Thursday, January 23, 2025

মজি বা কামরস কি পাক নাকি নাপাক

 প্রশ্ন: মজি বা কামরস কি পাক নাকি নাপাক? এক শাইখ বলেছেন, যে মজি নাপাক নয়। তবে এতে ওজু ভেঙ্গে যাবে। এ কথা কি সঠিক?

উত্তর: “মজি বা কামরস পাক নয়” এ কথা সঠিক নয়। কিন্তু এতে ওজু ভেঙ্গে যায়, এ কথা সঠিক। নিম্নে মজি বা কামরস পাক নাকি নাপাক এবং তা শরীরে বা কাপড়ে লাগলে তা পবিত্র করার পদ্ধতি সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করা হলো:

মজি (পাতলা কামরস যা স্ত্রী শৃঙ্গার বা যৌন চিন্তার সময় বীর্যপাতের পূর্বে বের হয়)-এর ব্যাপার সঠিক কথা হলো, তা নাপাক। এটাই সবচেয়ে সঠিক কথা। অনেক আলেম এ ব্যাপারে ইজমা তথা সর্বসম্মত মত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কেউ তা পাক বললে তা নিতান্ত শায বা বিচ্ছিন্ন মত।

◈ শাওকানি রাহ. বলেন,

اتفق العلماء على أن المذي نجس، ولم يخالف في ذلك إلا بعض الإمامية

“আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, মজি নাপাক। এ ব্যাপারে কিছু ইমামিয়া (শিয়া) ছাড়া কেউ দ্বিমত করেনি।” [নাইলুল আওতার, ১/৭৩]

◈ নওয়াবি রাহ. বলেন,

“أجمعت الأمة على نجاسة المذي

“এ ব্যাপারে উম্মত একমত যে, মজি নাপাক।” [আল মাজমু, ২/৫৭১]

❑ এ ব্যাপারে দলিল উল্লেখ পূর্বক সে বিষয়ে পর্যালোচনা পেশ করা হলো:

◆ ১ম দলিল:

আলি রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার বেশি বেশি মজি বের হত। আমি এ সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে জিজ্ঞেস করতে লজ্জাবোধ করতাম। কারণ তার কন্যা (ফাতিমা রা.) ছিল আমার স্ত্রী। তাই আমি মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ রা. কে (এ সম্পর্কে জানতে) বললাম। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন তিনি বললেন,

يَغْسِلُ ذَكَرَهُ ويَتَوَضَّأُ

“এতে তার পুরুষাঙ্গ ধুয়ে ফেলবে এবং ওজু করে নিবে।” [সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী), অধ্যায়: ৩। হায়েজ বা ঋতুস্রাব, পরিচ্ছেদ: ৪. মজির বিবরণ]

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : ” كُنْتُ رَجُلًا مَذَّاءً فَجَعَلْتُ أَغْتَسِلُ حَتَّى تَشَقَّقَ ظَهْرِي فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْ ذُكِرَ لَهُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( لَا تَفْعَلْ ، إِذَا رَأَيْتَ الْمَذْيَ فَاغْسِلْ ذَكَرَكَ وَتَوَضَّأْ وُضُوءَكَ لِلصَّلَاةِ

আলি রা. বলেন, আমি এমন একজন ব্যক্তি ছিলাম, যার থেকে অধিক পরিমাণে মজি বের হতো। এতে আমি বারবার গোসল করতাম। ফলে আমার পিঠ ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়।

এরপর আমি এ বিষয়টি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে উল্লেখ করলাম বা এ বিষয়টি তাঁর কাছে উল্লেখ করা হলো। তখন রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “এ কাজ করো না। যখন মজি দেখতে পাবে, তখন তোমার পুরুষাঙ্গ ধুয়ে নাও এবং নামাজের জন্য যেমন ওজু করা হয়, তেমনি ওজু করে নাও।” [আবু দাউদ ২০৬-সহিহ]

এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, মজি নাপাক। ফলে পুরুষাঙ্গ ধুয়ে ফেলা ওয়াজিব। এতে ওজু নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু গোসল করা ফরজ হয় না।

◆ ২য় দলিল:

সাহল ইবনে হুনাইফ রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, মজি (পাতলা কামরস) বের হওয়ার কারণে আমি কঠিন অবস্থার মধ্যে ছিলাম। কেননা এ কারণে আমাকে প্রায়ই গোসল করতে হত। আমি ব্যাপারটা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বর্ণনা করলাম এবং তার বিধান জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, “এটা বের হলে তোমার জন্য ওজুই যথেষ্ট।” আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল, তা যদি আমার কাপড়ে লেগে যায় তবে কী করব?
তিনি বললেন, “এক অঞ্জলি পানি তোমার কাপড়ের যে অংশে মজি দেখতে পাও সেখানে ছিটিয়ে দাও। এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট।” [ইবনে মাজাহ, হা৫০৬-হাসান]

উপরোক্ত হাদিস দ্বয় দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মজি অবশ্যই নাপাক। অন্যথায় মজি নির্গত হলে লজ্জা স্থান এবং কাপড়ের যে স্থানে তা লেগেছে তার উপর পানি ছিটানোর কথা বলা হতো না।

শাওকানি তার “নাইলুল আওতার” (১/৭৩) গ্রন্থে বলেছেন:

اتفق العلماء على أن المذي نجس، ولم يخالف في ذلك إلا بعض الإمامية ، محتجين بأن النضح لا يزيله ، ولو كان نجسا لوجبت الإزالة ؟
ويلزمهم القول بطهارة العذرة ؛ لأن النبي – صلى الله عليه وسلم – أمر بمسح النعل منها بالأرض ، والصلاة فيها، والمسح لا يزيلها ؛ وهو باطل بالاتفاق .
وقد اختلف أهل العلم في المذي إذا أصاب الثوب فقال الشافعي وإسحاق وغيرهما: لا يجزيه إلا الغسل أخذا برواية الغسل ، على أن رواية الغسل إنما هي في الفرج ، لا في الثوب الذي هو محل النزاع ؛ فإنه لم يعارض رواية النضح المذكورة في الباب معارض، فالاكتفاء به صحيح مجز”

“আলেমগণ ঐক্যমত্যে পৌঁছেছেন যে, মজি (যৌন উত্তেজনার সময় লজ্জা স্থান থেকে নির্গত তরল পদার্থ) অপবিত্র। এই বিষয়ে শুধুমাত্র কিছু ইমামিয়া (শিয়া) ভিন্ন মত পোষণ করেছে। তাদের যুক্তি হল, মজি পরিষ্কার করতে শুধু ছিটানো (النضح) যথেষ্ট। কিন্তু যদি এটি অপবিত্র হতো তবে সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করা আবশ্যক হতো।
তাদের এই যুক্তির ভিত্তিতে মল মূত্রও পবিত্র হতে হবে। কারণ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মল-মূত্র দূর করতে জুতা মাটিতে ঘষতে বলেছেন এবং সেই জুতা পরেই নামাজ পড়তে অনুমতি দিয়েছেন। অথচ মাটিতে ঘষে সম্পূর্ণরূপে অপবিত্রতা দূর করা সম্ভব নয়। এই যুক্তি সর্বসম্মতভাবে অগ্রহণযোগ্য।

আলেমগণের মধ্যে মজি যদি কাপড়ে লাগে তবে তা পরিষ্কার করার পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম শাফিয়ি, ইসহাক এবং অন্যান্যদের মতে, শুধু ধৌত করাই যথেষ্ট। কারণ ধৌত করার বর্ণনা এসেছে। তবে এই বর্ণনা যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; কাপড়ে নয়। যেখানে কেবল ছিটানোর (النضح) বর্ণনা রয়েছে এবং এই বর্ণনার কোনও বিরোধিতা নেই। তাই শুধু (النضح) তথা পানি ছিটানোই যথেষ্ট।” (শাওকানির বক্তব্য সমাপ্ত)

❑ মজি কি নাজাসাতে গলীযা (ভারী নাপাকি) নাকি নাজাসাতে খাফীফা (হালকা নাপাকি)? তা পবিত্র করার পদ্ধতি কী?

যেহেতু উপরোক্ত হাদিস সমূহে কাপড়ের যে স্থানে মজি লাগবে সে স্থানে পানি ছিটানো (النضح) এর কথা এসেছে তাই এতে প্রমাণিত হয় যে, এটা পেশাব-পায়খানার মত নাজাসাতে গলীযা বা ভারী নাপাক নয় বরং তা নাজাসাতে খাফীফা বা হালকা নাপাকি।

❂ শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. বলেন,

المذي نجس، لكنه نجاسة مخففة، فإذا رشه بالماء ونضحه بالماء في ثوبه أو في فخذه كفى

“মজি নাপাক, তবে এটি হালকা ধরনের নাপাক। যদি এটি পানি দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হয় বা কাপড় বা উরুতে স্পর্শ করলে পানি ছিটিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেটি যথেষ্ট।” [binbaz]

❂ islamqa তে বলা হয়েছে, “মজি হলো, সাদা স্বচ্ছ পিচ্ছিল পানি। যৌন উত্তেজনার সময় এটি বের হয়; যৌন চিন্তার ফলে কিংবা অন্য কোন কারণে। এটি বের হওয়ার সময় সুখানুভূতি হয় না এবং এটি বের হওয়ার পর যৌন নিস্তেজতা আসে না।
এটি নাপাক। এটি শরীরে লাগলে তা ধুয়ে ফেলা ফরজ। কাপড়ে লাগলে কাপড় পবিত্র করার জন্য পানি ছিটিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট। কামরস বের হলে ওজু ভেঙ্গে যাবে কিন্তু গোসল ফরজ হয় না।”

যেমনটি দুধ পান করে এমন ছোট ছেলে শিশু পেশাব নাপাক কিন্তু তা হালকা। অর্থাৎ কাপড়ে যে স্থান এমন ছোট ছেলে শিশুর পেশাব লাগে সেখানে পানির ছিটা দিলেই তা পবিত্র হয়ে যাবে। (অধিক বিশুদ্ধ মতানুসারে)।

অবশ্য হানাফি মাজহাবে মজি এবং দুগ্ধপৌষ্য ছেলে শিশুর পেশাবকে নাজাসাতে গালীযা বা ভারী নাপাকি বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের মতে, এ ক্ষেত্রে পানি ছিটানো যথেষ্ট নয় বরং তা পানি দ্বারা ভালোভাবে ধৌত করতে হবে। কারণ النضح শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে। ধৌত করা ও পানির ছিটা দেওয়া। তারা ধৌত করার অর্থ গ্রহণ করেছেন।

যাহোক, জুমহুর বা অধিকাংশ আলেম النضح শব্দটিকে পানির ছিটা অর্থে গ্রহণ করেছেন। সে কারণে তাদের মতে ধৌত করা অবশ্যক নয় বরং পানির ছিটা দিলেই তা পবিত্র হয়ে যাবে। এটাই অধিকাংশ আলেমের অভিমত এবং এটাই অধিক বিশুদ্ধ ইনশাআল্লাহ। তবে সতর্কতার স্বার্থে যদি ধুয়ে ফেলা হয় তাহলেই উত্তম। আল্লাহু আলাম।

▬▬▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate