Thursday, January 23, 2025

মাটির তৈরি বিস্কুট বা ছিকর খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা এবং এ সংক্রান্ত ইসলামি বিধান

 প্রশ্ন: ইদানীং ফেসবুকে মাটির তৈরি বিস্কুট খাওয়ার ভিডিও চোখে ‌‌‌‌পড়ছে।কুরআন-হাদিসের আলোকে এই বিস্কুট খাওয়া জায়েজ কি?

উত্তর: নিম্নে মাটির তৈরি বিস্কুট কী এবং তা কোথায় কীভাবে তৈরি করা হয়, এটি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা এবং এ সংক্রান্ত ইসলামের বিধান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো: وبالله التوفيق

❑ মাটির তৈরি বিস্কুট কী? তা কোথায় এবং কীভাবে তৈরি করা হয়?

বিস্কুট বলতে কেউ বিশ্বাস করবে না যে, মাটি দিয়ে বিস্কুট তৈরি করা হয় এখনো। শুনতে অবাক লাগলেও বিষয়টি কিন্তু সত্য। সত্তর কি আশির দশকে খিদে মেটাতে তৈরি হত পোড়া মাটির বিস্কুট।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার যোগিবিল গ্রামের শব্দকর সম্প্রদায়ের ময়না রানী শব্দকর উন্নজুলী শব্দকর, রত্না শব্দকর ও ছায়া রানী শব্দকরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়: (যাদের পেশা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে বাদ্য বাজানো তাদেরকে শব্দকর বলা হয়)

টিলার ভেতরে গর্ত করে বা নদীর বালি সরিয়ে নিচ থেকে সংগ্রহ করা হয় মিহি নরম মাটি। তাকে জলে ভিজিয়ে প্রথমে তৈরি করা হয় মণ্ড। স্বাদের ভিন্নতার জন্য মাটির মিশ্রণ তৈরির সময় গোলাপজল, আদার রস ও ক্ষেত্র বিশেষে অল্প পরিমাণ চিনি ইত্যাদি মেশানো হয়। এই মণ্ড থেকেই বিভিন্ন আকারের কাটার পর কাঁচা বিস্কুটগুলো রোদে দেওয়া হয়। দু-এক দিন শুকানোর পর একটি মাটির হাঁড়ির নিচের অংশ ভেঙে সেখানে লোহার শিক দিয়ে তৈরি চালুনি বসানো হয়। বিস্কুট ও ছিকরগুলো ওই চালুনির ওপর বসানো হয়। তারপর হাঁড়িটি রাখা হয় চুলার উপরে। ধানের তুষ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয় গর্তে। সতর্কতার সঙ্গে বর্গাকার বিস্কুট, আবার কখনো লজেন্সের মতো ছিকরের গায়ে শুধু ধোঁয়া লাগানো হয়। দুই ঘণ্টা পর কালচে রং ধারণ করে। সুঘ্রাণ তৈরি হয়।

রমেন্ড শব্দকর বলেন, দরিদ্র মানুষজন মাটির বিস্কুট খেয়েও তাদের পেট ভরাত। মাটি পোড়া মাটির বিস্কুট তৈরি করে বাজারজাত করতেন। কারণ সন্তানসম্ভবা মহিলাদের কাছে বেশ মুখরোচক বলে জনপ্রিয় ছিল।” [desh.tv]

এই মাটির তৈরি বিস্কুটকে ছিকরও বলা হয়। ছিকর শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ ছিয়া অর্থ কালো এবং কর মানে মাটি থেকে। ছিয়াকর শব্দটিই পরে ছিকর হিসেবে পরিচিতি পায়। [bbarta24]

শুধু বাংলাদেশের সিলেট, মৌলবি বাজার, হবিগঞ্জ ইত্যাদি এলাকা নয় বরং আমেরিকার হাইতি এবং আফ্রিকার বহু দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এই মাটি খেয়ে জীবন ধারণ করে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হাইতির ছোটবড় সবাই মাটির বিস্কুট খায়। দেশটির প্লাতেও এলাকায় মেলে এক প্রকার হলুদ মাটি। এই মাটি দিয়ে তৈরি হয় বিস্কুট। তাদের ধারণা এই মাটিতে ক্যালসিয়াম রয়েছে। ফলে কয়েক বছর ধরে সে দেশের গর্ভবতী মহিলাদেরও এই মাটি খাওয়ানো হচ্ছে।

বিশেষ এই হলুদ মাটির সঙ্গে কেউবা সামান্য লবণ, আবার কেউ তেল ও লবণ দিয়ে এক ধরনের মণ্ড তৈরি করে। সেই মণ্ড দিয়ে বিস্কুটের মতো বানিয়ে রোদে শুকানো হয়। শুকানোর পর সেগুলো খাওয়া হয়। [risingb]

❑ মাটির বিস্কুট খাওয়া কি স্বাস্থ্য সম্মত?

প্রচলিত ধারণা ছিল, মাটির বিস্কুট বা ছিকর রক্তশূন্যতা দূর করে, খনিজের যোগান দেয়। গর্ভাবস্থায় যথেষ্ট প্রয়োজন হয় খনিজের। তাই অনেকে বিশ্বাস করত মাটির তৈরি বিস্কুট ছিকর খেলে রোগ-বালাই থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এই কারণেই অনেক ছোট্ট বাচ্চাদের খাওয়ানো হয় এই বিস্কুট।

কিন্তু এসব ধারণার পক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক বা আধুনিক চিকিৎসার ব্যাখ্যার মিল নেই।

মাটির এই বিস্কুট খাওয়া স্বাস্থ্যকর কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন বলেন, “মাটি যত উন্নত মানের হোক না কেন, এতে ভাইরাস বা কৃমির ডিম থাকতে পারে। এই মাটির বিস্কুট খাওয়া ক্ষতিকর কি না, তা নিয়ে কোনো পরীক্ষামূলক তথ্য নেই। অনেক এলাকায় অন্তঃসত্ত্বা নারীরা এই বিস্কুট খান। এতে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে।” [প্রথম আলো]

চিকিৎসকরা আরও বলেন, এতে অপুষ্টি জনিত সমস্যা হতে পারে। মাটিতে হেলমিথ নামক ব্যাকটেরিয়া জন্মে যা অপুষ্টির কারণ। কয়েক বছর আগে এনবিসি নিউজের এক প্রতিবেদক প্রতিবেদন তৈরির সময় খেয়েছিলেন এই বিস্কুট। তিনি লিখেছেন, মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এটি গলে যায়। কিন্তু একটা দীর্ঘসময় শরীর ও জিহ্বায় অস্বস্তিকর অনুভূতি লেগে থাকে। [risingbd]

❑ ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে মাটি খাওয়ার বিধান:

মাটি খাওয়ার উদ্দেশ্য ভেদে তার বিধান ভিন্ন ভিন্ন হবে। যথা:

❂ ১. যদি বিশেষ কোনও রোগের ক্ষেত্রে কাদা-মাটি, ধুলোবালি ইত্যাদি খেলে উপকার হবে বলে স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বা বাস্তব অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত হয় তাহলে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে সতর্কতার সাথে এগুলো কেবল যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু খেতে কোন বাধা নেই। এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নাই।

❂ ২. অনুরূপভাবে এছাড়া যদি জীবনধারণের বিকল্প কিছু না থাকে এবং এগুলো খেয়ে সাময়িকভাবে জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয় তাহলেও শরিয়তের দৃষ্টিতে কোন আপত্তি নেই। কারণ তা জরুরত বা অপারগ অবস্থা।

❂ ৩. অন্যথায় খাওয়া মাকরুহ বা অপছন্দনীয়। কেননা এগুলো কোন উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য নয়। কোন সুস্থ রুচি সম্পন্ন মানুষ এসব জিনিস কে সাধারণ খাবার হিসেবে গ্রহণ করে না।

❂ ৪. কিন্তু যদি এসব খেলে শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি হয় বা শরীরে রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হয় তাহলে তা খাওয়া হারাম। কেননা ইসলামে এমন কোন কিছু খাওয়া শরিয়তসম্মত নয় যা মানব দেহের ক্ষতি সাধন করে বা জীবন নাশ করে।

কিন্তু সরাসরি হারাম বলা যাবে না এ কারণে যে, এ ব্যাপারে কোন বিশুদ্ধ দলিল নেই। আর ইসলামের একটি প্রসিদ্ধ মূলনীতি হলো,
الأصل في الأشياء الإباحة حتى يدل الدليل على التحريم
“দুনিয়ার সব কিছুই হালাল যতক্ষণ পর্যন্ত হারাম হওয়ার পক্ষে সুস্পষ্ট দলিল না থাকে।”

এই মূলনীতির পক্ষে দলিল হলো, ইবনে আব্বাস রা. সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, জাহিলি যুগের লোকেরা কিছু জিনিস খেতো এবং ঘৃণাবশত কিছু জিনিস পরিহার করতো। এ অবস্থায় আল্লাহ তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করলেন ও তাঁর কিতাব অবতীর্ণ করে তাতে কিছু জিনিস হালাল করলেন ও কিছু জিনিস হারাম করলেন।

فَمَا أَحَلَّ فَهُوَ حَلَالٌ، وَمَا حَرَّمَ فَهُوَ حَرَامٌ، وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَفْوٌ ”

“অতএ তিনি যা হালাল করেছেন তা হালাল এবং যা হারাম করেছেন তা হারাম। আর যেগুলো সম্পর্কে নীরব থেকেছেন এগুলোতে ছাড় দেওয়া হয়েছে।” (অর্থাৎ সেগুলো খাওয়া-না খাওয়া ইচ্ছাধীন বিষয়) অতঃপর ইবনে আব্বাস রা. তিলাওয়াত করেন:
قُلْ لَا أَجِدُ فِيمَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا..
’’আপনি বলুন, আমার নিকট যে ওহি এসেছে তাতে এমন কোনো জিনিস পাইনি যা আহার করা কারো জন্য হারাম…।’’ আয়াতের শেষ পর্যন্ত। [সুনান আবূ দাউদ (তাহকিককৃত), অধ্যায়: ২২/ খাদ্যদ্রব্য, পরিচ্ছেদ: ৩১. যেসব জিনিসের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আসেনি]

অতএব মাটি কিংবা মাটি দ্বারা বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরিকৃত বিস্কুট খাওয়ার ক্ষেত্রে উপরোক্ত ব্যাখ্যা প্রযোজ্য।

হাম্বলি মাজহাবের বিখ্যাত ফকিহ ইমাম ইবনে কুদামা রাহ. বলেন,

” قال أحمد: أكره أكل الطين، ولا يصح فيه حديث، إلا أنه يضر بالبدن، ويقال : إنه رديء ، وتركه خير من أكله

“ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বলেছেন, মাটি খাওয়াকে আমি মাকরুহ বা অপছন্দনীয় মনে করি। তবে এ বিষয়ে কোনো সহিহ হাদিস বর্ণিত না হলেও তা দেহের জন্য ক্ষতিকর।
অথবা বলা যেতে পারে, এটা একটা বাজে জিনিস। তাই তা খাওয়ার থেকে না খাওয়াই ভালো।” [আল মুগনি ৯/৪২৯]

সুতরাং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সখের বশবর্তী হয়ে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এই মাটি (মাটির তৈরি বিস্কুট বা ছিকর) খাওয়া থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

No comments:

Post a Comment

Translate