Sunday, March 2, 2025

মুসলিমদের পারস্পারিক হক ও সামাজিক দায়িত্ব কর্তব্যসমূহ

 সমাজে এক মুসলিমের ওপর আরেক মুসলিমের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ হক (অধিকার) রয়েছে। ইসলাম নির্দেশিত এসব হক ও দায়িত্ব-কর্তব্য বাস্তাবায়ন করা হলেই একটি সুন্দর, স্থিতিশীল, কল্যাণমুখী এবং উন্নত শান্তিময় আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং সমাজ থেকে জুলুম ও অন্যায়ের অবসান ঘটবে-তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ এগুলো আসমান থেকে অবতীর্ণ ওহির দিকনির্দেশনা। তাই আসুন, আমরা এগুলো নিজেরা জানার পাশাপাশি যথাসাধ্য চর্চা করি এবং সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমিন।

নিম্নে সংক্রান্ত কতিপয় বিষয় দলিলসহ উল্লেখ করা হলো:

❖ ১. বিশেষ পাঁচটি হকের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ: رَدُّ السَّلَامِ، وَعِيَادَةُ الْمَرِيضِ، وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِزِ، وَإِجَابَةُ الدَّعْوَةِ، وَتَشْمِيتُ الْعَاطِسِ

“একজন মুসলিমের ওপর আরেক মুসলিমের পাঁচটি হক রয়েছে:
ক. সালামের উত্তর দেওয়া,
খ. রোগীকে দেখতে যাওয়া,
গ. জানাজায় উপস্থিত হওয়া,
ঘ. দাওয়াতে সাড়া দেওয়া,
ঙ. এবং হাঁচি দিলে (আলহামদুলিল্লাহ বললে) তার জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা।”
[সহিহ বুখারি: ১২৪০, সহিহ মুসলিম: ২১৬২]

❖ ২. দোয়া করা:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

دَعْوَةُ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ لأَخِيهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مُسْتَجَابَةٌ

“একজন মুসলিম যদি তার অনুপস্থিতিতে তার ভাইয়ের জন্য দোয়া করে তবে তা কবুল হয়।” [সহিহ মুসলিম: ২৭৩৩]

❖ ৩. দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

مَنْ شَهِدَ الْجِنَازَةَ حَتَّى يُصَلَّى عَلَيْهَا فَلَهُ قِيرَاطٌ، وَمَنْ شَهِدَهَا حَتَّى تُدْفَنَ فَلَهُ قِيرَاطَانِ

“যে ব্যক্তি জানাজায় উপস্থিত হয় এবং জানাজার নামাজ পড়ে সে এক কিরাত সওয়াব পায়। আর যে ব্যক্তি দাফন পর্যন্ত থাকে সে দুই কিরাত সওয়াব পায়। জিজ্ঞাসা করা হলো: “দুই কিরাত (পুরস্কার) কী?” তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “দুটি বিশাল পর্বতের মতো।” [বুখারি ও মুসলিমে সম্মত, সহিহ হাদিস)” [সহিহ বুখারি: ১৩২৫, সহিহ মুসলিম: ৯৪৫]

❖ ৪. বিপদে সহানুভূতি দেখানো ও সাহায্য করা:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ

“যে ব্যক্তি কোনও মুমিনের দুনিয়ার কষ্ট দূর করে, আল্লাহ কিয়ামতের দিনে তার কষ্ট দূর করবেন।” [সহিহ মুসলিম: ২৬৯৯]

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,

“المُسْلِمُ أَخُو المُسْلِمِ، لا يَظْلِمُهُ وَلا يُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ، كَانَ اللَّهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً، فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ بِهَا كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ القِيَامَةِ

“এক মুসলিম আরেক মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করবে না, তাকে (শত্রুর হাতে) ছেড়ে দেবে না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে ব্যস্ত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের কষ্ট দূর করে আল্লাহ কিয়ামতের দিনে তার কষ্ট দূর করবেন।” [সহিহ বুখারি: ২৪৪২, সহিহ মুসলিম: ২৫৮০]

❖ ৫. অন্যায় কাজ করলে নিষেধ করা:

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ

“তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোনও মন্দ কাজ দেখে, তাহলে সে যেন তা হাত দিয়ে পরিবর্তন করে। যদি সে এতটা সামর্থ্য না রাখে তাহলে সে যেন মুখ দিয়ে বলে। যদি এটাও না পারে তাহলে যেন অন্তরে ঘৃণা করে। আর এটি হলো ইমানের সবচেয়ে দুর্বল স্তর।” [সহিহ মুসলিম: ৪৯]

❖ ৬. আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া এবং দ্বীন সম্পর্কে না জানলে শিক্ষা দেওয়া

আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ

“তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক যেন দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং ফিরে এসে তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করে যাতে তারা সাবধান হতে পারে।” [সূরা তওবা: ১২২]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ

“তোমার রবের পথে ডাকো প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সঙ্গে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করো।” [সূরা নাহল: ১২৫]

আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

بَلِّغُوا عَنِّي وَلَوْ آيَةً

“আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দাও।” [সহিহ বুখারি: ৩৪৬১]

❖ ৭. বিপদাপদ এবং ভালো কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করা:

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

“আর তোমরা নেকি ও তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতির কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করো এবং গুনাহ ও সীমালঙ্ঘন (জুলুম) এর কাজে সহযোগিতা করো না। আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয়ই তিনি কঠোর শাস্তি দাতা।” [সূরা মায়িদা: ২]

আল্লাহতালা আরো বলেন,

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ أُولَٰئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

“মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের সাহায্যকারী। তারা সৎকর্মের আদেশ দেয়, অসৎকর্ম থেকে নিষেধ করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করে। তাদের উপর আল্লাহ অবশ্যই দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা তওবা: ৭১]

হাদিসে এসেছে,

وَاللَّهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ

“যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে ততক্ষণ আল্লাহ তার সাহায্যে থাকেন।” [সহিহ মুসলিম: ২৬৯৯]

❖ ৮. কল্যাণ কামনা এবং সদুপদেশ দেওয়া:

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

الدِّينُ النَّصِيحَةُ

“দ্বীন হলো নসিহত বা কল্যাণ কামনার নাম।” [সহিহ মুসলিম: ৫৫]

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন:

إِذَا اسْتَنْصَحَ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ فَلْيَنْصَحْ لَهُ

“তোমাদের কেউ যদি তার ভাইয়ের কাছে উপদেশ চায়, তাহলে সে যেন তার জন্য উপদেশ দেয়।” [সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৭৪৫]

৯. বিশ্বাসঘাতকতা না করা, মিথ্যা না বলা ও কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা:

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“المسلِمُ أخو المسلِمِ، لا يَخونُه ولا يَكذِبُهُ ولا يَخذُلُه، كُلُّ المسلِمِ على المسلِمِ حَرامٌ؛ عِرضُهُ ومالُهُ ودَمُهُ، التَّقوى هاهنا، بحسْبِ امرئٍ من الشرِّ أن يَحقِرَ أخاهُ المسلِمَ”.

“একজন মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাই। সে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে না, মিথ্যা বলে না এবং তাকে পরিত্যাগ করে না। প্রতিটি মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের সম্পদ, সম্মান ও রক্ত হারাম (নিষিদ্ধ)। তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) এখানে (বুকের দিকে ইঙ্গিত করে)। কারও জন্য এতটুকুই মন্দ যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করে।” [সহিহ মুসলিম: ২৫৬৪]

❖ ১০. জুলুম-অবিচার না করা:

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لاَ يَظْلِمُهُ، وَلاَ يُسْلِمُهُ

“এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করবে না এবং তাকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দেবে না।” [সহিহ বুখারি: ২৪৪২, সহিহ মুসলিম: ২৫৮০]

১১. দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا، سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ القِيَامَةِ

“যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের গোপন বিষয় গোপন রাখে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার গোপন বিষয় গোপন রাখবেন।” [সহিহ বুখারি: ২৪৪২, সহিহ মুসলিম: ২৫৮০]

এখানে মূলত] সাধারণ মুসলিমদের পারস্পারিক হক ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

এ ছাড়াও ইসলামে পিতামাতা, সন্তান-সন্তুতি, স্বামী-স্ত্রী, প্রতিবেশী, ছোটদের প্রতি বড়দের ও বড়দের প্রতি ছোটদের, পথিক, মুসাফির, অসুস্থ ব্যক্তি, আলেম, শাসক ইত্যাদির বিশেষ কিছু হক রয়েছে। এসব হক সম্পর্কে জানা ও সেগুলোর প্রতি যত্নশীল হওয়া অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে।

মোটকথা, একজন মুসলিমের ওপর আরেক মুসলিমের হক অনেক। এগুলো পালনের মাধ্যমে সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য বজায় থাকে। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, এই হকগুলো আদায় করা এবং ইসলামের নির্দেশিত পদ্ধতিতে জীবন পরিচালনা করা। মুসলিমগণ যদি পরস্পরের হকগুলো আদায় করে তাহলে নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার সৌহার্দ পূর্ণ সহযোগিতা মূলক সুন্দর আদর্শ সমাজ গড়ে উঠবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ তৌফিক দান করুন। আমিন। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate