তি-প্রতিমাসহ বিভিন্ন উপাস্যের নিকটে মাথা নতকরবে ও তাদেরকেই মুক্তির অসীলা কিংবা সরাসরি মুক্তিদাতা ভাববে, তখনই তার শ্রেষ্ঠত্বভূলুণ্ঠিত হবে। নিকৃষ্ট সৃষ্টি সাপ ও তুলসী গাছ পর্যন্ত তার পূজা পাবে। মানুষেরদুঃখ-দুর্দশা লাঘবও তার সেবা বাদ দিয়ে সে নির্জীব মূর্তির সেবায় লিপ্ত হবে। একজন ক্ষুধার্ত ভাইকে বাএকটি অসহায় প্রাণীকে খাদ্য না দিয়ে সে নিজেদের হাতে গড়া অক্ষম-অনড় মূর্তিকে দুধ-কলার নৈবেদ্য পেশ করবে ও পুষ্পাঞ্জলী নিবেদন করবে। এমনকি কল্পিত দেবতাকেখুশী করার জন্য সে নরবলি বা সতীদাহ করতেও কুণ্ঠিত হবে না। পক্ষান্তরে যখনইএকজন মানুষ সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবলমাত্র আল্লাহ্কে তার সৃষ্টিকর্তা, রূযীদাতা,বিপদহন্তা, বিধানদাতা, জীবন ও মরণদাতা হিসাবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে, তখনই সে অন্যসকল সৃষ্টির প্রতি মিথ্যা আনুগত্য হ’তে মুক্তি পাবে। আল্লাহর গোলামীর অধীনেনিজেকে স্বাধীন ওসৃষ্টির সেরা হিসাবে ভাবতে শুরুকরবে। তার সেবার জন্য সৃষ্ট জলে-স্থলে ও অন্তরীক্ষের সবকিছুর উপরে স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সে উদ্বুদ্ধহবে। তার জ্ঞান ও উপলব্ধি যত বৃদ্ধি পাবে, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও ভক্তি ততই বৃদ্ধিপাবে। মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টজীবের প্রতি তার দায়িত্ববোধ তত উচ্চকিত হবে।দ্বিতীয়তঃবস্ত্তগত কোন স্বার্থ ছাড়াই মানুষ যখন কাউকে সৎ পথের দাওয়াত দেয়, তখন তা অন্যেরমনে প্রভাব বিস্তার করে।ঐ দাওয়াত যদি তার হৃদয় উৎসারিত হয় এবং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রেরিতঅভ্রান্ত সত্যের পথের দাওয়াত হয়, তাহ’লে তা অন্যের হৃদয়ে রেখাপাত করে। সংশোধনমূলকদাওয়াত প্রথমে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও তা অবশেষে কল্যাণময় ফলাফল নিয়ে আসে।নবীগণের দাওয়াতে স্ব স্ব যুগের ধর্মনেতা ও সমাজ নেতাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়াসৃষ্টি হ’লেওদুনিয়া চিরদিন নবীগণকেই সম্মান করেছে, ঐসব দুষ্টমতি ধর্মনেতা ও সমাজনেতাদের নয়।তৃতীয়তঃ মানুষ যখন অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ও আল্লাহর নিকটেক্ষমাপ্রার্থী হয়, তখন তার দুনিয়াবী জীবনে যেমন কল্যাণ প্রভাব বিস্তার করে, তেমনিতার পরকালীন জীবন সুখময় হয় এবং সে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়। হূদ (আঃ)স্বীয় জাতিকে বিশেষভাবে বলেছিলেন, ‘হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর নিকটেক্ষমাপ্রার্থনা কর ও তাঁর দিকে ফিরে যাও। তাহ’লে তিনি আসমান থেকে তোমাদের জন্যবৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির উপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন’(হূদ ১১/৫২)।এখানে ‘শক্তি’ বলতে দৈহিক বল, জনবল ও ধনবল সবই বুঝানো হয়েছে। তওবা ওইস্তেগফারের ফলে এসবই লাভ করা সম্ভব, এটাই অত্র আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি :হযরত হূদ (আঃ) স্বীয় কওমে ‘আদকে শিরক পরিত্যাগ করে সার্বিকজীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। তিনি তাদেরকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করার এবং যুলুম ওঅত্যাচার পরিহার করে ন্যায় ও সুবিচারের পথে চলার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু নিজেদেরধনৈশ্বর্যের মোহে এবং দুনিয়াবী শক্তির অহংকারে মদমত্ত হয়ে তারা নবীর দাওয়াতকেপ্রত্যাখ্যান করে। তারা বলল, তোমার ঘোষিত আযাব কিংবা তোমার কোন মু‘জেযা নাদেখে কেবল তোমার মুখের কথায় আমরা আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসাউপাস্য দেব-দেবীদের বর্জন করতে পারি না। বরং আমরা সন্দেহ করছি যে, আমাদেরদেবতাদের নিন্দাবাদ করার কারণে তাদের অভিশাপে তোমাকে ভূতে ধরেছে ও মস্তিষ্কবিকৃত হয়ে তুমি উন্মাদের মত কথাবার্তা বলছ। তাদের এসব কথার উত্তরে হযরত হূদ (আঃ)পয়গম্বর সূলভ নির্ভীক কণ্ঠে জবাব দেন যে,তোমরা যদি আমার কথা না মানো, তবেতোমরা সাক্ষী থাক যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তোমাদের ঐসব অলীক উপাস্যদের আমিমানি না। তোমরা ও তোমাদের দেবতারা সবাই মিলে আমারঅনিষ্ট সাধনের চেষ্টা কর। তাতেআমার কিছুই হবে না আল্লাহর হুকুম ছাড়া। তিনিই আমার পালনকর্তা। তাঁর উপরেই আমি ভরসারাখি। যারাসরল পথে চলে, আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন।অহংকারী ও শক্তি মদমত্ত জাতির বিরুদ্ধেএকাকী এমন নির্ভীক ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও তারা তাঁরকেশাগ্র স্পর্শ করার সাহসকরেনি। বস্ত্ততঃ এটা ছিল তাঁর একটি মু‘জেযা বিশেষ। এর দ্বারা তিনি দেখিয়ে দিলেন যে,তাদের কল্পিত দেব-দেবীদের কোন ক্ষমতা নেই। অতঃপর তিনি বললেন, আমাকেযেসত্য পৌঁছানোর দায়িত্ব আল্লাহ পাক দিয়েছেন, সে সত্য আমি তোমাদের নিকটেপৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে যদি তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করতেই থাক এবং হঠকারিতার উপরে যিদকরতে থাক, তাহ’লে জেনে রেখ এর অনিবার্য পরিণতি হিসাবে তোমাদের উপরেআল্লাহর সেই কঠিন শাস্তি নেমে আসবে, যার আবেদন তোমরা আমার নিকটে বারবারকরেছ। অতএব তোমরা সাবধান হও। এখনো তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে এসো।কিন্তু হতভাগার দল হযরত হূদ (আঃ)-এর কোন কথায় কর্ণপাত করল না।তারা বরং অহংকারে স্ফীতহয়ে বলে উঠলো, ‘আমাদের চেয়ে বড় শক্তিধর (এ পৃথিবীতে) আর কে আছে’?(হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৫)। ফলে তাদের উপরে এলাহী গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো।কওমে ‘আদ-এর উপরে আপতিত গযব-এর বিবরণ :মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক বলেন, কওমে ‘আদ-এর অমার্জনীয় হঠকারিতার ফলে প্রাথমিক গযব হিসাবে উপর্যুপরি তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধথাকে। তাদের শস্যক্ষেত সমূহ শুষ্ক বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়। বাগ-বাগিচাজ্বলে-পুড়েছারখার হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও তারা শিরক ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেনি। কিন্তু অবশেষে তারাবাধ্য হয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। তখন আসমানে সাদা, কালো ও লাল মেঘদেখা দেয় এবং গায়েবী আওয়ায আসে যে, তোমরা কোনটি পসন্দকরো? লোকেরাকালো মেঘ কামনা করল। তখন কালো মেঘ এলো। লোকেরা তাকে স্বাগত জানিয়েবলল, ﻫَﺬَﺍ ﻋَﺎﺭِﺽٌ ﻣُّﻤْﻄِﺮُﻧَﺎ ‘এটি আমাদের বৃষ্টি দেবে’। জবাবে তাদের নবী হূদ (আঃ)বললেন, ﺑَﻞْ ﻫُﻮَ ﻣَﺎ ﺍﺳْﺘَﻌْﺠَﻠْﺘُﻢْ ﺑِﻪِ ﺭِﻳْﺢٌ ﻓِﻴْﻬَﺎ ﻋَﺬَﺍﺏٌ ﺍَﻟِﻴْﻢٌ، ﺗُﺪَﻣِّﺮُ ﻛُﻞَّ ﺷَﻲْﺀٍ ﺑِﺄَﻣْﺮِﺭَﺑِّﻬَﺎ … )ﺍﻷﺣﻘﺎﻑ২৪-২৫(-‘বরং এটা সেই বস্ত্ত যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা এমন বায়ু যার মধ্যেরয়েছে মর্মন্তুদআযাব’। ‘সে তার প্রভুর আদেশে সবাইকে ধ্বংস করে দেবে…’।[4]ফলে অবশেষে পরদিন ভোরে আল্লাহর চূড়ান্ত গযব নেমে আসে। সাত রাত্রি ও আটদিন ব্যাপী অনবরত ঝড়-তুফান বইতে থাকে। মেঘের বিকট গর্জন ও বজ্রাঘাতে বাড়ী-ঘরসব ধ্বসে যায়, প্রবল ঘুর্ণিঝড়ে গাছ-পালা সব উপড়ে যায়, মানুষ ও জীবজন্তু শূন্যে উত্থিতহয়ে সজোরে যমীনে পতিত হয়(ক্বামার ৫৪/২০; হাক্বক্বাহ ৬৯/৬-৮)এবং এভাবেইশক্তিশালী ও সুঠাম দেহেরঅধিকারী বিশালবপু ‘আদ জাতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়েযায়। আল্লাহ বলেন, এছাড়াও তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী অভিসম্পাৎ দুনিয়া ও আখেরাতে(হূদ ১১/৬০)।আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মেঘ বা ঝড় দেখতেন, তখন তাঁরচেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত এবং বলতেন হে আয়েশা! এই মেঘ ও তার মধ্যকার ঝঞ্ঝাবায়ুদিয়েই একটি সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে। যারা মেঘ দেখে খুশী হয়ে বলেছিল,‘এটি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করবে’।[5]রাসূলের এই ভয়ের তাৎপর্য ছিল এই যে, কিছুলোকের অন্যায়ের কারণে সকলের উপর এই ব্যাপক গযব নেমে আসতে পারে।যেমন ওহোদ যুদ্ধের দিন কয়েকজনেরভুলের কারণে সকলের উপর বিপদ নেমেআসে। যেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ﻭَﺍﺗَّﻘُﻮْﺍ ﻓِﺘْﻨَﺔً ﻻَّﺗُﺼِﻴْﺒَﻦَّ ﺍﻟَّﺬِﻳْﻦَ ﻇَﻠَﻤُﻮْﺍ ﻣِﻨْﻜُﻢْ ﺧَﺎﺻَّﺔًﻭَﺍﻋْﻠَﻤُﻮْﺁ ﺃَﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﺷَﺪِﻳْﺪُ ﺍﻟْﻌِﻘَﺎﺏِ – )ﺍﻷﻧﻔﺎﻝ ২৫(-‘আর তোমরা ঐসব ফেৎনা থেকে বেঁচে থাক, যাবিশেষভাবে কেবল তাদের উপর পতিত হবে না, যারা তোমাদের মধ্যে যালেম। আরজেনে রাখো যে, আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’(আনফাল ৮/২৫)।উল্লেখ্য যে, গযবনাযিলের প্রাক্কালেই আল্লাহ স্বীয় নবী হূদ ও তাঁর ঈমানদার সাথীদের উক্ত এলাকাছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন ও তাঁরা উক্ত আযাব থেকে রক্ষা পান(হূদ ১১/৫৮)। অতঃপরতিনি মক্কায় চলে যান ও সেখানেই ওফাত পান।[6]তবে ইবনু কাছীর হযরত আলী (রাঃ)থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, হূদ (আঃ) ইয়ামনেই কবরস্থ হয়েছেন।[7]আল্লাহসর্বাধিক অবগত।কওমে ‘আদ-এর ধ্বংসের প্রধান কারণসমূহ :১. মনস্তাত্ত্বিক কারণ সমূহ :(ক)তারা আল্লাহর অনুগ্রহ সমূহের অবমূল্যায়ন করেছিল। যার ফলে তারা আল্লাহর আনুগত্য হ’তেমুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং শয়তানেরআনুগত্য বরণ করে স্বেচ্ছাচারী হয়ে গিয়েছিল (খ)আল্লাহর নে‘মত সমূহকে তাদের জন্য চিরস্থায়ী ভেবেছিল (গ) আল্লাহর গযব থেকেবাঁচার জন্য বিভিন্ন কল্পিত উপাস্যের অসীলা পূজা শুরু করেছিল (ঘ) তারা আল্লাহর নবীকেমিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল (ঙ) তারা আল্লাহর গযব থেকে নির্ভীক হয়ে গিয়েছিল। যদিও তারাআল্লাহকে বিশ্বাস করত।২. বস্ত্তগত কারণসমূহ : প্রধানত:তিনটি :(ক) তারা অযথা উঁচু স্থান সমূহেসুউচ্চ টাওয়ার ও নিদর্শন সমূহ নির্মাণ করত। যা স্রেফ অপচয় ব্যতীত কিছুই ছিল না(শো‘আরা১২৮)।(খ) তারা অহেতুক মযবূত প্রাসাদ রাজি তৈরী করত এবং ভাবত যেন তারাসেখানে চিরকালবসবাস করবে(ঐ, ১২৯)।(গ) তারা দুর্বলদের উপর নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হানতো এবং মানুষেরউপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতো(ঐ, ১৩০)।শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :উপরোক্ত বিষয়গুলিরমধ্যে বর্তমান যুগের অত্যাচারী সমাজনেতা ও যালেম সরকার সমূহ এবং সভ্যতাগর্বীমানুষের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ নিহিত রয়েছে। যেমন:(১) অহি-র বিধানকে অস্বীকারকরা এবং অন্যায়ের উপর যিদ ও অহংকার প্রদর্শন করাই হ’ল পৃথিবীতে আল্লাহর গযব নাযিলেরপ্রধান কারণ।(২) আল্লাহ প্রেরিত গযবের ধরন বিভিন্ন রূপ হ’তে পারে। কিন্তু সেই গযবকেঠেকানোর ক্ষমতা মানুষের থাকে না।(৩) বিলাসী, অপচয়কারী ও অত্যাচারী নেতাদেরকারণেই জাতি আল্লাহর গযবের শিকার হয়ে থাকে।(৪) আল্লাহর গযব যাদের উপর আপতিত হয়,তারা সকল যুগে নিন্দিত হয় এবং কখনোই তারা আর মাথা উঁচু করেদাঁড়াতে পারে না।(৫) আল্লাহরবিধান লংঘনকারী ব্যক্তি বা সম্প্রদায় চূড়ান্ত বিচারে দুনিয়াতেই আল্লাহর গযবের শিকার হয়।উপরন্তু আখেরাতের আযাব তো থাকেই এবং তা হয় আরো কঠোর(ক্বলম ৬৮/৩৩)।[1].ইবনু কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৬৫, ৭৩।[2]. কুরতুবী, আ‘রাফ ৬৫।[3]. যথাক্রমে: (১) আ‘রাফ৭/৬৫-৭২, (২) তওবা ৯/৭০, (৩) হূদ ১১/৫০-৬০, ৮৯, (৪) ইবরাহীম ১৪/৯, (৫) হজ্জ ২২/৪২, (৬)ফুরক্বান ২৫/৩৮, ৩৯, (৭) শো‘আরা ২৬/১২৩-১৪০, (৮) আনকাবূত ২৯/৩৮, (৯) ছোয়াদ ৩৮/১২,(১০) গাফের/মুমিন ৪০/৩১, (১১) ফুছছিলাত/হামীম সাজদাহ ৪১/১৩-১৬, (১২) আহক্বাফ ৪৬/২১-২৬,(১৩) ক্বাফ ৫০/১৩, (১৪) যারিয়াত ৫১/৪১, ৪২, (১৫) ক্বামার ৫৪/১৮-২২, (১৬) হা-ক্বক্বাহ ৬৯/৪-৮,(১৭) ফাজ্র ৮৯/৬-৮। সর্বমোট ৭৩।[4]. আহক্বাফ ৪৬/২৪, ২৫; ইবনু কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৭১।[5]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১৫১৩‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘ঝঞ্ঝা-বায়ু’ অনুচ্ছেদ।[6]. তাফসীরকুরতুবী, আ‘রাফ ৬৫।[7]. তাফসীর ইবনে কাছীর, সূরা আ‘রাফ ৬৫।
No comments:
Post a Comment