বিদাতিদের সাথে সখ্যতা, সম্পর্ক ও মেলামেশা
(সাথে রয়েছে দাঈদের জন্য বিশেষ নসিহত)
প্রশ্ন: আমরা জানি যে, ইমামদের মধ্যেও ইখতেলাফ (মতবিরোধ) ছিল। তারপরেও তারা একে অপরকে বন্ধু হিসেবে মেনে নিতো। আমার প্রশ্ন হলো, এখনকার মানুষরা যে বিভিন্ন মাজহাব মেনে চলেন তারা তো কোনও না কোনও ইমামকেই অনুসরণ করেন। তারা যা করেন সেটা তো আহলে হাদিস তথা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মতে অনেক কিছুই বিদাতত। আর যতটুকু জানি, হাদিসে বিদাতিদের সাথে বন্ধুত্ব রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। তাহলে ইমামদের মধ্যে পরস্পর বন্ধুত্ব রাখা আর আমাদের সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিদাতিদের সাথে বন্ধুত্ব না রাখা টা কেমন সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে না? বিষয় টা একটু বুঝিয়ে বললে উপকৃত হবো ইনশাআল্লাহ।
উত্তর: শাখাগত বিভিন্ন মাসআলা বিষয়ে আমাদের পূর্বসূরি ইমামগণ মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছেন। আকিদাগত ও দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে মতবিরোধ ছিল খুবই সীমিতG তারপরও তাদের একে অপরের সাথে সম্পর্ক বজায় ছিল। এর কারণ হলো, তারা কুরআন-সুন্নাহর দলিলকে কেন্দ্র করে মতবিরোধ করেছেন। তাদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য ছিল, সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। এখানে তাদের ব্যক্তিগত কোন উদ্দেশ্য বা স্বার্থ ছিল না। তবে যারা আকিগতভাবেই পথভ্রষ্ট ও বিদাতি ছিল আমাদের পূর্বসূরিগণ তাদের সাথেও কথা বলেছেন, তাদের কাছে গেছেন এবং তাদের সাথে বিতর্ক করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল, তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আনা বা তাদের বাতিল আকিদাকে মানুষের কাছে প্রকাশ করে দেওয়া। যাতে অন্যরা তাদের ভ্র্রষ্টতা সম্পর্কে সচেতন হয়। যেমন: আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. খারেজি সম্প্রদায়ের সাথে বিতর্ক করেছেন, ইবনে তায়মিয়া রাহ. বিভিন্ন বিদাতি গোষ্ঠীর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল যেন, তারা সঠিক পথে ফিরে আসে বা অন্য মানুষ যেন তাদের মাধ্যমে প্রতারিত না হয়।
বিদাতিদের সাথে এ ধরণের সম্পর্ক বর্তমানেও অব্যাহত রাখা যাবে। তবে সাধারণ মানুষ নয় বরং যারা দ্বীনের বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন এবং বাতিলের সাথে মোকাবেলা করার যোগ্যতা রাখেন কেবল তারা। সাধারণ মানুষ তাদের সাথে সম্পর্ক রাখার ফলে নিজেরাই গোমরাহির দিকে ধাবিত হতে পারে।
কিন্তু যদি তাদের সাথে সম্পর্ক রাখায় কোন কল্যাণের আশা না থাকে তাহলে তাদের সাথে কথা বলা যাবে না বা তাদের সাথে উঠবস করা যাবে না। শরয়ি স্বার্থ ছাড়া তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা হলে এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّىٰ يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ ۚ وَإِمَّا يُنسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَىٰ مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ
“যখন আপনি তাদেরকে দেখেন, যারা আমার আয়াত সমূহে ছিদ্রান্বেষণ করে, তখন তাদের কাছ থেকে সরে যান যে পর্যন্ত তারা অন্য কথায় প্রবৃত্ত না হয়, যদি শয়তান আপনাকে ভুলিয়ে দেয় তবে স্মরণ হওয়ার পর জালেমদের সাথে উপবেশন করবেন না।” [সূরা আনআম: ৬৮]
হাসান রহ. বলেন,
لا تجالسوا أهل الأهواء ولا تجادلوهم ولا تسمعوا منهم
“প্রবৃত্তির অনুসারীদের সাথে উঠবস করো না, তাদের সাথে বিতর্ক করো না এবং তাদের কথা শুনিও না।” [লালাকাঈ]
মোটকথা, যোগ্য আলেমগণ বিদাতি ও বাতিল আকিদাপন্থী লোকদের সাথে বন্ধুত্ব নয় বরং তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বা মানুষকে তাদের গোমরাহি মূলক আকিদা ও আমল সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখা যাবে। তবে সাধারণ মানুষ তাদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব রাখা, তাদের সাথে উঠবস করা, তাদের বক্তব্য শোনা, তাদের ভিডিও দেখা, তাদের দরসে বসা এবং তাদের লিখিত বই-পুস্তক পড়া ইত্যাদি থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখবে যেন তারা বিদাতিদের বাতিল আকিদা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ তাওফিক দানকারী।
❑ বিদাতিদের সাথে সখ্যতা ও সম্পর্ক:
সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা শাইখ বিন বায রাহ. কে প্রশ্ন করা হয় যে, বিদাতপন্থীদের সঙ্গে উঠবস করা এবং তাদের দরসে অংশ গ্রহণ করা কি বৈধ?
উত্তরে তিনি বলেন,
لا يجوز مجالستهم ولا اتخاذهم أصحابًا، ويجب الإنكار عليهم وتحذيرهم من البدع، نسأل الله العافية
“তাদের সঙ্গে উঠবস বা মেলামেশা করা অথবা তাদেরকে বন্ধু বানানো বৈধ নয় বরং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং তাদের বিদাত থেকে সাবধান করা আবশ্যক। আল্লাহ আমাদের নিরাপত্তা দিন। আমিন। [মাজল্লাতুল ফুরকান, সংখ্যা ১০০, রবিউস সানি ১৪১৯ হিজরি-তে প্রকাশিত। শাইখ ইবন বায-এর ফতোয়া ও প্রবন্ধসমূহ, ২৮/২৬৭]
❑ দাঈদের জন্য বিশেষ নসিহত:
বিন বায রাহ. বিদাতিদের সাথে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দাঈদের উদ্দেশ্যে বলেন,
الدعاة عليهم البلاغ والبيان والنصيحة، والله يهدي من يشاء، وإذا دعوتهم إلى الخير، إلى التوحيد والإيمان والسنة، وترك البدع، فلم يستجيبوا؛ فقاطعهم، لا تكن صاحبًا لهم، قاطعهم، واهجرهم، ولا تدعهم إلى بيتك، ولا تجب دعوتهم حتى يدعوا ما هم عليه من الباطل؛ لأنك إذا صحبتهم ودعوتهم، وأجبت دعوتهم؛ أظهرت الرضا بأعمالهم.
فلا ترضى بأعمالهم، لكن النصيحة، استمر فيها، النصيحة والدعوة والتوجيه، وإرسال من ترى أنهم يقدرون ترسله إليهم؛ لعله يدعوهم إلى الله، ولعلهم يستجيبون
“দাঈদের দায়িত্ব হলো, পরিষ্কারভাবে বার্তা পৌঁছে দেওয়া, উপদেশ দেওয়া এবং সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দিবেন। আপনি যদি তাদেরকে কল্যাণ, তাওহিদ, ঈমান ও সুন্নাহর পথে ডাকেন এবং বিদাত পরিত্যাগে আহ্বান করেন, তবুও তারা সাড়া না দিলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করুন। তাদের বন্ধু হবেন না। তাদের সঙ্গে মেলামেশা ত্যাগ করুন। তাদেরকে বাড়িতে আমন্ত্রণ করবেন না এবং তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন না যতক্ষণ না তারা তাদের ভুল পথ পরিত্যাগ করে। তাদের কাজকে অনুমোদন করবেন না। তবে উপদেশ অব্যাহত রাখুন। দাওয়াত, দিকনির্দেশনা ও সঠিক পথে ফেরানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। এমন কাউকে পাঠান যাকে আপনি উপযুক্ত মনে করেন। হয়তো সে তাদেরকে আল্লাহর পথে ডাকবে এবং হয়তো তারা সাড়া দেবে।” [binbaz]
▬▬▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।
No comments:
Post a Comment