আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা ও আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাগ বা ঘৃণা পোষণ করার গুরুত্ব, মর্যাদা ও অর্থ:
‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাগ বা ঘৃণা পোষণ করা’ ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আকিদাগত বিষয়। ইসলামের একে ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’ও বলা হয়। তাই এ সম্পর্ক সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা জরুরি।
তাই নিম্নে অতিসংক্ষেপে এ বিষয়ে আলোচনা পেশ করা হলো:
❒ ১মত: ‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাগ বা ঘৃণা পোষণ করা’র মর্যাদা:
এ বিষয়ে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নে কয়েকটি হাদিস পেশ করা হল। যথা:
🔷 যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ভালোবাসবে আর আল্লাহর জন্যই রাগ বা দুশমনি পোষণ করবে সে প্রকৃত ইমানের স্বাদ উপভোগ করবে:
“আনাস বিন মালিক রা. হতে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ طَعْمَ الْإِيمَانِ: مَنْ كَانَ يُحِبُّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ، وَمَنْ كَانَ اللهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَمَنْ كَانَ أَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يَرْجِعَ فِي الْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْقَذَهُ اللهُ مِنْهُ
“তিনটি জিনিস যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে ইমানের স্বাদ উপভোগ করতে পারবে।
১. যে ব্যক্তি কোনও মানুষকে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসবে।
২. যার নিকট আল্লাহ ও আল্লাহর রসুল অন্য সব কিছু হতে অধিক প্রিয় হবে।
৩. এবং আল্লাহ তাকে কুফরি থেকে রক্ষা করার পর পুনরায় কুফরিতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া তার নিকট অধিক প্রিয় মনে হবে।” [সহীহ বুখারী, হাদিস: ২১, ৬০৪১ ও সহীহ মুসলিম, হাদিস: ৪৩, ৬৮]
🔷 আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য রাগ বা ঘৃণা পোষণ করা ইমানের সবচেয়ে মজবুত বন্ধন:
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
« إِنَّ أَوْثَقَ عُرَى الْإِيمَانِ أَنْ تُحِبَّ فِي اللهِ، وَتُبْغِضَ فِي اللهِ »
“ইমানের সবচেয়ে সুদৃঢ় বন্ধন হল, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা পোষণ করা”। [জারির ইবনে আব্দুল হামিদ এর সনদে ইমাম বায়হাকী শুয়াবুল ইমানে হাদিসটি বর্ণনা করেন। হাদিস নং ১৪]
🔷 এটি আল্লাহর নিকট অতি পছন্দনীয় আমল:
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« إِنَّ أَحَبَّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللهِ الْحُبُّ فِي اللهِ، وَالْبُغْضُ فِي اللهِ »
“নিশ্চয় আল্লাহর নিকট উত্তম আমল হল, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা পোষণ করা”।[আবু দাউদ, হাদিস: ৪৫৯৯]
❒ ২য়ত: আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা ও আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাগ বা ঘৃণা পোষণ করার অর্থ:
🔸‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসা’-এর অর্থ হল, আল্লাহর কারণে ভালোবাসা বা আল্লাহকে কেন্দ্র করে ভালোবাসা। কাউকে আমি ভালোবাসবো এ কারণে যে, সে আল্লাহকে ভালোবাসে, আল্লাহর ইবাদত করে, তার মধ্যে ইমান, তাকওয়া ও দ্বীনদারী বিদ্যমান রয়েছে…। এ ভালোবাসার পেছনে দুনিয়ার কোনও স্বার্থ নেই। এর আলামত হলো ৪টি। যথা:
১. তার জন্য কল্যাণ কামনা করা ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া।
২. ভালো কাজে তাকে সাহায্য করা।
৩. তার অনুপস্থিতিতে তার জন্য দুআ করা।
৪. তার যে কোনও সমস্যায় পাশে দাঁড়ানো এবং তার প্রয়োজন পূরণে সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
🔸‘আল্লাহর উদ্দেশ্যই রাগ বা ঘৃণা পোষণ’ করার অর্থ হল, কোন ব্যক্তিকে আমি ঘৃণা করব বা তার সাথে দুশমনি পোষণ করব এ কারণে যে, সে আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে ঘৃণা করে বা তাদের সাথে দুশমনি পোষণ করে, আল্লাহর সাথে শিরক ও কুফরিতে লিপ্ত, সে বিদআতে নিমজ্জিত, পাপাচারে মত্ত, তার মধ্যে ইমান ও তাকওয়া নেই, কুরআন-সুন্নাহর বরখেলাফ কাজ করে..ইত্যাদি।
সুতরাং আল্লাহ ভীরু, দ্বীনদার, সৎ লোক ও আহলে ইলমদের কেবল আল্লাহর জন্যই পরিপূর্ণভাবে ভালোবাসতে হবে। আর কাফের-মুশরিক, বিদআতি, মুনাফিক এবং আল্লাহর দুশমনদেরকে পরিপূর্ণভাবে ঘৃণা করতে হবে এবং আন্তরিক দুশমনি পোষণ করতে হবে। তাদের সাথে আন্তরিক ভালোবাসা স্থাপন করা জায়েজ নয়। এটি ইমানের দাবি।
অবশ্য কাফের-মুশরিকদের সাথে দুনিয়াবি স্বার্থে, যেমন: ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, আত্মীয়ার বন্ধন, কূটনৈতিক বিষয় ইত্যাদি কারণে বাহ্যিক সম্পর্ক রাখায় কোন দোষ নেই। আর যার মধ্যে কিছু নেকির কাজ আছে আর কিছু গুনাহর কাজ আছে, যারা কিছু কুরআন-সুন্নাহর অনুকূলে কাজ করে আর কিছু কুরআন-সুন্নাহর বিপরীত কাজ করে অর্থাৎ যার মধ্যে ভালো-মন্দ দু ধরণেরই আচরণ বিদ্যমান রয়েছে তাদেরকে যতটুকু নেকির কাজ বা ইসলামের আদর্শ আছে ততটুকু ভালোবাসতে হবে আর যতটুকু গুনাহ বা ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম রয়েছে ততটুকু ঘৃণা করতে হবে।
➤ বি:দ্র: কাফের-মুশরেক ও পাপাচারীদের প্রতি রাগ, ঘৃণা বা দুশমনি পোষণ করার অর্থ এই নয় যে, তাদের সাথে কোন ধরণের যোগাযোগ রাখা যাবে না, তাদের সাথে কথা বলা যাবে না বা তাদেরকে মোটেই সাহায্য-সহযোগিতা করা যাবে না। বরং সঠিক কথা হল, দাওয়াতের স্বার্থে বা নিজের প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে তাদের সাথে বাহ্যিক সম্পর্ক রাখা যাবে, চলাফেরা করা যাবে এবং তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা যাবে। এভাবে সুসম্পর্ক রেখে তাকে দ্বীনের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতে হবে। হতে পারে, এই সদাচরণ ও সাহায্য-সহযোগিতা তাদেরকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করবে, ইসলামের প্রতি তাদের বিদ্বেষ ও দুশমনি লাঘব করবে অথবা তদেরকে কুরআন-সুন্নাহর দিকে ফিরে আসতে উৎসাহিত করবে। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬▬ ◈◉◈▬▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।