এই লেখায় আমি নামাজে মনোযোগ বৃদ্ধির কিছু টিপস শেয়ার করব যেগুলোর মাধ্যমে আমি আমার নামাজে মনোযোগ বাড়াতে সক্ষম হয়েছি । এই টিপসগুলো আমাকে একজন বেনামাজী থেকে কিছুটা হলেও মনোযোগী নামাজী হতে সাহায্য করেছে।
১। নামাজের গুরুত্ব জানুন: মহান আল্লাহ আল–কোরআনে একটিমাত্র ইবাদতকে ঈমান এর সমার্থকরূপে ব্যবহার করেছেন, আর তা হলো নামাজ। ঘটনাটি ছিল এরকম – প্রিয়নবী মুহাম্মদ(সা) এর নবুয়তীর প্রথম দিকে সাহাবারা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ পড়তেন। হিজরতের পরে আল্লাহ কিবলা পরিবর্তন করে যখন কা’বা শরীফের দিকে করে দিলেন তখন অনেক সাহাবা প্রশ্ন করতে লাগলেন যে তাদের আগের নামাজগুলির কি হবে? সেগুলির জন্য কি সওয়াব পাওয়া যাবে না? উত্তরে আল্লাহ নিচের আয়াত নাজিল করেন:
“আর আল্লাহ এরূপ নন যে তিনি তোমাদের ঈমানকে ব্যর্থ করবেন”। (সূরা বাকারাহ:১৪৩ এর অংশবিশেষ)
উপরের আয়াতে আল্লাহ নামাজকে ঈমানের সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এই আয়াত দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, নামাজ না পড়লে ঈমান থাকে না। এছাড়া রাসূলুল্লাহ(সা) তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ এর একাধিক হাদিসে বলেছেন, যে নামাজ না পড়ল সে কুফরী করল। ইমাম আহমাদ ইবনে হানবাল, শাইখ মুহাম্মাদ আল উসাইমিন সহ বহু আলেম মনে করেন, যে ব্যক্তি নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত আদায় না করে সে কাফের এবং পরকালে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।
” ‘কিসে তোমাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছে‘? তারা বলবে, ‘আমরা নামাজীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না‘ ” (সূরা মুদ্দাসসির:৪২–৪৩)
২। কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটিতে মনোযোগী হোন: তাড়াহুড়া করে পড়া নামাজ আল্লাহ কবুল করেন না। কাজেই, ফরজ–সুন্নাত–নফল সব নামাজকে টার্গেট না করে আগে শুধু ফরজ নামাজটাকে ধীরে ধীরে খুশু‘ (বিনয় ও নম্রতা) এর সাথে আদায় করুন।
“কাজেই দুর্ভোগ সেই নামাজীদের যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে অমনোযোগী”। (সূরা মা‘উন:৪–৫)
সারাদিন মাত্র ১৭ রাকআত নামাজ আদায় করা ফরজ, এই নামাজগুলো আগে ধীরতার সাথে পড়া আয়ত্ব করুন। সুন্নাত সহ ১০ রাকআত যোহর নামাজ যে সময়ে পড়েন সেই সময়ে ধীরে ধীরে ৪ রাকআত ফরজ নামাজটুকু পড়ুন। যখন ফরজ নামাজে ধীরতা আয়ত্ব করে ফেলবেন তারপর সুন্নাত নামাজগুলো যদি আবার চালু করেন তাহলে অবচেতনভাবে সেগুলোও আপনি ধীর ভাবেই পড়বেন।
“পৃথিবীর উপরে যা কিছু আছে তার সবকিছু আমি এর জন্য শোভা করেছি মানুষকে পরীক্ষার জন্য যে তাদের মধ্যে কে কর্মে উত্তম”। (সূরা কাহফ:৭)
লক্ষ্য করুন, এখানে আল্লাহ বলেননি তিনি পরীক্ষা করবেন কে সবচেয়ে বেশী আমল করে, বরং তিনি বলেছেন কে সবচেয়ে উত্তম আমল করে। কাজেই, আমাদের উচিত হবে নামাজসহ সকল ইবাদতের কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটির দিকে গুরুত্ব দেয়া।
“অবশ্যই বিশ্বাসীগণ সফল হয়েছে, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়–নম্র” (সূরা মু‘মিনুন:১–২)
৩। সিজদায় নিজের ভাষায় দু‘আ করুন: আমরা অনেকেই জানি না, রুকুতে সিজদায় আরবীর ট্র্যাডিশনাল দু‘আ গুলোর বাইরে নিজের ভাষায় দু‘আ করা যায়। আমার এখনো মনে আছি, এই বিধানটা যেদিন জেনেছিলাম সেদিন থেকেই আমার নামাজ কেমন বদলে গিয়েছিল। আগে নামাজ পড়তাম এই ভেবে যে কখন নামাজ শেষ হবে আর মুনাজাতে যেয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাইব, আর এখন জানতে পারলাম নামাজের মধ্যেই আল্লাহর কাছে চাওয়া যায় – দারুন ব্যাপার তো! সিজদায় নিজের ভাষায় দু‘আ করলে অনুভব করতে পারি আল্লাহর সাথে যেন কথা সরাসরি বলছি – নামাজের অনুভূতিটা ঠিক যেরকম হওয়া উচিত।
রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন: তোমরা তোমাদের রবের সবচেয়ে কাছে আসো যখন সিজদায় থাকো। কাজেই তোমরা সিজদারত অবস্থায় বেশী করে দু‘আ কর। [মুসলিম ও আহমাদ]
৪। কোরআনীয় আরবী শিখুন: পয়েন্টটা পড়ে মনে হতে পারে, ওরে বাবা! আরবী শিখব? এত অনেক কঠিন কাজ। আসলে ব্যাপারটা মোটেই তা নয়, কেন? কারণ, এটা আল্লাহর ওয়াদা।
অবশ্যই আমি কোরআনকে বুঝার ও মুখস্থ করার জন্য সহজ করে দিয়েছি। (সূরা ক্বমর:১৭ আয়াতাংশ)
আল্লাহর এই ওয়াদা কতটুকু সত্য – আসুন তলিয়ে দেখা যাক । কোরআনীয় আরবী আর স্পোকেন আরবী এক জিনিস নয়। কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা একই শব্দ বহুবার রিপিট করেছেন, ফলে খুব অল্প কিছু শব্দ আর বেসিক গ্রামার শিখে নিলেই আমরা নামাজে নিয়মিতভাবে সে সূরা ও দু‘আ গুলো পড়ি সেগুলোর অর্থ বোঝা সম্ভব হবে। আরো স্পেসিফিকভাবে বলতে গেলে, মাত্র ১২৫টি হাই–ফ্রিকোয়েন্সী আরবী শব্দ যদি আপনি শিখে নেন তাহলে ৬০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের ৫০% শব্দই আপনি বুঝতে পারবেন! পৃথিবীর ইতিহাসে শেখার জন্য এর চেয়ে সহজ বই বোধ করি আর দুইটা নাই।
নামাজে ব্যবহৃত সূরা ও দু‘আগুলির অর্থ যখন আপনি জানবেন এবং বুঝে বুঝে নামাজ পড়বেন, তখন আপনার নামাজ সম্পূর্ণরূপে বদলে যেতে বাধ্য। স্কলারেরা বলেন, নামাজ হলো আল্লাহর সাথে বান্দার কথোপকথন। নামাজে যখন আমরা কোরআন তেলাওয়াত করি তখন আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন, আর যখন আমরা দু‘আ করি তখন আমরা আল্লাহর সাথে কথা বলি। আপনি যখন নামাজের সূরাগুলি, দু‘আ গুলি অর্থ বুঝে পড়বেন, তখনই কেবল অনুধাবন করতে পারবেন দিনে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা একটি কন্টিনিউয়াল লাইফ ইম্প্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম।
কোরআনের হাই–ফ্রিকোয়েন্সী শব্দগুলো নিয়ে গবেষনা করে অসাধারণ এক কোর্স তৈরী করেছেন Understand Quran Academy এর প্রতিষ্ঠাতা ড. আব্দুল আজিজ আব্দুর রহীম। “Understand Quran 50%” নামে মাত্র ৯ ঘণ্টার এক কোর্সে তিনি কোরআনের হাই–ফ্রিকোয়েন্সী ১২৫টি শব্দ শিখিয়েছেন। কোর্সটি খুবই সহজ কারণ তিনি সেইসব সূরার মাধ্যমে শব্দগুলি শিখিয়েছেন (যেমন – ফালাক, নাস, ইখলাস) যা আমরা বেশীরভাগ মুসলিমই জানি। একেকটি শব্দ ১ বা ২ বার নয়, ১০–২০ করে তিনি রিপিট করেছেন ফলে সেগুলো আপনার মাথায় গেঁথে যাবে। হাই–ফ্রিকোয়েন্সী কোরআনীয় শব্দগুলির বুকলেট আপনি ডাউনলোড করতে পারবেন নিচের লিঙ্ক থেকে। আমি সাজেষ্ট করব Understand Quran Academy এর ওয়েবসাইট থেকে কিছু টাকা খরচ করে হলেও 50% Words এর কোর্সটি করে ফেলুন – আপনি জিতবেন, ঠকবেন না।
http://d1.islamhouse.com/data/en/ih_books/single/en_understand_Quran.pdf
আর একান্তই যদি টাকা খরচ করতে অপরাগ হন তাহলে Islamic Online University এর ডিপ্লোমা বিভাগে যেয়ে “Introduction to Qur’anic Arabic” নামক ফ্রি কোর্সটি করতে পারেন।
৫। নতুন সূরা ও দু‘আ মুখস্থ করুন: আমরা যখন আমাদের গৎবাঁধা একই সূরা আর দু‘আ দিয়ে নামাজ পড়তে থাকি তখন নামাজ একটা রোবাটিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, চিন্তা করার আগেই আমাদের ঠোঁটের আগায় একেকটা আয়াত চলে আসে, ফলে আমাদের মনোযোগ নামাজ থেকে অন্যত্র চলে যায়। প্রতি মাসে ১/২টা নতূন সূরা, কিছু নতুন আয়াত বা দু‘আ শিখুন, তারপর সেগুলো নামাজে ব্যবহার করুন। নতুন আয়াতগুলো যেহেতু আপনাকে সচেতনভাবে মনে করে করে পড়তে হবে, কাজেই আপনি বাধ্য হবেন নামাজে মনোযোগী হতে।
উদাহরণস্বরুপ বলা যায় – রুকু‘ থেকে উঠার পর আমরা সবাই জানি যে বলতে হয় “রাব্বানা লাকাল হামদ”। কিন্তু এর সাথে অতিরিক্ত আরেকটি দু‘আ আছে যেটি হলো – “হামদান কাসিরান তাইয়িবান মুবারাকান ফি”। ছোটবেলায় আমরা যখন নামাজ শিখেছি তখন আমাদের হুজুর এটা শিখাননি, কারণ তিনি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যেটুকু না পড়লেই নয় সেটুকু শিখিয়েছিলেন। আমরা আমাদের জ্ঞানের এই সীমাবদ্ধতাকে পজিটিভ দৃষ্টিতে দেখে নতুন নতুন সূরা ও দু‘আ মুখস্থ করে যদি নামাজে ব্যবহার করি তাহলে আল্লাহ চাইলে নামাজে আমাদের মনোযোগ বাড়বে।
৬। তাজউইদ শিখুন: দুই বন্ধুর মধ্যে কথা হচ্ছে। দুজনেই কোরআন আরবীতে পড়তে পারে, কিন্তু একজন তাজউইদ (উচ্চারণের বিধি–বিধান) ভালমত জানে, আরেকজন জানে না।
১ম বন্ধু: এই তুই কোরআন পড়তে পারিস?
২য় বন্ধু: হ্যাঁ, পারি।
১ম বন্ধু: আচ্ছা এটা পড়ে দেখাতো, ঠিক করে উচ্চারণ করবি। বাংলা শব্দের মত করে পড়বি না, আরবীর মত করে উচ্চারণ করবি।
২য় বন্ধু: কোন্ শব্দটা পড়তে হবে – এইটা? ফাজলামী করিস আমার সাথে? আমাদের প্রভুর নাম আরবীতে পড়তে পারে না এরকম কোন মুসলিম আছে নাকি? এটা হলো “আল্ লা হু”।
১ম বন্ধু: হয়নি। আরবীতে لَ এর উচ্চারণ সবখানে হাল্কা “লা” হয়, শুধু এই শব্দটাতেই এটা ভারী ও লম্বা “লঅ” হয়, ইংরেজী Law শব্দটার মত। কাজেই, এর সঠিক উচ্চারণ হবে “আল্ লঅ হু”।
২য় বন্ধু: তাই নাকি! জানতাম না তো!
১ম বন্ধু: আচ্ছা এই বাক্যটা এবার পড়ে শুনা।
২য় বন্ধু: দোস্ত এটা তো সবাই পারে, কোরআনের সূরা তাওবা বাদে প্রত্যেকটা সূরাই এই বাক্য দিয়ে শুরু হয়। এর উচ্চারণ হলো, দাঁড়া একটু চিন্তা করে নেই। ও আচ্ছা, لَ কে ভারী করে পড়তে হবে – এই তো? কাজেই এটাকে পড়তে হবে “বিসমিল্ লআ হির রাহমাআ নির্ রাহিইম”
১ম বন্ধু: এটাও হয়নি রে। এখানে لَ হাল্কা হবে অর্থাৎ “লঅ” না হয়ে “লা” হবে। আর رَ এর উচ্চারণ সবসময়ই “র” হয় (ইংরেজী Raw এর মত), এর উচ্চারণ কখনো “রা” হয় না। এছাড়া حَ কেও ভারী করে পড়তে হবে। কাজেই বাক্যটার উচ্চারণ হলো “বিসমিল্ লাআ হি‘র্ রহ‘ মাআনির্ রহি‘ইম”
…
উপরের ঘটনার পর তাজউইদ শেখার গুরুত্ব নিয়ে নিশ্চয় আর কিছু বলার দরকার নেই। আপনি যখন সঠিক উচ্চারণ চিন্তা করে করে নামাজে কোরআন তেলাওয়াত করবেন তখন এমনিতেই আপনার মনোযোগ নামাজে চলে আসবে। তাজউইদ শেখার জন্য Understand Quran Academy এর পেইড কোর্স Read Quran করতে পারেন, আর ফ্রি কোর্স চাইলে শেইখ ইয়াসির কাদির “The Noble Emissaries” (ইউটিউবে পাবেন) কোর্সটি করতে পারেন।
৭। শাইখ হুসসারি এর তেলাওয়াত শুনুন: লক্ষ্য করুন আমি বলিনি যে কোন ক্বারীর কোরআন তেলাওয়াত শুনতে, আমি নির্দিষ্ট একজনের নাম বলেছি। কেন? কারণ, শাইখ খলিল আল–হুসসারি (Khalil Al-Hussary) এর তেলাওয়াত একটা খুব বিশেষ কিছু। তিনি প্রতিটা হরফ, প্রতিটা হরকত অত্যন্ত ধীরে ধীরে, স্পষ্টভাবে তাঁর দরাজ কন্ঠে তেলাওয়াত করে যান। তাঁর তেলাওয়াত শুনলে মনে হয় কোরআনের প্রত্যেকটা অক্ষরের প্রতি তাঁর সে কি মায়া, প্রত্যেকের উপরে তিনি কন্ঠ দিয়ে যেন পরশ বুলিয়ে যাচ্ছেন, প্রত্যেক অক্ষরকে তিনি প্রাপ্য এটেনশন দিবেন, এতটুকু কৃপণতা বা বাহুল্য করবেন না।
নামাজে যে সূরাগুলি আপনি পড়েন সেগুলি শাইখ হুসসারি এর কন্ঠে ডাউনলোড নিন (গুগল করলেই mp3 পাবেন), মোবাইলে বা গাড়ির সিডিতে কপি করে নিয়ে বার বার শুনুন। এর ফলে আপনি যখন নামাজে ঐ সূরা পড়তে যাবেন তখন নিজের অজান্তেই শাইখ হুসসারি এর ধীর–গতির আবৃত্তি আপনার কানে বাজতে থাকবে। ফলে, আপনার মনে তাড়াহুড়া করে নামাজ পড়ার কু–ইচ্ছা থাকলেও শাইখ হুসসারি এর দরাজ কন্ঠ আপনাকে তা করতে দেবে না। আমরা অনেকেই বেঁচে থেকেও মরে আছি, আর শাইখ হুসসারি কবরে শুয়ে শুয়েও আমাদের শিখিয়ে যাচ্ছেন কিভাবে কোরআনকে মর্যাদা দিতে হয়!
No comments:
Post a Comment