عن عَبْد الرَّحْمَنِ بْن سَمُرَةَ -رضي الله عنه- أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم- قال له: «يا عبد الرحمن بن سَمُرَة، لا تَسْأَلِ الإِمَارَةَ؛ فإنك إن أُعْطِيتَها عن مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إليها، وإن أُعْطِيتَهَا عن غير مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عليها، وإذا حَلَفْتَ على يمينٍ فرأيتَ غيرها خيرًا منها، فَكَفِّرْ عن يمينك، وَأْتِ الذي هو خير».
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরকারী পদ চেয়ে নেওয়া থেকে নিষেধ করেছেন। কারণ, যাকে পদ চাওয়ার কারণে তা দেওয়া হয়, লাঞ্চিত হয় এবং দুনিয়ার প্রতি আগ্রহী হওয়া এবং আখিরাতের ওপর তাকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর যদি না চাওয়া সত্বেও তা দেওয়া হয় আল্লাহ তার ওপর তাকে সাহায্য করেন। কোন কিছুর ওপর সপথ করা কোনো কল্যাণকর কাজের জন্য বাধা হবে না। যদি কোন ব্যক্তি সপথ ভিন্ন অন্য কিছুতে কল্যাণ দেখে, তখন সে কাফফারা আদায়ের মাধ্যমে সপথ থেকে রেহাই নিবে এবং কল্যাণকর কাজটি করবে।
ব্যাখ্যা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন আল্লাহ আমীরের ভালো চান। এখানে এরাদা (অর্থাৎ চাওয়া) দ্বারা উদ্দেশ্য ইরাদায়ে কাওনী. কাদারী (অর্থাৎ পার্থিব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট তাকদীর)। এ কারণেই তাতে—এই চাওয়াতে— ভালো ও মন্দ একাধিক বিষয় রয়েছে। কারণ, আল্লাহ কখনো এই এরাদাকে মহব্বত করে এবং কখনো তাকে ঘৃণা করেন। ফলে এই ইরাদাহ ব্যাপকতার কারণে ইরাদায়ে শর‘ঈয়াহ যাকে আল্লাহ মহব্বত করেন তাকও সামিল করে। আর এ কল্যাণকে এ বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, আমীরের জন্য একজন সত্যবাদী ওযীরের তাওফীক দেওয়া যাতে দুনিয়া আখিরাত উভয় জাহানে তার কল্যাণ হয়। এমনিভাবে এর ব্যখ্যা জান্নাত দ্বারাও করা হয়ে থাকে। তার বাণী: “সত্যবাদী মন্ত্রী নিয়োজিত করেন” আল্লাহ তা‘আলা তার কথা, কাজে, প্রকাশ্যে ও গোপনে একজন সত্যবাদী মন্ত্রী নিযুক্ত করেন। এখানে তাকে সততার দিকে নিসবত করা হয়েছে। কারণ, সাথী হওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে সততাই মূল। “যদি আমীর ভুলে যায়”—ভুলে যাওয়া মানুষের স্বভাব—অর্থাৎ, যদি আমীর প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো ভুলে যায় অথবা শর‘ঈ কোন বিধানের বিষয়ে অজ্ঞ থাকে অথবা কোন অত্যাচারিত লোকের ফায়সালা অথবা জন কল্যাণকর কোন বিষয় ভুলে গেছে তা এ সৎ মন্ত্রী স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তাকে দিক নির্দেশনা দেয়। আর যদি আমীরের স্মরণ থাকে, তবে সে তাকে কথা, কাজ বা মতামত দিয়ে সাহায্য করে। আর যদি তার সাথে অন্য কিছু অর্থাৎ অমঙ্গল ইচ্ছা করেন, এভাবে ব্যক্ত করা দ্বারা খারাপ কর্ম থেকে বিরত থাকার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। কারণ, যখন সে খারাপ কর্ম ঘৃণিত বা মন্দ হওয়ার কারণে তার নাম নেওয়া থেকেই বিরত থাকে, তাহলে খারাপ কর্ম থেকে বিরত থাকা আরও অধিক শ্রেয়। আর এখানে ইসম ইশারাহ যালিকা যা দূরের অর্থ বুঝায় নিয়ে আসা দ্বারা, ভালো কর্ম মহান, তার মর্যাদা উচ্চ হওয়া এবং তা তালাশ করা ও লাভ করতে স্বচেষ্ট হওয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদানের ইশারা করা হয়েছে। ফলাফল হল, “তার জন্য অসৎ মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়”। অর্থাৎ, কথা কর্মে উল্লেখিত গুণের বিপরীত। যদি সে ভুলে যায় তখন সে প্রয়োজনীয় বিষয় ছেড়ে দেয়। সে তা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় না। কারণ, তার অন্তরে নূর নেই যা তাকে তার ওপর উঠাবে। আর যদি স্মরণ থাকে তাকে সাহায্য করে না। বরং তার স্বভাব ও কর্ম খারাপ হওয়ার কারণে তাকে তা থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করে।
নবী ‘আলাইহিস সালাম বলেছেন যে, আল্লাহ যাকেই নবী হিসাবে প্রেরন করেন এবং খলীফা হিসাবে নিযুক্ত করেন, তার জন্য দু’জন করে (একান্ত) সঙ্গী থাকে। একজন ভালো সঙ্গী যে তাকে ভালো কাজের নির্দেশ দেয় এবং তাকে তৎপ্রতি অনুপ্রাণিত করে। আর একজন খারাপ সঙ্গী যে তাকে মন্দ কাজের পরামর্শ দেয় এবং তৎপ্রতি উৎসাহিত করে। অকল্যাণকর সঙ্গী থেকে সেই নিষ্পাপ থাকে যাকে আল্লাহ রক্ষা করেন।
ব্যাখ্যা
নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেন যে, অত্যাচারী বাদশাহর নিকট হক কথা বলা সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ। কারণ হতে পারে এ কারণে সে তার থেকে প্রতিশোধ নেবে এবং তাকে কষ্ট দেবে।
ব্যাখ্যা
সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে শোনা এবং আনুগত্য করার ওপর বাইয়াত গ্রহণ করেন। কারণ, আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর আর রাসূল ও ক্ষমতাশীলদের আনুগত্য কর”। [সূরা নিসা, আয়াত: ৫৯] আর রাসূলের পরে কর্তৃত্বকারী দ্বারা দুটি জামাত উদ্দেশ্য। আলেমগণ ও শাসকগণ। তবে আলেমগণ ইলম ও বয়ানের অভিভাবক আর শাসকগণ বাস্তবায়ন ও ক্ষমতা প্রয়োগের অভিভাবক। তিনি বলেন, আমরা শ্রবণ ও আনুগত্য করার ওপর বাইয়াত করি। আর তার বাণী: আরামে ও কষ্টে। অর্থাৎ চাই জনগণ সম্পদশালী হোক বা অভাবী এবং ফকীর হোক বা ধনী হোক সকল জনগণের ওপর ওয়াজিব হলো তারা তাদের ক্ষমতাশীলদের আনুগত্য করবে এবং তাদের কথা মানবে। অনুরুপভাবে আগ্রহে ও অনাগ্রহে। অর্থাৎ, জনগণ সেটা অপছন্দ করুক যেহেতু তাদেরকে এমন বিষয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যা তারা চায় না ও পছন্দ করে না অথবা তারা সেটা সাদরে গ্রহণ করে নিক যেহেতু তাদেরকে তাদের পছন্দ ও ইচ্ছার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। “আমাদের উপর (অন্যদেরকে) প্রাধান্য দেওয়ার অবস্থায় আমরা তাঁর পূর্ণ আনুগত্য করব”। অর্থাৎ ক্ষমতাশীলগণ যদি প্রজাদের ওপর রাষ্টীয় সম্পদ ইত্যাদিতে নিজেদের প্রাধান্য দেয় এবং তার দ্বারা তারা নিজেরা আনন্দ-ফুর্তি করে আর যাদের ওপর তাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাদেরকে বঞ্চিত করে, তবুও তাদের কথা শোনা ও আনুগত্য করা ওয়াজিব। তারপর বলেন, “রাষ্ট্র নেতার বিরুদ্ধে তার নিকট থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার লড়াই করব না”। অর্থাৎ, আল্লাহ ক্ষমতাশীলদের আমাদের ওপর যে ক্ষমতা দিয়েছেন তাদের থেকে সে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা জগড়া করবো না। কারণ, এ ধরনের বিবাদ বড় বির্পয়, মহাফিতনা এবং মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি নিয়ে আসবে। উম্মতে মুসলিমাহ উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ক্ষমতাশীলদের সাথে বিবাদ করার কারণেই ধ্বংস হয়েছে। তিনি বলেন, যতক্ষণ না তোমরা (তার মধ্যে) প্রকাশ্য কুফরী দেখ, যে ব্যাপারে তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে দলীল রয়েছে। চারটি শর্ত যখন আমরা দেখতে পাব এবং চারটি শর্ত যখন পূর্ণ হবে তখন আমরা তাদের বিরোধিতা করব এবং তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করব। প্রথম শর্ত: তাদের বিষয়ে নিশ্চিতভাবে জানা, শুধু ধারণার বসবতী হয়ে তাদের আনুগত্য থেকে বের হওয়া বৈধ নয়। দ্বিতীয় শর্ত: তাদের থেকে কুফর সম্পর্কে অবগত হওয়া ফাসেকী নয়। শাসকদের থেকে ফাসেকী পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বৈধ নয়। যদিও তারা মদ পান করে, ব্যভিচার করে এবং মানুষের ওপর জুলুম অত্যাচার করে। তবে যদি তাদের থেকে কোন সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য কুফরী পাওয়া যায় তখন বিদ্রোহ করা যাবে। তৃতীয় শর্ত: স্পষ্ট কুফর। তবে যদি কোন ব্যাখ্যা বা বর্ণনার সম্ভাবনা থাকে তখন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বৈধ হবে না। অর্থাৎ যদি দেখি তারা এমন কোন কর্ম করেছে যাকে আমরা কুফর বিবেচনা করছি; অথচ তাতে কুফর না হওয়ারও সম্ভাবনা আছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বা তাদের সাথে বিবাদ করা বৈধ নয়। কিন্তু যদি তা সু স্পষ্ট কুফর হয় যেমন, সে জনগণের জন্য ব্যভিচার করা ও মদ পান করাকে বৈধ করল। চতুর্থ শর্ত: তোমাদের নিকট আল্লাহ পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে। আমাদের নিকট অকাট্য প্রমাণ রয়েছে যে, তা কুফর। তবে যদি প্রমান সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্র দুর্বল হয় বা বুঝার ক্ষেত্র দুর্বল হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বৈধ নয়। কারণ, শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাতে অনেক খারাবী ও অনিষ্টতা আছে। আর যখন আমরা তাদের থেকে এ সব দেখতে পাবো, তখন যতক্ষণ পর্যন্ত তা দূর করার ক্ষমতা আমাদের না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিরোধিতা করা যাবে না। আর যদি আমাদের কোন ক্ষমতা না থাকে তবে তাদের বিরোধিতার করা বৈধ নয়। কারণ, হতে পারে জনগণ যখন তাদের বিরোধিতা করবে; অথচ তাদের হাতে কোন ক্ষমতা নেই, তখন সে অবশিষ্ট ভালোর অপর ক্ষমতা চালাবে। তখন তার ক্ষমতা আরও পূর্ণতা লাভ করবে। সক্ষমতা থাকার শর্তে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার উপরোক্ত শর্তগুলোর ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে বের হওয়া জায়েয অথবা ওয়াজিব। যদি সক্ষমতা না থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জায়েয নেই। কারণ, এটি হবে আত্মঘাতী—নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া। কারণ, তখন বিদ্রোহ করে কোন লাভ নেই।
ব্যাখ্যা
শাকীক ইবনে সালামা-রাহিমাহুল্লাহ- বলেন, ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু প্রত্যেক বৃহস্পতিবারে আমাদেরকে নসীহত শুনাতেন। একটি লোক তাঁকে নিবেদন করল, আমরা পছন্দ করি যে, আপনি আমাদেরকে প্রত্যেক দিন নসীহত শুনান। তিনি বললেন, আমাকে এতে যে বিষয়টি বারণ করছে, তা হলো আমি তোমাদেরকে বিরক্তি ও সংকোচে ফেলতে অপছন্দ করি। আমি নসীহতের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি ঠিক ঐভাবে লক্ষ্য রাখছি, যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বিরক্ত হবার আশংকায় উক্ত বিষয়ে আমাদের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন।’ কারণ, বিরক্তির সময় নসীহত করা দ্বারা কোন উপকার হয় না।
ব্যাখ্যা
এ হাদীসটি হিরাকলের সাথে আবূ সুফিয়ান সাখার ইবন হারবের প্রসিদ্ধ হাদীস। আবূ সুফিয়ান তখন মুশরিক ছিল, কারণ তিনি শেষে ইসলাম গ্রহণ করেছেন হুদাইবিয়্যাহ ও মক্কা বিজয়ের মাঝামাঝি সময়ে। আবূ সুফিয়ান ও তার সাথে কুরাইশের একটি জামাত শিরিয়ায় হিরাকলের নিকট আগমন করে। এ সময়ে হিরাকল ছিল খৃষ্টানদের বাদশাহ। সে তাওরাত ও ইনজিল অধ্যয়ন করে ছিল এবং পূর্বের আসমানী কিতাবসমূহ সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল এবং একজন মেধাবী ও বিচক্ষণ বাদশাহ ছিল। যখন তিনি শুনতে পেলেন যে, আবূ সুফিয়ান ও তার সাথীরা হিজায থেকে আগমন করেছে তখন তিনি তাদের ডেকে পাঠালেন। আর তিনি তাদের রাসূলের অবস্থা, তার বংশ, সাথী ও তার প্রতি তাদের সম্মান এবং প্রতিশ্রুতি পূর্ণতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। সে যখনই কোন কিছু উল্লেখ করে তারা তাকে তা অবহিত করে এবং সে বুঝতে পারে যে, তিনিই সেই নবী যার সম্পর্কে পূর্বের আসমানী কিতাবসমূহ খবর দিয়েছে। কিন্তু সে তার রাজত্ব নিয়েই আঁকড়ে থাকে। ফলে আল্লাহর কোন হিকমতের কারণে সে ইসলাম গ্রহণ করেনি। আবূ সুফিয়ানকে সে যা জিজ্ঞাসা করল তার মধ্যে ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কি বিষয়ে আদেশ করেন। তখন আবু সুফিয়ান তাকে জানান যে, তিনি তাদের আল্লাহর ইবাদত করতে, তার সাথে কাউকে শরীক না করতে ও গায়রুল্লাহের ইবাদত না করতে নির্দেশ দেন। না কোন ফিরিশতা, রাসূল, গাছ, পাথর, সূর্য, চন্দ্র বা অন্য কিছু, ইবাদত কেবল এক আল্লাহর জন্য। আর এটিই হলো রাসূলগণের দাওয়াত। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে দাওয়াত নিয়েই এসেছেন যে দাওয়াত নিয়ে তার পূর্বে নবীগণ এসেছিলেন। অর্থাৎ ইবাদত কেবল আল্লাহর ইবাদত করা যিনি একক তার কোন শরীক নেই। আর তিনি বলেন, “তোমরা তোমাদের বাপ দাদাগণ যার ওপর আছে তা পরিত্যাগ কর”। এটিই ছিল সত্যের ঘোষণা। তাদের বাপ দাদা যেসব মুর্তির উপাসনা করত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সেসব ছাড়ার নির্দেশ দেন। আর তাদের বাপ দাদার মধ্যে যে সব উন্নত চরিত্র ছিল তা ছাড়ার তিনি নির্দেশ দেননি। তার বাণী: “তিনি আমাদের সালাতের নির্দেশ দিতেন”। সালাত হলো বান্দা ও তার রবের মাঝে সম্পর্কের সেতু বন্ধন। শাহাদাতাইনের পর সেটি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকন। এ দ্বারা একজন মুমিন কাফির থেকে পৃথক হয়। সালাতই হলো আমাদের মাঝে এবং কাফের মুশরিকদের মাঝে চুক্তি। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন। আমাদের মাঝে ও তাদের মাঝে বন্ধন হলো সালাত যে ব্যক্তি সালাত ত্যাগ করল সে কাফের হয়ে গেল। আর তিনি আমাদের সততার নির্দেশ দেন”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতকে সত্য কথা বলার নির্দেশ দিতেন। এটি আল্লাহর বাণীর মতো, “হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর আর তোমরা সত্যবাদীদের সাথে থাকো”। [সূরা তাওবাহ, আয়াত: ১১৯] সত্য কথা বলা একটি উন্নত চরিত্র। এটি দুই ভাগে বিভক্ত: আল্লাহর সাথে সততা আর আল্লাহর বান্দাদের সাথে সততা। উভয়টিই উন্নত চরিত্র। আর তার বাণী: “পবিত্রতা”। পবিত্রতা দুই প্রকার: লজ্জাস্থানের চাহিদা থেকে পবিত্রতা, আর পেটের চাহিদা থেকে পবিত্রতা। আর প্রথম প্রকার পবিত্রতা যেমন একজন মানুষের যিনা ও উপকরণ যা হারাম করা হয়েছে তা থেকে দূরে থাকা। আর দ্বিতীয় প্রকার পবিত্রতা: আর সেটি হলো পেটের চাহিদা থেকে বিরত থাকা। অর্থাৎ, মানুষের হাতে যা আছে তা থেকে বিরত থাকা ও তাদের নিকট না চাওয়া। যেমন সে কোন মানুষের নিকট কোন কিছু চায় না। কারণ, চাওয়া বেঈজ্জতী। ভিক্ষুকের হাত নিকৃষ্ট ও নিম্ন মানের। আর যে দান করে তার হাত উঁচা ও সম্মানী। সুতরাং নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কারো কাছে কোন কিছু চাওয়া উচিত নয়। আর পঞ্চম: তার বাণী “আত্মীয়তা রক্ষা” সম্পর্ক। আল্লাহ তা‘আলা যে সব আত্মীয়ের সাথে সু সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তাদের সাথে সু সম্পর্ক বজায় রাখা। আর তাদের মধ্যে সবোর্চ্চ হলো মাতা-পিতা। কারণ, মাতা-পিতার সাথে সু সম্পর্ক সৎ কর্ম ও সত্যিকার সু-সম্পর্ক। আত্মীয়দের সাথে সু সম্পর্ক যে যতটুকু কাছের সে অনুযায়ী রাখতে হবে। যেমন, ভাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ চাচা থেকে আর চাচা অধিক গুরুত্বপূর্ন বাপের চাচা থেকে। আর আত্মীয়তা বজায় রাখা এমন সব কর্ম দ্বারা বাস্তবায়ন করতে হয় যা মানুষের নিকট পরিচিত ও প্রসিদ্ধ।
ব্যাখ্যা
বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা আমীরুল মু‘মিনীন উমার উবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনুহর ঘটনা আমাদের বর্ণনা করেন। উয়াইনাহ ইবন হিসন যিনি তার সম্প্রদায়ের বয়স্কদের একজন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট আসেন। তিনি প্রথমেই কটু বাক্য,গাল মন্দ ও অশালীন কথা বলেন। তারপর এ বলে তাকে ভৎসণা করেন যে, তুমি আমাদের বেশি বেশি দান করো না এবং আমাদের মাঝে ইনসাফ করো না। তার কথায় তিনি এতো বেশি ক্ষুব্ধ হলেন যেন তিনি তাকে মারার উপক্রম। কিন্তু কতক ক্বারী যাদের মধ্যে রয়েছেন উয়াইনাহর ভাই হুর ইবন কায়েস তারা খলীফাকে সম্বোধন করে বললেন, হে আমীরুল মু‘মীনিন, আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে বলেছেন, “তুমি ক্ষমাশীলতার পথ অবলম্বন কর। ভাল কাজের আদেশ প্রদান কর এবং মূর্খদিগকে পরিহার করে চল।” (সূরা আল আ’রাফ, আয়াত: ১৯৮) আর এতো মূর্খদের একজন।’ তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একটুকুও আগে বাড়লেন না। কারণ, তিনি আল্লাহর কিতাবের কাছে (অর্থাৎ, তাঁর নির্দেশ শুনে) সঙ্গে-সঙ্গে থেমে যেতেন। তার কানের সামনে আয়াতটির তিলাওয়াত শোনে তিনি সাথে সাথে থেমে গেলেন তাকে কোন প্রকার মারধর করলেন না। আল্লাহর কিতাবের সামনে এটিই ছিল সাহাবীগনের শিষ্টাচার। তারা তার আগে কখনো বাড়তেন না। যদি তাদের বলা হতো এটি আল্লাহর বাণী তাহলো তারা যে অবস্থায় থাকতেন সে অবস্থায় থেমে যেতেন।
ব্যাখ্যা
এ হাদীসটিতে শাসকদের সাথে সম্পৃক্ত একটি মহান বিষয়ের ওপর সতর্ক করা হয়েছে। আর সেটি হলো শাসকদের জুলুম করা ও জনগণকে বাদ দিয়ে সম্পদ আত্মসাৎ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দেন যে, মুসলিমদের ওপর এমন কতক ক্ষমতাশীল আসবে তারা মুসলিমদের সম্পদকে নিজেদের সম্পদ মনে করবে, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যয় করবে এবং মুসলিমদেরকে তাদের হক থেকে বিরত রাখবে। এটি হবে এসব শাসকগোষ্ঠী থেকে আত্মসাৎ ও জুলুম। যে সম্পদে মুসলিমদের অধিকার রয়েছে তাতে তারা আত্মসাৎ করবে এবং মুসলিমদের বাদ দিয়ে তাদের সম্পদ তারা নিজেরা এককভাবে ভক্ষণ করে। কিন্তু সন্তুষ্টি-প্রাপ্ত সাহাবীগণ যালিমদের সম্পর্কে নয়, নিজেদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা কামনা করেন। তারা বলেন, আপনি আমাদের কি নির্দেশ দেন? এটি তাদের জ্ঞানের পরিচায়ক। রাসূলুল্লাহ বলেন, তোমাদের ওপর যে দায়িত্ব তোমরা তা আদায় করবে। অর্থাৎ, তাদের আত্মসাৎ করা যেন তোমাদের ওপর তাদের কথা শোনা ও মানা, তাদের বিরোধিতা না করা এবং তাদের ক্ষেত্রে ফিতনায় না পড়া ইত্যাদি যে দায়িত্ব রয়েছে তা থেকে যেন তোমরা বিরত না থাক। বরং তোমরা সবর কর, শোন এবং আনুগত্য কর। আল্লাহ তাদের যে ক্ষমতা দিয়েছে তাতে তোমরা বিবাধ করো না। আল্লাহর নিকট চাও যা তোমাদের পাওনা। অর্থাৎ তোমাদের যে হক রয়েছে তা আল্লাহর কাছে চাও। অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে দো‘আ কর যেন, আল্লাহ তাদের সঠিক বুঝ দান করে যাতে তারা তাদের ওপর তোমাদের যে হক রয়েছে তা আদায় করেন। এটি রাসূলের হিকমত। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম জানতেন নফস তার অধিকার বিষয়ে ছাড় দেয় না। যারা তার অধিকার ছিনিয়ে নেয় তার প্রতি সে কখনো সন্তুষ্ট হয় না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি বিষয়ের প্রতি দিক নির্দেশনা দেন যাতে রয়েছে কল্যাণ এবং যার কারণে দূরীভূত হয় অন্যায় ও খারাবী। আর তা তখনই সম্ভব যখন আমাদের ওপর আনুগত্য করা ও তাদের কথা মানার দায়িত্ব আদায় করব এবং তাদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হবো না। আর আমাদের পাওনা আল্লাহর কাছে চাইব।
ব্যাখ্যা
সম্মানীত এ ঘরের জন্যে রয়েছে সম্মান ও মর্যাদা। এ গৃহটি আল্লাহর ইবাদত এবং তাঁর সমীপে বিনয় ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশের নিদর্শন। ফলে মানুষের বক্ষে এ ঘরের ব্যাপারে রয়েছে ভীতি। অন্তরে রয়েছে সম্মানবোধ, এ ঘরের সাথে সম্পর্ক ও ভালোবাসা। এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজীদেরকে সবশেষে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করে বিদায় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সর্বশেষ এ তাওয়াফটি বিদায়ী তাওয়াফ বলা হয়। কিন্তু হায়েযগ্রস্ত মহিলাদের জন্য এ তাওয়াফ মাফ করা হয়েছে। যেহেতু তারা হায়েয অবস্থায় অপবিত্র থাকায় মসজিদে প্রবেশ করলে তা নোংরা হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় তাদের থেকে বিদায়ী তাওয়াফ ফিদিয়া ব্যতীতই মাফ করে দেওয়া হয়েছে। এ বিধানটি হজের ব্যাপারে প্রযোজ্য, উমরার ব্যাপারে নয়। তাইসীরুল ‘আল্লাম, 434পৃ; তাম্বীহুল আফহাম, 2/584 ও তা’সীসুল আহকাম, 3/436।
ব্যাখ্যা
আবূ যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সংবাদ দেন, একদা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, “আমি তোমাকে দুর্বল দেখছি এবং আমি তোমার জন্য তাই ভালবাসি, যা আমি নিজের জন্য ভালবাসি। (সুতরাং) তুমি অবশ্যই দু’জনের নেতা হয়ো না এবং এতীমের মালের তত্ত্বাবধায়ক হয়ো না।” এ চারটি বাক্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ যারকে বলেন, প্রথম: তাকে তিনি বলেন, আমি তোমাকে দুর্বল দেখছি। এ বিশেষণটি ছিল বাস্তব সম্মত, তার ভিত্তিতে তাকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। কোন লোককে এ ধরনের কথা বলাতে কোন অসুবিধা নেই যখন তা হবে কল্যাণের উদ্দেশ্যে খাট করা বা দোষারোপের উদ্দেশ্যে নয়। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাকে দুর্বল দেখছি। দ্বিতীয় বাক্য: তিনি বলেন, আমি তোমার জন্য তাই ভালোবাসি যা আমি আমার নিজের জন্য পছন্দ করি। এটি রাসূলের উত্তম চরিত্রের অংশ। প্রথম বাক্যে যেহেতু সংশোধন ছিল পরের বাক্যে তিনি বলেন, আমি তোমার জন্য তাই ভালোবাসি যা আমি আমার নিজের জন্য পছন্দ করি। অর্থাৎ আমি তোমাকে কথাগুলো এ কারণেই বলছি যে, আমি তোমার জন্য তাই ভালোবাসি যা আমি আমার নিজের জন্য পছন্দ করি। তৃতীয়: তুমি দুইজনের ওপরও আমীর হয়ো না। অর্থাৎ তুমি দুই জনের ওপর আমীর হয়ো না। আর যদি বেশি হয় তাহলে আগেই হবে না। মোট কথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আমীর হতে নিষেধ করেছেন। কারণ সে দূর্বল। আর আমীর হওয়ার জন্য শক্তিশালী আমানতদার লোক দরকার। যাতে তার কর্তৃত্ব ও শক্ত কথার প্রতিফলণ ঘটে। মানুষের সামনে সে দূর্বল হতে পারবে না। কারণ, যখন মানুষ কাউকে দুর্বল মনে করবে তখন তাদের সামনে তার সম্মান থাকবে না এবং মুর্খরা তার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে। কিন্তু যখন সে শক্তিশালী হবে আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন না করবে আল্লাহ তাকে যে ক্ষমতা দিয়েছে তাতে কোন কমতি করবে না সেই প্রকৃত আমীর। চতুর্থ: ইয়াতীমের মালের তত্বাবধায়ক হবে না। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বে যার পিতা মারা যায় তাকে ইয়াতীম বলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াতীমের মালের তত্বাবধায়ক হতে নিষেধ করেছেন। কারণ, ইয়াতীমের মালের সংরক্ষণ করা ও যত্ন করার প্রয়োজন পড়ে। আর আবূ যার দূর্বল সে এ সম্পদকে যথাযথ সংরক্ষণ করতে পারবে না। এ কারণেই তিনি বলেন, তুমি ইয়াতীমের মালের তত্বাবধায়ক হয়ো না। অর্থাৎ তুমি অভিভাবক হয়ো না, তুমি তা অপরের জন্য ছেড়ে দাও। এতে আবূ যারকে ছোট করে দেখা হয়নি। কারণ, পরহেজগারী ও দীনদারীর সাথে সাথে আবু যার ভালো কাজের আদেশ ও অসৎ কর্ম থেকে নিষেধ করতেন। তবে তিনি একটি ব্যাপারে দুর্বল ছিলেন। আর তা হলো অভিভাবকত্ব ও নেতৃত্ব।
ব্যাখ্যা
সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ থেকে বর্ণিত নু’মান ইবন বাশীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার হাদীস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহর নির্ধারিত সীমায় অবস্থানকারী এবং ঐ সীমা লংঘনকারী উপমা হল। অর্থাৎ, যে আল্লাহর দ্বীনের ওপর অটুট রইল এবং এর ফলে সে তার ওপর অপির্ত দায়িত্ব পালন করল এবং নিষিদ্ধ বিষয়গুলো ছেড়ে দিল। তাতে পতিত হওয়ার অর্থ আল্লাহর সীমায় পতিত হওয়া অর্থাৎ হারাম কাজ করা অথবা অর্পিত ওয়াজিব দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া। “সে সম্প্রদায়ের মত; যারা একটি দ্বিতলবিশিষ্ট জাহাজে লটারি ক’রে”। অর্থাৎ তারা লটারির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করল যে কে উপরে থাকবে? “ফলে কিছু লোক উপর তলায় এবং কিছু লোক নিচের তলায় স্থান নিল। সুতরাং নিচের তলার লোকেরা যখন পানির প্রয়োজন বোধ করত” অর্থাৎ, যখন তারা পান করার জন্য পানি তলব করত। “তখন তারা তাদের উপরের লোকদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করত”। অর্থাৎ যারা তাদের উপরে। কারণ, উপর থেকে নেওয়া ছাড়া পানি পাওয়া সম্ভব নয়। “তখন নিচের তলার লোকেরা বলল, ‘আমরা যদি আমাদের ভাগে ছিদ্র ক’রে দিই, অর্থাৎ,আমরা যদি আমাদের স্থান ছিদ্র করে দেই তাহলে দিব্যি আমরা তা থেকে পানি ব্যবহার করতে পারব। আর উপর তলার লোকদেরকে কষ্টও দেব না। এ ভাবেই তারা পরিকল্পনা করল এবং ইচ্ছা ও আশা করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তখন যদি উপর তলার লোকেরা তাদেরকে নিজ ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয় (এবং সে কাজে বাধা না দেয়), তাহলে সকলেই (পানিতে ডুবে) ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ, যখন নৌকার নিচ দিয়ে ছিদ্র করবে, তখন নৌকায় পানি প্রবেশ করবে। অতঃপর নৌকা সবাইকে নিয়ে ডুবে যাবে। পক্ষান্তরে উপর তলার লোকেরা যদি তাদের হাত ধরে (জাহাজে ছিদ্র করতে) বাধা দেয়, তাহলে তারা নিজেরাও বেঁচে যায় এবং সকলকেই বাঁচিয়ে নেয়। এরা এবং তারা সবাই বেঁচে যাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন তাতে রয়েছে একটি উচ্চ অর্থ এবং মহান তাৎপর্য। মানুষ আল্লাহর দীনের মধ্যে সমুদ্রের মাঝের নৌকার যাত্রীর মতো। তাদেরকে সমূদ্রের টেউ এদিক সেদিক নাড়াচ্ছে। আর যখন তাদের সংখ্যা বেশি হবে তখন অবশ্যই নৌকার ভারসাম্য রক্ষা এবং যাতে পরস্পরের কষ্ট না হয় সে জন্য তারা কতক উপরে এবং কতক নিচে অবস্থান নিতে বাধ্য। এতে বলা হয় যখন নৌকার যাত্রীদের মধ্য হতে কোন যাত্রী যদি নৌকা ছিদ্র করতে চায়, তখন সবার ওপর দায়িত্ব হলো তাকে বিরত রাখা এবং তার হাত ধরা, যাতে সবাই বাঁচতে পারে। যদি তারা এ কাজটি না করে তবে তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে আল্লাহর দীন। যখন জ্ঞানী, আহলে ইলম এবং দ্বীনদার লোকেরা অজ্ঞ, মুর্খদের বাঁধা দেয় তবে সবাই নাজাত পাবে। আর যদি তাদেরেকে তাদের ইচ্ছানুযায়ী ছেড়ে দেয়া হয়, তারা সবাই ধ্বংস হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরা ভয় কর সেই ফিতনাকে যা শুধু যারা অন্যায় করেছে তাদেরকে ঘ্রাস করবে না। আর তোমরা জেনে রাখো আল্লাহ কঠিন শাস্তি দাতা। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ২৫] ইবনে উসাইমীনের রিয়াদুস সালেহীনের ব্যাখ্যা (৪৩২-২/৪৩১)
ব্যাখ্যা
আমিরুল মুমিনীন আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন যে, সাধারণ জনগণকে শুধু এটিই বলা উচিৎ যা মানুষকে তাদের দীনের মূলনীতি ও বিধিবিধানের ক্ষেত্রে উপকারী। যেমন, তাওহীদ, হালাল-হারাম বর্ণনা করা। আর যা মানুষকে তার থেকে বিরত রাখে সেগুলো পরিহার করা, যার কোনো প্রয়োজন নেই অথবা যা মানুষের নিকট কঠিন হয়ে পড়ে ও যা বুঝা তাদের জন্যে কষ্টকর হয়, (সেগুলোও না বলা) যা তাদেরকে সত্য পরিহার ও তা গ্রহণ না করার দিকে ধাবিত করে।
ব্যাখ্যা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ তালিবকে তার মুমূর্ষ অবস্থায় দেখতে গিয়ে তার কাছে ইসলাম পেশ করেন, যাতে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ইসলামের ওপর হয় এবং এ দ্বারা সে সৌভাগ্যবান হয় এবং সফলতা লাভ করে। তিনি তাকে তাওহীদের কালিমা উচ্চারণ করাইতে চাইলেন। আর মুশরিকরা তার কাছে তাদের বাপ-দাদার দীন অর্থাৎ শির্কের ওপর অটুট থাকা চাইলেন। কারণ, তারা জানতেন যে, এ কালিমা এমন একটি কালিমা যা শির্ককে না করে এবং এক আল্লাহর জন্য ইবাদত করা সাব্যস্ত করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চাচার কাছে বার বার কালিমা শাহাদাত উচ্চারণ করা কামনা করলেন। আর মুশরিকরা বার বার তার বিরোধিতা করতে লাগল। ফলে সত্য থেকে বিরত থাকা এবং শির্কের ওপর তার মৃত্যু বরণ করার তাঁরাই কারণ ছিল। এ সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা সপথ করেন যে, নিশ্চয় তিনি তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন যতক্ষণ না তাকে তা থেকে নিষেধ করা না হয়। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তা থেকে নিষেধ নাযিল করেন এবং তাকে জানিয়ে দেন যে, হিদায়াত কেবল আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে চান তাকে তা দ্বারা মর্যাদাবান করেন। কারণ, তিনি জানেন কে হিদায়েতের যোগ্য আর কে যোগ্য নয়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা নাযিল করেন: “নবীর জন্য সঙ্গত নয় এবং ঈমানদারদের জন্যও সঙ্গত নয় যে,তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থণা করবে। যদিও তারা তার নিকটাত্মীয় হয়ে থাকে। তাদের নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে নিশ্চয় তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী”। আর আল্লাহ তা‘আলা আবূ তালিব সম্পর্কে নাযিল করেন যে, “তুমি যাকে পছন্দ করো তাকে হিদায়াত দিতে পারবে না। তবে আল্লাহ যাকে চান তাকেই হিদায়াত দান করেন। আর তিনি হিদায়াত প্রাপ্তদের বিষয়ে অধিক জ্ঞাত”।
ব্যাখ্যা
আবূ যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন ও পদে নিয়োগ সম্পর্কে তাকে নির্দিষ্টভাবে নসিহত করেছেন। আর এটা তখন ঘটেছে যখন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোন পদে নিয়োগ পেতে আবেদন করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, হে আবূ যার! তুমি দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। এ কথায় এক ধরণের শক্তি রয়েছে, তবে আমানতের দাবি হচ্ছে মানুষ যে মানের হবে সেও সে মানের হবে। শক্তিশালী হলে শক্তিশালী আর দুর্বল হলে দুর্বল। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত হতে হলে শক্তিশালী ও আমানতদার হওয়া শর্ত। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এটি একটি আমানত। সুতরাং কেউ শক্তিশালী ও আমানতদার হলে তার আমীর ও গভর্নর হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। পক্ষান্তরে কেউ শক্তিশালী; কিন্তু আমানতদার নয় অথবা আমানতদার; কিন্তু শক্তিশালী নয় অথবা দুর্বল ও আমানতদার নয় এমন তিন ধরণের লোক আমীর হওয়া উচিত নয়। উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হলো যে, আমরা শক্তিশালী লোককে দায়িত্বশীল করব। কেননা এ ধরণের লোক মানুষের জন্য অধিক উপকারী। জনগণ ক্ষমতা ও শক্তির প্রয়োজন বোধ করে। আর সে যদি শক্তিশালী না হয়ে দুর্বল হয়, বিশেষ করে দীনদারীতার ব্যাপারে দুর্বল হলে সব কিছুই শেষ হয়ে যাবে। এ হাদীসটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দলিল; বিশেষ করে যারা দুর্বলাতার কারণে দায়িত্বপালনে অক্ষম। হাদীসে বর্ণিত অপমান ও অনুপাতের ব্যাপারে বলা হবে, “কিয়ামতের দিন এটা (পদাধিকারীর জন্য) অপমান ও অনুতাপের কারণ হয়ে দাঁড়াবে” যারা উক্ত পদের যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও দায়িত্ব নিয়েছে অথবা যোগ্য ছিলো; কিন্তু ন্যায়পরায়নতা ও সমতা বিধান করেনি। তাকে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিনে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অপদস্ত করবেন এবং সে তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবে। অপর দিকে যে ব্যক্তি এই পদের যোগ্য এবং সে এর হক ন্যায়পরায়নাতার সাথে যথাযথভাবে আদায় করেছে সে উক্ত আতঙ্ক ও হুমকির অন্তর্ভুক্ত নয়। এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আলাদা করেছেন এবং তাদের সম্পর্কে বলেছেন, “কিন্তু যে ব্যক্তি এই পদের হক যথাযথভাবে আদায় করবে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করবে তার কথা স্বতন্ত্র।” যারা এ দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায় করবে সহীহ হাদীস অনুযায়ী তাদের জন্য রয়েছে অপরিসীম মর্যাদা। যেমন যে হাদীসে বর্ণিত আছে, “সাত ধরণের লোককে আল্লাহ (তাঁর আরশের নিচে) ছায়া দিবেন।” আরেকটি হাদীস: ন্যায়পরায়নগণ নূরের মিনারে আরোহণ করবেন। এগুলো ছাড়াও এ সম্পর্কে আরো অসংখ্য হাদীস রয়েছে।
ব্যাখ্যা
আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা এই আয়াত পড়ছ, “হে মু’মিনগণ! তোমাদের আত্মরক্ষা করাই কর্তব্য। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।” (সূরা মায়েদাহ ১০৫ আয়াত) এতে তোমরা মনে করেছিলে যে, যখন কোন মানুষ নিজে সঠিক পথের ওপর থাকে, মানুষের গোমরাহ হওয়া তার কোন ক্ষতি করবে না। কারণ, সে নিজে সঠিক আছে। আর যখন নিজে সঠিক থাকে তখন অন্যদের অবস্থা আল্লাহর ওপর। এই অর্থ ঠিক নয়, কারণ যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করবে এ কথা আমাদের হিদায়াত প্রাপ্ত হওয়ার সাথে শর্তযুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন: “যে গোমরাহ হয়েছে সে তোমাদের ক্ষতি করবে না যদি তোমরা হিদায়াত প্রাপ্ত হও”। আর হিদায়াত প্রাপ্ত হওয়ার একটি নিদর্শন হচ্ছে: আমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করব। এটা যেহেতু হিদায়েতের অন্তর্ভুক্ত, তাই যারা পথ ভ্রষ্ট হয়েছে তাদের অনষ্টি থেকে বাচার জন্যে আমাদেরকে অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে হবে। এ কারণেই আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কিন্তু আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, “যখন লোকেরা অন্যায় বা অত্যাচারীকে (অত্যাচার করতে) দেখবে এবং তা পরিবর্তন করবে না বা অত্যাচারীর হাত পাকাড়াও করবে না, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের সকলকে ব্যাপকভাবে তার শাস্তির কবলে নিয়ে নেবেন। অর্থাৎ যে গোমরাহ হবে তার গোমরাহী তাদের ক্ষতি করবে যখন তারা গোমরাহকে দেখতে পাবে কিন্তু তাকে ভালো কাজের আদেশ দেবে না এবং মন্দ কর্ম থেকে ফিরাবে না। তখন আল্লাহ তা‘আলা কর্তা ও নিরব দর্শক গাফিল সবাইকে আযাবে সামিল করবেন। কর্তা মানে যে খারাপকর্ম করেছে, আর গাফিল মানে যে তাকে খারাপ কর্ম থেকে বাধা প্রদান করেনি।
ব্যাখ্যা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দেন যে, অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ওপর দায়িত্বশীলদের পক্ষ হতে এমন শাসকবৃন্দ নিযুক্ত করা হবে, যাদের (কিছু কাজ) শরী‘আতের বিধান অনুযায়া হওয়ার কারণে আমরা ভালো দেখব এবং শরী‘আত বিরোধি হওয়ার কারণে কিছু কাজ হবে গর্হিত। সুতরাং যে ব্যক্তি (তাদের গর্হিত কাজকে) অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে, তাদের অত্যাচারের কারণে তার বিরোধিতা করার ক্ষমতা রাখে না সে গুনাহ থেকে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে এবং আর যে হাত বা মুখ দিয়ে বাধা দিতে সক্ষম হবে ও তাদের প্রতিবাদ জানাবে সেও পরিত্রাণ পাবে। কিন্তু যে ব্যক্তি তাদের কর্মকে অন্তর দিয়ে পছন্দ করবে এবং কর্মে তাদের অনুসরণ করবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে যেমনটি তাদের পূর্বের লোকেরা ধ্বংস হয়েছিল।” সাহাবীগণ পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না?’ তিনি বললেন, “না; যে পর্যন্ত তারা তোমাদের মধ্যে সালাত কায়েম করবে।”
ব্যাখ্যা
উকবাহ ইবনে হারেস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন যে, তিনি একদিন নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আসরের সালাত পড়েন। অতঃপর যখন সালাত শেষ করলেন তখন তিনি অতি শীঘ্র দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর লোকদের গর্দান টপকে তাঁর কোন এক স্ত্রীর কামরার দিকে রওয়ানা করলেন। লোকেরা তাঁর শীঘ্রতা দেখে ঘাবড়ে গেল। অতঃপর তিনি বের হয়ে এলেন; দেখলেন লোকেরা তাঁর শীঘ্রতার কারণে আশ্চার্যান্বিত হয়েছে। তাই তাদের এর কারণ বর্ণনা করে তিনি বললেন, “(সালাতে) আমার মনে পড়ল যে, (বাড়ীতে সোনা অথবা চাঁদির) একটি টুকরা যা বন্টন করা ওয়াজিব ছিল রয়ে গেছে। তাই তিনি অপছন্দ করলেন যে, তা সম্পর্কে চিন্তা করা তাকে আল্লাহর স্বরণ ও তার প্রতি মনোযোগী হতে বাধা দেয়।”
ব্যাখ্যা
যে ব্যক্তি নেতৃত্ব চায় বা তার প্রতি লোভ করে তাকে নেতা বানানো নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে এ হাদীস। দুই ব্যক্তি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আল্লাহ তা‘আলা তাকে যার ওপর দায়িত্বশীল করেছে তাতে তাদের আমীর বানানোর জন্য আবেদন পেশ করলেন, তখন তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম! আমরা এমন কাউকে এ দায়িত্ব দেই না যে তা (সরকারী পদ) প্রার্থনা করে অথবা তার প্রতি লোভ রাখে।” অর্থাৎ যে আমীরগিরী তলব করে এবং লোভ করে এমন কাউকে আমরা দায়িত্বশীল বানাই না। কারণ, যে তলব করে বা লোভ করে তার উদ্দেশ্য অনেক সময় ক্ষমতা লাভ করা হতে পারে জন কল্যাণ নয়। যেহেতু তাকে এ ধরনের অপবাধে অপবাধ দেওয়া যায়, তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের লোককে নেতা বানাতে নিষেধ করেন এবং তিনি বলেন, “আল্লাহর কসম! যে সরকারী পদ চেয়ে নেয় অথবা তার প্রতি লোভ রাখে, তাকে অবশ্যই আমরা এ কাজ দিই না। এ হাদীসের আলোচ্য বিষয়টি আব্দুর রহমান ইবন সামুরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীসকে সমর্থন করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তুমি দায়িত্ব চেয়ো না। কারণ, যদি চাওয়া ছাড়া তোমাকে শাসন ক্ষমতা দেওয়া হয়, তার ওপর তোমাকে সাহায্য করা হবে। আর যদি তোমার চাওয়ার ওপর নির্ভর করে দেওয়া হয় তবে তোমাকে তার দিকে সপর্দ করা হবে। যখন কোন ব্যক্তি কোন শহর বা যমীনের কোন অংশের যাতে আবাদী বা এ ধরনের কিছু রয়েছে তার ওপর শাসক বানানোর আবেদন দেয়, তখন দায়িত্বশীলদের জন্য তাকে আমীর বানানো উচিত হবে না। এমনকি যদি সে যোগ্য ব্যক্তিও হয়ে তাকে। অনুরূপভাবে যদি কোন ব্যক্তি বিচারক হওয়ার জন্য এ কাজের দায়িত্বশীল যেমন আইন মন্ত্রীর নিকট গিয়ে বলল, আমাকে অমুক শহরের বিচারের দায়িত্ব দিন, তাহলে তাকে বিচারক বানানো যাবে না। তবে যদি কোন ব্যক্তি এক শহর থেকে অপর শহরে বদলী হওয়া কামনা করে তার বিষয়টি এ হাদীসের অন্তভুর্ক্ত নয়। কারণ, এ লোক আগেই দায়িত্বশীল হয়ে আছে তবে সে শুধু অন্য স্থানে বদলী হতে চাচ্ছে। কিন্তু যদি স্থান পরিবর্তন দ্বারা তার উদ্দেশ্য সে শহরের লোকদের ওপর কর্তৃত্ব করা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা অবশ্যই বারণ করবো। কারণ, আমলের বিবেচনা নিয়তের ওপরই নির্ভরশীল। যদি কোন প্রশ্নকারী প্রশ্ন করে বলে আযীযে মিসরকে লক্ষ্য করে ইউসুফ আল্লাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী-“আমাকে যমীনের ধন-ভান্ডারের ওপর দায়িত্বশীল নির্ধারণ করুন। নিশ্চয় আমি সংরক্ষণকারী ও জ্ঞানী”। [সূরা ইউসূফ, আয়াত: ৫] -বিষয়ে তুমি কি জাওয়াব দেবে? আমরা দুই জাওয়াবের যে কোন একটি দ্বারা জাওয়াব দেবো। এক—এ কথা বলা যাবে যে, আমাদের পূর্বে উম্মাতদের শরী‘আত যদি আমাদের শরী‘আতের বিধানের পরিপন্থী হয়, তখন উসূলীদের প্রসিদ্ধ কায়েদা “আমাদের পূর্ববতীদের শরী‘আত আমাদেরই শরী‘আত যতক্ষণ না তা আমাদের শরী‘আতের পরীপন্থী না হয়”—এর ভিত্তিতে বলা যাবে যে, আমাদের শরী‘আত অনুযায়ী আমল হবে। আর এখানে আমাদের পূর্বের শরী‘আত আমাদের শরীয়তের পরিপন্থী। কারণ, আমাদের শরী‘আতে আছে আমরা এমন কাউকে শাসক বানাবো না যে শাসন ক্ষমতা তলব করে। দুই—ইউছুফ আলাইহিস সালাম দেখলেন যে, সম্পদ নষ্ট হবে এবং তাতে সীমালঙ্ঘন ও তামাশা করা হবে, তাই দেশকে তামাশার হাত থেকে রক্ষা করতে চাইলেন। এ ধরনের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য সাধারণত খারাপ পরিচালনা ও মন্দ পরিণতিকে দূর করা হয়ে থাকে। আর এতে কোন অসুবিধা নেই। যেমন যখন আমরা কোন ভূ-খণ্ডের আমীরকে দেখি যে, সে তার ক্ষমতা নষ্ট করছে ও মানুষ ধ্বংস করছে, তখন এ কাজের জন্য যোগ্য ব্যক্তির জন্য উচিত হল যখন দেখবে যে, সে ছাড়া আর কোন যোগ্য লোক নেই, দায়িত্বশীলদের নিকট শাসন ক্ষমতা তলব করা। সে তাকে বলবে, এখানে যে খারাপ অবস্থা রয়েছে তা দূর করতে আমাকে এ শহরের দায়িত্ব দিন। নীতি অনুসারে এ ধরণের চাওয়াতে কোন অসুবিধা নেই। আর উসমান ইবন আবুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, আমাকে সালাতে আমাদের সম্প্রদায়ের লোকদের ইমাম নিযুক্ত করুন। বললেন, তুমি তাদের ইমাম। উলামাগণ বলেন, হাদীসটি প্রমান করে যে, জন কল্যাণে ইমামতি চাওয়া বৈধ। রহমানের বান্দাদের দু‘আসমূহে যাদের আল্লাহ এ বলে প্রশংসা করেছেন যে তারা বলে, “আর আপনি আমাদের মুত্তাকীদের ইমাম বনান”। এটি অপছন্দনীয় তলব নয়। কারণ, অপছন্দনীয় তলবের সম্পর্ক দুনিয়ার নেতৃত্বের সাথে যেই যে চায় তাকে সাহায্য করা হয় না এবং তাকে দেওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে”! এটি শপথ বাক্য যার দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নামে শপথ করছেন। কারণ, তিনিই এমন সত্বা যার হাতেই বান্দাদের জীবন। তিনি যদি চান হিদায়েত দেন যদি চান গোমরাহ করেন যদি চান মুত্যু দেন আর যদি চান বাচিয়ে রাখেন। সুতরাং হিদায়াত দেওয়া বা গোমরাহ করা, জীবিত রাখা বা মৃত্যু দেওয়া, হস্তক্ষেপ করা বা পরিচালনা সবই আল্লাহর হাতে। যেমন, আল্লাহ বলেন, “কসম নফসের এবং তিনি যা সুষম করেছেন। অতঃপর তিনি তাকে অবহিত করেছেন তার পাপসমূহ ও তার তাকওয়া সম্পর্কে”। (সূরা আশ-শামস: ৭-৮) সুতরাং জীবন কেবলই আল্লাহর হাতে। এ কারণেই তিনি শপথ করেছেন। আর তিনি অধিকাংশই এ বাক্য দ্বারা শপথ করতেন : “সে সত্তার কসম যার হাতে আমার নফস”। আবার কখনো তিনি বলতেন “যার হাতে মুহাম্মদের জীবন তার শপথ”। কারণ মুহাম্মাদের নফস সবচেয়ে পবিত্র নফস। তাই তিনি তার দ্বারা কসম খান। কারণ, তা ছিল পবিত্র আত্মা। অতঃপর তিনি যার ওপর শপথ করলেন তা উল্লেখ করেন। আর তা হলো, আমরা ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করার দায়িত্ব আঞ্জাম দেব, তা না হলে শীঘ্রই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পক্ষ থেকে আমাদেরকে আযাবে সামিল করে নেবেন। তখন আমরা তাকে ডাকবো সে আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন না।
ব্যাখ্যা
আয়েয ইবন আমর রাদিয়াল্লাহ আনহু উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদ যিনি তার পিতার পর ইরাকীদের আমীর ছিলেন তার নিকট প্রবেশ করলেন এবং বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। নিশ্চয় নিকৃষ্টতম শাসক হচ্ছে প্রজাদের ওপর কঠোর শাসক। এখানে হুতামাহ হচ্ছে সে, যে উট হাঁকানোর সময়, পানি পান করাতে নিয়ে যাওয়া ও তার থেকে নিয়ে আসার সময় দেখা-শোনার ক্ষেত্রে কঠোর এবং একটির ওপর অপরটি নিক্ষেপ করে ও তাদের সাথে খারাপ আচরণ করে। তার সামনে তিনি খারাপ শাসকের একটি উদাহরণ পেশ করেছেন। এ দ্বারা উদ্দেশ্য “কাসী” শব্দ (অর্থ নির্দয়) যে তাদের ওপর জুলুম করে, তাদের প্রতি নমনীয়তা ও দয়া করে না। আর তার বাণী, “সুতরাং তুমি তাদের দলভুক্ত হয়ো না”। এটি ইবনে যিয়াদের প্রতি আয়েযের উপদেশ। এরপর ইবন যিয়াদ এ ছাড়া আর কিছু বলল না যে, “আপনি তো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীদের চালা আটার অবশিষ্ট ভুসি (অপদার্থ)”! অর্থাৎ, তুমি তাদের সম্মানীত, আলেম ও মর্যাদাশীল ব্যক্তিদের কেউ নয়, বরং তুমি তাদের পরিত্যক্তদের থেকে। আর “নাখালা” এখানে গমের ভুসির রূপক শব্দ। আর তা হলো বাকল। আর নাখালা, হাকালা আর হাসালা একই অর্থবোধক শব্দ। তার বাণী: “বিশিষ্ট সাহাবী তার উত্তর দেন। ‘তাঁদের মধ্যেও কি ভুসি আছে? (কখনই না।) বরং ভুসি তো তাঁদের পরবর্তী এবং তাঁরা ছাড়া অন্যদের মধ্যে আছে”। এটি বড় কথা এবং তার স্পষ্ট ভাষা ও সততা, যা প্রতিটি মুসলিম মেনে নেয়। কারণ, সাহাবীগণ সবাই সমস্ত মানুষ থেকে শ্রেষ্ঠ, উম্মতের সরদার এবং তাদের পরবতীদের থেকে উত্তম। আর তারা সবাই ইনসাফগার তাদের মধ্যে কোন ভুসি নেই। তবে গোজামিল এসেছে যারা তাদের পরে তাদের থেকে বা তাদের মধ্যে।
ব্যাখ্যা
যখন কোন মানুষের এ অভ্যাস থাকে যে, সে সুস্থ ও অবসর অবস্থায় কোন নেক আমল করে থাকে তারপর সে অসুস্থ হল, এখন আর সে ঐ নেক আমলটি করতে পারছে না, তখন তার জন্য ঐ আমলের পুরো সাওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে। যেমনটি সে সুস্থ অবস্থায় আমলটি করলে লিপিবদ্ধ করা হতো। অনুরূপভাবে তার আমলের বাঁধা যদি সফর হয় বা অন্য কোন অপারগতা হয় যেমন হায়েয। (তখনো তার জন্য পুরো সাওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে।)
ব্যাখ্যা
সাওয়াবের প্রত্যাশায় মসজিদে যাওয়া-আসা করার মাধ্যমে মানুষ যদি আল্লাহর কাছে বিনিময় প্রত্যাশা করে তাহলে তাকে এর বিনিময়ে সাওয়াব দান করা হবে। লেখক এখানে যে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন, তাতে এমন এক ব্যক্তির ঘটনা রয়েছে, যার বাড়ি মসজিদ থেকে অনেক দূরে ছিলো। পায়ে হেঁটে মসজিদের দিকে আগমন করা ও মসজিদ থেকে ফিরে আসার মাধ্যমে সে আল্লাহর কাছে সাওয়াব পাওয়ার আশা করত। কতিপয় লোক তাকে বলল, তুমি যদি একটি গাধা কিনে নাও এবং তার পিঠে আরোহন করে রাতের অন্ধকারে এবং রোদের মধ্যে সালাত আদায় করতে আসো তাহলে তো বেশ ভালোই হয়। অর্থাৎ রাতের অন্ধকারে ইশা ও ফজরের সালাত আদায় করার জন্য আসার সময় অথবা গরমের দিন যোহরের সালাত আদায় করার জন্য আসার সময় গাধার উপর আরোহন করে আসতে তাহলে ভালো হতো। বিশেষ করে হিজায অঞ্চলের আবহাওয়া যেহেতু অত্যন্ত গরম, তাই সেখানে এর প্রয়োজন পড়ে। তখন সাহাবী লোকটি বললো, আমার বাড়ি মসজিদের পাশে হোক তা আমি পছন্দ করি না। অর্থাৎ তার বাড়ি মসজিদ থেকে দূরে থাকুক, এটিই সে পছন্দ করে। সে পায়ে হেঁটে মসজিদে আসা যাওয়া করবে। তাই তার বাড়ি মসজিদের কাছে থাকা তার কাছে পছন্দনীয় নয়। কেননা তার বাড়ি মসজিদের কাছে হলে মসজিদে আসা যাওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপের সাওয়াব তার জন্য লিপিবদ্ধ হবে না; অথচ সে তো আল্লাহ তা‘আলার কাছে মসজিদে আসা যাওয়ার প্রত্যেক পদক্ষেপের বিনিময়ে সাওয়াব প্রত্যাশা করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহ তোমার জন্য এসব সাওয়াবই একত্রিত করে রেখেছেন।” অর্থাৎ মসজিদে আসা যাওয়ার যে সাওয়াবের আশা তুমি করো, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে তা দিবেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, “তুমি যা আশা করছ তোমার জন্য তাই লিপিবদ্ধ হবে।”
ব্যাখ্যা
মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নাছোড় বান্দা হয়ে যাচ্ঞা করার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিষেধাজ্ঞার একটি সংবাদ দেন। অর্থাৎ চাওয়ার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও বাধ্য করো না। হাদীসে বর্ণিত, ‘তুলহিফূ’ শব্দটি ‘আলহাফা’ শব্দ থেকে নির্গত, বলা হয়ে থাকে, ‘আলহাফা ফিল মাসআলাতে’ যখন নাছোড় বান্দা হয়ে কেউ চায়। কারণ তার এ বাড়াবাড়ি সে প্রাপ্ত বস্তুর বরকত দূর করে দেয়। অতঃপর তিনি শপথ করে বলেন, তাদের কেউ যদি বাড়াবাড়ি করে কোনো কিছু চায়, তারপর তার যাচ্ঞা ও চাওয়ার কারণে তিনি কিছু দেন, অথচ দিতে নারাজ ছিলেন, অর্থাৎ তাকে দিতে অথবা বের করতে নারাজ ছিলেন, সে অবস্থায় তাকে সে প্রাপ্ত বস্তুতে বরকত দেওয়া হবে না, অর্থাৎ বাড়াবাড়ির ওপর তাকে আমি যা দিলাম তাতে তার জন্য বরকত দেওয়া হবে না।
ব্যাখ্যা
হাদীসের অর্থ: আমার থেকে উত্তরাধিকারী সূূত্রে প্রাপ্ত কুরআন ও হাদীসের ইলম মানুষের কাছে পৌঁছে দাও; যদিও পৌঁছে দেওয়া ইলম সামান্য পরিমাণ যেমন কুরআনের একটি আয়াতও হয়। তবে শর্ত হলো যা পৌঁছাবে তা ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করা ও জানা জরুরি। ব্যক্তির ওপর পৌঁছানোর এ নির্দেশ তখনই ওয়াজিব যখন সেটা তার ওপর একান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে যাবে। আর যদি তার ওপর পৌঁছানো ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত না হয়, যেমন দেশে মানুষকে দীন শিক্ষা ও দীনের ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দেওয়ার মতো আরও বেশ কিছু দা‘ঈ লোক থাকে তাহলে পৌঁছানো তার ওপর ওয়াজিব নয়; বরং তখন তার জন্যে মুস্তাহাব। বনী ইসরাঈলদের বর্ণিত সত্য ঘটনাবলী তাদের থেকে বর্ণনা করাতে কোনো দোষ নেই। যেমন, আসমান থেকে আগুন নেমে কুরবানীর গোশত পুড়িয়ে দেওয়া, গো বৎস পূজারীদের তাওবা কবুল হতে একে অন্যকে হত্যা করার ঘটনা অথবা কুরআনে বর্ণিত ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা যাতে উপদেশ রয়েছে। যে ব্যক্তি (ইচ্ছাকৃতভাবে) আমার ওপর মিথ্যারোপ করল সে যেনো জাহান্নামে তার নিজের ঠিকানা নির্ধারিত করে নিলো। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর মিথ্যারোপ করা সাধারণ মানুষের ওপর মিথ্যারোপ করার মতো নয়। বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর মিথ্যারোপ মানে আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করা। অতঃপর আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ তার শরী‘আতের ওপর মিথ্যারোপের নামান্তর। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অহীর মাধ্যমে যা কিছু আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন তাই আল্লাহর শরী‘আত। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর মিথ্যারোপ করার শাস্তি অধিক কঠিন।
ব্যাখ্যা
হাদীসের অর্থ: বান্দা যখন রাতের সালাতে থাকে এবং ঘুমের প্রভাবে তার পক্ষে কুরআন তিলাওয়াত করা কঠিন হয় যে, কি পড়ছে বলতে পারে না, তখন সে শুয়ে পড়বে, যতক্ষণ না তার থেকে ঘুম চলে যায়। যাতে আল্লাহর কালাম বিকৃত ও পরিবর্তিত না হয় এবং হতে পরে তার মুখ থেকে এমন কথা বের হবে যা বৈধ নয়। যেমন, অর্থের পরিবর্তন, বাক্য বিকৃতি এবং হতে পারে নিজের ওপর বদ-দো‘আ করবে। সহীহ বুখারীতে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু‘ হিসেবে বর্ণিত, “যখন তোমাদের কেউ সালাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়, সে ঘুমিয়ে নিবে, যতক্ষণ না সে তার তিলাওয়াত বুঝতে পারে।”
ব্যাখ্যা
এ হাদীসের অর্থ: যে মুসলিম কোনো গাছ লাগায় অথবা ফসল বুনে অতঃপর তা থেকে জীবিত মাখলুক থেকে কোনো প্রাণী খেল, তার বিনিময়ে তাকে অবশ্যই সাওয়াব দেওয়া হয়; এমনকি তার মৃত্যুর পরও। যতদিন ফসল ও তার রোপন অবশিষ্ট থাকবে ততদিন তার জন্য তার আমলও জারী থাকবে। এই বাবের হাদীসে ফসল উৎপাদন ও বৃক্ষরোপনের ওপর উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আর অবশ্যই ফসল উৎপাদন ও বৃক্ষরোপনে অনেক কল্যাণ নিহিত। এতে দীন ও দুনিয়ার উপকারিতা রয়েছে। আর যখন তা থেকে ভক্ষণ করা হয় তখন তার জন্য তা সদকা হয়ে যায়। এর চেয়ে আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, যদি কোনো চোর তা থেকে চুরি করে; যেমন কোনো ব্যক্তি একটি খেজুর বৃক্ষের কাছে এসে তা থেকে খেজুর চুরি করল। এতে তার মালিকের সাওয়াব হবে, এতদসত্বেও যে, যদি সে এই চুরকে সম্পর্কে অবগত হতো তাহলে সে তাকে আদালতে উপস্থিত করত। তারপরও আল্লাহ তা‘আলা এই চুরির বিনিময়ে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তার জন্য সদকার সাওয়াব লিখবেন।এমনিভাবে যদি তা থেকে যমীনে বিচরণশীল কোনো জন্তু ও কোনো হিংস্র প্রাণী খায় তাহলে এর জন্য তার মালিকের সাওয়াব হবে। আর এ হাদীসটি মুসলিমের জন্য খাস। কেননা সেই দুনিয়া ও আখেরাতে সদকার সাওয়াবের মাধ্যমে উপকৃত হয়।
ব্যাখ্যা
উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু এমন ব্যক্তির কথা আলোচনা করলেন, যে অহী নাযিলের যুগে কিছু গোপন করত। অহীর কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তার বিষয়টি গোপন থাকত না। কতক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মুনাফিক ছিল। তারা ভালো প্রকাশ করত; কিন্তু তারা মন্দ গোপন করত। তবে আল্লাহ তাআলা তার রাসূলের উপর অহী নাযিল করে তাদেরকে অপমান করতেন। কিন্তু যখন অহী বন্ধ হয়ে গেল তখন কে মুনাফিক জানার পথ বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, নিফাক থাকে অন্তরে, তাই তিনি বললেন, আমরা তোমাদেরকে তার দ্বারাই জবাবদিহি করব, যা আমাদের সামনে প্রকাশ পায়। অতএব যে আমাদের সামনে ভালো প্রকাশ করবে, আমরা তার সাথে ভালো ব্যবহার করব, যদিও সে অন্তরে খারাপ গোপন রাখে। আর সে খারাপ প্রকাশ করবে, তা প্রকাশ করার কারণে আমরা তার সাথে খারাপ আচরণ করব। তবে তার নিয়মতের ব্যাপার আল্লাহর উপর সোপর্দ। যিনি মানুষের নফসের ওয়াসওয়াসা জানেন।
ব্যাখ্যা
ইখলাসের সাথে নসীহত বা কল্যাণ কামনা করা এবং তা অন্যের জন্য ব্যয় করার জন্যই একনিষ্ঠ দীন এসেছে। এর অর্থ হলো আমরা মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনব, তাঁর একত্বের স্বীকারোক্তি প্রদান করব এবং তাঁকে সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র জানব। সেই সঙ্গে তাঁকে সকল পরিপূর্ণ গুণে গুণান্বিত করব। আরো বিশ্বাস করবো যে, কুরআন আল্লাহর কালাম। এটি তাঁর নবীর ওপর নাযিল হয়েছে। এটি তার সৃষ্টি নয়। আমরা এর সুস্পষ্ট বিধানের ওপর আমল করব এবং তার মুতাশাবিহ এর প্রতি ঈমান রাখব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তাকে সত্যায়ন করব, তার নির্দেশ মানব ও তার নিষেধ থেকে বিরত থাকব। মুসলিমদের ইমামদের নসীহত করব, হকের ক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করবো এবং তারা যা জানে না সেটা জানিয়ে দিবো এবং তারা যা ভুলে গেছে কিংবা যা থেকে তারা গাফিল সেটা স্মরণ করিয়ে দিবো। সাধারণ মুসলিমকে সত্যের দিকে আহ্বান করব, সাধ্যানুসারে আমাদের থেকে ও অন্যদের থেকে কষ্ট দূর করব, তাদের সৎ কাজের আদেশ দিবো ও অসৎ কাজ থেকে তাদেরকে বিরত রাখব। তাদের কল্যাণ কামনার সারাংশ হচ্ছে: আমরা নিজেদের জন্যে যা পছন্দ করবো তাদের জন্য সেটাই পছন্দ করব।
ব্যাখ্যা
‘আমর ইবন সা‘ঈদ ইবন আল‘আস যিনি আল-আশদাক নামে পরিচিত, তিনি সে সময় ইয়াযীদ ইবন মু‘আবিয়া কর্তৃক মদীনার গভর্নর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যখন আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মক্কায় সৈন্যবাহিনী প্রেরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন আবূ শুরাইহ খুওয়াইলিদ ইবন আমর আল-খুযা‘ঈ তাকে উপদেশ দিতে গেলেন। কিন্তু আমর যেহেতু পদমর্যাদায় বড় ছিলেন, তাই আবূ শুরাইহ কৌশল ও প্রজ্ঞাস্বরূপ তার বক্তব্যে নম্রতা প্রকাশ করলেন। যাতে তিনি সহজেই উপদেশ কবুল করেন এবং তিনি নিজেও নিরাপদ থাকেন। ফলে তিনি (মক্কায়) সৈন্যবাহিনী প্রেরণ সম্পর্কে তাকে নসীহত করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলেন এবং তাকে সংবাদ দিলেন যে, তিনি তাকে যে হাদীস শুনাবেন সেটির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ও হাদীসটির সত্যতার ব্যাপারে তিনি সুদৃঢ়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হাদীসটি বলেছেন তখন তিনি হাদীসটি দু’ কানে শুনেছেন, তার অন্তর তা স্মরণ রেখেছে এবং তার দু’চোখ তাকে দেখেছে। আমর ইবন সা‘ঈদ তাকে কথা বলার অনুমতি দিলেন। আবূ শুরাইহ বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন প্রত্যুষে আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা বর্ণনা করার পর বললেন, “মক্কাকে আল্লাহ তা‘আলা সেদিন থেকে হারাম করেছেন যেদিন তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং এটির সম্মান ও মর্যাদা প্রাচীনকাল থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। মানুষ এটিকে হারাম করেনি, যেমনটি তারা সাময়িকভাবে সংরক্ষিত এলাকা, নির্দিষ্ট চারণভূমি ও জলাশয় সর্বসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে থাকে। কিন্তু মক্কাকে মহান আল্লাহ নিজেই হারাম করেছেন। যাতে তার মর্যাদা সুমহান হয় ও অধিক বলে বিবেচিত হয়। সুতরাং যেহেতু মক্কার হারাম ঘোষণার বিষয়টি সুপ্রাচীন কাল থেকেই এসেছে এবং তা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকেই হয়েছে, তাই যে লোক আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, যদি তার ঈমানকে সংরক্ষণকারী হয়, তাহলে তার জন্য সেখানে রক্তপাত করা এবং সেখানকার কোনো গাছপালা কাটা হালাল নয়। মক্কা বিজয়ের দিন আমার যুদ্ধকে অযুহাত বানিয়ে কেউ যদি সেখানে যুদ্ধ করতে চায় তাহলে তোমরা বলে দিও যে, তুমি তো রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো নও। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে এর অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তোমাকে অনুমতি দেননি। তাছাড়া সেখানে কাউকেই সর্বদা যুদ্ধ করার অনুমতি প্রদান করা হয়নি। আমাকেও প্রয়োজন অনুসারে সেদিন কিছু সময়ের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তারপর আগের মতো আজ আবার এর নিষেধাজ্ঞা ফিরে এসেছে। উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিত লোকদের কাছে (এ বাণী) পৌঁছে দেয়। হে আমীর, এ কারণেই আমি আপনার কাছে এ হাদীস পৌঁছে দিলাম। কেননা মক্কা বিজয়ের দিন সকাল বেলা উক্ত কথা বলার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। আর আপনি উপস্থিত ছিলেন না। লোকজন আবূ শুরাইহকে বললো, ‘আমর আপনাকে কী জবাব দিয়েছিলেন? তিনি বললেন, আমাকে উত্তর দিয়েছেন, হে আবূ শুরাইহ আমি সে হাদীস সম্পর্কে আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞাত। মক্কা কোনো বিদ্রোহীকে, কোনো খুনের পলাতক আসামীকে এবং কোনো সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দেয় না। এভাবে তিনি নিজের মতের ভিত্তিতে হাদীসের বিরোধিতা করেছেন এবং তিনি আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইরের বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ থেকে বিরত হননি। বরং তাতে তিনি অনঢ় ছিলেন। দেখুন, তাইসীরুল ‘আল্লাম, পৃ. ৩৮১; তাম্ববীহুল আফহাম (৩/৫০৯-৫১০); তা’সীসুল আহকাম (৩/৩৪৬)।
ব্যাখ্যা
প্রতিদিন যাতে সূর্য উদয় হয় (আর তা হচ্ছে ৩৬০ দিন) প্রত্যেক গ্রন্থির ওপর সেদিন একটি করে সাদকাহ রয়েছে। এরপর তিনি সদকার বিভিন্ন উদাহরণ দিলেন, সেগুলো কথা, কর্ম, সীমাবদ্ধ, সম্প্রসারিত নানা প্রকার রয়েছে। সীমাবদ্ধ বলতে যার উপকারিতা কর্তার নিজের মাঝে সীমাবদ্ধ আর সম্প্রসারিত বলতে যার উপকারিতা অপর পর্যন্ত পৌঁছায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাদীসে যা উল্লেখ করেছেন তা উদাহরণস্বরূপ, তবে সদকা এতেই সীমাবদ্ধ নয়। দু’জনের মাঝে বিচার-ফয়সালার ক্ষেত্রে ইনসাফ করা অথবা দু’জনের মাঝে সন্ধির ক্ষেত্রে ইনসাফ করা সদকা, তবে এগুলো অপর পর্যন্ত সম্প্রসারিত কথা-জাতীয় সদকা। অনুরূপ কাউকে তার সাওয়ারীর ওপর উঠতে সাহায্য করা অথবা সাওয়ারীর উপর তার সামান উঠিয়ে দিয়ে সাহায্য করা অপর পর্যন্ত সম্প্রসারিত কর্ম জাতীয় সাদকাহ। আর “ভালো কথা” দ্বারা সকল ভালো কথাকে বুঝায়, যেমন, যিকির, দো‘আ, কিরাত, তা‘লীম, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজের নিষেধ প্রভৃতি কোনটি কর্তার নিজের ভেতর সীমাবদ্ধ কোনোটি অপর পর্যন্ত সম্প্রসারিত সদকা। সালাতের জন্য মুসলিমের কৃত প্রত্যেক পদক্ষেপ নিজের ওপর সাদকাহ, তবে এটি কর্ম-জাতীয় নিজের ওপর সীমাবদ্ধ সদকা। আর রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস দূরীভূত করা; যেমন, কাটা, পাথর অথবা কাঁচ ইত্যাদি কর্ম-জাতীয় সদকা, তবে তার উপকারিতা অপর পর্যন্ত সম্প্রসারিত।
ব্যাখ্যা
এ হাদীসটিতে শাসন ক্ষমতার দায়িত্বটি যে কত বড় তা স্পষ্ট করা হয়েছে। যে ব্যক্তি মানুষকে শাসন করার দায়িত্ব পেল তারপর সে তাদের ওপর সংকীর্ণতা করল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আ করলেন আল্লাহ যেন তার সাথে একই রকম আচরণ করেন। আর যে ব্যক্তি তাদের সাথে ন্যায় ইনসাফ রহমত ও কোমল আচরণ করে আল্লাহ যেন তাকে একই রকম বিনিময় দেন। কারণ, বিনিময় আমলের ধরণ অনুযায়ী হয়।
ব্যাখ্যা
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সংবাদ দিয়ে বলেন: (একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে চলছিলাম। সে সময় তাঁর উপর ছিল একটি চাদর।) অর্থাৎ সেলাই করা কাপড় নিহায়া গ্রন্থের বর্ণনা মতে। (নাজরানী) নাজরান ইয়ামনের একটি শহর, তার দিকে সম্পর্কযুক্ত করে নাজরানী বলা হয়। কাপড়টির পাড় ছিল মোটা। (একজন বেদুইন লোক তাকে ধরল।) অর্থাৎ তার সাথে এসে যুক্ত হলো। (পিছন দিক থেকে, অতঃপর তাকে টান দিল) অর্থাৎ বেদুইন লোকটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চাদর ধরে পেছন থেকে খুব জোরে টান দিল। আনাস বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেদুইন লোকটির দিকে ফিরে গেলেন। অর্থাৎ, খুব জোরে টানার কারণে তার বুকের বরাবর মুখোমুখি হলেন। আল্লামা তীবী রহ. বলেন, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বুকের বরাবর তার সম্পূর্ণ মুখোমুখি হলেন। আর এটিই হলো (অন্য হাদীসে আসা) ‘যখন রাসূল কারো দিকে তাকাতেন তখন পুরো শরীর নিয়ে তাকাতেন’ এর অর্থ। অর্থাৎ যখন তিনি কারো দিক ফিরতেন তখন পুরোপুরি ফিরতেন। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে লোকটির বেআদবীর কারণে কোনো রকম পরিবর্তন কিংবা প্রভাব পড়েনি। (আমি নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাঁধের এক পাশে দেখলাম) অর্থাৎ তা হলো কাঁধের কোনো অংশ। (দাগ পড়ে গেছে।) অর্থাৎ তার কাঁধে। (খুব জোরে টানার কারণে) আমি বললাম, আল্লাহ সত্যিই বলেছেন, “বেদুইনরা কুফর ও কপটতায় কঠিনতর এবং আল্লাহ তাঁর রাসূলের উপর যা নাযিল করেছেন তার সীমারেখা না জানার অধিক উপযোগী।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৯৭] তারপর বেদুইন লোকটি বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! বাহ্যিকভাবে প্রতীয়মান হয়, লোকটি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট, যার কারণে সে যা করার তাই করছে। তারপর সে নাম ধরে ডাকলো। দয়ার সাগরের বিপক্ষে হটকারী ভাব ও অহমিকার স্বরে ডেকে বলল, (আদেশ কর।) অর্থাৎ তোমার প্রতিনিধিদের আদেশ দাও যাতে তারা আমাকে দান করে। অথবা আমার জন্য দান করার নির্দেশ দাও। (আল্লাহর সম্পদ থেকে যা তোমার নিকট আছে। অর্থাৎ আমাকে দান কর সে সম্পদ থেকে যা তোমার উপার্জিত নয়। যেমনটি অপর একটি বর্ণনায় স্পষ্ট হয়, সেখানে সে বলেছে, তোমার ও তোমার বাপের মাল থেকে নয়। কেউ কেউ বলেছেন, এ দ্বারা উদ্দেশ্য যাকাতের মাল। কারণ, তিনি তা থেকে কিছু অংশ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ব্যক্তিদের পেছনে ব্যয় করতেন। (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন) অর্থাৎ তার দিকে আশ্চর্য হয়ে দেখলেন। তারপর তিনি মুচকি হাসলেন। অর্থাৎ দয়াদ্র হয়ে। অতঃপর তাকে সম্পদ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।
ব্যাখ্যা
যুবাইর ইবন আদী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এক দল লোক নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদেম আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকটে আসলেন এবং তাঁর কাছে উমাইয়্যাহ খলিফাদের একজন গভর্নর হাজ্জাজ ইবন ইউসূফ আস-সাকাফীর অভিযোগ করলেন। আর তিনি (হাজ্জাজ) ছিলেন আত্যাচার ও রক্তপাতে প্রসিদ্ধ। তিনি ছিলেন প্রভাবশালী ও একগুয়ে। অতঃপর আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাদেরকে রাষ্ট্রীয় গভর্নরের অবিচারের ওপর ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দিলেন। এরপর তাদের জানালেন যে, এখন যে যুগ আসবে তার পরবর্তী যুগ এর চেয়ে খারাপ হবে, যতক্ষণ না তারা তাদের প্রভূর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।’ আর এ কথা আনাছ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শুনেছেন। খারাপ বলতে পুরোপুরি খারাপ বুঝানো হয় নি। বরং কখনো খারাপ হতে পারে আবার কখনও ভালো হতে পারে।
ব্যাখ্যা
এ হাদীসে সালামা ইবন ইয়াযীদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সেসব নেতাদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন, যারা কথা শোনা ও আনুগত্য করা ইত্যাদি অধিকার মানুষের কাছে পুরোপুরি আদায় করে নেয়; কিন্তু তাদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাদের অধিকার আদায় করে না; বরং তাদের প্রতি যুলুম-নির্যাতন করে ও তাদের না দিয়ে কবজা করে নেয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশ্নকারীর প্রশ্নকে উপেক্ষা করে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, যেন তিনি এ ধরনের প্রশ্ন অপছন্দ করলেন এবং এদ্বার উন্মুক্ত করা অপছন্দ করলেন। কিন্তু প্রশ্নকারী তাকে আবার প্রশ্ন করলেন। তিনি এবারও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। প্রশ্নকারী আবার প্রশ্ন করলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শাসকের প্রাপ্ত অধিকার আদায় করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তারা যা কিছু করে তার বোঝা তাদের উপরই বর্তাবে এবং আমরা যা কিছু করি তার বোঝা আমাদের উপর বর্তাবে। আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো তাদের আদেশ শোনা ও আনুগত্য করা আর তাদের দায়িত্ব হলো ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করা এবং কারো প্রতি যুলুম না করা, আর আল্লাহর বান্দাদের মাঝে তাঁর নির্ধারিত শাস্তি বাস্তবায়ন করা, যমীনে তাঁর শরী‘আত প্রতিষ্ঠা করা এবং তাঁর শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করা।
ব্যাখ্যা
ছোট হোক বা বড় হোক যে ব্যক্তি মুসলিমদের কোনো কাজের দায়িত্ব পেয়ে তাদের ওপর কষ্ট চাপিয়ে দিল তার জন্য হাদীসটিতে কঠিন হুমকি রয়েছে। আর তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদ-দো‘আ দ্বারা যে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার আমলের ধরণ অনুযায় বিনিময় দিবেন।
ব্যাখ্যা
মা‘কাল ইবন ইয়াসারের হাদীসে প্রজাদের ধোঁকা না দিতে সতর্ক করা হয়েছে। আর সেটা হচ্ছে, “আল্লাহ তা‘আলা কোনো বান্দাকে যখন কোনো প্রজার দায়িত্বশীল বানান।” অর্থাৎ জনগণের দেখাশোনার দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করেন। যেমন, তাকে তাদের ভালো-মন্দ দেখার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং তাকে তাদের যাবতীয় কর্মের দায়িত্ব দিলেন। রা‘ঈ হচ্ছে: প্রজাদের যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তার দেখভালকারী ও আমানতদার। “প্রতারক অবস্থায় যেদিন সে মরবে” অর্থাৎ তার প্রজাদের প্রতি খিয়ানত করা অবস্থায় মারা যাবে। আর যে দিন সে মরবে দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, তার রূহ বের হওয়ার ও তার পূর্বের সময় যখন তাওবা কবুল করা হয় না। কারণ, খিয়ানত বা নিজের ত্রুটি থেকে তাওবাকারী এ ধরনের শাস্তির উপযুক্ত হয় না। যার শাসনে খিয়ানত পাওয়া যাবে চাই ক্ষমতা ব্যাপক হোক বা খাস হোক মহা সত্যবাদী ও সত্যায়িত (যার ওপর সর্বোত্তম সালাত ও সর্বাধিক পবিত্র সালাম) তাকে এ বলে হুমকি দেন যে, “তবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন।” যদি খিয়ানত করা হালাল জানে অথবা তাকে প্রথম শ্রেণির লোকদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
ব্যাখ্যা
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যেমনিভাবে নবীদের ওপর মানুষের জন্য যা কল্যাণ তা বর্ণনা করা, মানুষকে তার প্রতি পথ দেখানো এবং যা অকল্যাণ তা বর্ণনা করা ও তা থেকে সতর্ক করা ওয়াজিব, তেমনিভাবে দা‘ঈদের ওপরও তা ওয়াজিব। এ হাদীসে আরও বলা হয়েছে যে, এ উম্মতের প্রথম যুগের লোকগণ প্রচুর কল্যাণ এবং পরীক্ষা থেকে নিরাপত্তা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এ উম্মতের শেষাংশের লোকেরা এমন অকল্যাণ ও পরীক্ষার সম্মূখীন হবে যে, পরবর্তী ফিতনা পূর্ববর্তী ফিতনাকে হালকা করে দিবে। আর তার থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হচ্ছে, তাওহীদ ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা, মানুষের সাথে সদাচারণ করা, শাসকের বাই‘আতকে রক্ষা করা, তার বিরুদ্ধে অস্ত্র না ধরা এবং যে মুসলিমদের জামা‘আতে বিভক্তি সৃষ্টি করতে চায় তার সাথে যুদ্ধ করা।
ব্যাখ্যা
আমরা তোমাদের মধ্যে যাকে যাকাত, গণীমত ও অন্যান্য সম্পদ জমা করার কাজে নিযুক্ত করি, অতঃপর সে তা থেকে একটি সূঁচ অথবা তার চেয়ে কম কিছু লুকালো তা খিয়ানত হবে। কিয়ামতের দিন সে তা নিয়ে হাযির হবে। এ কথা শুনে আনসারদের মধ্যে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে তার ওপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব তার কাছ থেকে ফিরিয়ে নিতে অনুমতি চাইলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, তোমার কি হয়েছে? সে বলল, ‘আমি আপনাকে এ রকম কথা বলতে শুনলাম।’ তিনি বললেন, “আমি এখনো বলছি যে, যাকে আমরা কোনো কাজে নিযুক্ত করি, সে যেন অল্প-বেশি যাই হোক আমার কাছে নিয়ে আসে। অতঃপর তা থেকে তাকে যা দেওয়া হবে, তাই সে গ্রহণ করবে এবং যা থেকে তাকে বিরত রাখা হবে, তা থেকে বিরত থাকবে।”
ব্যাখ্যা
উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মুহাজিরদের জন্য বাৎসরিক চার হাজার দিরহাম ধার্য করলেন এবং তার ছেলে (ইবন উমার) এর জন্য ধার্য করলেন তিন হাজার পাঁচশ দিরহাম। কারণ, তিনি পিতার সাথে নাবালেগ অবস্থায় হিজরত করেছেন। তাই তাকে বালিগ মুহাজিরদের অন্তর্ভুক্ত করেননি। এ কারণে যারা নিজে নিজে হিজরত করেছেন তাদের থেকে তিনি তার ছেলের ভাতা কমিয়ে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর পর সম্পদের ব্যাপারে দুনিয়াবিমুখ ন্যায়পরায়ণ শাসক উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু অপেক্ষা অন্য কেউ ছিলেন না। এমনিভাবে যারাই মুসলিমদের দায়িত্বভার গ্রহণ করবে তাদের উচিত কোনোভাবেই স্বজনপ্রীতি না করা, আত্মীয়কে আত্মীয়তার কারণে কিংবা ধনীকে তার ধনাঢ্যতার কারণে অথবা দরিদ্রকে তার দারিদ্রতার কারণে; বরং প্রত্যেককে স্ব-স্ব স্থানে রাখা এবং তাদের প্রাপ্য দেওয়া। এটিই হচ্ছে আল্লাহভীতি ও ন্যায়পরায়ণতা।
ব্যাখ্যা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিনয়ের এটি একটি ঘটনা। একদা তিনি খুৎবা দিচ্ছিলেন, এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বলল, একজন অপরিচিত লোক এসেছে, সে তার দীন সম্পর্কে জানতে চায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ বন্ধ করে তার দিকে দ্রুত অগ্রসর হলেন এবং তার কাছে এসে পৌঁছলেন। অতঃপর তাঁর কাছে একটি চেয়ার নিয়ে আসা হলো। তিনি এ লোকটিকে দীন শিক্ষা দিচ্ছিলেন। কারণ, লোকটি অাগ্রহ করে জ্ঞানের মহব্বতে ছুটে এসেছে। সে আমল করার উদ্দেশ্যে দীন শিখতে চায়। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবা দেওয়া মুলতবি করে তার দিকে অগ্রসর হলেন এবং তাকে দীন শিক্ষা দিলেন। অতঃপর তিনি তার অসম্পন্ন ভাষণ পরিপূর্ণ করলেন।
ব্যাখ্যা
হাদীসের আলোচ্য বিষয়, ইবাদতে আত্মার ওপর কষ্ট চাপিয়ে দেওয়া অপছন্দ করা। যখন কোনো সালাত আদায়কারী সালাত আদায় অবস্থায় নিজের ওপর ঘুমের প্রচণ্ড চাপ অনুভব করে, তখন তার জন্য উচিত, সালাত ভেঙ্গে ফেলা বা সম্পন্ন করে ঘুমিয়ে পড়া এবং আত্মাকে কিছু সময় বিশ্রাম দেওয়া, যাতে ক্লান্ত থাকা অবস্থায় তার থেকে তার বিপক্ষে দো‘আ করা প্রকাশ না পায়।
ব্যাখ্যা
সহজ-সরলতা ও কোমলতা পরিহার করে কেউ দীনি কাজ করলে অবশ্যই ঐ কাজটি সম্পূর্ণ বা আংশিক পালন করতে সে অক্ষম হবে। অতএব, তোমরা দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো এবং (মধ্যপন্থার) নিকটবর্তী থাকো; যদিও দীনের সব কাজ পূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে নাও পারো। অতএব, যা মধ্যপন্থার কাছাকাছি তা অনুযায়ী আমল করো, স্থায়ীভাবে সম্পন্ন করা কাজের সাওয়াব লাভে আশান্বিত থাকো; যদিও তা কম আমল হয় এবং তোমাদের (দিনের বেলার) অবসর ও (রাতের) বিশ্রামের কিছু অংশে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাও। ইমাম নাওয়াবী রহ. বলেছেন, হাদীসে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী “দীন” শব্দটি মারফু‘ হিসেবে রয়েছে, যার কর্তা উল্লেখ করা হয় নি। “দীন”কে মানসূব হিসেবেও কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন। আবার (لن يشاد الدين أحد) এভাবেও বর্ণিত হয়েছে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী (إلا غلبه) অর্থাৎ দীন তার ওপর বিজয়ী হবে এবং সে কঠোরতা আরোপকারী দীনের মোকাবিলায় পরাজিত হবে; কারণ দীনের মধ্যে চলার অনেক পথ রয়েছে (শুধু কঠোরতাই একমাত্র পথ নয়)।
ব্যাখ্যা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালমান ও আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন করে দেন। একবার সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে উম্মুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে বিবাহিত নারীর মত দেখতে পান নি। অর্থাৎ তার জামা কাপড় সুন্দর ছিল না। তিনি এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে উম্মুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেন, আপনার ভাই আবুদ দারদা দুনিয়া, পরিবার-পরিজন, পানাহারসহ সবকিছু থেকে বিমুখী হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরে আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বাড়িতে আসলে তিনি সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর জন্য আহার্য প্রস্তুত করে তাকে খেতে দিলেন। তিনি সাওম পালনকারী ছিলেন। সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে সাওম ভঙ্গ করে তার সাথে খেতে বললেন। যেহেতু তিনি জানতেন আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সর্বদা সাওম পালন করতেন। আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সঙ্গে খেলেন। রাত হলে আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সালাত আদায়ে করতে দাঁড়াতে গেলেন। সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে রাতের শেষভাগ পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকতে বললেন। রাতের শেষভাগে দু’জনে উঠে সালাত আদায় করলেন এবং সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বুঝাতে চেয়েছেন যে, প্রতিটি মানুষের সাধ্যের বাইরে সালাত ও সিয়াম আদায় করা উচিৎ নয়; বরং তার এমনভাবে সালাত ও সিয়াম পালন করা উচিত যাতে কল্যাণ সাধন হয় আবার নিজের ওপর কষ্ট-ক্লেশও দূরীভূত হয়।
ব্যাখ্যা
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি উট দেখলেন, যার পেট ও পিঠ অনাহারে একত্র হয়ে গিয়েছিল। তা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোবা পশুদের সাথে দয়ার্দ্র হওয়ার নির্দেশ দিলেন। বস্তুত মানুষের ওপর দায়িত্ব হলো তারা যেন বোবা পশুদের সাথে ভালো ব্যবহার করে। তাদের উপর এমন বোঝা চাপিয়ে দিবে না যা তারা বহন করতে পারে না। তাদের খাবার ও পানীয়ের ব্যাপারে কার্পণ্য করবে না। ফলে যদি তার পিঠে আরোহণ করে তখন সেটাকে আরোহণ উপযোগী পাবে আর যদি তার গোস্ত খেতে হয় তবে সেটা খাওয়ার উপযোগী পাবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতের জন্য দুআ করেছেন যেন আল্লাহ তাআলা তাদের সকাল ও দিনের প্রথমভাগে বরকত দান করেন। যাতে তাদের কাজ সম্পন্ন করার সময় প্রশস্ত হয় এবং কাজে বরকত ও সমৃদ্ধি আসে। চাই তা উপার্জনের ক্ষেত্রে হোক বা ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে হোক কিংবা শত্রুর বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যের ক্ষেত্রে হোক অথবা অন্য যে কোনো আমলের ক্ষেত্রেই হোক না কেন। তাই তিনি দিনের প্রথমভাগে যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনী পাঠাতেন। এর আরও উদাহরণ হলো, সাখর বিন ওয়াদাআ রাদিয়াল্লাহু আনহু যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুআর বরকতে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছিলেন।
ব্যাখ্যা
অর্থ: সবচেয়ে সুন্দর সাথী চারজন। আর সবচেয়ে উত্তম সৈন্যদল চারশত জনবলে গঠিত সৈন্যদল । আর চার হাজার সৈন্যদল হলো সবচেয়ে উপকারী সৈন্যবাহিনী। আর যখন কোনো সৈন্যদলের সংখ্যা বারো হাজার হবে, অর্থাৎ বা তার চেয়ে বেশি হবে, তারা কখনোই পরাজিত হবে না। আর যদি পরাজিতও হয়, তবে তারা সংখ্যা কম হওয়ার কারণে নয়। তারা অন্য কারণে পরাজিত হবে। যেমন, দীনদারীতে ত্রুটি অথবা বেশি হওয়ার কারণে অহংকার বা গুনাহে লিপ্ত হওয়া বা আল্লাহর ইখলাস না থাকা ইত্যাদি।
ব্যাখ্যা
অর্থ: সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব মানুষের পিছনে থাকতেন, যাতে তিনি অবলোকন করতে পারেন মানুষের অবস্থা, তাদের মধ্যে যাদের সাহায্য প্রয়োজন তাদের সাহায্য করার জন্যে, যেমন অক্ষম এবং যার বাহন নেই তাকে তিনি বাহনে উঠিয়ে নিতেন। আর তিনি দুর্বলকে হাটাতেন, তাকে পিছনে বহন করতেন ও তার জন্যে দো‘আ করতেন।
এ হাদীসটি প্রমাণ করে যে, একজন মুসলিমের ওপর ওয়াজিব হলো, সর্বাবস্থায় শাসকদের কথা শোনা ও আনুগত্য করা, যদি কোনো খারাপ কর্মের নির্দেশ না দেওয়া হয় অথবা অসাধ্য কোনো কর্ম চাপিয়ে না দেওয়া হয়। যদিও তাতে কখনো কখনো তার কষ্ট হয় বা নিজের কোনো কোনো অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। ব্যক্তি স্বার্থের ওপর জন স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার লক্ষ্যে।
ব্যাখ্যা
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জানাচ্ছেন যে, যখন তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাই‘আত করতেন, তখন তিনি তাদের শুনতে ও মানতে নির্দেশ দিতেন। মানাকে তিনি সক্ষমতার সাথে শর্তারোপ করতেন। যখন কোনো মুসলিমকে কোনো শাসক তার সক্ষমতার বাহিরে কোনো কাজ করার নির্দেশ দেয়, তখন তার আনুগত্য করা জরুরি নয়। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা কাউকে তার সাধ্যের বাইরের কোনো দায়িত্ব দেন না।
No comments:
Post a Comment