প্রশ্ন: সালাতুল ইস্তিস্ক্বা বা বৃষ্টি প্রার্থনার সালাত আদায়ের বিধান কি? উক্ত সালাত কিভাবে আদায় করতে হয়?
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “ পাঁচটির প্রতিফল পাঁচটি।” জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আল্লাহর রসূল! পাঁচটির প্রতিফল পাঁচটি কি কি?’ তিনি বললেন, “যে জাতিই (আল্লাহর) প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে সেই জাতির উপরেই তাদের শত্রুকে ক্ষমতাসীন করা হবে। যে জাতিই আল্লাহর অবতীর্ণকৃত সংবিধান ছাড়া অন্য দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে সেই জাতির মাঝেই দরিদ্রতা ব্যাপক হবে। যে জাতির মাঝে অশ্লীলতা (ব্যভিচার) প্রকাশ পাবে সে জাতির মাঝেই মৃত্যু ব্যাপক হবে। যে জাতিই যাকাত দেওয়া বন্ধ করবে সেই জাতির জন্যই বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। যে জাতি দাঁড়ি-মারা শুরু করবে সে জাতি ফসল থেকে বঞ্চিত হবে এবং দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হবে।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৭৬০)
বৃষ্টি প্রার্থনার সময় উল্টা হাতে দুআ করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, সাধারণ প্রার্থনার করার সময় হাতের তেলো বা ভিতর দিকটা হবে আকাশের দিকে এবং বৃষ্টি প্রার্থনার সময় হবে মাটির দিকে; আর হাতের বাহির দিকটা হবে আকাশের দিকে। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘একদা নবী (ﷺ) বৃষ্টি প্রার্থনা করলে তিনি তাঁর হাতের পিঠের দিকটা আকাশের দিকে তুলে ইঙ্গিত করলেন।’ (সহীহ মুসলিম, সহীহ ৮৯৫-৮৯৬) ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্ প্রমুখ উলামাগণ বলেন, কোন কিছু চাওয়া হয় হাতের ভিতরের অংশ দিয়েই, বাইরের অংশ দিয়ে নয়। আসলে আল্লাহর নবী (ﷺ) হাত দুটিকে মাথার উপরে খুব বেশী উত্তোলন করলে দেখে মনে হয়েছিল যে, তিনি হাতের বাইরের অংশ আকাশের দিকে করেছিলেন। (আল-ইনসাফ ২/৪৫৮, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৫/২৮৩)
অতঃপর কিবলামুখ হয়ে ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ে চাদর উল্টাবেন; অর্থাৎ, চাদরের ডান দিকটাকে বাম দিকে, বাম দিকটাকে ডান দিকে করে নেবেন এবং উপর দিকটা নিচের দিকে ও নিচের দিকটা উপর দিকে করবেন। এরপর সকলে পুনরায় (একাকী) দুআ করে বাড়ি ফিরবে। চাদর উল্টানো এবং দুআর সময় উল্টাহাত করা আসলে এক প্রকার কর্মগত দুআ। অর্থাৎ, হে মওলা! তুমি আমাদের এই চাদর ওহাত উল্টানোর মত আমাদের বর্তমান দুরবস্থাও পাল্টে দাও। আমাদের অনাবৃষ্টির অবস্থাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে দাও। (নামাযে নববী, সাইয়েদ শাফীকুর রহ্মান, লাহোর ছাপা ২৩৪পৃ:) প্রকাশ থাকে যে, ইস্তিসকার জন্য কোন নির্দিষ্ট দিন নেই। যে কোন একটি দিন ঠিক করে সেই দিনে নামায পড়া যায়। রোযা রাখা, পশু নেওয়া ইত্যাদির কথাও হাদীসে নেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৫/২৭১-২৭২)
▪️বৃষ্টি প্রার্থনার দ্বিতীয় পদ্ধতি: জুমআর খুতবায় ইমাম সাহেব হাত তুলে দুআ করবেন এবং মুক্তাদীরাও হাত তুলে ‘আমীন-আমীন’ বলবে। একদা মহানবী (ﷺ) জুমআর খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় এক মরুবাসী (বেদুঈন) উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! মাল-ধন ধ্বংস হয়ে গেল আর পরিবার পরিজন (খাদ্যের অভাবে) ক্ষুধার্ত থেকে গেল। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করুন।’ তখন নবী (ﷺ) নিজের দুইহাত তুলে দুআ করলেন এবং লোকেরাও তাঁর সাথে দুআর জন্য হাত তুলল। ফলে এমন বৃষ্টি শুরু হল যে পরবর্তী জুমআতে উক্ত (বা অন্য এক) ব্যক্তি পুনরায় খাড়া হয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! ঘর-বাড়ি ভেঙে গেল এবং মাল-ধন ডুবে গেল। সুতরাং আপনি আমাদের জন্য দুআ করুন!’ মহানবী (ﷺ) তখন নিজেরহাত তুলে পুনরায় বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার জন্য দুআ করলেন এবং বৃষ্টিও থেমে গেল। (বুখারী ৯৩২, ৯৩৩, ১০১৩, ১০২৯, মুসলিম, সহীহ ৮৯৭নং, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৩/২৫৬, ২৭১)
▪️বৃষ্টি প্রার্থনার তৃতীয় পদ্ধতি :শুরাহ্বীল বিন সিমত একদা কা’ব বিন মুর্রাহ্কে আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর হাদীস বর্ণনা করতে বললে তিনি বললেন, এক ব্যক্তি আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর নিকট এসে বলল, ‘আপনি মুযার (গোত্রের) জন্য বৃষ্টি প্রার্থনা করুন।’ তিনি বললেন, “তুমি তো বেশ দুঃসাহ্সিক! (কেবল) মুযারের জন্য (বৃষ্টি)?” লোকটি বলল, ‘আপনি আল্লাহ আযযা অজাল্লার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, তিনি আপনাকে সাহায্য করেছেন। আল্লাহ আযযা অজাল্লার কাছে দুআ করেছেন, তিনি তা কবুল করেছেন।’ এ কথা শোনার পর মহানবী (ﷺ) দুইহাত তুলে বৃষ্টি প্রার্থনার দুআ করলেন এবং এত বৃষ্টি হল যে, তা বন্ধ করার জন্য পুনরায় তিনি দুআ করলেন। (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে মাজাহ্, সুনান ১২৬৯ বায়হাকী, ইবনে আবী শাইবা)
(১) উচ্চারণ: আলহামদুলিল্লা-হি রব্বিল ‘আ-লামীন, আররহমা-নির রহীম, মা-লিকি ইয়াওমিদ্দ্বীন। লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ইয়াফ‘আলু মা ইউরীদু। আল্লা-হুম্মা আনতাল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা আনতা। আনতাল গানিইয়ু ওয়া নাহ্নুল ফুক্বারা-উ। আনঝিল ‘আলায়নাল গায়ছা ওয়াজ‘আল মা আনঝালতা ‘আলায়না কুউওয়াতাঁও ওয়া বালা-গান ইলা হীন।
অনুবাদ: সকল প্রশংসা বিশ্বপালক আল্লাহর জন্য। যিনি করুণাময় ও কৃপানিধান। যিনি বিচার দিবসের মালিক। আল্লাহ ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই। তিনি যা ইচ্ছা তাই-ই করেন। হে প্রভু! আপনি আল্লাহ। আপনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আপনি মুখাপেক্ষীহীন ও আমরা সবাই মুখাপেক্ষী। আমাদের উপরে আপনি বৃষ্টি বর্ষণ করুন! যে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তা যেন আমাদের জন্য শক্তির কারণ হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদী কল্যাণ লাভে সহায়ক হয়’। (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৫০৮ সালাত’ অধ্যায়-৪, ‘ইস্তিসকা’ অনুচ্ছেদ-৫২)
(2) اَللَّهُمَّ اسْقِ عِبَادَكَ وَبَهَائِمَكَ وَانْشُرْ رَحْمَتَكَ وَاحْيِ بَلَدَكَ الْمَيِّتَ-
(২) উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাস্ক্বে ‘ইবা-দাকা ওয়া বাহা-এমাকা ওয়ানশুর রহমাতাকা ওয়াহ্ইয়ে বালাদাকাল মাইয়েতা।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি পান করান আপনার বান্দাদেরকে ও জীবজন্তু সমূহকে এবং আপনার রহমত ছড়িয়ে দিন ও আপনার মৃত জনপদকে পুনর্জীবিত করুন’।(মুওয়াত্ত্বা, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৫০৬ ‘ছালাত’ অধ্যায়-৪, ‘ইস্তিসক্বা’ অনুচ্ছেদ-৫২।)
(3) اَللَّهُمَّ اسْقِنَا غَيْثًا مُّغِيْثًا مَّرِيْئًا مَّرِيْعًا، نَافِعًا غَيْرَ ضَارٍّ عَاجِلاً غَيْرَ آجِلٍ-
(৩) উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাসক্বেনা গায়ছাম মুগীছাম মারীআম মারী‘আ, না-ফে‘আন গায়রা যা-র্রিন ‘আ-জেলান গায়রা আ-জেলিন।অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এমন বৃষ্টি দান করুন, যা চাহিদা পূরণকারী, পিপাসা নিবারণকারী ও শস্য উৎপাদনকারী। যা ক্ষতিকর নয় বরং উপকারী এবং যা দেরীতে নয় বরং দ্রুত আগমনকারী’। (আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১৫০৭।)
এই সময় বৃষ্টি দেখলে বলবে, اَللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا আল্লা-হুম্মা ছাইয়েবান না-ফে‘আন (হে আল্লাহ! উপকারী বৃষ্টি বর্ষণ করুন)। (সহীহ বুখারী হা/১০৩২, মিশকাত হা/১৫০০।) বৃষ্টিতে চাদর ভিজিয়ে আল্লাহর বিশেষ রহমত মনে করে আগ্রহের সাথে তা বরণ করে নিতে হবে। (সহীহ মুসলিম, মিশকাত হা/১৫০১)
(২) এ সালাতের কোন নির্ধারিত সময় বা দিন নেই, নিষিদ্ধ সময় ছাড়া যেকোন সময় বৃষ্টির সালাত আদায় করা যায়। তবে উত্তম হলো ঈদের সালাতের মতো সকালে সূর্যোদয়ের একটু পরপরই পড়া।
(৩) শিশু ও নারীদেরকেও এ সালাতে নিয়ে যাওয়া, তবে বৃদ্ধদের উপস্থিতি আরো উত্তম।
(৪) জীবিত কোন মুত্তাক্বী পরহেযগার ব্যক্তির মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে বৃষ্টি প্রার্থনা করা যাবে। রাসূল (ﷺ) এর মৃত্যুর পরে তাঁর চাচা আব্বাস (রাঃ) এর মাধ্যমে ওমর (রাঃ) বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন। (সহীহ বুখারী হা/১০১০, মিশকাত হা/১৫০৯)
(৫) কোন মৃত ব্যক্তির দোহাই বা অসীলা দিয়ে বৃষ্টি প্রার্থনা করা যাবেনা। কারণ এটি হ’ল সবচেয়ে বড় শিরক।
(৬) দু’আর সময় ইমাম সাহেব মুসল্লীদের দিকে পিঠ দিয়ে কিবলামুখী হয়ে প্রার্থনা করবে, দু’আর সময় হাত যতখানী সম্ভব উপরে উঠিয়ে দুআ করবে, রাসূল (স) যখন হাত উঠিয়ে দু’আ করতেন তখন তার দুই বোগল পর্যন্ত নজরে আসত। দু’হাতের পিঠ উপরে এবং তালু নিচের দিকে দিয়ে দু’আ করবে, সে সময় গায়ের চাদর বা রুমান উল্টিয়ে পড়বে।
(৭) ঈদের সালাতের মতো প্রথম রাকআতে তাকবীরে তাহরীমা পর অতিরিক্ত সাত তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাকআতে তাকবীরে তাহরীমা দিয়ে ওঠে দাঁড়ানোর পর অতিরিক্ত আরো পাঁচ তাকবীর দেওয়ার বিধানও রয়েছে। (শরহেস্ সুন্নাহ লিলবাগাউয়ী- ৪/৪০২) তবে অতিরিক্ত তাকবির না দিলে বা কম বেশি হলে সমস্যা নেই ইনসাআল্লাহ।
(৮) ইস্তিস্ক্বার খুৎবা সাধারণ খুৎবার মত নয়। এটির সবটুকুই কেবল আকুতি ভরা দো‘আ আর তাকবীর মাত্র। (আবুদাঊদ হা/১১৬৫)
(৯) অতিবৃষ্টি হ’লে বলবে, اَللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا আল্লা-হুম্মা সাইয়েবান না-ফে‘আন (হে আল্লাহ! উপকারী বৃষ্টি বর্ষণ করুন)। (বুখারী হা/১০৩২, মিশকাত হা/১৫০০।)আর তাতে ব্যাপক ক্ষতির আশংকা দেখা দিলে তা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করে বলবে, اَللهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلاَ عَلَيْنَا، اَللّهُمَّ عَلَى الآكَامِ وَالظِّرَابِ وَ بُطُوْنِ الأَوْدِيَةِ وَمَنَابِتِ الشَّجَرِ।
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাহাওয়া-লাইনা অলা আলাইনা, আল্লা-হুম্মা আলাল আ-কামি অযযিরা-বি অবুতূনিল আউদিয়াতি অমানা-বিতিশ শাজার।অর্থ:- হে আল্লাহ! আমাদের আশে-পাশে বর্ষাও, আমাদের উপরে নয়। হে আল্লাহ! পাহাড়, টিলা, উপত্যকা এবং বৃক্ষাদির উদগত হওয়ার স্থানে বর্ষাও। (বুখারী,হা/৯৩৩, ১০২১; সহীহ মুসলিম,৮৯৭ আবুদাঊদ হা/১১৭৪)
No comments:
Post a Comment