বর্তমান যুগে পায়ে হেঁটে হজে গমন যে ৮টি কারণে তা উচিৎ নয়
উত্তর: নিম্নে পায়ে হেঁটে হজ করার বিধান, শর্তাবলী এবং বর্তমান আধুনিক যুগে যে ৮টি কারণে তা উচিৎ নয় সে বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল:
❑ পায়ে হেঁটে হজ করা কি জায়েজ?
“এবং মানুষের মধ্যে হজের জন্যে ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে।” [সূরা হজ: ২৭]
তবে এ জন্য বিজ্ঞ আলেমগণ কতিপয় শর্ত উল্লেখ করেছেন। যেমন:
❑ পায়ে হেঁটে হজ করা উত্তম নাকি যানবাহনের মাধ্যমে করা উত্তম?
উল্লেখ্য যে, কারও যদি যাতায়াত করার মত যানবাহন না থাকে বা যানবাহনের খরচ বহন করার মত পর্যাপ্ত অর্থ-কড়ি না থাকে তাহলে তার উপর হজ ফরজ নয়।
❑ দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে হজ সফরে যাওয়া কতটা যৌক্তিক?
আধুনিক উন্নত ও সহজলভ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার পরেও পায়ে হেঁটে কষ্টসাধ্য এত দীর্ঘ পথ পড়ি দিয়ে হজ করতে আসা উচিত নয় কয়েকটি কারণে। নিম্নে সেগুলো উপস্থাপন করা হল:
✪ ১. নিজেকে সীমাহীন কষ্ট, ক্লান্তি এবং ঝুঁকির মধ্যে ফেলা:
একাধিক হাদিস থেকে প্রমাণিত যে, আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পায়ে হেঁটে হজ করার জন্য মানত কারীকে নিয়ত পরিবর্তন করে সওয়ারিতে আরোহণ করে সফর করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। যেমন: হাদিসে এসেছে, ইবনে আব্বাস রা. সূত্রে বর্ণিত,
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا بَلَغَهُ أَنَّ أُخْتَ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ نَذَرَتْ أَنْ تَحُجَّ مَاشِيَةً، قَالَ: إِنَّ اللهَ لَغَنِيٌّ عَنْ نَذْرِهَا، مُرْهَا فَلْتَرْكَبْ
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন জানতে পারলেন, উকবা ইবনে আমের রা. এর বোন পায়ে হেঁটে হজ করার মানত করেছেন। তখন তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তার এরূপ মানতের মুখাপেক্ষী নন। তাকে যানবাহনে চড়ে হজে আসার নির্দেশ দাও।” [সহিহ আবু দাউদ, হাদিস নাম্বার: ৩২৯৭, জামে তিরমিজি, হাদিস নাম্বার: ১৫৩৬]
আরেকটি হাদিস: আনাস রা. থেকে বর্ণিত,
➤ লক্ষণীয় বিষয় হল, মানতের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হল, একজন মানুষ যেভাবে মানত করবে তাকে তা সেভাবে পালন করতে হবে যদি তা বৈধ হয়। এটি ফরজ বা আবশ্য পালনীয়। কিন্তু কেউ যদি এমন মানত করে যা তার জন্য পালন করা কষ্টসাধ্য তাহলে উক্ত মানত সেভাবে পালন করা আবশ্যক নয় বরং তার পরিবর্তে যেভাবে তার জন্য সহজ হয় সেভাবে পালন করবে। সে কারণেই উপরোক্ত ব্যক্তিগণ তাদের মানত পালনার্থে যখন হেঁটে হজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলো তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়টি দেখতে পেয়ে পায়ে হাঁটার পরিবর্তে যানবাহনে চড়ে হজে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সুতরাং যদি উক্ত ব্যক্তি দ্বয় পায়ে হেঁটে হজ করার মানত করেও থাকে তারপরও তা পালন করা বৈধ নয়। কারণ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা নিষেধ করেছেন। আর যদি তা মানত না হয়ে থাকে তাহলে এমনটি করা কতটা সঙ্গত তা সহজে অনুমেয়।
✪ ২. এতে রিয়া (ছোট শিরক) হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে:
এত দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি হওয়ার বিষয়টি ব্যতিক্রমী ঘটনা হওয়ার কারণে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে থাকে। মানুষ এ বিষয়ে প্রচুর আলোচনা-পর্যালোচনা করে।
إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ قَالُوْا وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ الرِّيَاءُ يَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عَندَهُمْ جَزَاءً
“তোমাদের উপর আমার সবচেয়ে অধিক যে জিনিসের ভয় হয় তা হল ছোট শিরক। সাহাবিগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রসূল, ছোট শিরক কী? উত্তরে তিনি বললেন, রিয়া (লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করা)। আল্লাহ তাআলা যখন (কিয়ামত দিবসে) মানুষকে তাদের আমলের প্রতিদান দান করবেন তখন তাদের উদ্দেশ্যে বলবেন, “তোমরা দুনিয়ায় যাদেরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করেছিলে তাদের নিকট গিয়ে দেখ, কোন প্রতিদান পাও কি না!” [মুসনাদে আহমদ, হা/২৩৬৩০, ইবনে আবিদ্দুনিয়া, বায়হাকির যুহুদ, সহীহ তারগীব, হা/২৯-সহিহ]।
✪ ৩. কৃত্রিমতা বা লৌকিকতা:
আধুনিক যানবাহন রেখে পায়ে হেঁটে এত সুদীর্ঘ কষ্টসাধ্য পথ পাড়ি দেওয়া কৃত্রিমতা তথা অপ্রয়োজনীয় কষ্ট ও পরিশ্রমের অন্তর্ভুক্ত। তাতে কোনও সন্দেহ নাই। এর উদাহরণ হল, শুষ্ক স্থান রেখে পানিতে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করার মত।
– “উপকার হীন কথা বা কাজে কষ্ট-পরিশ্রম করাকে তাকাল্লুফ বা কৃত্রিমতা বলা হয়।” [রিয়াদুস সালেহিন]।
✪ ৪. রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নীতি ও আদর্শ পরিপন্থী কাজ:
আধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থা ও সবধরনের সুযোগ-সুবিধা পরিত্যাগ করে পায়ে হেঁটে কণ্টকাকীর্ণ ও দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নীতি ও আদর্শ পরিপন্থী কাজ। কারণ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নীতি বা আদর্শ ছিল, কোনও কাজের ক্ষেত্রে যদি তাঁর সামনে দুটি সুযোগ থাকতো তাহলে সে ক্ষেত্রে তিনি যেটা অধিকতর সহজ সেটা গ্রহণ করতেন। যেমন: মা-জননী আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
مَا خُيِّرَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بَيْنَ أَمْرَيْنِ إِلَّا أَخَذَ أَيْسَرَهُمَا مَا لَمْ يَكُنْ إِثْمًا فَإِنْ كَانَ إِثْمًا كَانَ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنْهُ
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যখনই দুটি জিনিসের একটি গ্রহণের এখতিয়ার দেওয়া হত তখন তিনি অধিকতর সহজটিই গ্রহণ করতেন যদি তাতে গুনাহ না থাকতো। গুনাহ থাকলে সেখান থেকে তিনি সবচেয়ে দূরে অবস্থান করতেন।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন), অধ্যায়: ৬১/ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য, পরিচ্ছেদ: ৬১/২৩. নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনা]
✪ ৫. স্ত্রী-পরিবারের হক নষ্ট:
✪ ৬. যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অপচয়:
একজন ইমানদারের জীবনে সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আল্লাহ তাআলা বান্দার জীবন ও যৌবনকাল সম্পর্কে আখিরাতে প্রশ্ন করবেন। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে যৌবনের এত দীর্ঘ সময় অপচয় করার কারণে আল্লাহর কাছে হয়তো পাকড়াও-এর শিকার হতে হবে। কারণ বর্তমান আধুনিক যুগে উড়োজাহাজ ও যানবাহনের মাধ্যমে অল্প সময়ে যে কাজটা করা সম্ভব ছিল সেটা ইচ্ছাকৃত ভাবে না করে পায়ে হেঁটে এত দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য পথ পাড়ি দেওয়া জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ সময় অপচয়ের মধ্যে গণ্য হবে।
✪ ৭. প্রচুর শক্তির অপচয়:
لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ
“পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামতের দিন রবের নিকট থেকে আদম সন্তানের পা সরবে না: জিজ্ঞাসা করা হবে তার বয়স সম্পর্কে, কী কাজে সে তা অতিবাহিত করেছে, তার যৌবন সম্পর্কে কী কাজে সে তা বিনাশ করেছে; তার সম্পদ সম্পর্কে, কোথা থেকে সে তা অর্জন করেছে আর কী কাজে সে তা ব্যয় করেছে এবং সে যা শিখেছিল সে তদনুযায়ী কী আমল করেছে?” [সুনান আত তিরমিজি (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪০/ কিয়ামত, পরিচ্ছেদ: কিয়ামত প্রসঙ্গে]
✪ ৮. তাদের এই কাজ অন্যদেরকেও এই পথে পা বাড়াতে প্ররোচিত করবে:
No comments:
Post a Comment