প্রশ্ন: মনে হয় আমি কনসিভ করেছি। কিন্তু সব সময়ই আমার ভিতরে একটা ভয় কাজ করে। যেমন: বাচ্চা কীরকম হবে, বাচ্চা যদি প্রতিবন্ধী হয়, কথা বলতে না পারে, খাটো বা অসুন্দর হয় এই সব বিষয় নিয়ে খুবই ভয় পাই। এই ভয় দূর করতে আমি কী করতে পারি?
নিচে কয়েকটি উপায় উল্লেখ করা হলো যা আপনার মনের ভয়ও দুশ্চিন্তা দূর করে সেখানে অনাবিল প্রশান্তি সৃষ্টিতে সাহায্য করবে ইনশাআল্লাহ:
১. ইতিবাচক চিন্তা চর্চা করুন:
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভাবস্থায় বেশির ভাগ হবু মায়েদের মনে কিছুটা ভয় দানা বাঁধে। সেখান থেকে নানা রকম প্যানিক বা উদ্বেগও তৈরি হয়। এ সময় শারীরিক কিছু পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তাই এই ভয়কে স্বাভাবিক ধরে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তার পরিবর্তে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে।
প্রতৃতপক্ষে সব শিশুই সুন্দর এবং অনন্য। আপনার শিশুকে ভালোবাসা ও যত্ন দিলে সে তার নিজস্ব সৌন্দর্য এবং সম্ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠবে। শিশুর গুণাগুণ বা চেহারা নিয়ে আগে থেকেই দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই বরং তাকে সুস্থভাবে জন্ম দেওয়ার দিকে মনোযোগ দিন।
২. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন:
আপনার গর্ভাবস্থার সময় পুষ্টিকর খাবার খান, নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চেকআপ করান। এতে আপনার বাচ্চার সুস্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
৩. অতিরিক্ত ভয় দূর করার জন্য বাস্তবসম্মত তথ্য জানুন:
গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পরে, নয় মাসের অভিজ্ঞতা যা ঘটে তা জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা। এমন সময় যখন গর্ভবতী মায়েরা এবং পিতারা তাদের অনাগত সন্তানের স্বাস্থ্যকে তাদের অগ্রাধিকারের তালিকার শীর্ষে রাখেন।
অনাগত শিশুর বিকাশ পর্যবেক্ষণ করা এবং তার সমস্ত অঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করছে তা নিশ্চিত করা পিতা-মাতার জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
তবে আপনি চাইলে গর্ভাবস্থার নির্দিষ্ট সময়ে কিছু পরীক্ষার (যেমন আলট্রাসাউন্ড, এনআইপিটি, অ্যামনিওসেন্টেসিস) মাধ্যমে ডাক্তার আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারেন।
বিশেষ করে এনআইপিটি (নন-ইনভেসিভ প্রিনাটাল টেস্টিং) পরীক্ষার মাধ্যমে যদি গর্ভস্ত সন্তানের মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু পাওয়া যায় তাহলে পিতামাতা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাহায্যে চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়।
৪. মানসিক চাপ কমান:
৫. জন্মের পরের বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করবেন না:
আপনার সন্তান কেমন হবে বা ভবিষ্যতে কী হবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। কিন্তু আপনি যে ভালোবাসাময় একটি পরিবেশে তাকে বড় করবেন, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনার শিশুকে যত্ন ও ভালোবাসা দিলে সে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে।
৬. আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলুন:
আপনি একজন মা হতে যাচ্ছেন এবং এটি আপনার জীবনের অন্যতম সুন্দর অভিজ্ঞতা হবে। সব শিশুই আলাদা। আর আপনি যে সন্তানই জন্ম দিন সে আপনার জন্য মূল্যবান ও ভালোবাসার অধিকারী।
৭. প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন:
আপনার ভয় যদি অতিরিক্ত হয় এবং মানসিক শান্তি ব্যাহত হয় তাহলে গাইনোকোলজিস্ট বা থেরাপিস্টের সাথে কথা বলুন।
আপনি একা নন, অনেক হবু মা-ই এ ধরনের দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে যান। ধীরে ধীরে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে, শুধু নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকুন।
৮. আল্লাহর তকদিরের উপর বিশ্বাস রাখুন:
৯. আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন:
আপনার সন্তান কেমন হবে তা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে। আল্লাহ আমাদের কল্যাণের জন্য যা ঠিক তাই নির্ধারণ করেন। তাই ভয় ও দুশ্চিন্তা দূর করে আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা রাখুন।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ
“মুমিনদের কর্তব্য, আল্লাহর উপর ভরসা রাখা।” [সূরা আলে ইমরান: ১২২]
১০. আল্লাহর কাছে সুসন্তানের জন্য দুআ করুন:
আল্লাহ আমাদেরকে সুস্থ, নেককার ও দ্বীনদার সন্তান দান করুন—এমন দুআ করতে পারেন।
কুরআনে এসেছে:
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
উচ্চারণ: Rabbanaa hab lanaa min azwaajinaa wa dhurriyyatinaa qurrata a’yunin waj‘alnaa lil-muttaqeena imamaa.
অর্থ: “হে আমাদের রব! আমাদের স্ত্রীগণ ও সন্তান-সন্ততিদের আমাদের চোখের শীতলতা বানিয়ে দাও এবং আমাদেরকে মুত্তাকিদের নেতা বানিয়ে দাও।” [সূরা আল-ফুরকান: ৭৪]
১১. অকল্যাণ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করুন:
আপনার সন্তান যেন শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ-সবল হয় এবং কোনও পরীক্ষায় না পড়ে সে জন্য আল্লাহর নিকট আশ্রয় চেয়ে দুআ করুন। আল্লাহর কাছে চাইতে পারেন-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْجُبْنِ وَالْبُخْلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ غَلَبَةِ الدَّيْنِ وَقَهْرِ الرِّجَالِ
উচ্চারণ: Allahumma inni a‘udhu bika minal-hammi wal-hazan, wa a‘udhu bika minal-‘ajzi wal-kasal, wa a‘udhu bika minal-jubni wal-bukhl, wa a‘udhu bika min ghalabatid-dayni wa qahrir-rijal.
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ-কষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই, আমি অক্ষমতা ও অলসতা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই, আমি কাপুরুষতা ও কৃপণতা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই এবং ঋণের বোঝা ও মানুষের আধিপত্য থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই।” [সহিহ বুখারি: ৬৩৬৯]
১২. যদি সন্তান প্রতিবন্ধী হয় তবে ধৈর্য ধারণ করুন এবং এটিকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করুন:
যদি আল্লাহ আপনাকে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (প্রতিবন্ধী) সন্তান দান করেন, তাহলে এটিকে ধৈর্য ও সন্তুষ্টির মাধ্যমে গ্রহণ করুন। এটি হতে পারে আপনার জন্য একটি পরীক্ষা, যার মাধ্যমে আল্লাহ আপনার ইমানের পরীক্ষা নিচ্ছেন এবং এর বিনিময়ে তিনি পরকালের আপনার মর্যাদাকে উন্নীত করার ব্যবস্থা করছেন।
❂ মুমিনের অবস্থা কতই না বিস্ময়কর!
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন—
“মুমিনের অবস্থা কতই না বিস্ময়কর! তার সবকিছুই তার জন্য কল্যাণকর, আর এই গুণ কেবল মুমিনের মধ্যেই রয়েছে। যদি তার জীবনে আনন্দ (কল্যাণ) আসে, সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এতে তার জন্য কল্যাণ থাকে। আর যদি সে কোনও বিপদে পড়ে, সে ধৈর্য ধরে এতে তার জন্য কল্যাণ থাকে।” [সহিহ মুসলিম]
এই হাদিস থেকে আমাদের শিক্ষা:
❂ ধৈর্যের পরীক্ষায় সফলদের জন্য সুসংবাদ:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন—
❂ ধৈর্যধারণকারীদের জন্য অসীম প্রতিদান:
আল্লাহ আরও বলেন:
إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ
“নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের প্রতিদান দেওয়া হবে গণনা ছাড়াই।” [সূরা আজ-জুমার: ১০]
আপনার যদি কোনও ভয় বা দুশ্চিন্তা থাকে, তাহলে এ সকল প্রতিদানের কথা স্মরণ করুন। এতে ইনশাআল্লাহ মনে প্রশান্তি আসবে।
সর্বোপরি বিশ্বাস রাখুন, মহান আল্লাহ সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী এবং তিনি তাঁর বান্দার জন্য সর্বদা কল্যাণ চান। সুতরাং সন্তান যেমনই হোক, তাকে ভালোবাসা, যত্ন এবং ইসলামি শিক্ষা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। প্রতিটি শিশু আল্লাহর দান এবং তার প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করলে আখিরাতে আমরা পুরস্কৃত হবো, ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ আপনাকে সুস্থ ও নেককার সন্তান দান করুন এবং আপনার অন্তরে প্রশান্তি দান করুন। আমিন!
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি। দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।
No comments:
Post a Comment