Tuesday, December 2, 2025

অবৈধ পন্থায় প্রবাসে বসবাস করা এবং কাজ করার বিধান

 প্রশ্ন: অবৈধ হিসাবে প্রবাসে বসবাসকারী অনেক ঋণগ্রস্ত ভাই রয়েছেন যাদের দেশে এসে জীবন ধারণের কোন ব্যবস্থা নেই। তাদের ক্ষেত্রে অবৈধভাবে প্রবাসে থেকে অর্থ উপার্জন করা কি হালাল হবে?

উত্তর: একজন মানুষ যখন প্রবাসে যাওয়ার জন্য ভিসা গ্রহণ করে তখন সে দেশে গিয়ে সেখানকার আইন-কানুন মেনে চলার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বলে পরিগণিত হয়‌। অতএব সে আইন ও শরিয়ত উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে উক্ত দেশের প্রচলিত আইন-কানুন মেনে চলতে বাধ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা অঙ্গীকার (ও চুক্তিসমূহ) পূর্ণ কর।” [সূরা মায়েদা: ১]
আর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
المسلمونَ على شروطِهم
“মুসলিমগণ তাদের শর্তের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” [সহীহ আবু দাউদ, হা/৩৫৯৫] অর্থাৎ মুসলিমগণ তাদের সাথে কৃত শর্ত লঙ্ঘন করবে না।
সুতরাং প্রবাসীদের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সে দেশের কোনো আইন লঙ্ঘন করা জায়েজ নেই। (যদি শরিয়ত বিরোধী কোন আইন না হয়। তবে শরিয়ত বিরোধী আইন হলে তা মানা জায়েজ নয়)।
অতএব কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অবৈধ ভাবে প্রবাসে বসবাস করে তাহলে সে দেশের আইনের দৃষ্টিতে যেমন অপরাধী বলে গণ্য হবে তেমনি শরিয়তের দৃষ্টিতেও সে গুনাহগার হবে।
তবে হ্যাঁ, কোন ব্যক্তি যদি তার ইচ্ছার বাইরে কোন কারণে ‘অবৈধ’ হয়ে যায় তাহলে সে দেশে ফিরে আসার জন্য আইনানুগ পন্থায় চেষ্টা করবে। এ সময় তার জীবন ধারণ এবং দেশে ফেরত আসার খরচ যোগানের জন্য সে যেকোনো হালাল কাজ করতে পারে। কেননা এটা অপারগ অবস্থা। অপারগ অবস্থায় শরিয়তের ছাড় রয়েছে। ইসলামি ফিকহের একটি প্রসিদ্ধ মূলনীতি হলো,
الضرورة تبيح المحظورات
“জরুরত নিষিদ্ধ জিনিসকে বৈধ করে দেয়।” যেমন প্রচণ্ড ক্ষুধায় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য শূকর বা মরা প্রাণীর গোস্ত খাওয়া।
উল্লেখ্য যে, কোন অমুসলিম দেশে যাওয়ার আগে সেখানে কোন শরিয়ত বিরোধী কোন আইন মানার ব্যাপারে সে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। এমনটি হলে (বিশেষ কারণ ছাড়া) সে দেশে ভ্রমণ করা বা গমন করা জায়েজ নেই। অজ্ঞতাবশত সেখানে যাওয়ার পরে শরিয়ত বিরোধী আইন মানতে বাধ্য হতে হলে যথাসম্ভব দ্রুত সেখান থেকে দেশে ফিরে আসা অপরিহার্য। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

মাইজভান্ডারি দরবার শরীফ এই গুলো কি সহীহ

 প্রশ্ন: “মাইজভান্ডারি দরবার শরীফ” এই গুলো কি সহীহ ?

উত্তর: পাক-ভারত উপমহাদেশ সহ পৃথিবীতে এমন কোন পীরের দরবার বা খানকা নেই যেখানে বিদআতি বা শিরকি কার্যক্রম সংঘটিত না হয়। কোথাও কম কোথাও বেশি। বরং এগুলোই শিরক, বিদআত, কুসংস্কার, জাল-জয়ীফ হাদিস, আজগুবি কিচ্ছা-কাহিনী ইত্যাদির উৎপাদন ও পরিচর্যা কেন্দ্র। এরাই সমাজে ধর্মের নামে অধর্ম বিস্তারের কাজ করে থাকে। এরাই অজ্ঞ ও ধর্মভীরু মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে দ্বীনের অপব্যাখ্যা ও বিকৃতি সাধনের পাশাপাশি মানুষের অর্থ সম্পদ লুণ্ঠন এবং ধর্ম ব্যবসা পরিচালনা করে। এই সকল শয়তানের আখড়াগুলোর বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের সচেতন হওয়া আবশ্যক। এগুলোর পরিবর্তে আমাদের উচিত, তাওহিদ ও সুন্নাহর জ্ঞান সমৃদ্ধ ও বিশুদ্ধ আকিদার ধারক ও বাহক বিজ্ঞ আলেমদের শরণাপন্ন হওয়া, তাদের নিকট থেকে কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক সঠিক জ্ঞান অর্জন করে আমল করার পথ নির্দেশনা লাভ করা, দ্বীন সম্পর্কে কোন কিছু না জানলে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে সঠিক করণীয় বর্জনীয় সম্পর্কে জেনে নেওয়া।
মহান আল্লাহ তৌফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

পুরুষের অনুপস্থিতে কি মহিলা নবজাতক শিশুর কানে আযান দিতে পারে

 আসলে নব জাতকের কানে আজান দেয়া বৈধ না কি অবৈধ -এ বিষয়টিই দ্বিমত পূর্ণ। কেননা এ মর্মে হাদিসগুলো সহিহ-জঈফ হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের মাঝে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়।

যাহোক, তবে আযান দেয়ার হাদিসগুলোকে অনেক মুহাদ্দিস সহীহ বলেছেন আর যুগে যুগে মুসলিমদের মাঝে এই আমল চলে আসছে। সুতরাং নব জাতক শিশুর কানে আযান দেয়া জায়েজ রয়েছে-এটাই অধিক গ্রহণযোগ্য মত। তবে এ আজান দিবে পুরুষ। পুরুষের অনুপস্থিতিতে মহিলা আযান দিতে পারবে কি না এ বিষয়টিও মতানৈক্য পূর্ণ। এ মতানৈক্যের কারণ হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবীদের যুগে মহিলা কর্তৃক শিশুর নিকট আযান দেয়ার ব্যাপারে কোন হাদিস পাওয়া যায় না। এই কারণে অনেক আলেম বলেন, মহিলারা আযান দিতে পারবে না। তারা আরেকটি কারণ বলেন, আযান মূলত: পুরুষদের বৈশিষ্ট্য। চাই তা নামাযের জন্য হোক অথবা অন্য কারণে হোক, কেবল পুরুষরাই আজান দিবে; মহিলারা নয়। আরেকদল আলেম বলেন, এখানে আজান দেয়ার উদ্দেশ্য, শিশুর কানে আল্লাহর বড়ত্ব ও তাওহিদের বাণী পৌঁছে দেয়া। সুতরাং নারী বা পুরুষ যেই হোক আজান দিলে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়ে যায়। সুতরাং কোন কারণে পুরুষের আজান দেয়া অসম্ভব হলে যদি মহিলা নবজাতক শিশুর কানে আজান দেয় তাহলে তা যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। তবে এ আজান দিতে হবে নিচু স্বরে যেন তার আওয়াজ পরপুরুষ না শুনে। আল্লাহু আলাম।
-الله أعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

দুধ দিয়ে গোসল নিছক কুসংস্কার পূর্ণ কাজ এবং অপচয়ের শামিল

 আমাদের দেশে কেউ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে, কেউ রোগ থেকে মুক্ত হয়ে আর কেউ ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে দুধ দিয়ে গোসল করে করে। কেউ নতুন বিয়ে করে দুধ দিয়ে গোসল করে, আবার কেউ বউ তালাকের পরে দুধ দিয়ে গোসল করে। কেউ নির্বাচনে জয়লাভ করে আবার কেউ বা কেউ রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিয়ে দুধ দিয়ে গোসল করে!! এরকম নানা ধরণের সংবাদ আমরা প্রায়শই দেখি। এসব খবরে নেট দুনিয়া সয়লাব। কিন্তু এসব কারণে-অকারণে দুধ দিয়ে গোসল করার আদৌ কি কোনও ভিত্তি আছে নাকি এটা শুধুই আবেগ? প্রকৃতপক্ষে দুধ দিয়ে গোসল করার রীতি হিন্দুদের থেকে এসেছে। কিন্তু দুঃখ জনক বিষয় হল, দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে এবং বিধর্মীদের অন্ধ অনুকরণে ফলে এই জঘন্য প্রথা মুসলিমদের মধ্যেও প্রবেশ করেছে এবং অনেক নামধারী মুসলিম দেখাদেখি এই প্রথা পালন করে চলেছে।

❑ দুধ দিয়ে গোসল করার প্রথা কোথা থেকে এলো?
ভারতীয় উপমহাদেশে দুধকে পবিত্র উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। বৈদিক যুগ থেকেই এটি নানা আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হিন্দু ধর্মের মন্দির চর্চায় দেবমূর্তি বা প্রতীককে পবিত্র তরল (দুধ, পানি, ঘি, মধু ইত্যাদি) দিয়ে স্নান করানো বা ‘অভিষেক’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় রীতি। বিশেষত শিবলিঙ্গে দুধ ঢালা পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে করা হয়। দুধকে ‘সত্ত্ব’ গুণ বা শুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। জন্মাষ্টমী, মহা শিবরাত্রি, উপনয়ন, বিবাহ বা রাজ্যাভিষেকের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে দুধ দিয়ে স্নান করানো হতো। এটি পাপমোচন, আত্মশুদ্ধি এবং রাজাকে ‘দেব-মানব’ হিসেবে তুলে ধরার প্রতীক ছিল।
❑ দুধের পুষ্টিগুণ এবং দুধ দিয়ে গোসল করার ব্যাপারে ইসলামের বিধান:
নিঃসন্দেহে দুধ আল্লাহ তাআলার একটি বড় নেয়ামত। এটি মানব দেহের জন্য অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর একটি খাদ্য এবং পানীয় দ্রব্য। এতে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, খনিজ লবণ এবং পানি—এই ছয়টি উপাদানের প্রায় সঠিক অনুপাত থাকে। তাই একে একটি সুষম এবং আদর্শ খাদ্য বলা হয়ে থাকে। সুতরাং সঠিক নিয়মে তা গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা শারীরিকভাবে অনেক উপকৃত হতে পারি। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য চর্চা ছাড়া বিশেষ কোনো উপলক্ষে দুধ দিয়ে গোসল করার কোনও ভিত্তি নাই। বরং তা অত্যন্ত জঘন্য কুসংস্কার ও মূর্খতা সুলভ কাজ বলে বিবেচিত। পাশাপাশি এটি অকাজে সম্পদ নষ্ট করা এবং আল্লাহর নেয়ামতের অপচয় হিসেবে পরিগণিত। অমুসলিমদের অন্ধ অনুকরণ তো বটেই যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সুতরাং কোনও মুসলিমের জন্য এমন কাজ করা জায়েজ নাই।
🔹নিম্নে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে দুধ দিয়ে গোসল করার বিধান তুলে ধরা হল:
পূর্বোল্লিখিত উদ্দেশ্যে দুধ দিয়ে গোসল করা অর্থ অপচয়ের শামিল। আর কুরআনে একাধিক স্থানে অর্থ অপচয়ের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা কঠিন এসেছে। যেমন:
✪ ১. আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا ۚ إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
“তোমরা খাও ও পান করো। তবে অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয় কারীদের ভালোবাসেন না।”[সুরা আরাফ: ৩১]
✪ ২. আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَآتِ ذَا الْقُرْبَىٰ حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا
“আর আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরকে। আর কোনোভাবেই অপব্যয় করো না।” [সুরা বনি ইসরাইল: ২৬]
✪ ৩. অপচয় কারী শয়তানের ভাই: আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ
“নিশ্চয়ই যারা অপচয় করে, তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার রবের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।” [সুরা বনি ইসরাইল: ২৭]
❑ ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ মোচন, আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং জীবনের দুঃখ-কষ্টের অবসান কিংবা আনন্দময় পরিস্থিতিতে কী করণীয়?
ইসলাম পাপ মোচন, আত্মশুদ্ধি অর্জন এবং জীবনের দুঃখ-কষ্টের অবসান কিংবা আনন্দঘন আবেগময় পরিস্থিতিতে কী করণীয় তার সঠিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। আমাদের কর্তব্য, ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় কাজ করা এবং সব ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও মূর্খতা সুলভ কার্যক্রম এবং অন্য ধর্মের অন্ধ অনুকরণ থেকে দূরে থাকা।
❁ ১. মানুষ শয়তানের প্ররোচনা, কু প্রবৃত্তির তাড়না বা অজ্ঞতা বশত ভুল কাজ করতে পারে। কিন্তু যখন সে ভুল বুঝতে পারবে তখন তার জন্য করণীয় হল উক্ত পাপ বা ভুল কাজটি ছেড়ে দেওয়া। অতঃপর লজ্জিত অন্তরে আল্লাহর কাছে তওবা-ইস্তিগফার করা বা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং ভবিষ্যতে আর কখনো এমন কর্মে লিপ্ত না হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করা। তৎসঙ্গে ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।
কেউ যদি গুনাহ ও আল্লাহর নাফরমানি মূলক কর্ম পরিত্যাগ পূর্বক খাঁটি অন্তরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা না করে তাহলে এক মণ দুধ কেন দুধের নদীতে ডুব দিয়ে গোসল করলেও তার গুনাহ মোচন হবে না।
❁ ২. অনুরূপভাবে জীবনে আনন্দ দায়ক কোনও কিছু ঘটলে করণীয় হল, আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ
“তোমরা যদি কৃতজ্ঞ হও তবে আমি তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।” [সূরা ইবরাহিম: ৭]
কৃতজ্ঞতা আদায়ের অন্তর্ভুক্ত হল, মুখে আল হামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য) পাঠ করার পাশাপাশি একটি সেজদায়ে শোকর দেওয়া। এটাই সুন্নত সম্মত আমল। (শুকরিয়ার দু রাকাত নামাজ পড়ার ভিত্তি নাই)।
❑ সৌন্দর্য চর্চায় দুধের ব্যবহার কি জায়েজ?
কেউ যদি কেবল সৌন্দর্য চর্চার উদ্দেশ্যে দুধ ব্যবহার করে তাহলে তাতে শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনও সমস্যা নেই। কেননা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে দুধ ত্বকের জন্য উপকারী। দুধে থাকা প্রোটিন, ভিটামিন ‘এ’ এবং ‘ডি’ ত্বককে মসৃণ করে এবং রোদে পোড়া ভাব দূর করতে সাহায্য করে। দুধ ত্বকের মৃত কোষ দূর করতে সাহায্য করে। প্রাচীনকালে রোমানরা ত্বক কোমল রাখতে দুধ মিশ্রিত পানিতে গোসল করতেন এবং মিশরের রানি ক্লিওপেট্রাও এর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। অ্যালোভেরা মিশিয়ে গোসল করলে আরও বেশি উপকার পাওয়া যায়। আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরণের কুসংস্কার ও অজ্ঞতা সুলভ কার্যক্রম এবং অন্ধ অনুকরণ থেকে হেফাজত করুন এবং ইসলাম নির্দেশিত পথে চলার তওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পেছনে বৈজ্ঞানিক এবং শারঈ কারণ

 ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর বিভিন্ন সময় ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পেছনে বৈজ্ঞানিক এবং শার’ঈ কারণ নিম্নে তুলে ধরা হলো:

▪️(১) বৈজ্ঞানিক কারণ: আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তি অনুযায়ী ভূমিকম্পের প্রধান কারণ হলো—টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া:অর্থাৎ আধুনিক বিজ্ঞান বলে,অনেক আগে পৃথিবীর সব স্থলভাগ একত্রে ছিল। পৃথিবীর উপরিভাগে কতগুলো অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত বলে ধীরে ধীরে তারা আলাদা হয়ে গেছে। এই প্লেটগুলোকেই বিজ্ঞানীরা বলেন টেকটোনিক প্লেট।পৃথিবীর উপরিভাগ কয়েকটি বিশাল টেকটোনিক প্লেট দ্বারা গঠিত, যা ম্যান্টলের (ভূ-অভ্যন্তরের গলিত ও অর্ধগলিত অংশ) উপর ধীরে ধীরে ভাসমান অবস্থায় থাকে। এই প্লেটগুলো একে অপরের সাথে ক্রমাগত নড়াচড়া করে, কিন্তু ঘর্ষণের কারণে প্রায়শই প্লেটের প্রান্তগুলো একে অপরের সাথে আটকে যায়। প্লেটগুলো আটকে গেলেও তাদের নড়াচাড়ার গতিশক্তি থেমে থাকে না, ফলে আটকে থাকা অংশে চাপ বা শক্তি জমা হতে থাকে। যখন এই সঞ্চিত চাপ শিলার ধারণক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন হঠাৎ করে শিলা ভেঙে যায় এবং প্লেটগুলো একে অপরের পাশ দিয়ে দ্রুত পিছলে যায়। শক্তির এই আকস্মিক মুক্তির ফলে ভূগর্ভে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, যা পৃথিবীর ভূত্বকের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভূমিতে কম্পন তৈরি করে।এটাই ভূমিকম্প।
.
▪️(২) শারঈ কারন: নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাঁর শার’ঈ বিধানগুলোতে যেমন পরিপূর্ণ হিকমত রাখেন, তেমনি সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্রে প্রদত্ত সিদ্ধান্তগুলোতেও রয়েছে পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা। আল্লাহ্‌র অনন্ত হিকমতের অন্যতম একটি দিক হলো, তিনি বিভিন্ন নিদর্শনের মাধ্যমে বান্দাদের প্রতি সতর্কতা, স্মরণ ও ভয়ের অনুভূতি প্রেরণ করেন।এই ধরনের নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম হলো ভূমিকম্প। এ পৃথিবীতে ভূমিকম্প আল্লাহর বড় নিদর্শনসমূহের অন্যতম একটি নিদর্শন।এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করেন; তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া,ভয় প্রদর্শন করা কিংবা তাদেরকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে। এই নিদর্শনগুলো সংঘটনকালে মানুষের কর্তব্য আল্লাহর সম্মুখে নিজের দুর্বলতা, অক্ষমতা, হীনতা ও মুখাপেক্ষিতাকে স্মরণ করা। এগুলোকে স্মরণ করে দোয়া, রোনাজারি ও নত হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া। যাতে করে আল্লাহ এই মহা বিপদ থেকে সকল মানুষকে মুক্তি দেন। ভূমিকম্প এমন একটি ঘটনা, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে কখনো সংঘটিত হয়নি। বরং ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবার এটি ঘটে উমার ইবনুল খাত্তাব রা. এর খিলাফতের সময়। তাঁর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে তিনি এ ঘটনাকে অত্যন্ত অপছন্দ করেন এবং এতে ভয় অনুভব করেন।
.
আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَا نُرْسِلُ بِالْآيَاتِ إِلَّا تَخْوِيفًا “(আসলে) আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনসমূহ পাঠাই”(সূরা ইসরা/বনী ইসরাইল: ৫৯) তিনি আরও বলেন, وَمَا نُرِيهِم مِّنْ آيَةٍ إِلَّا هِيَ أَكْبَرُ مِنْ أُخْتِهَا ۖ وَأَخَذْنَاهُم بِالْعَذَابِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ“আমি তাদেরকে যে নিদর্শনই দেখাতাম, তাই হত পূর্ববর্তী নিদর্শন অপেক্ষা বৃহৎ এবং আমি তাদেরকে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম, যাতে তারা ফিরে আসে।”(সূরা যুখরূফ: ৪৮) আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন,أَفَلَمْ يَرَوْا إِلَىٰ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُم مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ ۚ إِن نَّشَأْ نَخْسِفْ بِهِمُ الْأَرْضَ أَوْ نُسْقِطْ عَلَيْهِمْ كِسَفًا مِّنَ السَّمَاءِ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّكُلِّ عَبْدٍ مُّنِيبٍ “তারা কি তাদের সামনের ও পশ্চাতের আকাশ ও পৃথিবীর প্রতি লক্ষ্য করে না? আমি ইচ্ছা করলে তাদের সহ ভূমি ধসিয়ে দেব অথবা আকাশের কোন খণ্ড তাদের উপর পতিত করব। আল্লাহ অভিমুখী প্রত্যেক বান্দার জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।”(সূরা সাবা: ৯) তিনি আরও বলেন,قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَىٰ أَن يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِّن فَوْقِكُمْ أَوْ مِن تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَكُم بَأْسَ بَعْضٍ ۗ انظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ الْآيَاتِ لَعَلَّهُمْ يَفْقَهُونَ “বল, আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম, অথবা তিনি তোমাদের দল-উপদলে বিভক্ত করে একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে সক্ষম।”(সূরা আল আনআম:৬৫) আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন,فَلَمَّاۤ أَخَذَتۡهُمُ ٱلرَّجۡفَةُ قَالَ رَبِّ لَوۡ شِئۡتَ أَهۡلَكۡتَهُم مِّن قَبۡلُ وَإِیَّـٰیَۖ أَتُهۡلِكُنَا بِمَا فَعَلَ ٱلسُّفَهَاۤءُ مِنَّاۤۖ إِنۡ هِیَ إِلَّا فِتۡنَتُكَ تُضِلُّ بِهَا مَن تَشَاۤءُ وَتَهۡدِی مَن تَشَاۤءُۖ أَنتَ وَلِیُّنَا فَٱغۡفِرۡ لَنَا وَٱرۡحَمۡنَاۖ وَأَنتَ خَیۡرُ ٱلۡغَـٰفِرِینَ”যখন তারা একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে আক্রান্ত হলো তখন মূসা বলল, “রব আমার! তুমি চাইলে তো আগেই এদেরকে ও আমাকে ধ্বংস করে দিতে পারতে। আমাদের মধ্যকার নির্বোধেরা যা করেছে, তার জন্য কি তুমি আমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে? এটি তো ছিল তোমার পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। এর মাধ্যমে তুমি যাকে চাও পথভ্রষ্ট করো, আবার যাকে চাও হিদায়াত দান করো। তুমিই তো আমাদের অভিভাবক। কাজেই আমাদের মাফ করে দাও এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করো। ক্ষমাশীলদের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ।”(সূরা আরাফ: ১৫৫)
.
নিঃসন্দেহে বর্তমানে যেসকল ভূমিকম্পগুলো ঘটছে তা মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শনগুলোর একটি যা দিয়ে তিনি তাঁর বান্দাদের ভয় দেখিয়ে থাকেন। এই ভূমিকম্প এবং অন্যান্য সকল দূর্যোগগুলো সংগঠিত হওয়ার ফলে অনেক ক্ষতি হচ্ছে, অনেকে মারা যাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে; এই দূর্যোগগুলো আসার কারণ হচ্ছে, শিরকী কার্যকলাপ (ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে মহান আল্লাহর অংশীদার বানানো) এবং মানুষের পাপ (মহান আল্লাহ যে কাজগুলো করতে নিষেধ করেছেন সে কাজগুলো করার কারণে)।উদাহরণস্বরূপ; শিরক, বিদআত, যিনা, ব্যভিচার,মদপান,হারাম ভক্ষণ, অবৈধ হত্যা ইত্যাদি।মহান আল্লাহ বলেন: “(হে মানুষ) যে বিপদ আপদই তোমাদের উপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই, এবং (তা সত্ত্বেও) আল্লাহ তাআলা তোমাদের অনেক (অপরাধ এমনিই) ক্ষমা করে দেন।” [সূরা আশ শূরা: ৩০] তিনি আরও বলেন:“যে কল্যাণই তুমি লাভ কর (না কেন, মনে রেখো), তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, আর যেটুকু অকল্যাণ তোমার উপর আসে তা আসে তোমার নিজের থেকে।” [সূরা আন নিসা : ৭৯] মহান আল্লাহ অতীত জাতীর উপর প্রেরিত আযাব সম্পর্কে বলেন: “অতঃপর এদের সবাইকে আমি (তাদের) নিজ নিজ গুণাহের কারণে পাকড়াও করেছি, এদের কারো উপর প্রচন্ড ঝড় পাঠিয়েছি (প্রচন্ড পাথরের বৃষ্টি) {যেভাবে লূত জাতির উপর প্রেরণ করা হয়েছিল}, কাউকে মহাগর্জন এসে আঘান হেনেছে {যেভাবে শুআইব (আ.) এর জাতীর উপর আঘাত হেনেছিল}, কাউকে আমি যমীনের নীচে গেড়ে দিয়েছি {যেভাবে কারুন জাতীদের উপর এসেছিল}, আবার কাউকে আমি (পানিতে) ডুবিয়ে দিয়েছি {নূহ জাতী ও ফেরাউন ও তার লোকদের কে যেভাবে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল}, (মূলত) আল্লাহ তাআলা এমন ছিলেন না যে তিনি এদের উপর যুলুম করেছেন, যুলুম তো বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর করেছে।” [সূরা আল আনকাবূত: ৪০]
.
হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন ,নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে আনছার ও মুহাজিরের দল! তোমাদেরকে পাঁচটি ব্যাপারে পরীক্ষায় ফেলে কষ্ট দেওয়া হবে। …তার পঞ্চমটি হ’ল وَمَالَمْ تَحْكُمْ اَئِمَّتُهُمْ بِكِتَابِ اللهِ وَيَتَخَيَّرُوْا مِمَّا أَنْزَلَ اللهُ إِلاَّ جَعَلَ اللهُ بَأَسَهُمْ بَيْنَهُمْ.”যখন আলেম ও শাসকগণ আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী শাসন কাঠামো পরিচালনা করবে না; বরং আল্লাহর দেওয়া বিধানের উপর নিজ ইচ্ছা প্রয়োগ করবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা মানুষের উপর দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভোগ, দুরবস্থা, দরিদ্রতা ও দুর্যোগ চাপিয়ে দিবেন”(ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯, হাদীছ হাসান) জাবির ইবনু আবদুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, এ আয়াত যখন অবতীর্ণ হলঃ “হে নবী আপনি বলে দিন তোমাদের উপর থেকে তোমাদের ওপর শাস্তি পাঠাতে তিনিই সক্ষম”-(সূরা আন’আম ৬/৬৫)। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হে আল্লাহ্! আমি আপনার সত্তার সাহায্যে আশ্রয় চাচ্ছি। আল্লাহ্ তখন বললেনঃ “কিংবা তোমাদের পায়ের নীচ হতে; তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি আপনার সত্তার সাহায্যে আশ্রয় চাচ্ছি। আল্লাহ্ বললেনঃ কিংবা তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ এটি অপেক্ষাকৃত সহজ।”(সহীহ বুখারী হা/৭৪০৬) আবূল-শায়খ আল-ইস্পাহানি এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেন, “বল: আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) ” যার ব্যাখ্যা হলো, তীব্র শব্দ, পাথর অথবা ঝড়ো হাওয়া; “অথবা তোমাদের পায়ের নীচ থেকে আযাব পাঠাতে সক্ষম”, যার ব্যাখ্যা হলো, ভুমিকম্প এবং ভূমি ধ্বসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া। এছাড়াও নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,”প্রচুর পরিমাণ ভূমিকম্প না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সঙ্ঘটিত হবে না” (সহীহ বুখারী, হা/১০৩৬)। অপর বর্ননায় আবু মালিক আশ‘আরী (রাঃ) বলেন,নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমার কিছু উম্মত মদ পান করবে এবং তার নাম রাখবে ভিন্ন। তাদের নেতাদেরকে গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সম্মান করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ভূমিকম্পের মাধ্যমে মাটিতেই ধসিয়ে দিবেন। আর তাদেরকে বানর ও শুকরে পরিণত করবেন”।(ইবনু মাজাহ, হা/৪০২০) একবার মদীনায় ভূমিকম্প হলে উমার (রাদিআল্লাহু আনহু) লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা কত দ্রুত নতুন নতুন অপকর্মে করে লিপ্ত হয়ে গেলে! যদি পুনরায় ভূমিকম্প হয়, তাহলে তোমাদের সাথে এখানে আমি বসবাস করবো না(ইবনু আবী শায়বাহ হা/৮৩৩৫) নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বললেন,”আমার এ উম্মতের উপর আল্লাহর রহমত আছে। আখেরাতে তারা (স্থায়ী) আযাব ভোগ করবে না। বরং তাদের কাফ্ফারা এভাবে হবে যে, দুনিয়াতে তাদের শাস্তি হবে ফিতনা-ফাসাদ, ভূমিকম্প এবং হত্যা”।(আবু দাউদ হা/৪২৭৮; সহীহুল জামে হা/১৩৯৬)।
.
ইমাম ইবনু আব্দুল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:لم يأت عن النبي صلى الله عليه وسلم من وجه صحيح أن الزلزلة كانت في عصره ولا صحت عنه فيها سنة وقد كانت أول ما كانت في الإسلام على عهد عمر فأنكرها وقال أحدثتم والله لئن عادت لأخرجن من بين أظهركم”নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ভূমিকম্প ঘটেছে এ মর্মে কোনো সহিহ সূত্রে কিছুই বর্ণিত হয়নি। এ বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে কোনো সুন্নাতও প্রমাণিত নয়। ইসলামে প্রথম ভূমিকম্প ঘটে হযরত উমার রা. এর সময়। তখন তিনি এ ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং বলেন: তোমরা অবশ্যই নতুন কিছু সৃষ্টি করেছ! আল্লাহর শপথ যদি এটি আবার ঘটে, তবে আমি তোমাদের মধ্য থেকে সরে যাবো।”(আত-তামহীদ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩১৮)
.
আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, আল-মুফাসসির, আল-ফাক্বীহ,আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আবু বকর ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যা, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,
وذكر الامام أحمد عن صفية قالت: زلزلت المدينة على عهد عمر، فقال: يا أيها الناس ما أسرع ما أحدثتم لإن عادت لا تجدوني فيها, وقال كعب: إنما زلزلت الأرض إذا عمل فيها بالمعاصي فترعد فرقا من الرب عز وجل أن يطلع عليها, وكتب عمر بن عبد العزيز إلى الأمصار أما بعد: فإن هذا الرجف شيء يعاتب الله عز وجل به العباد, وقد كتبت إلى سائر الأمصار يخرجوا في يوم كذا وكذا في شهر كذا وكذا فمن كان عنده شيء فليتصدق به, فإن الله عز و جل قال: قد أفلح من تزكى وذكر اسم ربه فصلى ـ وقولوا كما قال آدم: ربنا ظلمنا أنفسنا وإن لم تغفر لنا وترحمنا لنكونن من الخاسرين ـ وقولوا كما قال نوح: وإلا تغفر لى وترحمني أكن من الخاسرين ـ وقولوا كما قال يونس: لا إله إلا أنت سبحانك إني كنت من الظالمين
“ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) সাফিয়্যাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে,উমার রা. এর যুগে মদীনায় ভূমিকম্প হয়েছিল। তখন তিনি বললেন: হে মানুষ! তোমরা কত তাড়াতাড়ি নতুন নতুন পাপ কার্য সৃষ্টি করে ফেললে! যদি আবার এমন ঘটে, তবে তোমরা আমাকে আর মদীনায় পাবে না।কা‘ব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:যখন পৃথিবীতে পাপ বাড়ে, তখনই ভূমিকম্প ঘটে। কারণ, পৃথিবী আল্লাহ্‌র ভয়ে কেঁপে ওঠে এই ভয়ে যে আল্লাহ্‌ তাআলা এসব পাপ দেখবেন। আর উমার ইবনু আব্দিল আজীজ বিভিন্ন প্রদেশে লিখে পাঠালেন: এ ভূকম্পন এমন এক বিষয়, যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাঁর বান্দাদের সতর্ক করেন ও তিরস্কার করেন। আমি সকল প্রদেশে লিখেছি, তারা যেন অমুক মাসের অমুক দিনে বাইরে বের হয় যার কাছে যা আছে, তা যেন সদকা করে। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ বলেন:”নিশ্চয় সে-ই সফল, যে নিজেকে পবিত্র করলো এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করলোও সালাত আদায় করলো।”তোমরা আদম (আ.)-এর মতো বলো:”হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব। নূহ (আ.)-এর মতো বলো:”আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।” ইউনুস (আ.)-এর মতো বলো:”আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আপনি পবিত্র। নিশ্চয় আমি ছিলাম জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।”(ইবনু ক্বাইয়িম, আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃষ্ঠা: ৪৭; মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২২১; গৃহীত; ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-৩৭১১৭৯)
.
কাতাদা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন: “إن الله يخوِّف الناس بما شاء من آياته لعلهم يعتبرون، أو يذَّكَّرون، أو يرجعون، ثم قال: ذُكِر لنا أن الكوفة رجفت على عهد ابن مسعود رضي الله عنه، فقال: يا أيها الناس، إن ربكم يستعتبكم فأعْتِبوه؛ أي: اطلبوا منه أن يُزِيل عَتَبَهُ، بترك الذنوب، والتوبة النصوح”আল্লাহ্‌ তাঁর ইচ্ছামতো বিভিন্ন নিদর্শনের মাধ্যমে মানুষকে ভয় দেখান যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করে, স্মরণ রাখে, অথবা ফিরে আসে (তওবা করে)।তিনি আরও বলেন:আমাদের কাছে বর্ণিত হয়েছে যে ইবনু মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর যুগে কুফা শহর কেঁপে উঠেছিল। তখন তিনি বললেন: ‘হে মানুষ! তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের থেকে ফিরে আসা (সংশোধন) চাইছেন; অতএব তোমরা তাঁর সন্তুষ্টি ফিরিয়ে আনো।’ অর্থাৎ, পাপ ত্যাগ করে এবং আন্তরিক তওবার মাধ্যমে তোমরা আল্লাহ্‌র অসন্তুষ্টি দূর করো।”(তাফসিরে তাবারী; খণ্ড: ১৭; পৃষ্ঠা: ৪৭৮)
.
সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকদের কাছে এরকম আরো অনেক ঘটনার বিবরণ রয়েছে।সুতরাং যখন কোথাও ভূমিকম্প সংগঠিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন মানুষদের উচিত মহান আল্লাহর নিকট অতি দ্রুত তওবা করা, তাঁর নিকট নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা এবং মহান আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা যেভাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূর্য গ্রহণ দেখলে বলতেন: “যদি তুমি এরকম কিছু দেখে থাক, তখন দ্রুততার সাথে মহান আল্লাহকে স্মরণ করো, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা। অতএব মুসলমানদের কর্তব্য হলো এ ধরনের (ভূমিকম্পের) নিদর্শন পতিত হলে তারা যেন দ্রুত তাওবার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার দিকে ফিরে আসে, আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট একমাত্র দ্বীন ইসলামকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরা এবং আল্লাহ তাআলা যেসব শিরকী কার্যকলাপ ও পাপ কাজ করতে নিষেধ করেছেন (যেমন: নামায পরিত্যাগ না করা, যাকাত আদায় করা থেকে বিরত না হওয়া, সুদ-ঘুষ না খাওয়া, মদ পান না করা, ব্যাভিচার না করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা না করা, গান ও বাদ্যযন্ত্র না শোনা, হারাম কাজ সমূহ ভঙ্গ না করা প্রভৃতি) তা থেকে বিরত থাকা।—এসবই আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার উপায়। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হলো: মানুষ যদি ঈমান ও তাকওয়া অবলম্বন করে, তাঁর বিধান প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে তিনি আসমান-যমীনের বরকত দান করেন; আর অমান্য করলে পাকড়াও করেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَاۤ اِلٰۤی اُمَمٍ مِّنۡ قَبۡلِكَ فَاَخَذۡنٰهُمۡ بِالۡبَاۡسَآءِ وَ الضَّرَّآءِ لَعَلَّهُمۡ یَتَضَرَّعُوۡنَ فَلَوۡلَاۤ اِذۡ جَآءَهُمۡ بَاۡسُنَا تَضَرَّعُوۡا وَ لٰكِنۡ قَسَتۡ قُلُوۡبُهُمۡ وَ زَیَّنَ لَهُمُ الشَّیۡطٰنُ مَا كَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ فَلَمَّا نَسُوۡا مَا ذُكِّرُوۡا بِهٖ فَتَحۡنَا عَلَیۡهِمۡ اَبۡوَابَ كُلِّ شَیۡءٍ ؕ حَتّٰۤی اِذَا فَرِحُوۡا بِمَاۤ اُوۡتُوۡۤا اَخَذۡنٰهُمۡ بَغۡتَۃً فَاِذَا هُمۡ مُّبۡلِسُوۡنَ“আর অবশ্যই আপনার আগে আমারা বহু জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি; অতঃপর তাদেরকে অর্থসংকট ও দুঃখ-কষ্ট দিয়ে পাকড়াও করেছি, যাতে তারা রোনাজারি করে। তাদের কাছে যখন আমার শাস্তি এসেছিল তখন তারা রোনাজারি করলো না কেন? বরং তাদের অন্তর কঠিন হয়েছিল এবং তারা যা করছিল শয়তান তা তাদের দৃষ্টিতে শোভাময় করেছিল। অতঃপর তাদেরকে যে উপদেশ করা হয়েছিল তারা যখন তা ভুলে গেল তখন আমরা তাদের জন্য প্রতিটি (আনন্দের) জিনিসের দরজা খুলে দিলাম। এভাবে তাদেরকে যা দেয়া হয়েছিল তারা যখন তা নিয়ে আনন্দিত তখন আমি অকস্মাৎ তাদেরকে পাকড়াও করি। তখনই তারা নিরাশ হয়ে যায়।”[সূরা আনআম, আয়াত: ৪২-৪৪] এ কারণে ফিকাহবিদ আলেমগণ ভূমিকম্পের সময় বেশি বেশি ইস্তিগফার করা, দোয়া করা, আল্লাহর কাছে রোনাজারি করা ও দান করাকে মুস্তাহাব বলেন। যেমনি ভাবে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময়ও এটি মুস্তাহাব।
.
আল্লামা যাকারিয়া আল-আনসারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: ويستحب لكل أحد أن يتضرع بالدعاء ونحوه عند الزلازل ونحوها من الصواعق والريح الشديدة، وأن يصلي في بيته منفردا لئلا يكون غافلا؛ لأنه صلى الله عليه وسلم كان إذا عصفت الريح قال: اللهم إني أسألك خيرها وخير ما فيها وخير ما أرسلت به، وأعوذ بك من شرها وشر ما فيها وشر ما أرسلت به. رواه مسلم”ভূমিকম্প, বজ্রপাত ও তীব্র বাতাসের সময় প্রত্যেকের জন্য মুস্তাহাব হলো: দোয়াতে মশগুল হয়ে রোনাজারি করা, ঘরে একাকী নামায আদায় করা; যাতে করে গাফেল না হয়। কেননা যখন তীব্র বাতাস বইতো তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন:اللَّهُمَّ إِنِّي أَسأَلك خَيرهَا وَخير مَا فِيهَا وَخير مَا أرْسلت بِهِ وَأَعُوذ بك من شَرها وَشر مَا فِيهَا وَشر مَا أرْسلت بِهِ “(হে আল্লাহ্‌! আমি আপনার কাছে এই বাতাসের কল্যাণ চাই, এর মধ্যে যে কল্যাণ আছে সেটা চাই এবং যে কল্যাণ দিয়ে এটাকে পাঠানো হয়ে তা চাই এবং আমি আপনার কাছে বাতাসের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই, এর মধ্যে যে অনিষ্ট অন্তর্ভুক্ত আছে তা থেকে আশ্রয় চাই এবং যে অনিষ্টসহ এটাকে পাঠানো হয়েছে তা থেকে আশ্রয় চাই)। (সহিহ মুসলিম; আসনাল মাতালিব শারহু রাওযুত তালিব; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৮৮; তুহফাতুল মুহতাজ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৬৫) আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী। আর আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর প্রতি শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

Translate