Wednesday, July 24, 2024

কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র ও জনগণের করণীয়

প্রশ্ন: কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়ে আমাদের করণীয় কী? উভয় পক্ষের দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সংঘর্ষ, অবরোধ ইত্যাদি কার্যক্রমে জন দুর্ভোগ বাড়ছে বৈ কমছে না। এ বিষয়ে শরিয়ার হুকুম কী?

উত্তর: একটি দেশে সুস্থ ও সুন্দর জীবনধারার জন্য অশান্তি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা কোনভাবেই প্রত্যাশিত নয়।

এ ক্ষেত্রে সরকারের কর্তব্য, অনতিবিলম্বে কোটা সংস্কার বিষয়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে বসে তাদের দাবী-দাওয়া আন্তরিকতার সাথে শোনা এবং অতি দ্রুত সুষ্ঠু সমাধানের পথ বের করা ও সংকট নিরসনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যদি তাদের দাবি-দাওয়া সঠিক ও ন্যায় সঙ্গত হয় তবে তা মেনে নেওয়া। অন্যথায় তাদের নিকট যৌক্তিকভাবে তাদের দাবীর অন্যায্যতা ও অসারতা ব্যাখ্যা করা অথবা আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা।

কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে ছাত্রদেরকে ব্যঙ্গোক্তি ও উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলে খেপিয়ে তোলা কোন শাসকের জন্য গ্রহণযোগ্য আচরণ হতে পারে না। এর দ্বারা দেশে হিংসাত্মক কার্যক্রম, রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

অনুরূপ ভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেশে সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং সর্বসাধারণের নিরাপত্তা বিধান করা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেই নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের রক্ত ঝরছে। ইতোমধ্যে নিহত হয়েছে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। আহত হয়েছে, কয়েক শত। হাসপাতালের শয্যায় মৃত্যুর প্রহর গুনছে অনেকে।

একজন নিরস্ত্র প্রতিবাদ কারী শিক্ষার্থীকে দু হাত উপরে উত্তোলিত অবস্থায় সামনে থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এটা কোনও দায়িত্বশীল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ হতে পারে না। প্রয়োজন বোধে তাকে অন্যভাবে সরানো‌ যেত।

আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, সরকার দলীয় ক্যাডার বাহিনী লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। হাসপাতালে আহত রোগীদের উপর আক্রমণ করছে। অথচ সেখানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্যাতিতদের সাহায্যে এগিয়ে না এসে তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে প্রশাসনের এহেন ভূমিকা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আর ছাত্রদের উচিত, কোন ধরনের ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও জানমালের ক্ষতি হয় এমন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা এবং শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের কাছে তাদের দাবি তুলে ধরা, গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা, জনমত সৃষ্টি করা, সভা, সেমিনার, লেখালেখি, সোশ্যাল মিডিয়া, টকশো, স্মারকলিপি প্রদান‌ ইত্যাদি বিভিন্নভাবে কোটা সংস্কারের যৌক্তিকতা তুলে ধরা। আদালতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া।

এত কিছুর পরও সরকার দাবি পূরণে সম্মত না হলে ধৈর্যের সাথে বিকল্প পন্থা খুঁজবে, ইমানদারগণ সমস্যার সমাধানের জন্য মহান আল্লাহর নিকট দুআ করবে ও অন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে কিন্তু কোনভাবেই ফিতনা-ফ্যাসাদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অবকাশ নেই। কোন এমন পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না যাতে সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরে। কেননা ইসলাম তা সমর্থন করে না।

❑ দাঙ্গাহাঙ্গামা, মারামারি-কাটাকাটি ও রক্তপাত সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?

ইসলামে সমাজে ফেতনা-ফ্যাসাদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং জি**হাদের ময়দা ছাড়া র**ক্তপাত ও দাঙ্গাহাঙ্গামাকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে।

এ মর্মে কয়েকটি হাদিস পেশ করা হলো:

✪ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেন,

« إنَّ دِماءكُمْ ، وَأمْوَالَكُمْ ، وأعْرَاضَكُمْ ، حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا »

“নিশ্চয়ই তোমাদেল পরস্পরের রক্ত (জীবন), ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম ও সম্মানের যোগ্য, তোমাদের আজকের এ দিনের সম্মানের মতই।” [বুখারী, হাদিস নং ১০৫; মুসলিম, হাদিস নং ৪৪৭৭]

✪ তিনি আরও বলেন,

« كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ : دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ »

“প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির রক্ত (জীবন), ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান অপর সব মুসলিমের জন্য হারাম।” [মুসলিম, হাদিস নং ৬৭০৬]

✪ তিনি আরও বলেছেন,

« سِبَابُ المُسْلِمِ فُسُوقٌ ، وَقِتالُهُ كُفْرٌ »

“মুসলিম ব্যক্তিকে গালি দেওয়া পাপ এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করা কুফরি।” [বুখারী, হাদিস নং ৬৬৬৫; মুসলিম, হাদিস নং ২৩০]

❑ অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করার ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি কী?

আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি,

مَنْ رَأَى مِنْكُم مُنْكراً فَلْيغيِّرْهُ بِيَدهِ ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطعْ فبِلِسَانِهِ ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبقَلبهِ وَذَلَكَ أَضْعَفُ الإِيمانِ

“তোমাদের কেউ যখন কোন অন্যায় দেখবে তখন সে যেন তা হাত দ্বারা (শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে) পরিবর্তন করে দেয়। যদি সে সে সামর্থ্য না রাখে তাহলে যেন মুখ দিয়ে পরিবর্তন করে (মুখে প্রতিবাদ করে)। যদি এ সামর্থ্যও না থাকে তাহলে যেন অন্তরে তাকে ঘৃণা করে (এবং মনে মনে ভিন্ন পন্থায় তা প্রতিহত করার পরিকল্পনা আঁটতে থাকে)। আর এটি হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতার স্তর।” [সহিহ মুসলিম]

এ হাদিসে অন্যায় প্রতিহত করার তিনটি স্তর বলা হয়েছে। এ তিনটি মধ্যে ১ম স্তরটি অর্থাৎ হাত দ্বারা বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তন করা এর পরের দুটি স্তর থেকে নি:সন্দেহ অধিক উত্তম। তবে তা শক্তি-সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ যদি কারও অন্যায় প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি-সামর্থ্য থাকে তাহলে তা ব্যবহার করে অন্যায় পরিবর্তন করবে। আর এটি হল শক্তিশালী মুমিনের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সে শক্তি না থাকলে মুখে (যেমন: মৌখিকভাবে সরাসরি প্রতিবাদ করা, বক্তৃতা, সভা-সেমিনার, টকশো, সামাজিক মাধ্যম, লেখালেখি, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার ইত্যাদি মাধ্যমে) প্রতিবাদ করবে। সে সুযোগ না থাকলে অন্তরে উক্ত অন্যায় কর্মের প্রতি ঘৃণা পোষণ করবে এবং বিকল্প পন্থায় অন্যায় প্রতিহত করার সুযোগ খুঁজবে। অন্যায়ের প্রতিবাদে এই ধারাবাহিকতা লঙ্ঘন করা যাবে না।

❑ দেশে সংঘাত ও হানাহানি পরিবেশ কতটা ক্ষতিকর?

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট সংঘাত, হানাহানি, কাটাকাটি ও রক্তপাত আমাদের একতা, সংহতি ও শক্তিকে বিনষ্ট করবে যা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে। কেননা শত্রুরা এমন ফিতনা-সংকুল ও বিশৃঙ্খল পরিবেশের অপেক্ষায় থাকে।

অরাজক পরিস্থিতি দেশের সাধারণ জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে, দেশের অর্থনীতিতে ধ্বস নামে, দেশের সার্বিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে, সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষুধা-দারিদ্র, হাহাকার ও অশান্তি বৃদ্ধি করে, শিক্ষা, গবেষণা, দ্বীন চর্চা, দাওয়াতি কার্যক্রম ইত্যাদি সব কিছুই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অবশ্য আমাদের দেশে তথাকথিত গণতন্ত্র না আছে সরকারের মধ্যে, না আছে জনগণের মধ্যে। বরং এখানে বিশৃঙ্খলা করাটাই যেন নিয়ম। এটাই যেন গণতন্ত্রের ভাষা।
বাস্তবতা হলো, যেমন জনগণ তেমন সরকার। যে দেশের অধিকাংশ মুসলিম ইসলামি আদর্শ ও রীতি-নীতি এবং ইসলাম চর্চা থেকে দূরে চলে যায় আল্লাহ তাদের উপর আজাব হিসেবে জালিম শাসককে চাপিয়ে দেন।

সুতরাং এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় আল্লাহর দ্বীনের পথে আমাদেরকে ফিরে আসতে হবে এবং সব ধরণের পাপাচার ও আল্লাহর নাফরমানি থেকে তওবা করতে হবে। অন্যথায় এহেন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।

আমাদের কর্তব্য, সর্ব প্রকার পাপাচার, আল্লাহর নাফরমানি, শিরক, বিদআত, মুনাফেকি, নৈতিক স্খলন, জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার, অধিকার হরণ, দুর্নীতি ইত্যাদি থেকে আল্লাহর নিকট তওবা করা এবং নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো। তাহলে আল্লাহও আমাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবেন। অন্যথায় পরিবর্তনের আশা করা দূরাশা ছাড়া কিছু নয়।

✪ আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ اللَّـهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ

“আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। (অর্থাৎ পাপ-পঙ্কিলতা ও আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে ফিরে আসে)।” [সূরা রা’দ: ১১]

✪ তিনি আরও বলেন,

ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّـهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِّعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ

“তার কারণ এই যে, আল্লাহ কখনও পরিবর্তন করেন না সে সব নেয়ামত, যা তিনি কোন জাতিকে দান করেছিলেন, যতক্ষণ না সে জাতি নিজেই পরিবর্তিত করে দেয় নিজের জন্য নির্ধারিত বিষয়।” [সূরা আনফাল: ৫৩]

আল্লাহ এই সরকার, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাধারণ জনগণকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং দেশে ফিতনার আগুন নির্বাপিত করে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার। সৌদি আরব

No comments:

Post a Comment

Translate