মিথ্যা থেকে বাঁচার উপায়
=================================================================
মিথ্যা যে একটি বদ অভ্যাস তাতে কেউ সন্দেহ করে বলে আমি মনে করি না, কারণ মিথ্যাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধ্বংসকর বলে মন্তব্য করেছেন। আরো বলেছেন, মিথ্যা মুনাফেকীর নিদর্শন। মানুষ মিথ্যা বলতে বলতে এক সময় আল্লাহর দরবারে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত হয়। আর সত্য বলা ও সত্য বলার প্রচেষ্টায় রত থাকলে আল্লাহ্ তাকে সত্যবাদী বলে লিখে নেন; এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীসের ভাষ্যই উদ্ধৃত করলাম।
কথা উঠেছিল আমাদের এক শিক্ষককে নিয়ে যিনি মিথ্যা কথা বলতে ছাত্রদেরকে নিষেধ করতেন। একদা আমরা তার বৈঠকখানায় অবস্থান করছিলাম, এমতাবস্থায় সেখানে এমন এক লোক এসে উপস্থিত যাকে তিনি পছন্দ করতেন না। আসা মাত্রই লোকটি প্রশ্ন করলো: “তোমাদের গুরুমশাই কোথায়”? আমরা জানতাম যে, উস্তাদজী তার সাথে দেখা করতে চান না; অথচ আমাদেরকে মিথ্যা বলতে নিষেধ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যকার সর্বকনিষ্ঠ জন সভয়ে বলে ফেললো যে, তিনি পাশের ফ্লাটে আছেন। উস্তাদজীকে তার কথামত ডাকা হলো, তিনি আসলেন এবং তার সাথে জরুরী কথাবার্তা সারলেন।
কিছুক্ষণ পর লোকটি বিদায় নিলো। আমরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। আমাদের অবস্থা দেখে তিনি বুঝতে পারলেন যে, তার অবস্থান বলে দেয়ায় তিনি যে খুশী হননি, এটা আমরা বুঝতে সক্ষম হয়েছি, কিন্তু আমরা অপরাগ ছিলাম, কারণ মিথ্যা বলা যাবে না। তিনি ব্যাপারটা সহজ করে নিতে নিতে বললেন, তোমরা এমনটি বললেই পারতে যে, “তিনি এখানে নেই”।
তিনি বললেন: তোমাদের এ প্রশ্নটি আমার কাছে ভালো লেগেছে। আসলে দ্বীনী ব্যাপারে কোন কিছু বলার পূর্বে আমাদের জানা আবশ্যক যে, আমাদের কথাটা কুরআন-সুন্নাহ্ অনুযায়ী হয়েছে কি না। আর যে আয়াত বা হাদীসকে আমি বা আমরা দলীল হিসেবে পেশ করবো, সে আয়াত বা হাদীস দ্বারা আমাদের সালফে সালেহীন তথা সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবেতাবেয়ীনের অনুসারীগণ আমরা যে রকম বুঝেছি সে রকম বুঝেছেন কি না? নাকি আমরা আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যায় নতুন কোন কথা সংযোজন করেছি? কেননা জগতে যত ফেৎনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয়েছে আর যত ফির্কার উৎপত্তি হয়েছে, সবাই দলীল হিসেবে কুরআন ও হাদীসের বাণী উদ্ধৃত করে থাকে, যদি সব ব্যাখ্যাই গ্রহণযোগ্য হতো তাহলে দ্বীনের অস্তিত্ব টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ত। তাই সালফে-সালেহীনের ব্যাখ্যা অনুসারেই কুরআন বা হাদীসকে আমাদের বুঝতে হবে।
তাই ইব্রাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম তাদেরকে বোকা বানানোর জন্য তারকারাজির দিকে ক্ষণিকের জন্য দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন, তারপর বললেন যে, “আমি অসুস্থ হয়ে যাবো”, তাঁর জাতির লোকেরা বুঝলো যে, ইব্রাহীম তারকার অবস্থান দেখে বুঝেছে সে অসুস্থ হয়ে যাবে তাই সে মেলায় যাচ্ছে না। অথচ ইব্রাহীম ‘আলাইহিস্ সালামের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে বোকা বানানো আর “আমি রোগগ্রস্ত” কথার দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল যে, আমি মানসিক ভাবে তোমাদের কর্মকাণ্ডে খুশী নই।
রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসেও এসেছে, বদরের যুদ্ধে তিনি (সা) কাফেরদের অবস্থান বুঝার জন্য অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর সেখানকার লোকদের কাছ থেকে তাদের অবস্থান জানার পর লোকেরা প্রশ্ন করেছিল: তোমরা কোথা থেকে এসেছ? রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন: نحن من ماء অর্থাৎ “আমরা পানি হতে”। লোকেরা বুঝে নিল যে, তারা কোন পানির কুপের কাছে থাকে, সেখান থেকে এসেছে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশ্য ছিল একথা বলা যে, আমরা পানি থেকে সৃষ্ট; কারণ সব সৃষ্টির মূলেই রয়েছে পানি।
উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করা হয়, তিনি বলেছেন যে, আমি আশ্চর্য হই এই ভেবে যে, “কোন ব্যক্তি معاريض বা কথা বলার কৌশল জানার পরেও মিথ্যা বলার দিকে ধাবিত হয় কি করে?” [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে একবার খাবার খেতে ডাকা হলো, সেখানে তিনি কোনো কারণে খাওয়া অপছন্দ করলেন, তাই তিনি বললেন: ‘আমি রোযাদার’। তারপর তারা তাকে খেতে দেখলো। তারা বললো: ‘আপনি কি বলেন নি যে, আপনি রোযাদার? তিনি জবাবে বললেন: ‘রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেননি যে, প্রত্যেক মাসে তিনদিন রোযা রাখা মানে চিরদিন রোযা রাখা?’ (অর্থাৎ ‘সে অনুসারে আমি রোযাদার’। কারণ তিনি প্রত্যেক মাসের ১৪, ১৫, ১৬ এ তিনদিন রোযা রাখতেন।)
প্রখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবন সিরীন রাহিমাহুল্লাহর নিকট যদি কোন ঋণদাতা তার ঋণ চাইত এবং তার কাছে দেওয়ার মত কিছু না থাকত, তবে তিনি বলতেন: ‘তোমাকে আমি দু’দিনের একদিনে পরিশোধ করব। ঋণদাতা মনে করত যে, আজ বা কাল দিয়ে দিবে অথচ তাঁর উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ার দিনে বা আখেরাতের দিনে আমি তোমার ঋণ পরিশোধ করে দেব’।
ইবনে সিরীন থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, কোন এক লোকের ভীষণ চোখ লাগতো (নযর লাগা)। কাজী সুরাইহ্ রাহিমাহুল্লাহ্ তার খচ্চরটি নিয়ে ঐ লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, লোকটি খচ্চরটির উপর চোখ লাগাতে চাইল। কাজী সুরাইহ্ রাহিমাহুল্লাহ্ সবকিছু বুঝতে পেরে সাথে সাথে বললেন: ‘আমার এই খচ্চরটা এমন বাজে যে, একবার বসে পড়লে আবার দাঁড় করিয়ে না দেয়া পর্যন্ত উঠবে না’। লোকটি বলল: ‘ধ্যাৎ, এমন বাজে জিনিস?’ এভাবে সুরাইহ্ রাহিমাহুল্লাহ্ লোকটির চোখ লাগানো থেকে তাঁর খচ্চরটাকে হেফাযত করলেন। অথচ কাজী সুরাইহ্-এর কথা ‘বসে পড়লে উঠিয়ে না দেয়া পর্যন্ত উঠে না’-এর অর্থ এ নয় যে, সত্যি সত্যিই সেটি উঠে না; বরং উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহ্ যতক্ষণ না উঠান ততক্ষণ সেটি উঠতে পারে না।
ইব্রাহীম নাখয়ী রাহিমাহুল্লাহ্ থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার তার স্ত্রী তাকে কোন একটা কিছু দেয়ার বিষয়ে খুব পীড়াপীড়ি করছিল, তখন তার হাতে একটা পাখা ছিল। তিনি পীড়াপীড়িতে অতিষ্ট হয়ে বলে উঠলেন: ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি এটা তোমার!’ তার স্ত্রী শান্ত হলে তিনি তার শিষ্যদের জিজ্ঞাসা করলেন: ‘তোমরা কি বুঝলে?’ তারা বলল: ‘আপনি আপনার স্ত্রীকে ঐ বস্তুটা দিয়ে দিলেন’। তিনি বললেন: ‘কখখনো নয়! তোমরা কি দেখনি যে, আমি পাখাটির দিকেই ইঙ্গিত করছিলাম? আমার উদ্দেশ্য ছিল পাখাটা দেয়া।’
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হাম্মাদ বিন যায়েদ রাহিমাহুল্লাহ্-এর কাছে যদি এমন কোন লোক আসত যার সাথে তিনি সাক্ষাৎ করতে চাইতেন না, সাথে সাথে তিনি তাঁর হাতটা মাড়ির দাঁতের উপর রেখে বলতেন: ’হায় আমার দাঁত! হায় আমার দাঁত! এভাবে বলতে থাকতেন। লোকটি মনে করত তাঁর বুঝি দাঁতে ব্যাথা তাই কথা বলবেন না, অথচ তিনি দাঁতে ব্যাথা হয়েছে এমন কথা বলেন নি।’
(২) আরেক প্রকার হিলা করা জায়েয। তবে ধর্মীয় স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে কখনো তা করা ভালো বলে বুঝায়, আবার কখনো ত্যাগ করা ভালো বলে প্রতীয়মান হয়। যার কিছু উদাহরণ আগেই পেশ করেছি।
(৩) তৃতীয় আরেক প্রকার হিলা বা বাহানা আছে যা করা হয় শরীয়তের কোন ফরদ্ব কাজ ত্যাগ করার জন্য বা কোন হারাম কাজকে হালাল করার জন্য অথবা অত্যাচারীকে নির্দোষ আর নির্দোষকে অত্যাচারী বানানোর জন্য, হককে বাতিল আর বাতিলকে হকের রূপে রূপদান করার জন্য; এ প্রকার হিলা বা বাহানা করা সম্পূর্ণরূপে হারাম।
এ প্রকারের হিলাকারীরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের লা’নতের ভাগীদার হওয়ার পথের পথিক। যেমনটি কোন কোন দেশের কিছু মুসলমানদের মধ্যে দেখা যায় তিন তালাকের মাসআলাতে অন্যস্থানে বিয়ে দেয়ার নামে মৌখিক বিয়ে ও সাথে সাথে মৌখিক তালাকের প্রচলন কিংবা এক রাতের জন্য চুক্তি করে ও পরদিন তালাক দেয়ার শর্তে বিয়ে করার হিলা বা বাহানা ইত্যাদি। আল্লাহ্ আমাদেরকে এ প্রকারের বাহানা অনুসরণ করার মাধ্যমে তাঁর লা’নতে পতিত হওয়া থেকে হেফাযত করুন। আমীন।
আমরা উস্তাদজীর আলোচনায় প্রীত হলাম। অন্যান্য দিনের মত আজও চা চক্রের মাধ্যমে আসরের সমাপ্তি ঘটিয়ে যে যার বাড়ী অভিমুখে রওয়ানা হলাম।
(ইবনুল কাইয়্যেমের “ইগাছাতুল লাহফান” অবলম্বনে রচিত)
[1] অর্থ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহর ওয়াদা সত্য, আর আগুন হচ্ছে কাফেরদের ঠিকানা আর আরশ পানির উপর ভাসছে, আর আরশের উপর আছেন সৃষ্টিকুলের রব, তাঁকে বহন করছে সম্মানিত ফেরেশতাগণ, আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাদল
No comments:
Post a Comment