নিম্নে নিম্নে প্রথমে ক্রেডিট কার্ড-এর পরিচয়, অতঃপর কুরআন, সুন্নাহ এবং বিজ্ঞ আলেমদের ফতোয়ার আলোকে এর ব্যবহার বিধি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
❑ ১. ক্রেডিট কার্ড কী?
ক্রেডিট কার্ড হলো, একটি আর্থিক সরঞ্জাম, যা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রদত্ত হয়। এটি ব্যবহার করে ব্যবহারকারী একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন এবং পরে তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। যদি ব্যবহারকারী সময়মত পরিশোধ না করেন তাহলে সুদ (ইন্টারেস্ট) প্রদান করতে হয়।
অন্য কথায়, ক্রেডিট কার্ড মূলত ঋণ গ্রহণের কার্ড। কার্ড ইস্যু কারী ব্যাংক তার গ্রাহককে এ কার্ডের মাধ্যমে একটি নির্ধারিত পরিমাণ ঋণ গ্রহণের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। এরপর এ কার্ডধারী বিভিন্ন দোকান থেকে এই কার্ডের মাধ্যমে পণ্য ক্রয় করতে পারে। যার মূল্য কার্ডধারীর ব্যাংক পরিশোধ করে থাকে। এখানে শরিয়তের দৃষ্টিতে কার্ডধারী হলো ঋণ গ্রহীতা। আর কার্ড ইস্যু কারী ব্যাংক হলো ঋণদাতা।
❑ ২. ইসলামে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের বিধান:
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ নাকি হারাম তা নির্ভর করে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারের উদ্দেশ্য, শর্তাবলি এবং এর সাথে জড়িত লেনদেনের প্রকৃতির উপর।
❑ ৩. ক্রেডিট কার্ডের বাস্তবতা ও সমস্যা:
ক্রেডিট কার্ড এমন একটি লেনদেন ব্যবস্থা যেখানে সাধারণত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান একজন গ্রাহককে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে দেয়, যা পরবর্তীতে ফেরত দিতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করা হয়, তাহলে সুদ (ইন্টারেস্ট) গুনতে হয়। যেমনটি আমরা এর সংজ্ঞা থেকে জেনেছি।
মূল সমস্যা:
❑. ৪. ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ব্যাপারে সৌদি আরবের গবেষণা-ফতোয়ার স্থায়ী বোর্ডের ফতোয়া:
সৌদি আরবের গবেষণা ও ফতোয়ার স্থায়ী বোর্ড (আল-লাজনাতুত দায়িমা লিল বুহুসিল ইলমিয়্যা ওয়াল ইফতা) তাদের এক ফতোয়ায় লিখেছে, (প্রশ্ন ছিল, মিনিমাম ডিউ-এর আগে বিল পরিশোধ করে দিলে কোনও ফি নেই আর না হয় অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে হয়)
‘বিষয়টি বাস্তবে এমনি হয়ে থাকলে সেটা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ গ্রাসের নামান্তর। এটি জাহেলি রিবা যা শরিয়তে হারামের অধীনে পড়ে যায়। জাহেলি রিবা হলো, এখন আদায় করো। নতুবা অতিরিক্ত প্রদানের শর্তে সময় নাও। সুতরাং এ ধরনের ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা বা ব্যবহার করা জায়েজ নয়। আল্লাহ তৌফিক দানকারী। আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরিবার ও সাহাবিদের প্রতি আল্লাহর শান্তি ও বরকত বর্ষিত হোক।
ওই ফতোয়ায় যারা সম্মতি প্রকাশ করেছেন তারা হলেন সদস্য: বকর আবু যায়েদ, আবদুল আজিজ আলে শাইখ, সালেহ ফাওজান, আবদুল্লাহ ইবনে গুদাইয়ান। প্রধান: আবদুল আজিজ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে বাজ (রহ.)। [ফাতাওয়া লাজনাতুত দায়িমা, প্রকাশ: চতুর্থ প্রকাশ, ২০০২ইং, ফতোয়া নং ১৭৬১১]
– এ বিষয়ে তাদের আরেকটি ফতোয়া:
প্রশ্নকারী বলেন: পশ্চিমা দেশগুলোতে আর্থিক লেনদেন সহজ করার জন্য কিছু কার্ড রয়েছে, যা একজন ব্যক্তিকে নগদ অর্থ বহন করার প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্ত রাখে। এই কার্ডের মাধ্যমে তিনি যে কোনও কিছু ক্রয় করতে পারেন, এবং মাসের শেষে তার খরচের হিসাবসংবলিত একটি বিল আসে, যা তিনি সম্পূর্ণরূপে পরিশোধ করেন এতে কোনও সুদ (রিবা) সংযুক্ত থাকে না। এই পদ্ধতি একজন ব্যক্তির অর্থ চুরির ঝুঁকি থেকে তাকে রক্ষা করে। তবে এই কার্ড পাওয়ার শর্ত হলো: যদি বিল পরিশোধে ২৫ দিনের বেশি দেরি হয়, তাহলে প্রতিদিনের জন্য নির্দিষ্ট হারে সুদ আদায় করা হবে। সেক্ষেত্রে, যদি কেউ এই কার্ড নেয় এবং নির্ধারিত ২৫ দিনের মধ্যে বিল পরিশোধ করে, তাহলে সে সুদের ফাঁদে পড়বে না। তাহলে কি এই কার্ড গ্রহণ করা বৈধ?
উত্তর:
যদি বাস্তব পরিস্থিতি এমন হয়, তবে এই কার্ড গ্রহণ করা বৈধ নয়। কারণ এটি একটি সুদ-সংযুক্ত চুক্তি, যেখানে দেরিতে পরিশোধের শর্ত হিসেবে সুদ নির্ধারিত রয়েছে। যদিও কেউ ২৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবুও মূল চুক্তিটিই সুদের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হওয়ায় এটি গ্রহণ করা অনুমোদিত নয়।
আল্লাহ তৌফিক দানকারী। আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরিবার ও সাহাবিদের প্রতি আল্লাহর শান্তি ও বরকত বর্ষিত হোক। [সৌদি আরবের গবেষণা ও ফতোয়ার স্থায়ী বোর্ড]
আন্তর্জাতিক ইসলামিক ফিকহ একাডেমি সহ বিশ্বের প্রায় সকল ফতোয়া বোর্ড সুদ যুক্ত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার হারাম হওয়ার ব্যাপারে ফতোয়া প্রদান করেছেন।
❑ ৫. ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের মূলনীতি:
◆ যদি কোনও কার্ড এমন হয় যেখানে সুদ প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই তাহলে তা ব্যবহার করা বৈধ। কিন্তু সাধারণত প্রচলিত ব্যাংকিং ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে সুদ প্রদানের শর্ত থাকে যা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম।
◆ তাই সুদের শর্তযুক্ত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা বৈধ নয় যতক্ষণ পর্যন্ত না নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এতে সুদের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। মনে রাখা আবশ্যক যে, ইসলামে সুদ হারাম এবং কবিরা গুনাহ। দুনিয়া ও আখিরাতে এর পরিণতি অত্যন্ত খারাপ।
❑ ৬. ইসলামে সুদের ভয়াবহতা:
ইসলামে সুদ (রিবা) আদান-প্রদান করা হারাম ও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কুরআন-হাদিসে এ ব্যাপারে অনেক বেশি সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। যেমন:
❖ মহান আল্লাহ বলেন,
اَلَّذِیۡنَ یَاۡكُلُوۡنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوۡمُوۡنَ اِلَّا كَمَا یَقُوۡمُ الَّذِیۡ یَتَخَبَّطُهُ الشَّیۡطٰنُ مِنَ الۡمَسِّ ؕ ذٰلِكَ بِاَنَّهُمۡ قَالُوۡۤا اِنَّمَا الۡبَیۡعُ مِثۡلُ الرِّبٰوا ۘ وَ اَحَلَّ اللّٰهُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا ؕ
“যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।” [সূরা বাকারা: ২৭৫]
❖ আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَذَرُواْ مَا بَقِيَ مِنَ ٱلرِّبَوٰٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ – فَإِن لَّمۡ تَفۡعَلُواْ فَأۡذَنُواْ بِحَرۡبٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۖ وَإِن تُبۡتُمۡ فَلَكُمۡ رُءُوسُ أَمۡوَٰلِكُمۡ لَا تَظۡلِمُونَ وَلَا تُظۡلَمُونَ
“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহর তাকাওয়া অবলম্বন কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর যদি তোমরা ঈমানদার হও। আর যদি তোমরা তা না কর, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শোন” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৮-২৭৯]”
❖ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَعَنَ اللَّهُ آكِلَ الرِّبَا وَمُوكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ، وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ
“আল্লাহ সুদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী, এর লেখক এবং এর সাক্ষী— সবার ওপর অভিশাপ দিয়েছেন।” [সহিহ মুসলিম, ১৫৯৮]
❑ ৭. ক্রেডিট কার্ড-এর বিকল্প ব্যবস্থা:
والله أعلم بالصواب
No comments:
Post a Comment