প্রশ্ন: সালাতে মনে বিনয়-নম্রতা ও ভয়ভীতি সৃষ্টি এবং মনস্থির রাখার উপায় গুলো কী কী?
নিম্নে সালাতরত অবস্থায় মনে ভয়ভীতি সৃষ্টি ও মনস্থির রাখার কতিপয় উপায় তুলে ধরা হল:
প্রশ্ন: সালাতে মনে বিনয়-নম্রতা ও ভয়ভীতি সৃষ্টি এবং মনস্থির রাখার উপায় গুলো কী কী?
নিম্নে সালাতরত অবস্থায় মনে ভয়ভীতি সৃষ্টি ও মনস্থির রাখার কতিপয় উপায় তুলে ধরা হল:
প্রশ্ন: কুরআনের আয়াত কিংবা আরবি হরফ দ্বারা রাস্তার দেওয়ালে ক্যালিগ্রাফি করার বিধান কী? অনুরূপভাবে ঘর ডেকোরেশনের উদ্দেশ্যে কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি কৃত ফলক বা ক্যালেন্ডার ঝুলানোর বিধান কী?
উত্তর: রাস্তা, মসজিদ বা বাড়ির দেওয়াল, প্রাচীর ইত্যাদির সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্দেশ্যে কুরআনের আয়াত দ্বারা ক্যালিগ্রাফি করা জায়েজ নেই। অনুরূপভাবে ঘর ডেকোরেশনের উদ্দেশ্যে কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি সম্বলিত ফলক ঝুলানোও জায়েজ নয়। সর্বনিম্ন তা অ পছন্দনীয় কাজ। কারণ আল্লাহ তাআলা ঘরবাড়ি বা দেওয়ালের ডেকোরেশন বা শোভা বর্ধনের উদ্দেশ্যে কুরআন নাজিল করেননি। সুতরাং তা কুরআনকে অপাত্রে ব্যবহার করার অন্তর্ভুক্ত।
❑ কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য:
কুরআন হলো, মানবজাতির গাইডবুক ও সংবিধান। মহান আল্লাহ তা নাজিল করেছেন এ জন্য যে, মানুষ কুরআন তিলাওয়াত করবে, কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং তদনুযায়ী আমল করবে। তৎসঙ্গে কুরআনের বিধানাবলীকে মানুষ তাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনীতি ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটাবে।
এ মর্মে কুরআন-হাদিসে পর্যাপ্ত বক্তব্য এসেছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি আয়াত ও হাদিস পেশ করা হলো:
✪ এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, (হে নবি আপনি বলুন যে),
وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ- وَأَنْ أَتْلُوَ الْقُرْآنَ
“আমি আরও আদিষ্ট হয়েছি যেন আমি মুসলিমদের (আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণকারীদের) দলভুক্ত হই এবং যেন আমি কুরআন তিলাওয়াত করি।” [সূরা নামল: ৯১-৯২]
✪ আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
“আর আপনার নিকট পাঠিয়েছি উপদেশ গ্রন্থ (কুরআন) যেন আপনি মানুষের কাছে সুস্পষ্টভাবে তা বিবৃত করে দেন, যা তাদের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে। হয়ত এতে তারা চিন্তা-ভাবনা করবে।” [সূরা আনআম: ৪৪]
✪ তিনি আরও বলেন,
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ
“তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?” [সূরা মোহাম্মাদ: ২৪]
তিনি আরও বলেন,
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ
“আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে। অতএব কোন চিন্তাশীল আছে কি? ” [সূরা কামার: ১৭]
✪ কুরআনের পরিচয় বিষয়ে আল্লাহ বলেছেন,
✪ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا: كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ».
“আমি তোমাদের মাঝে দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি, তোমরা বিভ্রান্ত হবে না যতদিন এ দুটি আঁকড়ে থাকবে। আল্লাহর কিতাব (কুরআন) এবং তাঁর নবির সুন্নাহ (হাদিস)।” [মুয়াত্তা মালিক : ৩৩৩৮]
এ ছাড়া বহু আয়াত ও হাদিসে কুরআন নাজিলের উদ্দেশ্য বিবৃত হয়েছে। তাই আমাদের কর্তব্য, কুরআনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত না হওয়া এবং কুরআনকে অপাত্রে ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।
❑ কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার থেকে বিরত থাকা আবশ্যক কেন?
আমাদের অজানা নয় যে, কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি করতে কুরআনের অক্ষরগুলোকে আঁকাবাঁকা করে বিভিন্ন ফন্ট ব্যবহার করে উপর-নিচ করে সাজানো হয়। একটা অক্ষর আরেক অক্ষরের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। তাতে বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করে ডিজাইন করা হয়। ফলে কুরআনের অক্ষরগুলো স্পষ্টভাবে বুঝা যায় না। ফলে মানুষের তা ভুল পড়ার আশঙ্কা থাকে। অথবা আদৌ পড়া সম্ভব হয় না। কারণ এখানে মানুষকে কুরআন শেখানো বা কুরআনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া উদ্দেশ্য থাকে না। বরং উদ্দেশ্য থাকে শৈল্পিক ভাবে ঘর বা দেওয়ালের শোভা বর্দ্ধন।
অনেকেই কুরআনের আয়াত দ্বারা ডিজাইন কৃত ক্যালিগ্রাফির ফলক বা ক্যালেন্ডার ঘরে ঝুলিয়ে রাখে অথবা সাধারণভাবে বিশেষ কোনও সূরা বা আয়াত সম্বলিত ফলক ঘরে ঝুলিয়ে রাখে ডেকোরেশনের উদ্দেশ্য নয় বরং বরকতের আশায় বা বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে। কেউ আবার জিন-শয়তানেরে উপদ্রব, জাদু, বদনজর, অসুখ-বিসুখ, চুরি-ডাকাতি, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে। এমন উদ্দেশ্য থাকলে তা হবে জঘন্য বিদআত। কেননা, ঘরে কুরআন-হাদিসে এমন কোনও নির্দেশনা আসেনি। আ সালাফ তথা সাহাবি ও তাদের একনিষ্ঠ অনুসারী তাবেয়ীদের থেকে এমন কোনও বিষয় পাওয়া যায় না।
❑ এ বিষয়ে কতিপয় বিজ্ঞ আলেমের ফতোয়া:
◆ হানাফি মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহ. বিখ্যাত ফতোয়ে শামীতে লিখেছেন,
“وتُكره كتابة القرآن، وأسماء الله تعالى على الدرهم، والمحاريب، والجدران، وما يُفرش، والله تعالى أعلم”
“কুরআনের আয়াত এবং আল্লাহর নামসমূহ দেরহাম, মেহরাব, দেওয়ালে ও আসবাব-পত্রের উপর লেখা মাকরুহ বা অ পছন্দনীয় কাজ। আল্লাহ ভালো জানেন। ” [ফাতাওয়ে শামী: ১/১৭৯]
◆ শাফেয়ী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম শরফুদ্দিন আন নওয়াবি রাহ. বলেছেন,
مذهبنا أنه يُكره نقش الحيطان والثياب بالقرآن، وبأسماء الله تعالى”
“আমাদের মাজহাব হল, কুরআনের আয়াত বা আল্লাহ তায়ালার নাম দ্বারা দেওয়াল বা কাপড়ের উপর নকশা করা মাকরূহ।” [তিবইয়ান: ৮৯ ও ৯৭]
◆ কুরআনের আয়াত দিয়ে ডেকোরেশন করার বিধান প্রসঙ্গে ইমাম নাসির উদ্দিন আলবানি রাহ. বলেন,
هذا التعليق (الديكورات في البيوت بآيات قرآنية) غير مشروع -أما الذين يصنعونها فهم لا يعملون عمالاً مشروعا ، لأن القرآن ما نزل لتزيين الجدر ، وإنما لتعمير القلوب لما فيها من الحكمة والموعظة الحسنة
“ডেকোরেশন বা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য কুরআনের আয়াত লটকানো শরিয়ত সিদ্ধ নয়। যারা এমন কাজ করে তারা শরিয়ত সম্মত কাজ করে না। কারণ কুরআন দেওয়াল সাজানোর জন্য অবতীর্ণ হয়নি; বরং কুরআনে যে প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশ আছে তার মাধ্যমে সুসংহত অন্তর নির্মাণ করার জন্য এসেছে।” [তুরাসুল আলবানী ফিল ফিকহ, ১৭/৭১৬, ফাতাওয়ায়ে আলবানী ৪৩৫, al-fatawa]
❑ কুরআন ও আল্লাহর নাম ছাড়া কেবল আরবি অক্ষর বা আরবি সাধারণ আরবি বাক্য দ্বারা ক্যালিগ্রাফি:
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার অপরিহার্যতা, নির্মানের ভয়াবহতা এবং কীর্তিমান সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য
:الحمد لله والصلاه والسلام على رسول الله -اما بعد
নিম্নে সংক্ষিপ্ত পরিসরে ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার অপরিহার্যতা, নির্মানের ভয়াবহতা এবং কীর্তিমান সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
❑ ইসলামের দৃষ্টিতে প্রাণীর মূর্তি ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার অপরিহার্যতা এবং তা নির্মানের ভয়াবহতা:
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ, পশুপাখি ইত্যাদি প্রাণীর প্রতিমা, মূর্তি, প্রতিকৃতি, প্রতিমূর্তি ও ভাস্কর্য তৈরি বা নির্মাণ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কোথাও নির্মান করা হলে সেগুলো ভেঙ্গে ফেলা অপরিহার্য। কারণ বহু হাদিসে প্রাণীর মূর্তি, প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার এবং ছবি মুছে ফেলার নির্দেশ এসেছে।
➧ নিম্নে এ সংক্রান্ত কতিপয় হাদিস তুলে ধরা হল:
◈ বিশিষ্ট তাবেয়ী আবুল হাইয়াজ আসাদি রাহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলি রা. আমাকে বললেন, আমি কি তোমাকে ঐ কাজে দায়িত্বশীল হিসেবে প্রেরণ করব যে কাজে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করে ছিলেন? কাজটা হলো,
لاَ تَدَعَ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَهُ وَلاَ تِمْثَالاً إِلاَّ طَمَسْتَهُ
“যে কোনও সুউচ্চ কবরকে ভেঙ্গে মাটি বরাবর করা আর কোন প্রতিকৃতিকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না।” [সহিহ মুসলিম, হা/৯৬৯]
◈ সহিহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় রয়েছে:
وَلاَ صُورَةً إِلاَّ طَمَسْتَهَا
“আর কোনও (প্রাণীর) ছবিকে না মুছা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না।”
◈ মুসলিম রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা (বিশিষ্ট তাবেয়ী) মাসরুকের সাথে ইয়াসার ইবনে নুমাইরের ঘরে ছিলাম। মাসরুক ইয়াসারের ঘরের আঙিনায় কতগুলো মূর্তি দেখতে পেয়ে বললেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. থেকে শুনেছি এবং তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছেন যে,
إِنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ القِيَامَةِ المُصَوِّرُونَ
“(কিয়ামতের দিন) মানুষের মধ্যে সব থেকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে (প্রাণির) ছবি অঙ্কন কারীদেরকে।” [মুসলিম ৩৭/২৬, হা/ ২১০৯, আহমদ ৩৫৫৮] আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫১৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪১৩]
◈ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ صَوَّرَ صُورةً فِي الدُّنْيَا كُلِّفَ أنْ يَنْفُخَ فِيهَا الرُّوحَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلَيْسَ بِنَافخٍ
“যে ব্যক্তি (প্রাণির) ছবি তৈরি করে, তাকে কিয়ামতের দিন তাতে জীবন দানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হবে কিন্তু সে সক্ষম হবে না।” [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]
◈ আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ الَّذِينَ يَصْنَعُونَ هَذِهِ الصُّوَرَ يُعَذَّبُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُقَالُ لَهُمْ أَحْيُوا مَا خَلَقْتُمْ
“যারা এ জাতীয় (প্রাণীর) ছবি তৈরি করে, কিয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। তাদের বলা হবে: “তোমরা যা বানিয়েছিলে তাতে জীবন দাও।” [মুসলিম ৩৭/২৬, হা/ ২১০৮] আধুনিক প্রকাশনী- ৫৫১৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৪১৪]
◈ ঘরে মানুষ, ছোট বাচ্চা, পশু-পাখি ইত্যাদি প্রাণীর ছবি টাঙ্গিয়ে রাখা হলে ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না:
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু তালহা রা. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«لَا تَدْخُلُ الْمَلَائِكَةُ بَيْتًا فِيهِ كَلْبٌ، وَلَا صُورَةٌ
◈ সম্মানিত ব্যক্তিদের মূর্তি-প্রতিকৃতি ভাস্কর্য ইত্যাদি নির্মাণ শিরকের মাধ্যম:
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়, সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন বা তাদের স্মৃতিকে মানুষের হৃদয়ে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে তাদের প্রতিমা, মূর্তি, প্রতিমূর্তি, প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য ঘরের দেয়ালে, রাস্তার মোড়ে, চৌরাস্তার মাঝখানে, স্কুলের মাঠ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর বা অন্য কোনও স্থানে অংকন, নির্মাণ বা স্থাপন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম। এর মাধ্যমে মূলত কাল পরিক্রমায় আগামী প্রজন্মের সামনে শিরকের দরজা উন্মুক্ত করা হয় যেমনটি পূর্ব যুগে ঘটেছিল।
◯ জ্ঞাতব্য:
– এ দায়িত্ব প্রধানত: সরকার বা প্রশাসনের; সাধারণ জনগণের নয়। বিশৃঙ্খলাতার আশঙ্কা থাকলে সাধারণ জনগণ এমন কাজ থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু এমন সম্ভাবনা না থাকলে সাধারণ জনগণও তা করতে পারে।
– মুসলিম দেশে বসবাসকারী অমুসলিমদের পূজামণ্ডপে তাদের দেবদেবীর মূর্তি এ নির্দেশের বাইরে। অর্থাৎ হিন্দুদের দেবদেবীর মূর্তি ভাঙ্গা ইসলাম সমর্থন করে না।
❑ ইসলামে কি সকল প্রকার ভাস্কর্য নিষিদ্ধ?
ইসলামের দৃষ্টিতে শিল্পকর্ম হিসেবে সকল প্রকার ভাস্কর্য তৈরি নিষিদ্ধ নয়। কেবল মানুষ, জীবজন্তু, পশুপাখি ইত্যাদি প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ বা তৈরি নিষিদ্ধ।
কেউ চাইলে জড়পদার্থ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গাছ, লতাপাতা, ফল, ফুল, আকাশ, সাগর, নদী, পাহাড়, বন-বনানী, ঘর-বাড়ি ইত্যাদির ছবি, দৃষ্টি নন্দন প্রতিকৃতি, শৈল্পিক ভাস্কর্য ইত্যাদি তৈরি করতে পারে। কারণ সে ব্যাপারে ইসলামে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।
❑ ভাস্কর্য বা মূর্তি নির্মাণের মাধ্যমে সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এর পরিবর্তে তাদেরকে অপমান করা হয়:
একথা কারো অজানা নয় যে, উন্মুক্ত স্থানে নির্মিত ভাস্কর্যের উপরে পাখ-পাখালি মল-মূত্র ত্যাগ করে, কুকুর, বিড়াল, শৃগাল ইত্যাদি সেগুলোর গায়ে পেশাব করে এবং নানা ময়লা-আবর্জনা পড়ে সেগুলো নোংরা হয়ে যায়।
সুতরাং এ সকল সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্য এর থেকে অবমাননাকর আর কী হতে পারে?
শুধু তাই নয় আমরা জানি, সময়ের আবর্তে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বা আদর্শিক পরিবর্তনের ফলে অনেক সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত মূর্তি বা ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং নানাভাবে সেগুলোকে অপমান করা হয়। যেমনটি বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটতে দেখা গেছে।
সুতরাং এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে এ সকল সম্মানিত ব্যক্তিদের মানহানি ও অবমাননার ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হয়।
❑ আমরা কীভাবে মৃত সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করব?
– এ সকল কীর্তিমান এবং দেশ ও মানবতার স্বার্থে জীবন উৎসর্গকারী ব্যক্তিদেরকে মানুষের স্মৃতিপটে ধরে রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ভবন বা রাস্তাঘাটের নামকরণ করা।
– তাদের গৌরবময় ইতিহাস ও জীবনের ভাল দিকগুলো মানুষের মাঝে আলোচনা-পর্যালোচনা করা।
– তাদের পক্ষ থেকে দান-সদকা করা।
– তাদের পক্ষ থেকে হজ ও ওমরা সম্পাদন করা ইত্যাদি।
পরিশেষে বলব, ইসলামের এই নিষিদ্ধ বিষয়টিকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক বা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা সঙ্গত নয় এবং এমন কিছু করা উচিত নয় যা, তাদের জন্য কোনও কল্যাণ বয়ে আনবে না।
নিম্নে আমরা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জালিমদের ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পক্ষ থেকে যে হুমকি ও করুণ পরিণতির কথা বলা হয়েছে সে ব্যাপারে কতিপয় আয়াত ও হাদিস উপস্থাপন করব ইনশাআল্লাহ।
❂ ১. আল্লাহ জালিমদের কার্যক্রমের ব্যাপারে অসচেতন নন:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ لَا تَحۡسَبَنَّ اللّٰهَ غَافِلًا عَمَّا یَعۡمَلُ الظّٰلِمُوۡنَ اِنَّمَا یُؤَخِّرُهُمۡ لِیَوۡمٍ تَشۡخَصُ فِیۡهِ الۡاَبۡصَارُ مُهۡطِعِیۡنَ مُقۡنِعِیۡ رُءُوۡسِهِمۡ لَا یَرۡتَدُّ اِلَیۡهِمۡ طَرۡفُهُمۡ وَ اَفۡـِٕدَتُهُمۡ هَوَآءٌ
“তুমি কখনও মনে করো না যে, জালিমরা যা করছে সে বিষয়ে মহান আল্লাহ উদাসীন। আসলে তিনি সেদিন পর্যন্ত তাদের অবকাশ দেন, যেদিন সব চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। ভীত-বিহ্বল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছুটাছুটি করবে, আতঙ্কে তাদের নিজেদের দিকেও ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে (ভয়ানক) উদাস।” [সুরা ইবরাহিম: ৪২ ও ৪৩]
❂ ২. জাহান্নামের আজাব দেখার পর প্রতিটি জালিম সারা পৃথিবীর সব সম্পদ দিয়ে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তির প্রত্যাশা করবে:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَوْ أَنَّ لِكُلِّ نَفْسٍ ظَلَمَتْ مَا فِي الْأَرْضِ لَافْتَدَتْ بِهِ ۗ وَأَسَرُّوا النَّدَامَةَ لَمَّا رَأَوُا الْعَذَابَ ۖ وَقُضِيَ بَيْنَهُم بِالْقِسْطِ ۚ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ
“জাহান্নামের আজাব দেখার পর প্রত্যেক জালিমের (কাফির-মুশরিকের) কাছে যদি সমগ্র পৃথিবীতে যে পরিমাণ অর্থ-সম্পদ আছে তা থাকতো তাহলে সে নিজের মুক্তির বিনিময়ে সে সবকিছু দিতে চাইতো। আর গোপনে গোপনে অনুতাপ করত। বস্তুত: তাদের জন্য সিদ্ধান্ত হবে ন্যায়সঙ্গত। তাদের উপর অবিচার করা হবে না।” [সূরা ইউনুস: ৫৪]
❂ ৩. জালিমের জন্য আখিরাতে কঠোর শাস্তির হুমকি:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَن يَظْلِم مِّنكُمْ نُذِقْهُ عَذَابًا كَبِيرًا
“তোমাদের মধ্যে যে জুলুম (শিরক) করবে আমি তাকে গুরুতর শাস্তি আস্বাদন করাব।” [সূরা ফুরকান: ১৯]
তিনি আরও বলেন,
وَ سَیَعۡلَمُ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡۤا اَیَّ مُنۡقَلَبٍ یَّنۡقَلِبُوۡنَ
“অচিরেই জালিমরা (মুশরিকরা) জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তন স্থল কোথায় হবে।” [সুরা শুআরা: ২২৭]
তিনি আরও বলেন,
وَعَنَتِ الۡوُجُوۡهُ لِلۡحَیِّ الۡقَیُّوۡمِ ؕ وَ قَدۡ خَابَ مَنۡ حَمَلَ ظُلۡمًا
“ আর (কিয়ামতের দিন) চিরঞ্জীব, চির প্রতিষ্ঠিত মহান সত্তার সামনে সকলেই অবনত হবে। আর সে অবশ্যই ব্যর্থ হবে যে (সে দিন) জুলুম (শিরক) নিয়ে হাজির হবে” [সূরা ত্বা-হা: ১১১]
❂ ৪. জালিমের জন্য জাহান্নামের শাস্তির এক ভয়ানক চিত্র:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا ۚ وَإِن يَسْتَغِيثُوا يُغَاثُوا بِمَاءٍ كَالْمُهْلِ يَشْوِي الْوُجُوهَ ۚ بِئْسَ الشَّرَابُ وَسَاءَتْ مُرْتَفَقًا
”‘আমি জালিমদের জন্য (কাফের-মুশরেকদের জন্য) প্রস্তুত করে রেখেছি আগুন, যার বেষ্টনী তাদের পরিবেষ্টন করে রাখবে, তারা পানীয় চাইলে তাদের দেয়া হবে গলিত ধাতুর মতো পানীয়, যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে, এটি কত নিকৃষ্ট পানীয়, জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়।” [সুরা কাহফ: ২৯]
❂ ৫. কিয়ামতের দিন অভিশপ্ত জালিমের কোনও ওজর-আপত্তি শোনা হবে না:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَوْمَ لَا يَنفَعُ الظَّالِمِينَ مَعْذِرَتُهُمْ ۖ وَلَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ
“সে দিন জালেমদের (কাফের-মুশরিকদের) ওজর-আপত্তি কোন উপকারে আসবে না, তাদের জন্যে থাকবে অভিশাপ এবং তাদের জন্যে থাকবে মন্দ গৃহ (জাহান্নাম)।” [সূরা মুমিন/গাফির: ৫২]
❂ ৬. দুনিয়াতে জালিমের ধ্বংসাত্মক পরিণতি:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَكَمْ قَصَمْنَا مِن قَرْيَةٍ كَانَتْ ظَالِمَةً وَأَنشَأْنَا بَعْدَهَا قَوْمًا آخَرِينَ
“আমি কত জনপদের ধ্বংস সাধন করেছি যার অধিবাসীরা ছিল জালিম (কাফের-মুশরিক) এবং তাদের পর সৃষ্টি করেছি অন্য জাতি।” [সূরা আম্বিয়া: ১১]
তিনি আরও বলেন,
وَتِلْكَ الْقُرَىٰ أَهْلَكْنَاهُمْ لَمَّا ظَلَمُوا وَجَعَلْنَا لِمَهْلِكِهِم مَّوْعِدًا
“এসব জনপদও তাদেরকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, যখন তারা জালেম হয়ে গিয়েছিল (অর্থাৎ তারা আল্লাহ ও তার রসুলকে অস্বীকার করেছিলো) এবং আমি তাদের ধ্বংসের জন্যে একটি প্রতিশ্রুত সময় নির্দিষ্ট করেছিলাম।” [কাহাফ: ৫৯]
তিনি আরও বলেন,
وَكَذَٰلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَىٰ وَهِيَ ظَالِمَةٌ ۚ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ
“এমনই ছিল তোমার রবের ধরপাকড়, যখন তিনি ধরেছিলেন ওই জালিম বসতিগুলোকে (যারা আল্লাহ ও নবি-রসুলদেরকে অবিশ্বাস করেছিলো)। নিশ্চয়ই তার ধরা অনেক কঠিন যন্ত্রণাময়।” [সুরা হুদ: ১০২]
❂ ৭. দুনিয়ার জালিমের ধ্বংসাত্মক পরিণতির করুণ চিত্র:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَكَأَيِّن مِّن قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا وَهِيَ ظَالِمَةٌ فَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَىٰ عُرُوشِهَا وَبِئْرٍ مُّعَطَّلَةٍ وَقَصْرٍ مَّشِيدٍ
“আমি কত জনপদ ধ্বংস করেছি এমতাবস্থায় যে, তারা ছিল জালিম (কাফের-মুশরেক)। এই সব জনপদ এখন ধ্বংসস্তূপ পরিণত হয়েছে এবং কত কূপ পরিত্যক্ত হয়েছে ও কত সুদৃঢ় প্রাসাদ ধ্বংস হয়েছে।” [সূরা হজ: ৪৫]
❂ ৮. জালিমকে আল্লাহর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
“আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে (জুলুম-নির্যাতনকারীদেরকে) ভালবাসেন না।” [সূরা আলে ইমরান: ৫৭ ও ১৪০]
❂ ৯. জালিমকে আল্লাহর হেদায়েত থেকে বঞ্চিত:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
“আর আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে হেদায়েত দান করেন না।” [ বাকারা, ২৫৮, সূরা আলে ইমরান: ৮৬, তওবা: ১৯ ও ১০৯, সফ: ৭, জুমা: ৫]
❂ ১০. জালিম আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশপ্ত:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَن لَّعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ
“আল্লাহর অভিসম্পাত জালেমদের উপর (অর্থাৎ ঐ সকল লোকদের উপর যারা ইমানের উপর কুফরিকে প্রাধান্য দিয়েছে)।” [সূরা আরাফ: ৪৪]
তিনি আরও বলেন,
أَلَا لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ
“শুনে রাখ, জালেমদের উপর (কাফের-মুশরিক ও মুনাফিকদের উপর) আল্লাহর অভিসম্পাত রয়েছে।” [সূরা হুদ: ১৮]
❂ ১১. কিয়ামতের দিন জালিমের পক্ষে কোনও সাহায্যকারী দাঁড়াবে না:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ
”জালিমদের (কাফের-মুশরিকদের) জন্য কোনও সাহায্যকারী নেই।” [সুরা আলে ইমরান: ১৯২]
❂ ১২. কিয়ামতের দিন জালিমের পক্ষে কোনও সাহায্যকারী ও শুপারিশকারী থাকবে না:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ
“জালিমদের ( (কাফের-মুশরিকদের) কোনও বন্ধু নেই এবং সুপারিশকারীও নেই, যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে।” [সুরা মুমিন/গাফের: ১৮]
❂ ১৩. কিয়ামতের দিন জালিমের পক্ষে কোনও অভিভাবক ও সাহায্যকারী এসে দাঁড়াবে না:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالظَّالِمُونَ مَا لَهُمْ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ
“আর জলেমদের (কাফের-মুশরিকদের) কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই।” [সূরা শূরা: ৮]
❂ ১৪. জুলুম থেকে মুক্তির জন্য দুআ শিক্ষা:
رَبَّنَا لَا تَجۡعَلۡنَا مَعَ الۡقَوۡمِ الظّٰلِمِيۡنَ
“হে আমাদের রব, আমাদেরকে জালিম সম্প্রদায়ের (পাপিষ্ঠদের) অন্তর্ভুক্ত করবেন না।” [সুরা আরাফ: ৪৭]
জালিমের পরিণতি সংক্রান্ত কতিপয় হাদিস উপস্থাপন করা হলো:
❂ ১. মানুষের উপর জুলুম-অত্যাচারকারী আখিরাতে রিক্ত ও নিঃস্ব অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত,
أَتَدْرُونَ ما المُفْلِسُ؟ قالوا: المُفْلِسُ فِينا مَن لا دِرْهَمَ له ولا مَتاعَ، فقالَ: إنَّ المُفْلِسَ مِن أُمَّتي يَأْتي يَومَ القِيامَةِ بصَلاةٍ، وصِيامٍ، وزَكاةٍ، ويَأْتي قدْ شَتَمَ هذا، وقَذَفَ هذا، وأَكَلَ مالَ هذا، وسَفَكَ دَمَ هذا، وضَرَبَ هذا، فيُعْطَى هذا مِن حَسَناتِهِ، وهذا مِن حَسَناتِهِ، فإنْ فَنِيَتْ حَسَناتُهُ قَبْلَ أنْ يُقْضَى ما عليه أُخِذَ مِن خَطاياهُمْ فَطُرِحَتْ عليه، ثُمَّ طُرِحَ في النَّارِ
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি জান নি:স্ব কে?”
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, “আমাদের মধ্যে নি:স্ব তো সে যার কোন দিনার-দিরহাম (টাকা-পয়সা) বা আসবাব-সামগ্রী নেই।”
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমার উম্মতের মধ্যে সত্যিকার নি:স্ব হল সেই ব্যক্তি যে, কেয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম ও জাকাতসহ অনেক ভালো কাজ নিয়ে উপস্থিত হবে অথচ দুনিয়াতে সে কাউকে গালি দিয়েছিল, কারো প্রতি অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছিল, কারো রক্তপাত ঘটিয়েছিল, কাউকে মেরেছিল। ফলে তার থেকে নেক আমলগুলো নিয়ে তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাওনা আদায় করা হবে।
এভাবে যখন তার নেক আমলগুলো শেষ হয়ে যাবে ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়ার জন্য আর কিছু থাকবে না তখন তাদের পাপগুলো তাকে দেওয়া হবে। ফলে সে (নিঃস্ব অবস্থায়) জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।” [সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪৭/ সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শিষ্টাচার, পরিচ্ছেদ: ১৫. জুলুম করা হারাম]
❂ ২. মানুষের উপর জুলুম-অবিচার করা হলে তা আল্লাহ ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না মজলুম ব্যক্তির সাথে মিটমাট করে নেওয়া হয়:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“ رَحِمَ اللَّهُ عَبْدًا كَانَتْ لأَخِيهِ عِنْدَهُ مَظْلَمَةٌ فِي عِرْضٍ أَوْ مَالٍ فَجَاءَهُ فَاسْتَحَلَّهُ قَبْلَ أَنْ يُؤْخَذَ وَلَيْسَ ثَمَّ دِينَارٌ وَلاَ دِرْهَمٌ فَإِنْ كَانَتْ لَهُ حَسَنَاتٌ أُخِذَ مِنْ حَسَنَاتِهِ وَإِنْ لَمْ تَكُنْ لَهُ حَسَنَاتٌ حَمَّلُوا عَلَيْهِ مِنْ سَيِّئَاتِهِمْ
“আল্লাহ রহম করুন বান্দার উপর, যার জিম্মায় তার কোন ভাইয়ের সম্মান ও সম্পদ বিনষ্ট করার মত জুলুমের অপরাধ রয়ে গেছে সে যেন এই অপরাধগুলো পাকড়াও হওয়ার আগেই মাফ করিয়ে নেয়। সেখানে (কিয়ামতের ময়দানে) কোন দিনার-দিরহাম (রৌপ্য ও রৌপ্য মুদ্রা) থাকবে না। যদি তার নেক আমল থাকে (মজলুমের বদলায়) তবে নেক আমল নিয়ে যাওয়া হবে। আর তার যদি নেক আমল না থাকে তবে মজলুমদের বদ আমল এনে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। [সহিহ বুখারি সুনানে তিরমিজি, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪০/ কিয়ামত, পরিচ্ছেদ: হিসাব এবং অন্যায়ের বদলা।]
এ প্রসঙ্গে আরেকটি হাদিস:
আনাস ইবনে মালেক রা. নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন,
“الظُّلْمُ ثَلاثَةٌ، فَظُلْمٌ لا يَغْفِرُهُ الله، وَظُلْمٌ يَغْفِرُهُ، وَظُلْمٌ لا يَتْرُكُهُ، فَأَمَّا الظُّلْمُ الَّذِي لا يَغْفِرُهُ الله فَالشِّرْكُ قَالَ الله: {إنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ} وَأَمَّا الظُّلْمُ الَّذِي يَغْفِرُهُ ظُلْمُ العِباَدِ أَنْفُسَهُمْ فِيمَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ رَبِّهِمْ وَأَمَّا الظُّلْمُ الَّذِي لا يَتْرُكُهُ الله فَظُلْمُ الْعِبَادِ بَعْضِهِمْ بَعْضًا حَتَّى يُدَبِّرُ لِبَعْضِهِمْ مِنْ بَعْضٍ
জুলুম তিন প্রকার। যথা:
❂ ৩. জুলুম-অত্যাচার কিয়ামতের দিন ভয়ানক অন্ধকার হিসেবে উপস্থিত হবে:
জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
اتَّقُوا الظُّلمَ ؛ فإنَّ الظُّلمَ ظُلُماتٌ يومَ القيامةِ
“তোমরা জুলুম-নির্যাতন করার ব্যাপারে সতর্ক হও। কারণ জুলুম-নির্যাতন পরকালে অন্ধকার (হিসেবে উপস্থিত হবে)।” [বুখারি ও মুসলিম] অর্থাৎ কিয়ামত দিবসে যে দিন মুমিনদের সামনে-পেছনে ডানে-বামে আলোকিত থাকবে (দেখুন: সূরা হাদিদ: ১২)। সে সময় অত্যাচারীর চারদিকে থাকবে অন্ধকার। ফলে সে মুক্তির পথ খুঁজে পাবে না।
❂ ৪. মজলুমের বদদুআ আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না:
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“ ثَلاَثُ دَعَوَاتٍ يُسْتَجَابُ لَهُنَّ لاَ شَكَّ فِيهِنَّ دَعْوَةُ الْمَظْلُومِ وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ وَدَعْوَةُ الْوَالِدِ لِوَلَدِهِ
“তিন ব্যক্তির দুআ কবুল হয়। এতে কোন সন্দেহ নাই। মজলুম (নির্যাতিত) এর দুআ, মুসাফিরের দুআ ও সন্তানের জন্য পিতার দুআ।” [সুনানে তিরমিজি, ১৯০৫, ৩৪৪৮, ১৫৩৬, মুসনাদে আহমদ ৭৪৫৮, ৮৩৭৫, ৯৮৪০, ১০৩৩০, ১০৩৯২। সিলসিলা সহীহাহ ৫৯৬, সহীহ আবু দাউদ ১৩৭৪]
❂ ৫. জুলুম-নির্যাতন করা কোনও মুসলিমের বৈশিষ্ট্য নয়:
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
المُسْلِمُ أَخُو المُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ
“এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সুতরাং সে তার প্রতি জুলুম করবে না, তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেবে না এবং তাকে তুচ্ছ ভাববে না।” [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫৬৪]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ
“এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), অধ্যায়: ৪৬/ অত্যাচার, কিসাস ও লুণ্ঠন, পরিচ্ছেদ: ৪৬/৩. মুসলিম মুসলিমের প্রতি অত্যাচার করবে না এবং তাকে অপমানিতও করবে না]
❂ ৬. জুলুম-নির্যাতন করা হারাম:
ইমাম মুসলিম আবু যার রা. হতে বর্ণনা করেন যে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা (হাদিসে কুদসিতে) বলেন,
يا عبادي إنِّي حرَّمتُ الظُّلمَ على نفسي وجعلتُهُ بينَكم محرَّمًا
“হে আমার বান্দাগণ, আমি জুলুমকে নিজের উপর হারাম করেছি এবং তোমাদের উপরও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর জুলুম করবে না।” [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫২]
❂ ৭. আল্লাহ অত্যাচারীকে ছাড় দেন কিন্তু ধরলে ছাড়েন না:
আবু মুসা আশআরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“ إِنَّ اللَّهَ لَيُمْلِي لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُ ”. قَالَ ثُمَّ قَرَأَ (وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهْىَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ)
❂ ৮. কারও উপর জুলুম করা বা জুলুমের শিকার না হওয়ার জন্য আল্লাহর নবির দুআ:
«اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْفَقْرِ وَالْقِلَّةِ وَالذِّلَّةِ وَأَعُوذُ مِنْ أَنْ أَظْلِمَ أَوْ أُظْلَمَ»
উচ্চারণ: “আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল ফাক্বরি, ওয়াল ক্বিল্লাতি ওয়ায্ যিল্লাতি ওয়া আঊযুবিকা মিন্ আন্ আযলিমা আও উযলামা’’
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অস্বচ্ছলতা, স্বল্পতা, অপমান-অপদস্থ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করি এবং আমি অত্যাচারী অথবা অত্যাচারিত হওয়া হতেও তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।
❂ ৯. অত্যাচারকারীকে ক্ষমা করা অথবা অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণ করা অথবা বিচারের ভার আল্লাহর উপর সমর্পণ করা-কোনটি উত্তম?
◆ ১. সম্মানিত সাহাবি আবু বকর রা. এর ঘটনা:
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। এক লোক এসে আবু বকর রা.-কে বকাবকি করতে লাগল। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানেই বসে ছিলেন। তিনি এ কাণ্ড দেখে আশ্চর্য হয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। লোকটি বেশি মাত্রায় বকাবকি শুরু করলে আবু বকর রা. তার দু-একটি কথার জবাব দিলেন। এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাগ করে সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন।
আবু বকর রা. পেছনে পেছনে গিয়ে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন: হে আল্লাহর রসুল, লোকটি আমাকে বকাবকি করছিল আর আপনি সেখানে বসে ছিলেন। কিন্তু যখনই তার কিছু কথার জবাব দিলাম তখনই আপনি রেগে সেখান থেকে চলে আসলেন।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: তোমার সাথে একজন ফেরেশতা ছিল যে তোমার পক্ষ থেকে উত্তর দিচ্ছিল। আর যখনই তুমি উত্তর দিলে সেখানে শয়তান ঢুকে পড়ল।
আর হে আবু বকর, তিনটি জিনিস খুবই সত্য:
ক. কেউ কোন ব্যাপারে জুলুমের শিকার হওয়ার পর সে যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে তা ক্ষমা করে দেয় তবে এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তাকে সম্মান জনক ভাবে সাহায্য করেন।
◆ ২. রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “দু জন লোক যদি পরস্পরকে গালাগালি করে তবে যাবতীয় গুনাহ তার উপর বর্তাবে যে আগে শুরু করেছে যদি অত্যাচারিত ব্যক্তি প্রতি উত্তরে অতিরিক্ত না বলে।” [সহীহ মুসলিম]
এ হাদিসের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি আগে কাউকে কষ্ট দেয় বা গালি দেয় তবে তার সমপরিমাণ প্রতি উত্তরে দেওয়া জায়েজ আছে আর তার যাবতীয় গুনাহ যে আগে শুরু করেছে তার উপর বর্তাবে। কারণ সেই এর মূল কারণ। অবশ্য যদি প্রতি উত্তরে সে অতিরিক্ত গালমন্দ করে তবে যে পরিমাণ অতিরিক্ত গালমন্দ করেছে তার জন্য গুনাহগার হবে। কারণ,ইসলামে কেবল সমপরিমাণ প্রতিশোধ নেয়ার অনুমোদন রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَجَزَاءُ سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِّثْلُهَا ۖ فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّـهِ ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
“অন্যায়ের প্রাপ্য শুধু সমপরিমাণ অন্যায়। তবে যে ব্যক্তি ক্ষমা করে দেয় এবং সমঝোতা করে সে আল্লাহর নিকট পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। তিনি তো অত্যাচারীদেরকে পছন্দ করেন না। [সূরা শূরা: ৪০]
যদিও সমপরিমাণ প্রতিশোধ নেয়া জায়েজ আছে তবুও ধৈর্য ধারণ করা উত্তম। যেমনটি আবু হুরায়রা রা. কর্তৃক বর্ণিত পূর্বোক্ত হাদিসটিতে বর্ণিত হয়েছে।
তবে কেউ যদি জুলুমকারীকে ক্ষমাও না করে এবং প্রতিশোধ গ্রহণ না করে বরং আখিরাতে আল্লাহর নিকট বিচারের ভার সপে দেয় তাহলে তা জায়েজ রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ আখিরাতে এর যথোপযুক্ত ন্যায় সঙ্গত বিচার করবেন। সে দিন মহান বিচারক আল্লাহ তাআলা জালিমের সওয়াবগুলো মজলুমকে দিবেন এবং মজলুমের গুনাহগুলো জালিমের উপর চাপিয়ে দিবেন। এভাবে অত্যাচারকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অত্যাচারিত ব্যক্তি লাভবান হবে। ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্য যে, কেউ কারো উপর অত্যাচার করলে আল্লাহর নিকট তওবার মাধ্যমে তা ক্ষমা হবে না যতক্ষণ অত্যাচারিত ব্যক্তি তাকে ক্ষমা না করে বা দুজনের মাঝে দুনিয়াতে সমঝোতা না হয়।
আল্লাহ আমাদেরকে জলুম করা থেকে এবং জুলুমের শিকার হওয়া হতে হেফাজত করুন। আমিন। (সমাপ্ত)
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার। সৌদি আরব।