প্রশ্ন: গর্ভবতী পশু কোরবানী করা কি বৈধ? কোরবানির পশু জবাইয়ের আগে মারা গেলে হুকুম কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর স্বাভাবিক ভাবে গর্ভবতী নয় এমন পশু দ্বারা কুরবানী দেওয়া উত্তম। তবে গর্ভবতী পশু বাহিমাতুল আনআম (উট, গরু ও ছাগল/বকরী) ইত্যাদি দ্বারা কোরবানী করা জায়েজ কিনা এ সম্পর্কে আলেমগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ আলেম ও ফিকহী মাযহাবের মতে, যদি পশুটি কোরবানীর জন্য নির্ধারিত বয়স ও শর্ত পূরণ করে, তবে গর্ভবতী পশু দ্বারা কোরবানী করা জায়েয। কারণ ইসলামী শরীয়তে যে দোষ-ত্রুটির কারণে কোনো পশুকে কোরবানীর অনুপযুক্ত বলা হয়েছে, তার মধ্যে গর্ভধারণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে শাফেয়ি মাযহাবের আলেমগণ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে, গর্ভবতী পশু দিয়ে কোরবানী করা মাকরূহ বা অনুচিত, এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ একে নিষিদ্ধও বলেছেন। তাদের যুক্তি হলো এতে গর্ভে থাকা ভ্রূণের জীবনহানি ঘটার সম্ভাবনা থাকে, যা কোরবানীর মূল উদ্দেশ্যপশু জবাই করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এমনকি কিছু কিছু আলেম চিকিৎসাগত দিক বিবেচনা করে গর্ভস্থিত পশু খাওয়াকে মাকরূহ বলেছেন।
.
আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা’ গ্রন্থে এসেছে: ولم يذكر جمهور الفقهاء الحمل عيبا في الأضحية ، خلافا للشافعية ، حيث صرحوا بعدم إجزائها في الأضحية ؛ لأن الحمل يفسد الجوف ويصير اللحم رديئا “অধিকাংশ ফিকাহবিদ আলেম গর্ভধারণকে কোরবানীর পশুর ত্রুটির মধ্যে উল্লেখ করেননি; তবে শাফেয়ি মাযহাবের আলেমগণ ব্যতীত। তারা পরিস্কারভাবে জায়েয না হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা গর্ভধারণের ফলে পেট নষ্ট হয়ে যায় এবং গোশত ভাল হয় না।”(আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা’ খণ্ড: ১৬; পৃষ্ঠা: ২৮১) শাফেয়ি মাযহাবের কিতাব ‘হাশিয়াতুল বুজাইরিমি আলাল খত্বীব’ এ এসেছে: والحامل لا تجزئ, وهو المعتمد [ يعني : في المذهب ] ؛ لأن الحمل ينقص لحمها وإنما عدوها كاملة في الزكاة ، لأن القصد فيها النسل دون طيب اللحم“গর্ভবতী পশু কোরবানীর পশু হিসেবে যথেষ্ট নয়। এটাই (মাযহাবের) প্রতিষ্ঠিত অভিমত। কেননা গর্ভধারণের ফলে গোশত কমে যায়। আর যাকাতের ক্ষেত্রে গর্ভবতী পশুকে পূর্ণ উপযুক্ত হিসেবে গণ্য করা হয় যেহেতু যাকাতের ক্ষেত্রে বংশবৃদ্ধির বিষয়টি উদ্দেশ্য; গোশত ভাল হওয়া নয়।” (পরিমার্জিতরূপে সমাপ্ত; দেখুন: হাশিয়াতুল বুজাইরিমি আলাল খত্বীব’ খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৩৫) অগ্রগণ্য অভিমত হলো: কোরবানীর পশু হিসেবে গর্ভবতী বাহিমাতুল আনআম (উট, গরু ও বকরী) উপযুক্ত; যদি তার ক্ষেত্রে অন্য কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকে। সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:يصح التضحية بالشاة الحامل ، كما يصح بالحائل ، إذا كانت سليمة من العيوب المنصوصة في الأضاحي ” ا“গর্ভবতী বকরী দিয়ে কোরবানী করা সঠিক; যেমনিভাবে অ-গর্ভবতী বকরী দিয়েও সঠিক; যদি পশুটি কোরবানীর ক্ষেত্রে দোষণীয় দোষগুলো থেকে মুক্ত হয়।”(ইমাম ইবনু ইব্রাহিম; ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলিস; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১৪৬)
.
যদি গর্ভস্থ বাচ্চাটি জীবিত অবস্থায় বের হয়,তাহলে তাকে শরিয়তের বিধান অনুসারে জবাই করে খাওয়া বৈধ। আর যদি মৃত অবস্থায় বের করা হয়, তবুও জমহুর (অধিকাংশ) আলেমের মতে,সেটিও খাওয়া যাবে। কেননা মাকে জবাই করার মাধ্যমে সেটাকেও জবাই করা হয়েছে বলে গণ্য হয়। এটি হানাফী মাযহাব ছাড়া অধিকাংশ মাযহাবের আলেমদের অভিমত। ইমাম আবু হানিফার মতে,বের হওয়ার পর জবাই করা ছাড়া সেটা হালাল হবে না।দলিল হচ্ছে, প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি (ﷺ) বলেন: ذَكَاةُ الْجَنِينِ ذَكَاةُ أُمِّهِ “মায়ের জবাই গর্ভস্থিত পশুর জবাই”।(সুনানে আবু দাউদ হা/২৮২৮; সুনানে তিরমিযি হা/১৪৭৬; সুনানে ইবনে মাজাহ হা/৩১৯৯ ও মুসনাদে আহমাদ হা/১০৯৫০; বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) ‘সহিহুল জামে’ হা/৩৪৩১; হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন) তালখিস গ্রন্থে বলা হয়েছে, যে যাবাহ দ্বারা মা হালাল হয়ে যাবে সেই যাবাহ দ্বারাই তার ভ্রূণও হালাল হয়ে যাবে ভ্রূণ তার মায়ের অনুসারী হওয়ার কারণে। কেননা ভ্রূণ তার মায়ের একটি অংশ। সুতরাং তার মাকে যাবাহ করার দ্বারা তার পুরা অঙ্কন যাবাহ হয়ে যাবে।(শারহে মিশকাতুল মাসাবিহ হা/৪০৯১-এর টিকা)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,فَإِنْ خَرَجَ حَيًّا حَيَاةً مُسْتَقِرَّةً , يُمْكِنُ أَنْ يُذَكَّى , فَلَمْ يُذَكِّهِ حَتَّى مَاتَ , فَلَيْسَ بِذَكِيٍّ ، قَالَ أَحْمَدُ : إنْ خَرَجَ حَيًّا , فَلَا بُدَّ مِنْ ذَكَاتِهِ ; لِأَنَّهُ نَفْسٌ أُخْرَى “যদি স্থিতিশীল জীবন নিয়ে জীবিত অবস্থায় বের হয় এবং জবাই করার সুযোগ পায়; কিন্তু জবাই না করে এক পর্যায়ে মারা যায়; তাহলে সে পশুটি জবাইকৃত হিসেবে গণ্য হবে না। ইমাম আহমাদ বলেন: যদি জীবিত অবস্থায় বের হয় তাহলে অবশ্যই জবাই করতে হবে। কেননা সেটি অন্য একটি প্রাণ।”(ইমাম ইবনু কুদামাহ; আল-মুগনী; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ৩২১) হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:والأضحية بالحامل جائزة , فإذا خرج ولدها ميتا فذكاته ذكاة أمه عند الشافعي وأحمد وغيرهما , سواء أشعر أو لم يشعر, وإن خرج حيا ذبح .ومذهب مالك : إن أشعر حل ، وإلا فلا .وعند أبي حنيفة لا يحل حتى يذكى بعد خروجه“গর্ভবতী পশু দিয়ে কোরবানী করা জায়েয। যদি কোরবানীর পশুর গর্ভস্থিত সন্তান মৃত অবস্থায় বের হয় তাহলে ইমাম শাফেয়ি, ইমাম আহমাদ ও অন্যন্য আলেমদের নিকট তার মায়ের জবাই করাটাই তার জবাই; চাই তার চুল গজিয়ে থাকুক; কিংবা না গজিয়ে থাকুক। আর যদি জীবিত অবস্থায় বের হয় তাহলে জবাই করতে হবে।ইমাম মালেকের মাযহাব হচ্ছে: চুল গজালে হালাল; অন্যথায় নয়। ইমাম আবু হানিফার মতে, বের হওয়ার পর জবাই করা ছাড়া সেটা হালাল হবে না।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২৬; পৃষ্ঠা: ৩০৭)
.

.
কোরবানির জন্য নির্ধারিত পশুর জবাই করার পূর্বে মারা গেলে দুটি অবস্থা হতে পারে।
(১)। কোনো ব্যক্তি যদি কোরবানির জন্য একটি পশু নির্ধারণ করেন, এরপর তাঁর কোনো অবহেলা ছাড়াই সেই পশুটি মারা যায়, সেক্ষেত্রে কোরবানি দাতার ওপর কোনো গোনাহ বা দায়িত্ব বর্তাবে না। এমনকি ঐ অবস্থায় তাঁর ওপর নতুন করে আরেকটি পশু কোরবানি করাও আবশ্যক নয়। কারণ, তা তার হাতে এক প্রকার আমানত,যা যত্ন করা সত্ত্বেও বিনষ্ট হলে তার যামানত নেই। হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,فَإِنْ تَلِفَتْ الْأُضْحِيَّةُ فِي يَدِهِ بِغَيْرِ تَفْرِيطٍ , أَوْ سُرِقَتْ , أَوْ ضَلَّتْ , فَلَا شَيْءَ عَلَيْهِ ; لِأَنَّهَا أَمَانَةٌ فِي يَدِهِ , فَلَمْ يَضْمَنْهَا إذَا لَمْ يُفَرِّطْ كَالْوَدِيعَةِ “যদি কোনো অবহেলা ব্যতিরেকে তার হাত থেকে কোরবানির পশুটি ধ্বংস হয়ে যায় কিংবা চুরি হয়ে যায় কিংবা হারিয়ে যায় সেক্ষেত্রে তার উপর কোন কিছু বর্তাবে না। কেননা পশুটি তার হাতে আমানত। যদি তার অবহেলা না থাকে সেক্ষেত্রে গচ্ছিত-রাখা সম্পদের মতো তাকে এটার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না”।(ইবনে কুদামা আল-মুগনি’ খন্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ৩৫৩; অনুরূপ ফাতওয়া দেখুন: মিরদাওয়ি এর ‘আল-ইনসাফ’ খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৭১) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:والْإِرَادَةُ الْجَازِمَةُ إذَا فَعَلَ مَعَهَا الْإِنْسَانُ مَا يَقْدِرُ عَلَيْهِ كَانَ فِي الشَّرْعِ بِمَنْزِلَةِ الْفَاعِلِ التَّامِّ : لَهُ ثَوَابُ الْفَاعِلِ التَّامِّ وَعِقَابُ الْفَاعِلِ التَّامِّ الَّذِي فَعَلَ جَمِيعَ الْفِعْلِ الْمُرَادِ حَتَّى يُثَابَ وَيُعَاقَبَ عَلَى مَا هُوَ خَارِجٌ عَنْ مَحَلِّ قُدْرَتِهِ مِثْلَ الْمُشْتَرِكِينَ والمتعاونين عَلَى أَفْعَالِ الْبِرِّ “কোন মানুষ যদি সুদৃঢ় সংকল্পের সাথে তার সাধ্যে যা কিছু করার ক্ষমতা রয়েছে তা করে তাহলে শরিয়তের দৃষ্টিতে সে ব্যক্তি পরিপূর্ণ কার্য সম্পাদনকারী ব্যক্তির সমান: পরিপূর্ণ কার্য সম্পাদনকারীর সওয়াব কিংবা শাস্তি সে ব্যক্তি পাবে; এমনকি যা তার সাধ্যের বাইরে এর জন্যেও সে ব্যক্তি সওয়াব কিংবা শাস্তি পাবে। উদাহরণস্বরূপ নেক কাজে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতাকারী ব্যক্তিবর্গ”।(ইবনু তাইমিয়াহ; মাজমুউল ফাতাওয়া; খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ৭২২-৭২৩; আরও বিস্তারিত জানতে দেখুন: মাজমুউল ফাতাওয়া; খণ্ড: ২৩; পৃষ্ঠা: ২৩৬)
.
(২)। যদি কোনো ব্যক্তি কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট করা পশুটি নিজে ধ্বংস করে কিংবা অন্য কেউ ধ্বংস করে থাকে তাহলে যে ব্যক্তি ধ্বংসের কারণ সে এর মূল্য কিংবা সমমানের পশু ক্ষতিপূরণ স্বরূপ প্রদান করবেন। অর্থাৎ নিজ অবহেলায় পশুটি মৃত্যুবরণ করার কারণে তার পরিবর্তে অন্য একটি পশু কোরবানী করা জরুরী হবে। ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন: إذَا أَتْلَفَ الْأُضْحِيَّةَ الْوَاجِبَةَ , فَعَلَيْهِ قِيمَتُهَا ; لِأَنَّهَا مِنْ الْمُتَقَوِّمَاتِ , وَتُعْتَبَرُ الْقِيمَةُ يَوْمَ أَتْلَفَهَا “যদি কেউ কোন ওয়াজিব কোরবানির পশু ধ্বংস করে তাহলে তাকে মূল্য জরিমানা দিতে হবে। কেননা পশু এমন শ্রেণীর যেটার মূল্য অনুমানযোগ্য। যেদিন পশুটিকে ধ্বংস করেছে সেই দিনের মূল্য ধর্তব্য হবে”।(ইবনে কুদামা আল-মুগনি’ খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ৩৫২; বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৭৮৫২৪)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬▬✪✪✪▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
No comments:
Post a Comment