প্রশ্ন: শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রপ্রধান তথা শাসকদের প্রশংসা করার বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’আলার জন্য। দুরুদ বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর। অতঃপর: মূলনীতি হল:”শাসকদের প্রশংসা অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই বিবেচিত হয়।” কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, শাসকদের ক্ষেত্রে এমন মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা ও তোষামোদের আশ্রয় নেওয়া হয়, যা সমাজে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা বাড়াবাড়ি সব ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর। প্রশংসার ক্ষেত্রেও তাই। অতি প্রশংসায় মিথ্যার মিশ্রণ লুকায়িত থাকে। স্বয়ং রাসূল (ﷺ) নিজের ক্ষেত্রেও অতি প্রশংসা পছন্দ করতেন না। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! আল্লাহ আমাকে যে মর্যাদা দান করেছেন, তোমরা তার চেয়ে উঁচু মর্যাদা আমাকে দাও, তা আমি পছন্দ করি না।”(মুসনাদে আহমদ, হা/১২১৪১) অপর বর্ননায় এসেছে, মিকদাদ ইবনু আসওয়াদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:إِذَا رَأَيْتُمُ الْمَدَّاحِيْنَ فَاحْثُوْا فِيْ وُجُوْهِهِمُ التُّرَابَ “যখন তোমরা প্রশংসায় বাড়াবাড়িকারীদের দেখবে, তখন তাদের মুখে মাটি নিক্ষেপ করবে।(সহীহ মুসলিম হা/৩০০২; সহীহুল জামি‘ হা/৫৭০) রাসূসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, إِيَّاكُمْ وَالتَّمَادُحَ فَإِنَّهُ الذَّبْحُ ‘তোমরা পরস্পর প্রশংসা করা থেকে বেঁচে থাক। কেননা তা হচ্ছে যব্হ করা”।(ইবনু মাজাহ, হা/৩৭৪৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১২৮৪)।
.
“দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, কিছু মানুষ শাসকদের জন্য কল্যাণ কামনায় দোয়া করাকে তাদের প্রশংসা ও গুণকীর্তনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন।” আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের একটি মূলনীতি হচ্ছে; শাসকবর্গ সৎ হোক কিংবা অসৎ,তাদের জন্য কল্যাণের দু’আ করা শরয়ী দিক থেকে ওয়াজিব।এটা যেমন নববী সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত;তেমনি এটা ছিল আমাদের ন্যায়নিষ্ঠ সালাফদের নিকট সুসাব্যস্ত নীতি।আওফ বিন মালিক থেকে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন, “তোমাদের ঐ সমস্ত আমির সর্বোত্তম, যাদেরকে তোমরা ভালোবাসো এবং তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসে, তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে এবং তোমরাও তাদের জন্য দোয়া কর।”(সহিহ মুসলিম, হা/৪৬৯৮)হাদীসটির ব্যাখায় বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:وقوله: ((ويصلون عليكم وتصلون عليهم)) الصلاة هنا بمعنى الدعاء يعني تدعون لهم ويدعون لكم) রাসূল ﷺ এর বানী:“তারা তোমাদের জন্য দোয়া করে এবং তোমরাও তাদের জন্য দোয়া কর। (এখানে সলাত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে) যার অর্থ, দোয়া করা। অর্থাৎ, তোমরা তাদের জন্য দোয়া কর, তারাও তোমাদের জন্য দোয়া করে।”(শারহু রিয়াদুস সালিহিন,খণ্ড;৩;,পৃষ্ঠা;৬৪৭) তাছাড়া শাসকদের জন্য কৃত দোয়া তাদেরকে নসিহাহ করার অন্তর্ভুক্ত। নাবী ﷺ বলেছেন, ‘সদুপদেশ দেয়াই দ্বীন।’ আমরা বললাম, ‘কার জন্য?’ তিনি বললেন, “আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিম শাসক এবং মুসলিম জনগণের জন্য।”(সহীহ মুসলিম, হা/১০০) এই হাদীসটির ব্যাখ্যায় বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:أما النصيحة لأئمة المسلمين فبالدعاء لهم والسمع والطاعة لهم في المعروف والتعاون معهم على الخير وترك الشر وعدم الخروج عليهم) “মুসলিম শাসকদের প্রতি নসিহত (উপদেশ) হলো—তাদের জন্য দোয়া করা, সৎকাজে তাদের কথা শোনা ও মানা, ভালো কাজে তাদের সহযোগিতা করা, মন্দ থেকে বিরত থাকা এবং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা।”(বিন বায; মাজমূউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ৮৭)
.
শাসকের জন্য কল্যাণের দোয়া করা—হোক সে সৎ কিংবা অসৎ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত। এটা ছিল আমাদের ন্যায়নিষ্ঠ সালাফদের নিকট সুসাব্যস্ত নীতি।প্রখ্যাত তাবি‘ তাবি‘ঈ, আহলুস সুন্নাহ’র শ্রেষ্ঠ ‘আলিম,শাইখুল ইসলাম, ইমাম ফুদ্বাইল বিন ‘ইয়াদ্ব (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৮৭ হি.] বলেছেন:لَوْ أَنَّ لِي دَعْوَةً مُسْتَجَابَةً، مَا جَعَلْتُهَا إِلاَّ فِي إِمَامٍ، فَصَلاَحُ الإِمَامِ صَلاَحُ البِلاَدِ وَالعِبَادِ “আমার যদি কবুলযোগ্য কোন দু‘আ থাকত, তবে তা আমি কেবল রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যই নির্ধারণ করতাম। কেননা রাষ্ট্রপ্রধানের কল্যাণের মাঝে দেশ ও জনগণের কল্যাণ নিহিত থাকে।”(সিয়ারু আ‘লামিন আন-নুবালা; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ১০৪; হিলইয়াতুল আলওলিয়া, খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৯১) এ কথার অর্থগত উদ্দেশ্য ‘শারহুস সুন্নাহ’য় ইমাম বারবাহারি (রাহিমাহুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন,إذا جعلتُها في نفسي لم تَعْدُني، وإذا جعلتُها في السلطان صلح فصلح بصلاحه العباد والبلاد“যদি দোয়াটি আমি আমার নিজের জন্য করি, তাহলে এটা আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, কিন্তু আমি যদি সেটা শাসকের জন্য করি তাহলে, সে সৎ হয়ে যাবে, তার সাথে সাথে জনগণ এবং নগর-রাষ্ট্রও পরিশুদ্ধ হবে।”(শারহুস সুন্নাহ লিল বারবাহারি, পৃষ্ঠা: ১১৪) এজন্য ইমাম আহমদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলতেন, (وإني لأدعو له بالتسديد والتوفيق – أي: الإمام – في الليل والنهار – والتأييد، وأرى ذلك واجباً علي)”আমি শাসকের জন্য দিবানিশি দোয়া করি, যাতে সে পরিশোধিত হয় এবং তৌফিক ও সাহায্য-সহযোগিতা পায়। আমি মনে করি এটা আমার জন্য অত্যাবশ্যক।”(সুন্নাহ লিল খাল্লাল, পৃষ্ঠা: ১৪) আহলুস সুন্নাহ’র ইমাম শাইখুল ইসলাম আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল আশ-শাইবানী (রাহিমাহুল্লাহ) জন্ম ১৬৪ হি./৭৮০ খ্রি. এবং মৃত্যু ২৪১ হি./৮৫৫ খ্রি.। বলেছেন “لو علمت أن لي دعوة مستجابة لصرفتها لولي الأمر لأن في صلاحه صلاح الرعية“আমি যদি জানতাম, আমার কোনো কবুলযোগ্য দু‘আ আছে, তাহলে অবশ্যই আমি সে দু‘আ শাসকের জন্য করতাম।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড: ২৮; পৃষ্ঠা: ৩৯১; বাদশাহ ফাহাদ প্রিন্টিং প্রেস, মাদীনাহ ছাপা; সন: ১৪২৫ হি./২০০৪ খ্রি.) ইমাম বারবাহারী (রহিমাহুল্লহ) বলেন: “وإذا رأيت الرجل يدعو على السلطان فاعلم أنه صاحب هوىً، وإذا رأيت الرجل يدعو للسلطان بالصلاح، فاعلم أنه صاحب سنة إن شاء الله “যদি তুমি কাউকে শাসকের বিরুদ্ধে বদদোয়া করতে দেখো, তাহলে জেনে রেখো সে বিদআতের অনুসারী (হাওয়ার অনুসারী)। আর যদি তুমি কাউকে শাসকের জন্য সংশোধন ও কল্যাণের দোয়া করতে দেখো, তাহলে জেনে রাখো সে সুন্নাহপন্থীদের একজন ইনশাআল্লাহ।” (শারহুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা: ১৩৬)
.
“বর্তমানে দেখা যায়, অনেকেই শাসকদের জন্য কল্যাণ কামনার দুআর পরিবর্তে অতিরিক্ত প্রশংসায় মেতে ওঠেন,আবার কেউ কেউ সীমা অতিক্রম করে সমালোচনা ও বদদোয়ার পথ বেছে নেন।” ইবনু রজব আল-হাম্বালী আল-বাগদাদী নামে প্রসিদ্ধ রাহিমাহুল্লাহ [জন্ম: ৭৩৬ হি. মৃত: ৭৯৫ হি:] বলেছেন,وكثيراً ما يمدح مَنْ لا يستحق المدح، ويلعن من لا يستحق اللّعن.”অনেকেই প্রশংসা পাবার হকদার নয়, এমন ব্যক্তির প্রশংসা করেন। আবার অনেকেই অভিশাপ পাওয়ার হকদার নন, এমন ব্যক্তিকেই অভিশাপ দেওয়া হয়।”(মাজমূ রাসায়েল ইবনু রজব; খণ্ড: ১ পৃষ্ঠা: ১১০; শারহু হাদিস লাব্বাইক, পৃষ্ঠা: ৪৭) জালেমদের প্রশংসা করা চাই তারা শাসক হোক কিংবা সাধারণ মানুষ এটা এক প্রকার জুলুম। এটি কোনোভাবেই সালাফিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। তাহলে ঐ ব্যক্তির অবস্থা কেমন হতে পারে, যে ব্যক্তি প্রশংসার মাধ্যমে আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং শেষমেশ মিথ্যা প্রশংসাকারীতে পরিণত হয়?!সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূল (ﷺ) বলেন:“একজন মানুষ এমন একটি কথা বলে ফেলে, যা আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হয়, অথচ সে তা তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনাও করে না; কিন্তু সেই কথার কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়।”(সহিহ বুখারি, হা/৬৪৭৮)
.
অন্যায় উদ্দেশ্যে শাসকের মিথ্যা প্রশংসা করা শরিয়ত বহির্ভূত কাজ। উদাহরণস্বরূপ, ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) যিনি তিনজন জালিম শাসক: মামুন, মুতাসিম এবং ওয়াসিক এর শাসনামলে জীবন অতিবাহিত করেছেন। তারা দ্বীনের বিষয়ে মানুষকে ফিতনায় ফেলেছিল, বিদআতের প্রচলন ঘটিয়েছিল এবং ‘খলকুল কুরআন’ এর মতো ভয়াবহ বিদআতের মাধ্যমে মুসলিমদের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছিল। এই অবস্থাতেও ইমাম আহমদ ও অন্যান্য উলামায়ে কেরাম ধৈর্য ধারণ করেন এবং শরিয়তসম্মত পরিসরে শাসকের কথা মানার এবং আনুগত্যের উপদেশ দিয়ে গেছেন। যদিও তারা নিজেরাও নির্যাতনের শিকার হন। তবুও কোথাও আমরা দেখতে পাই না যে, ইমাম আহমদ ঐ শাসকদের প্রশংসা করেছেন। ইমাম নাবাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,يكره في الخطبة أشياء …ثم قال: ومنها المجازفة في أوصاف السلاطين في الدعاء لهم وكذبهم في كثير من ذلك كقولهم السلطان العالم العادل ونحوه) “খুৎবায় কিছু কথা বলা অপছন্দনীয় (মাকরূহ) —অতঃপর তিনি সেখানে উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে একটি—শাসকদের জন্য দোয়া করতে গিয়ে তাদের প্রশংসায় অতিরঞ্জন করা এবং তাতে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া। যেমন বলা হয়, তিনি হলেন জ্ঞানবান ও ন্যায়পরায়ণ সরকার ইত্যাদি।”(নববী; আল-মাজমূ‘; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫২৯)
.
আল্লামাহ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আবু বুতাইন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, যেমনটি দুরারুস সানিয়্যাহ,
ফিল কুতুবিন নাজদিয়্যাহ)-তে এসেছে:ما في بعض الخطب، من الثناء والمدح بالكذب. وولي الأمر إنما يدعى له، لا يمدح لاسيما بما ليس فيه؛ وهؤلاء الذين يمدحون في الخطب، هم الذين أماتوا الدين، فمادحهم مخطئ، فليس في الولاة اليوم من يستحق المدح، ولا أن يثنى عليه، وإنما يدعى لهم بالتوفيق والهداية) “কিছু খুৎবায় যে মিথ্যাভাবে প্রশংসা ও গুণকীর্তন করা হয়। তা গ্রহণযোগ্য নয়। শাসকের জন্য দু’আ করা হবে,কিন্তু তার প্রশংসা করা হবে না;বিশেষত,এমন কিছু দিয়ে যা তার মধ্যে নেই। সুতরাং ঐ সমস্ত খতিব, যারা তাদের প্রশংসা করে, তারাই দ্বীনকে ধ্বংস করছে। তাদের প্রশংসাকারীরা ভুল করছে। আজকের দিনে এমন কোনো শাসক নেই, যে প্রশংসার হকদার, অথবা যার গুণকীর্তন করা যায়। বরং তাদের জন্য তৌফিক ও হিদায়াতের দোয়া করতে হবে।”(দুরারুস সানিয়্যাহ, ফিল কুতুবিন নাজদিয়্যাহ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৪১)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, “জনগণের সামনে শাসকের প্রশংসা করা অথবা তাতে মাত্রাতিরিক্ততা করা কি জায়েজ, না (শাসকদের ব্যাপারে) মানুষদের শুধু ধৈর্যধারণ, আনুগত্য ও বিদ্রোহ না করার আদেশ দেওয়াই যথেষ্ট?” উত্তরে শাইখ বলেন :
يلزمه الصمت وإذا أردا أنه يبين للناس يبين أن حكم الإسلام طاعة ولاة الأمور والسمع والطاعة لهم ولاة أمور المسلمين والسمع والطاعة لهم بما أمر الله به وأمر به رسوله صلى الله عليه وسلم والصبر على ما يحصل منهم من خطأ لا يصل إلى حد الكفر، نعم)
““তার জন্য কর্তব্য হচ্ছে চুপ থাকা। আর যদি সে (এই বিষয়ে) মানুষদের সামনে কিছু ব্যাখ্যা করতেই চায়, তাহলে সে যেন এটুকুই ব্যাখ্যা করে যে, ইসলামের বিধান হলো মুসলিম শাসকদের আনুগত্য করা, তাদের কথা শোনা ও মান্য করা এটি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ﷺ-এর নির্দেশ। আর তাদের পক্ষ থেকে যে ভুলত্রুটি হয়, তা যদি কুফর (অবিশ্বাস)-এর স্তরে না পৌঁছে, তাহলে সেসবের ওপর ধৈর্য ধারণ করা আবশ্যক।” (শাইখের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে লিংক: http://www.alfawzan.af.org.sa/node/14254)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ডের বর্তমান গ্র্যান্ড মুফতী প্রথিতযশা মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ আলুশ শাইখ (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৬২ হি./১৯৪৩ খ্রি.] ওকাফাতুন মাআ কালিমাতিন লি ইবনি মাসউদ রা: শিরোনামের একটি অডিওতে বলেন:
: (لكن الدعاء شيء والمدح شيء آخر. المدح لا يجوز؛ لأنه يراد به الدنيا.وأما الدعاء فيراد به صلاح الدين والدنيا والآخرة، فالدعاء مبعثه أمر شرعي لله.وأما المدح فلأهله مقاصد مختلفة، ولهذا العلماء يدعون ولا يمدحون مدحاً مطلقاً، قد يثني بعضهم بثناء خاص مقيد لظهور فائدة عمل عمله ولي الأمر؛ لكن هذا على الاستثناء ليس قاعدة مطَّردة يثني لتشجيعه على الخير وترغيبه فيه وحثه عليه.أما المدح فإنه ليس من صنيع السلف الصالح، وإنما من صنيعهم الدعاء؛ لأن الدعاء مما يرجى به صلاح دينه، وإذا صلح دين ولي الأمر صلح به شيء كثير.على الرابط التالي:
“(শাসকদের জন্য) দোয়া করা এক জিনিস, আর প্রশংসা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। প্রশংসা করা জায়েয নয়; কেননা এতে দুনিয়াবি উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। আর দোয়ার মাধ্যমে কামনা করা হয় দ্বীন, দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ। সুতরাং দু’আ হচ্ছে একটি শারঈ বিষয়। যা আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয়। অন্যদিকে প্রশংসার ক্ষেত্রে প্রশংসাকারীর বিভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে। এজন্য উলামাগণ শাসকদের জন্য দু’আ করেন, কিন্তু তাদের প্রশংসা করেন না। যদিও কখনো কখনো তাদের নির্দিষ্ট কিছু প্রশংসা করেছেন, কোনো কাজের উপকার জাহির করার জন্য, যে কাজ শাসক করেছে। কিন্তু এটা ব্যতিক্রম এবং এটা নির্ধারিত মূলনীতি নয়। তাদের প্রশংসা করেছেন, তাদেরকে ভালো কাজে উৎসাহপ্রদানের জন্য। আসলে প্রশংসা সালাফদের কর্ম ছিল না, বরং তাদের কর্ম ছিল দুয়া। কারণ দোয়ার মাধ্যমে আশা করা যায়, তার দ্বীন শুদ্ধ হবে। আর শাসকের দ্বীনে যখন পরিশুদ্ধতা আসবে, তখন তার মাধ্যমে আরও অনেক কিছুরই পরিবর্তন হবে।”
(ওকাফাতুন মাআ কালিমাতিন লি ইবনি মাসউদ; লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=Wx6-pns4y1I
·
এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, শাসকদের অযৌক্তিক বা অতিরঞ্জিত প্রশংসা করা ইসলামের শিক্ষা নয়। বিষয়টি আরও জঘন্য হয়ে ওঠে, যদি সেই শাসক অত্যাচারী হয়। এই নিকৃষ্টতা আরও বাড়ে, যখন প্রশংসা তার সামনেই করা হয়—বিশেষত যখন সে এমন একজন, যার আচরণ ও শাসনশৈলী কর্তৃত্ববাদী। হাম্মাম ইবনু হারিস (রহ.) বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সামনে তাঁর প্রশংসা করতে শুরু করলে, মিকদাদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) রাগান্বিত হয়ে হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তার মুখে কাঁকর ছুড়ে মারেন। উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি এমন করলে কেন?’ তিনি উত্তরে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি: “তোমরা যখন কারো মুখোমুখি প্রশংসাকারীদের দেখো, তখন তাদের মুখে ধুলো ছিটিয়ে দাও।” [সহিহ মুসলিম, হা/৩০০০) আমাদের ইমাম ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:المادح هو الذي يسمع منه مرة بعد أخرى لكن المداح كلما جلس عند إنسان كبيرا أو أميرا أو قاضيا أو عالما أو ما أشبه ذلك “প্রশংসাকারীর কাছ থেকে একবার দুইবার প্রশংসা শোনা যাবে। কিন্তু অধিক প্রশংসাকারী, যখনই মানুষের কাছে বসে সে বড়ো হোক, শাসক হোক, বিচারক হোক, আলেম হোক, কিংবা অন্য কেউ তখনই সে প্রশংসা করতে শুরু করে।”(ইবনু উসাইমীন; শারহু রিয়াদিস সালিহিন, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৫৬৫)
·
উল্লেখ যে, কিছু আলেম প্রশংসা বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁরা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে একে একে বৈধ বলেছেন,আবার অন্য কিছু প্রেক্ষিতে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেমন:আমাদের ইমাম বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল; কোনো ব্যক্তির উচিৎ কি তার ভাইকে সে যেসব গুণে গুণান্বিত,সে গুণের ভিত্তিতে প্রশংসা করা?
.
জবাবে শাইখ বলেন:
أو لا وهذا له أحوال
:الحال الأولى: أن يكون في مدحه خير وتشجيع له على الأوصاف الحميدة والأخلاق الفاضلة فهذا لا بأس به لأنه تشجيع تشجيع لصاحبه فإذا رأيت من رجل الكرم والشجاعة وبذل النفس والإحسان إلى الغير فذكرته بما هو فيه أمامه من أجل أن تشجعه وتثبته حتى يستمر على ما هو عليه فهذا حسن وهو داخل في قوله تعالى: {وتعاونوا على البر والتقوى}.
والثاني: أن تمدحه لتبين فضله بين الناس وينتشر ويحترمه الناس كما فعل النبي صلى الله عليه وسلم مع أبي بكر وعمر رضي الله عنهما أما أبي بكر فإن النبي صلى الله عليه وسلم كان يتحدث ذات يوم قال: ((من أصبح منكم صائما)) فقال أبو بكر: أنا. فقال: ((من تبع منكم جنازة)) قال أبو بكر: أنا. فقال: ((من عاد اليوم مريضا)) فقال أبو بكر: أنا. وذكر أشياء فقال النبي صلى الله عليه وسلم: ((ما اجتمعن في امرئ إلا دخل الجنة)). وكذلك لما حدث أنه من جر ثوبه خيلاء لن ينظر الله إليه قال أبو بكر: يا رسول الله إن أحد شقي إزاري يسترخي علي إلا أن أتعاهده فقال: ((أنك لست ممن يصنع ذلك خيلاء)). وقال لعمر: ((إن الشيطان ما سلكت فجا إلا سلك فجا غير فجك)) يعني: إذا سلكت طريقا فإن الشيطان يهرب منه ويذهب إلى طريق آخر كل هذا لبيان فضل أبي بكر وعمر رضي الله عنهما هذا لا بأس به.
الثالث: أن يمدح غيره ويغلو في إطرائه ويصفه بما لا يستحق فهذا محرم وهو كذب وخداع مثل أن يذكر رجلا أميرا أو وزيرا أو ما أشبه ذلك ويطريه ويصفه بما ليس فيه من الصفات الحميدة فهذا حرام عليك وهو أيضا ضرر على الممدوح.
الرابع: أن يمدحه بما هو فيه لكن يخشى أن الإنسان الممدوح يغتر بنفسه ويزهو بنفسه ويترفع على غيره فهذا أيضا محرم لا يجوز)
এমতাবস্থায় তার অবস্থা কয়েকরকম হতে পারে।
প্রথম অবস্থা: যদি কারো প্রশংসা করা হয় এবং তাতে কল্যাণ থাকে, যেমন ভালো গুণাবলি ও উত্তম চরিত্রে উৎসাহ প্রদান—তাহলে এতে কোনো দোষ নেই। কেননা এতে প্রশংসিত ব্যক্তিকে উৎসাহিত করা হয়। যেমন, আপনি যদি কোনো ব্যক্তির মধ্যে দানশীলতা, সাহসিকতা, আত্মোৎসর্গ ও পরোপকারিতার গুণ দেখতে পান, তাহলে তার সামনে তা উল্লেখ করতে পারেন যেন সে এতে আরও উৎসাহ পায় এবং তার উত্তম আচরণ চালিয়ে যায়। এটি একটি প্রশংসনীয় কাজ এবং আল্লাহ তাআলার এই বাণীর অন্তর্ভুক্ত:“তোমরা সৎকাজ ও আল্লাহভীতির কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করো।” (সূরা আল-মায়িদা: ২)
.
দ্বিতীয় অবস্থা: আপনি কাউকে প্রশংসা করছেন, যাতে তার মর্যাদা মানুষের কাছে প্রকাশ পায় এবং মানুষ তাকে সম্মান করে এটাও জায়েয। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর ও উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) সম্পর্কে করেছেন। একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:“তোমাদের মধ্যে আজ কে রোযাদার হয়ে সকাল করেছে?” আবু বকর (রাঃ) বললেন, “আমি।”তিনি বললেন: “কে আজ জানাজায় অংশ নিয়েছে?”আবু বকর বললেন, “আমি।” তিনি বললেন: “কে আজ অসুস্থকে দেখতে গিয়েছে?” আবু বকর বললেন, “আমি।”তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “এই গুণগুলো যার মধ্যে একত্রিত হবে, সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।”একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি অহংকার করে কাপড় ঝুলিয়ে পরে, আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না।” এ কথা শুনে আবু বকর (রাঃ) বললেন: “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাপড়ের একটি দিক অসতর্কতাবশত নিচে নেমে আসে, তবে আমি তা ঠিকঠাক রাখার চেষ্টা করি।” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “তুমি তো সে ধরনের লোক নও, যারা অহংকার করে এটা করে।” আর উমর (রাঃ) সম্পর্কে তিনি বলেন:“তুমি যে পথে চল, শয়তান সে পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে যায়।” অর্থাৎ, তুমি এমন রকম প্রতাপশালী ও আল্লাহভীরু যে, শয়তান তোমার পথ এড়িয়ে চলে।এই ধরনের প্রশংসাও বৈধ, কারণ এটি উত্তম গুণাবলি প্রসঙ্গে লোকদের জানানো এবং মর্যাদা প্রকাশের উদ্দেশ্যে।
.
তৃতীয় অবস্থা: কেউ যদি অন্য কারো প্রশংসা করে এবং তাতে বাড়াবাড়ি করে বা এমন গুণাবলি উল্লেখ করে যা তার মধ্যে নেই, তবে এটি হারাম। এটি মিথ্যা ও প্রতারণার শামিল। যেমন কেউ কোনো শাসক, মন্ত্রী বা বড় কোনো ব্যক্তির অতিরিক্ত প্রশংসা করে এবং এমন গুণাবলি তুলে ধরে যা আদৌ তার মধ্যে নেই তাহলে এটি হারাম। এ ধরনের প্রশংসা মুমিনের জন্য নিষিদ্ধ এবং এটা প্রশংসিত ব্যক্তির জন্যও ক্ষতিকর, কারণ তা তাকে ধোঁকায় ফেলতে পারে।
.
চতুর্থ অবস্থা: কাউকে তার প্রকৃত গুণাবলি দিয়ে প্রশংসা করা, কিন্তু আশঙ্কা থাকে যে এতে সে অহংকারে পতিত হবে, নিজেকে বড় মনে করতে শুরু করবে এবং অন্যদের প্রতি তুচ্ছ ভাব পোষণ করবে তাহলে এ ধরণের প্রশংসাও হারাম ও অনুচিত।”(ইবনু উসাইমীন;শারহুরিয়াদিস সালিহিন, খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৫৬৩)
·
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আমরা এটাই বুঝতে পারি যে, উলামায়ে কেরাম শাসকের প্রশংসা করতে নিরুৎসাহিত করেন বিশেষ করে যদি তা মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত হয়। বরং কোন কোন ইমামদের মতে, বর্তমান সময়ে এমন কোনো শাসক নেই, যিনি প্রকৃত অর্থে প্রশংসার যোগ্য। তবে কোনো শাসক যদি কোনো ভালো কাজ করেন, তাহলে তাকে সে কাজে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে আলেমগণ তার সে ভালো কাজটির প্রশংসা করতে পারেন। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই সঠিক নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুধাবন করার এবং তা অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◆◯◆▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
No comments:
Post a Comment