Saturday, November 15, 2025

কুরআন হিফয করার পর ভুলে যাওয়ার শাস্তি কী

 ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর ভুলে যাওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই তো কবি বলেন: “ইনসানকে ইনসান (ভুলকারী) নাম দেয়া হয়েছে যেহেতু সে ভুলে যায়। আর কলব (অন্তর) কে কলব (পরিবর্তনশীল) নাম দেয়া হয়েছে যেহেতু সে পরিবর্তিত হয়”। আর নিঃসন্দেহে কুরআন অধ্যয়ন করা, তেলাওয়াত করা ও মুখস্থ করা উত্তম নেকীর কাজ। কুরআন ভুলে যাওয়ার আশংকা রোধ করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়মিত কুরআন পড়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। অর্থাৎ মুখস্থকৃত অংশ নিয়মিত পুনঃপাঠ করা ও বারবার তেলাওয়াত করা। অন্যদিকে কুরআন ভুলে যাওয়া গর্হিত কাজ। কারণ এতে আল্লাহর কিতাব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া ও এ কিতাবকে পরিহার করার আলামত পাওয়া যায়।তাছাড়া কুরআন ভুলে যাওয়ার আশঙ্কায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বারবার পাঠ করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন,”যে ব্যক্তি অন্তরে কুরআন গেঁথে (মুখস্থ) রাখে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ মালিকের ন্যায়, যে উট বেঁধে রাখে। যদি সে উট বেঁধে রাখে, তবেই উট তার নিয়ন্ত্রণে থাকে, কিন্তু যদি সে বাঁধন খুলে দেয়, তবে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়”।(সহীহ বুখারী হা/৫০৩১; সহীহ মুসলিম হা/৭৮৯)। অন্যত্র তিনি বলেছেন,”যদি কেউ এভাবে বলে যে, আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গিয়েছি, তাহলে তা তার জন্য খুবই খারাপ। বরং তাকে তো ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা কুরআনকে স্মরণ রাখ। কারণ কুরআন মানুষের হৃদয় থেকে পা বাঁধা পলায়নপর চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও অধিক পলায়নপর। ছাড়া পেলেই পালিয়ে যায়ে অর্থাৎ স্মরণ রাখার চেষ্টা না করলেই ভুলে যায়”।(সহীহ বুখারী, হা/৫০৩২; সহীহ মুসলিম, হা/৭৯০; মিশকাত, হা/২১৮৮)।

.
▪️কুরআন হিফয করার পর ভুলে যাওয়ার শাস্তি:
.
কুরআন ভুলে যাওয়ার হুকুম কি এ ব্যাপারে আলেমগণ মতানৈক্য করেছেন: কেউ বলেন: কুরআন ভুলে যাওয়া কবিরা গুনাহ। কোন কোন মতে এটি গুনাহর কাজ; তবে কবিরা গুনাহর পর্যায়ে পৌঁছবে না। আবার কারো কারো মতে এটি এমন একটি মুসিবত যা বান্দার অন্তর ও দ্বীনদারিকে আক্রান্ত করে। এর ফলে বান্দার কোন কোন আমলের উপর আল্লাহর শাস্তি নামতে পারে। যদিও এটি কবিরা গুনাহ নয় বা পাপ নয়;অনেকের মতে এ মাসয়ালায় এটি তৃতীয়টি সর্বাধিক অগ্রগণ্য অভিমত। তবে আমি এই বিষয়ে আহালুল আলেমগনের মতামত গুলো পর্যালোচনা করে যেটা বুঝতে পারলাম সেটা হল কুরআন হিফয করার পর ভুলে যাওয়া দুইটি অবস্থা হতে পারে যথা: (১).স্বভাবগত ভুলে যাওয়া– অর্থাৎ,মানুষের প্রকৃতিগত দুর্বলতা ও স্মৃতিশক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে ভুলে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে বান্দার জন্য কোনো গুনাহ নেই, এবং এর জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হবে না। (২).গাফলতির কারণে ভুলে যাওয়া–অর্থাৎ, কুরআনের প্রতি উদাসীনতা, অবহেলা, কিংবা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ফলে ভুলে যাওয়া।এটি এক ধরনের আত্মিক বিপর্যয় বা মুসিবত, যা বান্দার অন্তর ও ঈমানি শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। এর ফলে বান্দার কোন কোন আমলের উপর আল্লাহর শাস্তি নামতে পারে।আবুল ‘আলিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”আমরা কোন ব্যক্তির কুরআন শিক্ষার পর তা থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখার কারণে ভুলে যাওয়াকে বড় পাপ হিসাবে গণ্য করতাম”।ইবনু সীরীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”কেউ কুরআন ভুলে গেলে লোকেরা তাকে কঠিন ভাষায় ভৎর্সনা করত”।(ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী হা/৫০৩৮-এর আলোচনা)। তবে জেনে রাখা ভালো'”যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করে ভুলে যাবে সে ক্বিয়ামতের দিন অঙ্গহানী অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে মর্মে বর্ণিত হাদীছটি যঈফ (আবু দাঊদ হা/১৪৭৪; মিশকাত হা/২২০০; যঈফুল জামে‘ হা/৫১৩৬, ৫১৫৩)। এছাড়া ‘কুরআন বা কুরআনের কোন আয়াত ভুলে যাওয়া সবচেয়ে বড় গোনাহ‘ মর্মে বর্ণিত হাদীছটিও যঈফ”।(তিরমিযী, মিশকাত হা/৭২০, যঈফুল জামে‘ হা/৩৭০০)।অতএব আমরা বলব—একজন হাফেযে কুরআন,নারী হোক বা পুরুষ—তার জন্য কুরআন মুখস্থ করার পর এর তেলাওয়াতে গাফলতি করা বা নিয়মিত তেলাওয়াতের প্রতি উদাসীন থাকা মোটেই সমীচীন নয়। বরং একজন হাফেযের উচিত সওয়াবের আশায় প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ কুরআন তেলাওয়াত করা; যাতে তার মুখস্থ কুরআন অক্ষুণ্ণ থাকে, ভুলে না যায় এবং সে কুরআনের নির্দেশনা ও হুকুম-আহকাম দ্বারা নিজেকে উপকৃত করতে পারে।
.
▪️একনজরে কুরআন হিফয করার পর ভুলে যাওয়া সম্পর্কে সন্মানিত আলেমদের বক্তব্য নিম্নরূপ:
.
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যা (রহিমাহুল্লাহ) বলেন—فإن نسيان القرآن من الذنوب “নিশ্চয়ই কুরআন ভুলে যাওয়া হলো গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।”(মাজমু‘ আল-ফাতাওয়া (১৩/৪২৩)
.
শাইখ যাকারিয়া আল-আনসারী আল-শাফেয়ি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:( ونسيانه كبيرة ) , وكذا نسيان شيء منه ؛ لخبر ( عُرضت عليَّ ذنوب أمتي فلم أر ذنبا أعظم من سورة من القرآن أو آية أوتيها رجل ثم نسيها ) ، وخبر ( من قرأ القرآن ثم نسيه لقي الله عز وجل يوم القيامة أجذم ) رواهما أبو داود ) “(কুরআন ভুলে যাওয়া) একটি কবিরা গুনাহ। এমনকি কুরআনের কিছু অংশ ভুলে যাওয়াও একই রকম। কারণ হাদীসে এসেছে—‘আমার উম্মতের গুনাহসমূহ আমাকে দেখানো হলো। আমি এমন কোনো গুনাহ দেখিনি যা এর চেয়ে বড়, যে ব্যক্তি কুরআনের একটি সূরা বা আয়াত মুখস্থ করেছিল, তারপর তা ভুলে গেছে।’ এবং অন্য হাদীসে এসেছে—‘যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে তারপর তা ভুলে যায়, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে কাটা হাতওয়ালা অবস্থায় উপস্থিত হবে।’এই দুই হাদীস আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন।”(আসনাল মাত্বালিব; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৬৪) আর-রামলী ‘নিহায়াতুল মুহতাজ’ গ্রন্থে এর ব্যাখ্যায় বলেন—قوله : ( ونسيانه كبيرة موضعه إذا كان نسيانه تهاوناً وتكاسل“তিনি বলেছেন, (কুরআন ভুলে যাওয়া কবিরা গুনাহ)—এর অর্থ হলো,যখন ভুলে যাওয়াটা হবে অবহেলা ও অলসতার কারণে।”(হাশিয়াতুর রামলী; আসনাল মাত্বালিব; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৬৪) এই আলোচনা থেকে বুঝা যায় কুরআন ভুলে যাওয়া কবিরা গুনাহ নয়; বরং এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক ধরনের পরীক্ষা বা শাস্তি। সাধারণত এমনটি তখনই ঘটে, যখন কেউ কুরআন তিলাওয়াত ও তার ওপর আমল করা থেকে গাফেল হয়ে যায়, এবং নিয়মিত পুনরাবৃত্তি করে মুখস্থ অংশকে সতেজ রাখে না। অথচ তাকে উভয় বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—কুরআনের ওপর আমল করা এবং নিয়মিত পাঠ করা।যখন সে এসব অবহেলা করে, তখন আল্লাহ তাআলা তাকে সেই মহান নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করেন—এটাই এক প্রকার শাস্তি।তবে যদি কেউ দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে ভুলে যায়, তাহলে তার ওপর কোনো গুনাহ নেই; বরং তার উচিত নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা এবং পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে মুখস্থ অংশকে দৃঢ় রাখা। কেননা এটাই কুরআন মুখস্থ রাখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
.
যারা বলেছেন যে এটি “মুসীবাহ” (বিপদ বা দুর্ভাগ্য): হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানি (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:وأخرج أبو عبيد من طريق الضحاك بن مزاحم موقوفاً قال : ” ما مِن أحد تعلم القرآن ثم نسيه إلا بذنب أحدثه ؛ لأن الله يقول : ( وما أصابكم من مصيبة فبما كسبت أيديكم ) ، ونسيان القرآن من أعظم المصائب “আবু উবাইদ (রাহিমাহুল্লাহ) দাহহাক ইবনু মুযাহিম থেকে বর্ণনা করেছেন:“যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করেছে,তারপর তা ভুলে গেছে, সে কোনো না কোনো গুনাহ করেছে। কারণ আল্লাহ বলেন:”আর তোমাদের প্রতি যে মুসীবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল।”(সূরা আশ-শূরা: ৩০) আর কুরআন ভুলে যাওয়া হলো সবচেয়ে বড় বিপদগুলোর একটি।”(ইবনু হাজার; ফাতহুল বারী; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ৮৬)
.
আবার যারা বলেছেন এটি এক ধরনের “শাস্তি” তাদের বক্তব্য উল্লেখ করে হাফিজ ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:قال أبو العباس القرطبي – رحمه الله – :مَن جمع القرآن : فقد علت رتبته ، ومرتبته ، وشرف في نفسه ، وقومه شرفاً عظيماً ، وكيف لا يكون ذلك و ” من حفظ القرآن فكأنما أدرجت النبوة بين كتفيه ” [ قاله عبد الله بن عمرو بن العاص ، وانظر ” السلسلة الضعيفة ” ( 5118 ) ]، وقد صار ممن يقال فيه : ” هو مِن أهلِ الله تعالى وخاصته ” [ رواه ابن ماجه ( 215) وهو صحيح ] ، وإذا كان كذلك : فمِن المناسب تغليظ العقوبة على من أخلَّ بمزيته الدينية ، ومؤاخذته بما لا يؤاخذ به غيره ، كما قال تعالى : ( يا نساء النبي من يأتِ منكن بفاحشة مبينة يضاعف لها العذاب ضعفين ) ؛ لاسيما إذا كان ذلك الذنب مما يحط تلك المزية ويسقطها ؛ لترك معاهدة القرآن المؤدي به إلى الرجوع إلى الجهالة”আবুল আব্বাস আল-কুরতুবি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:”যে ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ করেছে, তার মর্যাদা ও অবস্থান উঁচু হয়েছে, এবং সে তার নিজের ও জাতির মাঝে মহান সম্মান অর্জন করেছে। আর কেনই বা এমনটা হবে না,যখন (হাদীসে) বলা হয়েছে,”যে ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ করে, তার দুই কাঁধের মাঝে যেন নবুয়্যাত গুঁজে দেওয়া হয়েছে।”[এটি আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রা.) বলেছেন, এবং ইমাম আলবানী রাহিমাহুল্লাহ হাদীসটি দুর্বল বলেছেন ‘আস-সিলসিলাতুদ-দ্বা’ঈফাহ’ হা/৫১১৬)] এবং সে এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যাদের সম্পর্কে বলা হয়: ‘সে আল্লাহ তা’আলার আপনজন ও বিশেষ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।”(ইবনু মাজাহ হা/২১৫ সনদ সহীহ) কাজেই, যখন কুরআনে হাফিজ হওয়া এমন উচ্চ মর্যাদা,তখন যদি কেউ তা অবহেলা করে, তার বিরুদ্ধে শাস্তি কঠোর হওয়া যুক্তিযুক্ত, যেমন নবীদের স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন—“হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্য অশ্লীলতা করলে,তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে।”(সূরা আহযাব: ৩০) বিশেষ করে যদি সেই পাপ এমন হয় যা ঐ বিশেষ মর্যাদাকে হ্রাস করে দেয় ও বিলুপ্ত করে ফেলে যেমন কুরআনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করা, যা তাকে আবার অজ্ঞতার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।”(আল-মুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখীসে কিতাবে মুসলিম, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪১৯)
.
এ জন্য কুরআন হিফয করার পর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে ধরে রাখার। এ ব্যাপারে সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,فلا يليق بالحافظ له أن يغفل عن تلاوته ، ولا أن يفرط في تعاهده ، بل ينبغي أن يتخذ لنفسه منه ورداً يوميّاً يساعده على ضبطه ، ويحول دون نسيانه ؛ رجاء الأجر ، والاستفادة من أحكامه ، عقيدة ، وعملاً ، ولكن مَن حفظ شيئاً مِن القرآن ثم نسيه عن شغل ، أو غفلة : ليس بآثم ، وما ورد من الوعيد في نسيان ما قد حفظ : لم يصح عن النبي صلى الله عليه وسلم “অতএব,যে ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ করে,তার উচিত নয় এর তেলাওয়াত থেকে বিমুখ হওয়া, বা এর প্রতি যত্ন নেওয়া থেকে অবহেলা করা। বরং, তার উচিত প্রতিদিন কুরআনের একটি নির্দিষ্ট অংশ (ওয়ার্দ) নির্ধারণ করে নেওয়া—যা তাকে মুখস্থ অংশ দৃঢ়ভাবে সংরক্ষণে সহায়তা করবে এবং ভুলে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে।সে এটি করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রতিদানের আশায়, এবং কুরআনের শিক্ষা ও বিধান থেকে আকীদা ও আমল উভয় দিক থেকেই উপকৃত হওয়ার উদ্দেশ্যে। আর কেউ যদি কুরআন মুখস্থ করার পর ব্যস্ততা ও উদাসীনতার কারণে ভুলে যায়, তাহলে সে গুনাহগার হবে না। কেননা কুরআন ভুলে যাওয়ার শাস্তি সম্পর্কে যে দলীল পেশ করা হয়, তা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে ছহীহসূত্রে প্রমাণিত নয়”।(ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ৪র্থ খণ্ড; পৃষ্ঠা: ৯৯)।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: “আমরা ইলম অন্বেষণকারী ছাত্ররা দলিল-প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের জন্য অনেক আয়াত মুখস্থ করি। কিন্তু বছরের শেষে তার অনেক কিছুই ভুলে যাই। এতে কি আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত হব, যাদেরকে মুখস্থকৃত বিষয় ভুলে যাওয়ার কারণে শাস্তি দেওয়া হবে? জবাবে শাইখ বলেন:
نسيان القرآن له سببان :
الأول : ما تقتضيه الطبيعة .
والثاني : الإعراض عن القرآن ، وعدم المبالاة به .
فالأول : لا يأثم به الإنسان ، ولا يعاقب عليه ، فقد وقع من رسول الله صلى الله عليه وسلم حين صلى بالناس ، ونسي آية ، فلما انصرف ذكَّره بها أبيّ بن كعب ، فقال له النبي صلى الله عليه وسلم : ( هلا كنت ذكرتنيها ) ، وسمع رسول الله قارئاً يقرأ ، فقال : ( يرحم الله فلاناً فقد ذكرني آية كنت أنسيتها ) .
وهذا يدل على أن النسيان الذي يكون بمقتضى الطبيعة : ليس فيه لوم على الإنسان .أما ما سببه الإعراض ، وعدم المبالاة : فهذا قد يأثم به ، وبعض الناس يكيد له الشيطان ، ويوسوس له أن لا يحفظ القرآن لئلا ينساه ويقع في الإثم ! والله سبحانه وتعالى يقول : ( فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفاً ) النساء/ 76 ، فليحفظ الإنسان القرآن ؛ لأنه خير ، وليؤمل عدم النسيان ، والله سبحانه عند ظن عبده به
“কুরআন ভুলে যাওয়ার দু’টি কারণ আছে: প্রথম: স্বভাবগত কারণ। দ্বিতীয়: কুরআন থেকে বিমুখ হওয়া এবং ভ্রুক্ষেপ না করা। প্রথম কারণে কোন গুনাহ হবে না এবং শাস্তি ধার্য হবে না। এমনকি এটি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল, রাসূল (ﷺ) যখন সালাতের ইমামতি করেছিলেন, তখন তিনি একটি আয়াত ভুলে গিয়েছিলেন। অতঃপর নামাজ শেষ করার পর উবাই ইবনু কা‘ব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে সেই আয়াতটির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। তখন নবী ﷺ বললেন: “তুমি আমাকে তা স্মরণ করিয়ে দাওনি কেন?”(আবূ দাঊদ হা/৯০৭) আর একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক ক্বারীর তিলাওয়াত শুনলেন এবং বললেন: “আল্লাহ তাকে রহম করুন! আমাকে এমন আয়াত স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যা আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছিল।”(সহীহ মুসলিম হা/১৭১১) এটা প্রমাণিত হয় যে, স্বভাবগত কারণে মানুষ ভুলে যেতে পারে এতে তিরস্কারের কিছু নেই। অপরদিকে কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া ও ভ্রুক্ষেপ না করার কারণে গুনাহ হবে। কতিপয় মানুষকে শয়তান আয়ত্বাধীন করে নেয় এবং এভাবে কুমন্ত্রনা দেয় যে, কুরআন মুখস্থ করো না, তা ভুলে যাবে। এতে গুনাহ হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“অতএব তোমরা শয়তানের বন্ধুদের সঙ্গে যুদ্ধ করো;নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল দুর্বল।”(সূরা নিসা: ৭৬) সুতরাং,মানুষের উচিত কুরআন মুখস্থ করা, কারণ এটি সর্বতোভাবে কল্যাণকর। এবং তার উচিত এই আশা পোষণ করা যে, সে তা ভুলে যাবে না। নিশ্চয়ই, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর বান্দার তাঁর সম্পর্কে ধারণার উপরই আচরণ করেন।”(ইবনু উসাইমীন, কিতাবুল ইলম,পৃষ্ঠা: ৯৬–৯৭)
.
পরিশেষে আল্লাহ আমাদেরকে এবং আপনাকে এমন কাজ করার তৌফিক দান করুন যা তিনি পছন্দ করেন এবং যাতে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরআন তিলাওয়াত করা বা কবরের পাশে কুরআন পড়ার শরয়ি হুকুম কী

 প্রশ্ন: মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরআন তিলাওয়াত করা বা কবরের পাশে কুরআন পড়ার শরয়ি হুকুম কী? এ তিলাওয়াতের সওয়াব কি মৃতের কাছে পৌঁছে?

▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি। অতঃপর দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের শহর-গ্রাম সর্বত্র মৃত ব্যক্তিদের জন্য যে ইবাদতগুলো চালু রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো—মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত করা এবং সেই তিলাওয়াতের সওয়াব তাদের উদ্দেশ্যে দান বা কবরে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু এ ধরনের প্রথার পক্ষে স্পষ্ট কোনো ইসলামিক দলিল রয়েছে কি না, তা অনেক সময় যাচাই-বাছাই করা হয় না।জেনে রাখুন, ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হলো—সকল ইবাদত কেবল তওফিফিয়ায় বা কুরআন ও সুন্নাহর প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। একজন প্রকৃত ইমানদারের কর্তব্য হলো দলিলের অনুসরণ করা, নতুন উদ্ভাবন করা নয়। ইসলামে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কিংবা তার কবরের পাশে কুরআন তিলাওয়াত করলে সেই তিলাওয়াতের সওয়াব মৃতের কাছে পৌঁছে কি না—এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে দুটি মত রয়েছে:
.
▪️প্রথম মত: মৃতের পক্ষ থেকে সম্পাদিত সব নেক আমলের সওয়াব তার কাছে পৌঁছে যায়। এতে কুরআন তিলাওয়াত, রোযা, সালাত এবং অন্যান্য সকল ইবাদতই অন্তর্ভুক্ত।এটি হানাফী ও হাম্বলী মাযহাবের বিখ্যাত মত, আর শাফেয়ী মাযহাবের কিছু আলেমও এ মতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।এ মতের সমর্থনে তারা দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) তার সহীহ বুখারীতে:بَاب مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ نَذْرٌ”মানত আদায় না করে কেউ যদি মারা যায়।” নামে অধ্যায় রচনা করে বলেন;وَأَمَرَ ابْنُ عُمَرَ امْرَأَةً جَعَلَتْ أُمُّهَا عَلَى نَفْسِهَا صَلاَةً بِقُبَاءٍ فَقَالَ صَلِّي عَنْهَا وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ نَحْوَهُ”ইবনু ‘উমার (রাঃ) এক মহিলাকে আদেশ করেছিলেন যার মা কুবার মসজিদে সালাত আদায় করবে বলে মানত করেছিল। তিনি তাকে বলেছিলেন, তার পক্ষ থেকে সালাত আদায় করতে। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-ও এরকম বর্ণনা করেছেন।”(সহীহ বুখারী অধ্যায়: ৮৩/৩০ হা/৬৬৯৮)
.
আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষ,গ্রন্থে এসেছে;اختلف العلماء في قراءة القرآن للميت وإهداء ثوابها له، فذهب الحنفية والحنابلة إلى جواز قراءة القرآن للميت وإهداء ثوابها له، قال ابن عابدين نقلا عن البدائع: ولا فرق بين أن يكون المجعول له ميتا أو حيا، والظاهر أنه لا فرق بين أن ينوي به عند الفعل للغير أو يفعله لنفسه ثم بعد ذلك يجعل ثوابه لغيره، وقال الإمام أحمد: الميت يصل إليه كل شيء من الخير، للنصوص الواردة فيه، ولأن الناس يجتمعون في كل مصر ويقرؤون يهدون لموتاهم من غير نكير فكان إجماعا، قاله البهوتي من الحنابلة.”মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত করা এবং তার সওয়াব তাকে উৎসর্গ করার বিষয়ে আলেমগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।হানাফি ও হাম্বলি মাযহাবের ফকীহগণ বলেন—মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত করা এবং তার সওয়াব তাকে ইহসান (উৎসর্গ) করা জায়েয ও গ্রহণযোগ্য। ইবনু ‘আবিদীন (রহিমাহুল্লাহ) আল-বাদায়েউস-সানায়ি‘ থেকে বর্ণনা করেছেন: “যার প্রতি সওয়াব পৌঁছানো উদ্দেশ্য, সে মৃত হোক বা জীবিত তাতে কোনো পার্থক্য নেই। বাহ্যিকভাবে দেখা যায়, কাজটি অন্যের জন্য নিয়ত করে করা বা প্রথমে নিজের জন্য করে পরে তার সওয়াব অন্যকে পৌঁছে দেওয়া — উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।”ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:“নেক আমলের সবকিছুই মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যায়, কারণ এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নস (প্রমাণ) বিদ্যমান। তাছাড়া, মানুষ প্রত্যেক শহরে তাদের মৃতদের জন্য একত্র হয়, কুরআন পাঠ করে এবং তাদের সওয়াব উৎসর্গ করে থাকে— অথচ কেউ এর বিরোধিতা করে না।সুতরাং এটি এক প্রকারের ঐকমত্য (ইজমা‘) বলে গণ্য হয়েছে।”এই বক্তব্যটি হাম্বলী আলেম আল-বুহূতি (রাহিমাহুল্লাহ)-এর দ্বারাও বর্ণিত হয়েছে।”(আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ; খণ্ড: ৩৩; পৃষ্ঠা: ৬০)
.
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী’ হানাফি (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:১০১৬ হি:মতান্তরে ১০১০ হি:] বলেন;وفي الهداية: مذهب أهل السنة والجماعة أن الإنسان له أن يجعل ثواب عمله لغيره: صلاة. أو صوماً، أو صدقة، أو غيرها. يعني قراءة قرآن، وأذكار، وأدعية”আল-হিদায়া গ্রন্থে বলা হয়েছে: আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব হলো—মানুষ তার নিজের আমলের সওয়াব অন্য কাউকে দান করতে পারে; তা সালাত (নামায) হোক, সাওম (রোযা) হোক, সাদাকা (দান) হোক কিংবা অন্য কোনো ইবাদত হোক—যেমন কুরআন তিলাওয়াত, যিকর ও দোআ ইত্যাদি।”(ফাতহু বাবিল ইনায়াহ বি শারহিন নিকায়াহ” খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৪০; এবং হাশিয়াতু ইবনে আবিদীন; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৫৯৫)।
.
প্রিয় পাঠক! যদিও এই মতের পক্ষে কিছু আলেম রয়েছেন, তবে দলিলের দিক থেকে এটি দূর্বল মত। কারণ এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো সুস্পষ্ট সহিহ বর্ণনা নেই। এছাড়াও, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা হামজা রাদিয়াল্লাহু আনহু, তাঁর স্ত্রী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা এবং তাঁর তিন কন্যা, যারা তাঁর জীবদ্দশায় মারা গিয়েছিলেন, তিনি তাঁদেরকে উৎসর্গ করে কোরআন তেলাওয়াত, কোরবানি, রোজা বা সালাত ইত্যাদি কিছুই আদায় করেননি। একইভাবে, সাহাবায়ে কেরামদের কারও কাছ থেকেও এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়নি।সুতরাং যদি এটি শরীয়তসম্মত হতো, তবে তাঁরা অবশ্যই এ কাজটি করতেন। শরীয়তের দৃষ্টিতে যা বৈধ এবং যার সওয়াব মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছায়, তা হলো: হজ্ব, ওমরাহ, ওয়াজিব রোজা, সাদকা (দান) এবং দোয়া।
.
▪️দ্বিতীয় মত: মৃত ব্যক্তির কাছে কোনো নেক আমলের সওয়াব পৌঁছায় না; কেবল সেই আমলগুলো ব্যতীত, যেগুলোর বিষয়ে শরিয়তের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ বিদ্যমান। এটি শাফেয়ী, এবং মালেকি মাজহাবের প্রসিদ্ধ মত।bআর দলিলের আলোকে এটাই অধিকতর সঠিক এবং শক্তিশালী (রাজেহ) মত।কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা হামজা (রাদিয়াল্লাহু আনহু), তাঁর মহীয়সী স্ত্রী খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এবং তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করা তিন কন্যার কারও জন্যই তিনি (ﷺ) কুরআন তিলাওয়াত করেননি, কোরবানি দেননি, রোজা রাখেননি বা তাদের পক্ষ থেকে সালাত আদায় করেননি—এমন কোনো প্রমাণ সহিহ সূত্রে বর্ণিত নেই। সাহাবায়ে কেরামের কারও থেকেও এরকম কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় না।অতএব, যদি এ ধরনের আমল শরিয়তে বৈধ ও প্রমাণিত হতো, তবে নিশ্চয়ই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবাগণ আমাদের আগে তা করতেন। তবে শরয়ি দলিল দ্বারা যা ব্যতিক্রম হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এবং যার সওয়াব মৃত ব্যক্তির নিকট পৌঁছে যায়, তা হলো—হজ্ব, ওমরাহ, ওয়াজিব রোজা, দান-সদকা ও তাদের জন্য দোয়া এবং তাদের ঋণ পরিশোধ করা ইত্যাদি।
.
এই মতের পক্ষে প্রমাণ হলো আল্লাহ তাআলার বাণী:وَ اَنۡ لَّیۡسَ لِلۡاِنۡسَانِ اِلَّا مَا سَعٰی “আর মানুষ যা চেষ্টা করে, তা ছাড়া তার জন্য আর কিছুই নেই।”(সূরা আন-নাজম: ৩৯) এবং রাসূল (ﷺ)-বানী: প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যখন মানুষ মারা যায় তখন তার আমল স্থগিত হয়ে যায়; তবে তিনটি আমল ছাড়া: সদকায়ে জারিয়া, এমন জ্ঞান যা থেকে মানুষ উপকৃত হয় কিংবা নেক সন্তান যে তার তার জন্য দোয়া করে।”(সহিহ মুসলিম হা/১৬৩১)
.
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহ্‌ তাআলা বান্দার মর্যাদা উন্নীত করেন। তখন বান্দা বলে, এই মর্যাদা আমি কিভাবে পেলাম? তখন আল্লাহ্‌ বলেন: তোমার জন্য তোমার সন্তানের দোয়ার কারণে।” (তাবারানীর ‘আদ-দোয়া’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৩৭৫), হাইছামী তাঁর ‘মাজমাউয যাওয়ায়েদ’ গ্রন্থে (১০/২৩৪) হাদিসটিকে ‘বায্‌যার’’এর বর্ণনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বাইহাকী তাঁর ‘আস-সুনানুল কুবরা’ গ্রন্থে (৭/৭৮) হাদিসটি সংকলন করেছেন] ইমাম যাহাবী তাঁর ‘আল-মুহায্‌যাব’’গ্রন্থে (৫/২৬৫০) বলেন: হাদিসটির সনদ শক্তিশালী। হাইছামী বলেন: সনদের বর্ণনাকারীগণ সকলে সহিহ হাদিসের বর্ণনাকারী; শুধু আসেম বিন বাহদালা ব্যতীত। তিনি ‘হাসান’ হাদিসের রাবী।
.
হাফেজ ইবনে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) আল্লাহর বাণী: (وأن ليس للإنسان إلا ما سعى) অর্থ:”আর এই যে, মানুষ তাই পায় যা সে চেষ্টা করে”(সূরা নাজম:৩৯) এর তাফসিরে তিনি বলেন: “ومن هذه الآية استنبط الشافعي ومن تبعه أن القراءة لا يصل إهداء ثوابها إلى الموتى ؛ لأنه ليس من عملهم ولا كسبهم ، ولهذا لم يندب إليه رسول الله صلى الله عليه وسلم أمته ولا حثهم عليه، ولا أرشدهم إليه بنص ولا إيماء ، ولم ينقل عن أحد من الصحابة رضي الله عنهم ، ولو كان خيراً لسبقونا إليه وباب القربات يقتصر فيه على النصوص ، ولا يتصرف فيه بأنواع الأقيسة والآراء ، فأما الدعاء والصدقة ، فذاك مجمع على وصولها ومنصوصٌ من الشارع عليها “এই আয়াত থেকে ইমাম আশ-শাফেয়ী (রহিমাহুল্লাহ) এবং তাঁর অনুসারীগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, কুরআন তিলাওয়াতের সওয়াব মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পৌঁছানো বৈধ নয়; কারণ এটি মৃত ব্যক্তির নিজস্ব কর্ম বা অর্জন নয়। এই কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে এর জন্য উৎসাহিত করেননি; তাদেরকে এর প্রতি আহ্বান জানাননি; না কোনো স্পষ্ট বাণীতে, না কোনো ইঙ্গিতপূর্ণভাবে। এমনকি সাহাবিদের কারো পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কিছুই বর্ণিত হয়নি।আর যদি এটি কল্যাণকর (সুন্নাত ও নেক কাজের) অন্তর্ভুক্ত হতো, তবে নিশ্চয়ই সাহাবাগণ আমাদের আগে তা করতেন।কারণ,‘নৈকট্য ও ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো—এগুলো কেবল শরয়ি দলিলের উপর নির্ভরশীল; এখানে কিয়াস (তুলনামূলক যুক্তি) বা ব্যক্তিগত মতামতের কোনো অবকাশ নেই। তবে দো‘আ ও সদকা (দান)-এর সওয়াব পৌঁছানো বিষয়ে উম্মতের মধ্যে সর্বসম্মতি (ইজমা‘) রয়েছে, এবং শরিয়ত প্রণেতা (রাসূলুল্লাহ ﷺ) এ বিষয়ে স্পষ্ট দলিল দ্বারা তা অনুমোদন করেছেন।”।”(তাফসিরে ইবনু কাসীর; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ২৫৮)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,طبعة دار إحياء التراث العربي، بيروت: “وأما قراءة القرآن: فالمشهور من مذهب الشافعي أنه لا يصل ثوابها إلى الميت “কুরআন তেলাওয়াতের বিষয়ে ইমাম শাফেয়ী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মাজহাবে প্রচলিত মত হলো, মৃত ব্যক্তির কাছে এর সওয়াব পৌঁছায় না।”(ইমাম নববী; শারহু সহীহ মুসলিম; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৯০)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে মা-এর জন্য কুরআন তেলাওয়াত ও সাদকার সওয়াব জীবিত বা মৃত অবস্থায় দান করার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বলেন:
أما قراءة القرآن فقد اختلف العلماء في وصول ثوابها إلى الميت على قولين لأهل العلم ، والأرجح أنها لا تصل لعدم الدليل ؛ لأن الرسول صلى الله عليه وسلم لم يفعلها لأمواته من المسلمين كبناته اللاتي مُتْن في حياته عليه الصلاة والسلام ، ولم يفعلها الصحابة رضي الله عنهم وأرضاهم فيما علمنا ، فالأولى للمؤمن أن يترك ذلك ولا يقرأ للموتى ولا للأحياء ولا يصلي لهم ، وهكذا التطوع بالصوم عنهم ؛ لأن ذلك كله لا دليل عليه ، والأصل في العبادات التوقيف إلا ما ثبت عن الله سبحانه أو عن رسوله صلى الله عليه وسلم شرعيته . أما الصدقة فتنفع الحي والميت بإجماع المسلمين ، وهكذا الدعاء ينفع الحي والميت بإجماع المسلمين ، فالحي لا شك أنه ينتفع بالصدقة منه ومن غيره وينتفع بالدعاء ، فالذي يدعو لوالديه وهم أحياء ينتفعون بدعائه ، وهكذا الصدقة عنهم وهم أحياء تنفعهم ، وهكذا الحج عنهم إذا كانوا عاجزين لكبر أو مرض لا يرجى برؤه فإنه ينفعهم ذلك ، ولهذا ثبت عنه صلى الله عليه وسلم : أن امرأة قالت يا رسول الله إن فريضة الله في الحج أدركت أبي شيخا كبيرا لا يثبت على الراحلة أفأحج عنه ؟ قال: ” حجي عنه” وجاءه رجل آخر فقال : يا رسول الله إن أبي شيخ كبير لا يستطيع الحج ولا الظعن أفأحج عنه وأعتمر ؟ قال:” حج عن أبيك واعتمر” فهذا يدل على أن الحج عن الميت أو الحي العاجز لكبر سنه أو المرأة العاجزة لكبر سنها جائز ، فالصدقة والدعاء والحج عن الميت أو العمرة عنه، وكذلك عن العاجز كل هذا ينفعه عند جميع أهل العلم، وهكذا الصوم عن الميت إذا كان عليه صوم واجب سواء كان عن نذر أو كفارة أو عن صوم رمضان لعموم قوله صلى الله عليه وسلم : ” من مات وعليه صيام صام عنه وليه” متفق على صحته ، ولأحاديثٍ أخرى في المعنى ، لكن من تأخر في صوم رمضان بعذر شرعي كمرض أو سفر ثم مات قبل أن يتمكن من القضاء فلا قضاء عنه ولا إطعام ؛ لكونه معذورا اهـ .
“কুরআন তেলাওয়াতের সওয়াব মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো নিয়ে আলেমদের মধ্যে দুটি মত রয়েছে।তবে অধিকতর সঠিক মত হলো, তা পৌঁছায় না, কারণ এর কোনো দলিল নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মৃত মুসলিম স্বজনদের জন্য (যেমন তাঁর কন্যাগণ যারা তাঁর জীবদ্দশায় মারা গিয়েছিলেন) এটি করেননি, এবং আমাদের জানামতে সাহাবায়ে কেরামও তা করেননি। তাই একজন মুমিনের জন্য উত্তম হলো, এ কাজ থেকে বিরত থাকা; মৃত বা জীবিত কারও জন্য কুরআন তেলাওয়াত করা কিংবা সালাত আদায় না করা। অনুরূপভাবে, তাদের পক্ষ থেকে নফল রোজা রাখাও প্রমাণিত নয়; কারণ এর কোনো শরয়ি দলিল নেই।ইবাদতের মূলনীতি হলো ‘তাওক্বীফ’ (যা আল্লাহ বা তাঁর রাসূল দ্বারা প্রমাণিত), শুধুমাত্র আল্লাহ বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রমাণিত বিষয় ছাড়া। তবে সাদকা (দান) সর্বসম্মতভাবে জীবিত ও মৃত উভয়ের জন্য উপকারী, তেমনি দোয়াও সর্বসম্মতভাবে জীবিত ও মৃত উভয়ের জন্য উপকারী। জীবিত ব্যক্তি নিঃসন্দেহে তার নিজের বা অন্যের সাদকা এবং দোয়া দ্বারা উপকৃত হয়। যে ব্যক্তি তার জীবিত পিতামাতার জন্য দোয়া করে, তারা তার দোয়ায় উপকৃত হয়, এবং তাদের জন্য সাদকাও তাদের উপকার করে। অনুরূপভাবে, বার্ধক্য বা আরোগ্যহীন রোগের কারণে অক্ষম হলে তাদের পক্ষ থেকে হজ্ব করাও তাদের উপকার করে। এ কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক মহিলা এসে বলেছিলেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরযকৃত হজ্ব আমার বৃদ্ধ পিতার উপর এমন অবস্থায় এসেছে যে তিনি সওয়ারীর উপর স্থির থাকতে পারেন না। আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে হজ করতে পারি?’ তিনি বললেন: ‘তুমি তাঁর পক্ষ থেকে হজ্ব করো।’ অন্য একজন লোক এসে বললেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতা খুবই বৃদ্ধ, তিনি হজ্ব ও সওয়ারী বহন করতে পারেন না। আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে হজ ও ওমরাহ করতে পারি?’ তিনি বললেন: ‘তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ্ব ও ওমরাহ করো।’এটি প্রমাণ করে যে, মৃত বা বার্ধক্যজনিত অক্ষম জীবিত পুরুষ বা নারীর পক্ষ থেকে হজ করা বৈধ। সুতরাং সাদকা, দো‘আ, মৃত বা অক্ষমের পক্ষ থেকে হজ্ব ও ওমরাহ এ সবই আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে তাদের উপকার করে।অনুরূপভাবে, যদি মৃত ব্যক্তির ওপর কোনো ওয়াজিব রোযা বাকি থাকে—তা মানত, কাফফারা বা রমজানের কাজা যাই হোক—তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ হাদীসের কারণে তার অভিভাবক তার পক্ষ থেকে রোযা রাখবে: “যে ব্যক্তি মারা গেল এবং তার ওপর রোযা বাকি ছিল, তার অভিভাবক যেন তার পক্ষ থেকে রোযা রাখে।(সহীহ মুত্তাফাক আলাইহ)।তবে যদি কেউ অসুস্থতা বা সফরের মতো শরয়ি ওজরের কারণে রমজানের রোযা বিলম্বিত করে এবং কাজা করার সুযোগ পাওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করে, তবে তার পক্ষ থেকে কাজা বা ফিদিয়া কিছুই দিতে হবে না, কারণ সে ওজরযুক্ত অবস্থায় মারা গেছে।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৪৬)
.
তবে হা, মৃত ব্যক্তির উপকারে আসে দান-সদকা, দো‘আ তার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ কিংবা হজ্ব উমরাহ ইত্যাদি তা হোক উত্তরাধিকারী কিংবা পরের পক্ষ থেকে। নাইলুল মাআবির বি শারহি দালিলিত তালিব’ গ্রন্থে এসেছে-وكلَّ قربةٍ فَعَلَها مسلمٌ ، وجعَلَ ثوابَها لمسلمٍ ، حيٍّ أو ميّتٍ : حصَل له ثوابُها ، ولو جَهِلَ الجاعلُ من جعلَه لهُ ، كالدعاءِ إجماعاً ، والاستغفارِ”জীবিত বা মৃত মুসলমানের জন্য যদি কোন মুসলিম নেক কাজ করে এর সওয়াব উৎসর্গ করে মুসলিম সে সওয়াব পাবে। যদিও সে মুসলিম না জানে কে তার জন্য নেক কাজটি করল। এমন নেক কাজের মধ্যে রয়েছে- দুআ ও ইসতিগফার।”(নাইলুল মাআবির বি শারহি দালিলিত তালিব খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৩৭)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: একজন মানুষ কি তার মাল দান করে সেই দানের সওয়াব অন্য কারো সাথে ভাগ করতে পারে?
তিনি উত্তর দিলেন:يجوز أن يتصدق الشخص بالمال وينويها لأبيه وأمه وأخيه ، ومن شاء من المسلمين ، لأن الأجر كثير ، فالصدقة إذا كانت خالصة لله تعالى ومن كسب طيب تضاعف أضعافاً كثيرة ، كما قال اله تعالى : ( مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ) البقرة/261. وكان النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يضحي بالشاة الواحدة عنه وعن أهل بيته “একজন মানুষ তার ধন-সম্পদ দিয়ে দান করতে পারে এবং তা উদ্দেশ্য করতে পারে তার বাবা-মা, ভাই এবং ইচ্ছেমতো মুসলিমদের জন্য। কারণ সওয়াব অনেক বেশি। দান যদি পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ তাআলার জন্য হয় এবং সৎভাবে অর্জিত অর্থ থেকে করা হয়, তাহলে তা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন,”যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশ শস্যদানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ”।(সূরা বাকারা: ২৬১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ছাগল কুরবানি করতেন নিজের জন্য এবং নিজের পরিবারের জন্য।”(ইবনু উসাইমীন; মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ২৪৯)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:الصدقة تقبل وتنفع ، عن الأب والأم وعن غيرهما ، فالصدقة فيها خير كثير عن الحي والميت
“পিতামাতার জন্য বা অপর কারো জন্য সদকা করলে কবুল হয় এবং উপকার দেয়। অতএব জীবিত মৃত উভয়ের জন্য সদকার মধ্যে বহু কল্যাণ রয়েছে। সমাপ্ত নুরুন (১৪/৩০৩) আলাদ দারব থেকে]
.
পরিশেষে আমরা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন, আপনাকে বাবার ভালবাসার কারণে উত্তম প্রতিদান দেন এবং আপনার বাবাকে ক্ষমা করে দেন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)এর কিছু নাসীহাহ।
▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফিজাহুল্লাহ।
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব।

ইসলামের দৃষ্টিতে অনশন ধর্মঘট

 অনশন বা উপবাস বলতে শাব্দিক ভাবে বোঝায়, কোনরূপ খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ না করা। তবে খাবারের অভাবের কারণে অভুক্ত থাকা অনশন নয়। বাংলা উইকিসোর্স-এ বলা হয়েছে, “সাধারণতঃ অনশন বলিতে মৃত্যুসংকল্পপূর্বক উপবাস বুঝায়।” রাজনীতির ভাষায়, অনশন ধর্মঘটকে নীরব প্রতিবাদ বা অহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচী হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত রাজনৈতিক প্রতিবাদ হিসেবে বা কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন বা দাবী আদায়ের উদ্যেশ্যে দীর্ঘ সময় উপবাস করে থাকেন। এর উদ্দেশ্য হল, সরকার, নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তি বিশেষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং দাবি আদায়ের জন্য তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা। তা হয় কখনো হয় ব্যক্তি পর্যায়ে, কখনো দল বা সংগঠনের পক্ষ থেকে। কখনো ব্যক্তির নিকট বিশেষ দাবী আদায়, (যেমন: বিয়ের দাবীতে অনশন), কখনো বিশেষ কর্তৃপক্ষের নিকট দাবী আদায় (যেমন: জেল কর্তৃপক্ষ) আবার কখনো হয় রাষ্ট্রের নিকট দাবি উপস্থাপন। যখন এই অনশনকে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা বিশেষ দাবি পূরণের জন্য প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং তা আমৃত্যু (Hunger Strike to Death) করার হুমকি দেওয়া হয় তখন ইসলামে এর বিধান নিয়ে আলোচনা আসে।

❑ অনশন ধর্মঘটের ব্যাপারে ইসলামের বিধান:
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনশন করতে গিয়ে ইতিহাসে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে পানাহার করার সুযোগ থাকার পরেও বা পানাহারের সক্ষমতা থাকার পরেও কেউ যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে না খেয়ে থাকে (অনশন করে) এবং এর ফলে যদি তার মৃত্যু ঘটে তাহলে সে ‘আত্মহত্যা কারী’ বলে গণ্য হবে। অথবা এর কারণে যদি তার অঙ্গহানি বা শারীরিক ক্ষয়-ক্ষতি হয় তাহলেও সে গুনাহগার হবে। উভয়টির পরিণতি জাহান্নাম।
মোটকথা, স্বেচ্ছায় এমন কোনও কাজ করা যা নিজের ক্ষতির কারণ হয় কিংবা মৃত্যু ডেকে আনে তা হারাম বা নিষিদ্ধ। চাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হোক বা অন্য কোনও উদ্দেশ্যে হোক।
নিম্নে এর কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হল:
✪ ১. ইসলামে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ:
জীবন আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত। তাই ইসলাম মানুষকে দেওয়া জীবনের সুরক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। সে কারণে ইচ্ছাকৃত ভাবে নিজের জীবনকে বিপন্ন করা বা মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَلَا تَقْتُلُوا أَنفُسَكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا
“আর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। [সূরা নিসা: ২৯]
তিনি আরও বলেন:
وَأَنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ ۛ وَأَحْسِنُوا ۛ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
“আর তোমরা নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। আর তোমরা সৎকার্য করো। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্ম শীলদের ভালোবাসেন।” [সূরা বাকারা: ১৯৫]
আত্মহত্যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। এ ব্যাপারে মানবজাতিকে সতর্ক করে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَيْءٍ عُذِّبَ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
“যে ব্যক্তি কোনও কিছু দ্বারা আত্মহত্যা করবে কিয়ামতের দিন তাকে সেই জিনিস দিয়েই শাস্তি দেওয়া হবে।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ১০৯]
✪ ২. ইসলামে এমন কোনও কাজ করা হারাম যা ক্ষতিকর:
এটি ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি যে, ইসলামে এমন কোনও কাজ করা হারাম যাতে নিজের বা অন্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়।
নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ
“নিজের বা অন্যের কোনও ক্ষতি করা যাবে না। ”[ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৩৪১; মুয়াত্তা মালেক, হাদিস ১৪২৯]
সুতরাং যে কাজ করলে মৃত্যু সংঘঠিত হওয়ার অথবা কোনও প্রকার শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দীর্ঘমেয়াদী অনশনের ফলে শারীরিক নানা ধরণের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
❑ দীর্ঘ অনশনে শরীরের কী কী ক্ষতি হতে পারে?
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘ অনশনে বা স্বাভাবিক সময়ের বেশি না খেয়ে থাকলে শরীরে বিশাল ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
◆ ১. শরীরের নিজস্ব খাদ্য ফুরিয়ে যাওয়া:
প্রথম দিকে শরীর শক্তি জোগানোর জন্য লিভার (যকৃৎ) থেকে জমা রাখা শর্করা (গ্লাইকোজেন) এবং চর্বি ব্যবহার করে।
এরপর যখন জমা থাকা চর্বিও শেষ হয়ে যায় তখন শরীর শক্তি পেতে শুরু করে মাংসপেশি (Muscle) ভাঙতে। এই মাংসপেশি ভাঙা থেকেই শরীর কোনোমতে কাজ চালানোর মতো খাবার জোগাড় করে।
◆ ২. মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া:
দীর্ঘদিন না খেয়ে থাকার কারণে রক্তে শর্করার (Sugar) পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে যায়।
মস্তিষ্ক মূলত শর্করা থেকে শক্তি নেয়। শর্করার অভাবে ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে এবং অনশন কারী অচৈতন্য (Unconscious) হয়ে যেতে পারেন।
◆ ৩. বিষাক্ত কিটোন তৈরি হওয়া:
মাংসপেশি ভাঙার সময় শরীরে কিটোন বডি নামে কিছু উপাদান তৈরি হয়। এগুলি শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বা বিষাক্ত।
কিছু কিটোন প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে গেলেও, বাকিটা শরীরের ভিতরেই থেকে যায়। এই অবস্থায় অনশন চালিয়ে গেলে কিডনি, যকৃৎ (Liver), হৃৎপিণ্ড (Heart) সহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
◆ ৪. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি:
কিটোন বডি এবং শর্করার অভাবের কারণে যেসব অঙ্গের বড় ক্ষতি হতে পারে:
কিডনি (বৃক্ক) ও যকৃৎ (Liver): কিটোন বডির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
মস্তিষ্ক (Brain): শর্করার অভাবে এর স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।
হৃৎপিণ্ড (Heart): রক্তচাপ অনিয়মিত হওয়ার কারণে হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্কে মারাত্মক আঘাত আসতে পারে।
◆ ৫. দীর্ঘস্থায়ী বা স্থায়ী ক্ষতি:
এই ক্ষতিগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানা প্রয়োজন। যদি পরীক্ষা করে দেখা যায় যে হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক বা কিডনির মতো অঙ্গগুলো একবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে সেই ক্ষতি সাধারণত আর পূরণ করা যায় না। সেক্ষেত্রে অনশন কারীকে বাকি জীবন এই ক্ষতির মাত্রা জেনে-বুঝেই বিশেষ সতর্কতার সাথে কাটাতে হয়। [Anandabazar-এর অনলাইন পোর্টাল থেকে সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত]
✪ ৩. এটি ভিন্ন সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ:
ইসলামের দৃষ্টিতে অনশনের মাধ্যমে নিজের জীবনের ধ্বংস ডেকে আনা, কোনও ভাবে আত্মহননের পথে বেছে নেওয়া বা নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দেওয়া━কারণ যাই হোক না কেন━বড় অপরাধ এবং কবিরা গুনাহ। এটি অমুসলিমদের বা পাশ্চাত্যের রাজনীতির অংশ। এমনকি তা হিন্দু ধর্মের একটি ধর্মীয় রীতি থেকে আসতে পারে। কেননা হিন্দুধর্মে পূজা-পার্বণের পূর্বে কিংবা কোনও ব্রত অর্জনের লক্ষ্যে আমৃত্যু অনশন করার বিধান রয়েছে। অনশন তিন রকম স্বল্পানশন, অর্ধাশন ও পূর্ণানশন।” [অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম]
❑ পানাহার না করার ফলে মৃত্যু: আলেমদের ফতোয়া
কেউ যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে পানাহার থেকে বিরত থাকার ফলে মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাহলে ইসলামি পণ্ডিতদের মতে সে আত্মহত্যা কারী━যার পরিণতি জাহান্নাম। আল্লাহ হেফাজত করুন। আমিন।
১. ইমাম আবু বকর আর রাযী আল জাসসাস আল হানাফি রাহ.- বলেন,
” مَنْ امْتَنَعَ مِنْ الْمُبَاحِ حَتَّى مَاتَ كَانَ قَاتِلا نَفْسَهُ مُتْلِفًا لَهَا عِنْدَ جَمِيعِ أَهْلِ الْعِلْمِ… لَوْ امْتَنَعَ مِنْ أَكْلِ الْمُبَاحِ مِنْ الطَّعَامِ مَعَهُ حَتَّى مَاتَ كَانَ عَاصِيًا لِلَّهِ تَعَالَى
“যে ব্যক্তি মুবাহ (বৈধ ও অনুমোদিত) বস্তু গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে এবং এভাবে সে মারা যাবে, সে সকল আহলে ইলমের মতে সে আত্মহত্যাকারী ও নিজের জীবন বিনাশকারী হিসেবে পরিগণিত হবে… যদি সে তার কাছে থাকা মুবাহ খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকে এবং মারা যায় তবে সে আল্লাহ তাআলার নাফরমান বলে গণ্য হবে।” [সূত্র: আহকামুল কুরআন (১/১৭৭]
২. ইমাম আল কারাফি আল মালিকি রাহ. বলেন,
” لَوْ مَنَعَ مِنْ نَفْسِهِ طَعَامَهَا وَشَرَابَهَا حَتَّى مَاتَ : فَإِنَّهُ آثِمٌ قَاتِلٌ لِنَفْسِهِ
“যদি কোনও ব্যক্তি তার আত্মার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও পানীয় থেকে নিজেকে বিরত রাখে এবং এর ফলে সে মারা যায়: তবে সে পাপী এবং নিজ আত্মার হত্যাকারী বলে গণ্য হবে।” [সূত্র: “আল-ফুরূক” (৪/১৮৩)]
৩. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন,
الأَكْلَ عِنْدَ الضَّرُورَةِ وَاجِبٌ . قَالَ مَسْرُوقٌ : مَنْ اُضْطُرَّ إلَى الْمَيْتَةِ ، فَلَمْ يَأْكُلْ ، فَمَاتَ دَخَلَ النَّارَ
“চরম প্রয়োজনের সময় খাদ্য গ্রহণ করা ওয়াজিব। মাসরুক রহ. বলেন: “যে ব্যক্তি মৃত জন্তু (যা সাধারণত হারাম) খেতে বাধ্য হল কিন্তু খেলো না এবং মারা গেল সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” [সূত্র: আল ফাতাওয়া আল কুবরা (১/৩৮৯)]
❑ আমরণ অনশন ধর্মঘট সম্পর্কে আধুনিক যুগের আলেমদের ফতওয়া:
আমরণ অনশন ধর্মঘট সম্পর্কে আধুনিক আলেমগণও উপরোক্ত দলিলের উপর নির্ভর করে ফতওয়া দিয়েছেন।
❖ শাইখ আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ.:
বিশ্ব বরেণ্য ইসলামি স্কলার, সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রা. কে প্রশ্ন করা হয়━
আমরা প্রায়শই শুনতে পাই যে, মানুষ দাবি আদায়ের জন্য আমরণ অনশন ধর্মঘট করছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এর বিধান কী?
উত্তরে তিনি বলেন,
هذا الإضراب ما له أصل، هذا إعانة للأعداء على مقاصدهم الخبيثة، هذا النظام ما له أصل، وإذا كان يفضي إلى ضرر عليه، أو قتل نفسه؛ فهو لا يجوز، هذا الذي نعتقده في هذا، هذا أخذوه من أعداء الله، هذا لا نعرف له أصلًا
“এই ধরনের অনশনের শরিয়তে কোনও ভিত্তি নেই। এটি বরং শত্রুদের মন্দ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সাহায্য করার নামান্তর। এই পদ্ধতির কোনও ভিত্তি নাই।
যদি এই অনশন নিজের ক্ষতির কারণ হয় অথবা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয় তবে তা জায়েজ নেই। এই বিষয়ে আমাদের আকিদা এটাই। এই প্রথাটি আল্লাহর শত্রুদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ইসলামে আমরা এর কোনও ভিত্তি জানি না।”
২. আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ. এ প্রসঙ্গে একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন,
” حُكم من توفي وهو مضرب عن الطعام ، أَنَّه قاتل نفسه وفاعل ما نهى عنه الله تعالى ، فإن الله سبحانه وتعالى يقول: ( وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا ) ، ومن المعلوم أن من امتنع عن الطعام والشراب لابدَّ أن يموت ، وعلى هذا فيكون قاتلاً لنفسه ، ولا يحلُّ لإنسان أن يُضرِبَ عن الطعام والشراب لمدة يموت فيها ، أما إذا أضرب عن ذلك لمدة لا يموت فيها ، وكان هذا السبب الوحيد لخلاص نفسه من الظلم ، أو لاسترداد حقه فإنَّه لا بأس به ، إذا كان في بلد يكون فيه هذا العملُ للتخلص من الظلم ، أو لحصول حقِّه ، فإنَّه لا بأس به ، أما أن يَصِلَ إلى حدِّ الموت : فهذا لا يجوز بكل حال ” .
“যে ব্যক্তি অনশন রত অবস্থায় মারা যায়, তার বিধান হল সে আত্মহত্যাকারী এবং সে এমন কাজ করেছে যা আল্লাহ তা’আলা নিষেধ করেছেন। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا
‘আর তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।’ [সূর নিসা: ২৯]।
এটা জানা কথা যে, যে ব্যক্তি খাবার ও পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে সে অবশ্যই মারা যাবে। আর এর ভিত্তিতে সে নিজের আত্মহত্যাকারী হিসেবে গণ্য হবে। কোনও মানুষের জন্য এমন সময় পর্যন্ত অনশন করা বৈধ নয় যার ফলে তার মৃত্যু হবে। তবে যদি সে এমন সময় পর্যন্ত অনশন করে যে, এতে তার মৃত্যু হবে না এবং এটিই যদি তার উপর চলতে থাকা জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার অথবা নিজের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাওয়ার একমাত্র পথ হয় তাহলে এতে কোনও দোষ নেই—যদি সেই দেশে এটি জুলুম থেকে মুক্তি বা অধিকার আদায়ের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মৃত্যুর পর্যায়ে পৌঁছানো: এটি কোনও অবস্থাতেই জায়েজ নয়।”[মাজমু’ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল আল উসাইমিন (২৫/৩৬৫)] এ ফতোয়ার আলোকে এটিও প্রতীয়মান হয় যে, যদি কেউ সাময়িকভাবে খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন এবং এর উদ্দেশ্য যদি হয় কোনও দাবি আদায়ের জন্য সহানুভূতি লাভ করা কিন্তু তাতে জীবন নাশ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্থায়ী ক্ষতির কোনও আশঙ্কা না থাকে তবে তা জায়েজ। যেমন: ছেলে-মেয়েরা তাদের বিশেষ কোনও দাবি পূরণের জন্য সাময়িকভাবে খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকলে, বাবা-মার সহানুভূতি নিয়ে তাদের দাবী পূরণ হলে ইনশাআল্লাহ তাতে কোনও দোষ নেই। মূল পার্থক্যটা হল: জীবনের ক্ষতি বা মৃত্যুর হুমকি ছাড়া সাময়িক প্রতিবাদ এবং আমৃত্যু বা স্থায়ী ক্ষতির উদ্দেশ্যে অনশন-এই দুটির মধ্যে শরীয়তের বিধান ভিন্ন।
➧ মোটকথা, কোনভাবেই নিজেকে অনর্থক কষ্ট দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। তাই মুসলিমদের জন্য পাশ্চাত্যের এই সকল ফালতু ও ক্ষতিকর প্রতিবাদের পদ্ধতি বর্জন করা অপরিহার্য।
❑ অন্যায়ের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে ইসলামি পদ্ধতি:
কেউ যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চায় তাহলে অবশ্যই শরিয়ত সম্মত পন্থায় যৌক্তিক উপায়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায়ের প্রতিবাদের মূলনীতি প্রতিধ্বনিত হয়েছে নিম্নোক্ত হাদিসটিতে:
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ
“তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোনও মন্দ কাজ দেখে, তাহলে সে যেন তা হাত দিয়ে পরিবর্তন করে। যদি সে এতটা সামর্থ্য না রাখে তাহলে সে যেন মুখ দিয়ে বলে। যদি এটাও না পারে তাহলে যেন অন্তরে ঘৃণা করে। আর এটি হলো ইমানের সবচেয়ে দুর্বল স্তর।” [সহিহ মুসলিম: ৪৯]
অবশ্য পাশ্চাত্যের আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্র যেমন হারাম তেমনি এর জন্য এই ধরনের হারাম কর্মসূচি (অনশন ধর্মঘট) ডাবল হারাম। এগুলো মূর্খদের মুর্খামি ছাড়া কিছু নয়। আল্লাহ তাআলা মুসলিমদেরকে সব ধরণের জাহেলি প্রথা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব।

Saturday, November 8, 2025

জ্ঞান শেখার আগে আদব বা শিষ্টাচার শেখার গুরুত্ব

 ইসলামের দৃষ্টিতে আদব তথা শিষ্টাচার, ভদ্রতা এবং সুন্দর আচার-আচরণ বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষের জ্ঞানের বহর কম থাকলেও যদি তার মধ্যে থাকে, বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, মানবতাবোধ, পরোপকার এবং সুন্দর আচার-আচরণ তাহলে তার মধ্যে বেশি কল্যাণ রয়েছে—ওই ব্যক্তির চেয়ে, যার উচ্চ শিক্ষার সনদ এবং বিশাল জ্ঞানের বহর আছে কিন্তু সে বেয়াদব ও চরিত্রহীন। এইজন্যেই বলা হয়,“দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।” প্রকৃতপক্ষে যে শিক্ষা মানুষকে সহনশীলতা, ধৈর্যশীলতা, ক্ষমা, ভদ্রতা ও ন্যায়পরায়নতা ইত্যাদি মানবিক গুণে অলংকৃত করে না তা কোন শিক্ষা নয়। যে শিক্ষা মানুষকে মানুষের প্রতি মানুষের সম্মানবোধ, মানুষের অধিকার রক্ষা এবং মানবতা শেখায় না তা কোন শিক্ষা নয়। যে শিক্ষা মানুষকে অহংকারী, অসভ্য ও বেয়াদব করে তোলে তা হল, শিক্ষার নামে কুশিক্ষা।

তাই জ্ঞান শেখার চেয়ে ভালো ব্যবহার ও চরিত্র গঠনকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নিম্নে জ্ঞানের পাহাড় জমানোর চেয়ে আদব-কায়দা এবং ভদ্রতা ও চরিত্র শেখার প্রতি আমাদের সালাফ বা পূর্বসূরিগণ কতটা গুরুত্ব দিতেন তার কিছু চিত্র তুলে ধরা হল:
✪ ১. ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. বলেন:
طلبت الأدب ثلاثين سنةً, وطلبت العلم عشرين سنةً, وكانوا يطلبون الأدب قبل العلم
“আমি ত্রিশ বছর ধরে আদব শিখেছি, আর বিশ বছর জ্ঞান (ইলম) শিখেছি। সালাফগণ তথা পূর্বসূরিগণ জ্ঞানের আগে আদব শিখতেন।”
[ইবনু জাযারী, গায়াতুন নিহায়া, ১/৪৪৬]
✪ ২. তিনি আরও বলেন:
“نحن إلى قليل من الأدب أحوج منا إلى كثير من العلم
“আমাদের বেশি জ্ঞানের চেয়ে অল্প আদবের বেশি প্রয়োজন।”
[ইবনুল কায়্যিম, মাদারিজুস সালিকীন, ২/৩৫৬]
✪ ৩. খতিব আল বাগদাদী তাঁর ‘আল জামে’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, ইবনু সিরিন বলেছেন:
“সালাফগণ যেমন জ্ঞান শিখতেন, তেমনি সুন্দর চালচলন ও উত্তম চরিত্র শিখতেন। ইবনে সিরিন একজনকে পাঠিয়েছিলেন যেন সে বিশিষ্ট তাবেয়ী কাসেম (মুহাম্মদ বিন আবু বকর সিদ্দিক রা.) এর চালচলন ও অবস্থা দেখে আসে।”
[খতিব আল বাগদাদি, আল জামে, ১/৭৯]
✪ ৪. ইবরাহিম ইবনে হাবিব ইবনুশ শহিদ বলেন, তাঁর পিতা তাঁকে বলেছিলেন:
يا بنيَّ، ايتِ الفقهاءَ والعلماء، وتعلم منهم، وخُذْ مِن أدبهم وأخلاقهم وهَدْيِهم؛ فإن ذاك أحبُّ إليَّ لك من كثير من الحديث
“হে আমার সন্তান, তুমি ফকিহ ও উলামাদের কাছে যাও, তাদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করো এবং তাদের আদব, নৈতিকতা ও চালচলন থেকে শিক্ষা নাও। কারণ আমার কাছে, এটি তোমার জন্য প্রচুর পরিমাণ হাদিস শেখার চেয়েও বেশি পছন্দনীয়।”
[খতিব আল বাগদাদী, আল জামে, ১/৮০]
✪ ৫. ইমাম ইবনু মুফলিহ আল মাকদিসি রাহ. এই মহান আদবের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ইলমের অলঙ্কার পরার আগে আদবের অলঙ্কার পরিধান করা উচিত।
এবং প্রত্যেক মুমিনের উচিত, সকল অবস্থায় এই আদবগুলো (শিষ্টাচার/নিয়মগুলো) মেনে চলা/অনুসরণ করা।
✪ ৬. উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন,
تأدبوا ثم تعلموا
“তোমরা প্রথমে আদব শিখো, তারপর জ্ঞান (ইলম) অর্জন করো।”
✪ ৭. আবু আব্দুল্লাহ আল বালখি বলেছেন:
أدبُ العلم أكثرُ من العلم
“জ্ঞানের আদব জ্ঞানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
✪ ৮. আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন:
إذا وُصِف لي رجلٌ له علم الأولين والآخِرين لا أتأسَّف على فَوْت لقائه، وإذا سمعت رجلاً له أدب القسِّ أتمنى لقاءَه وأتأسَّف على فَوته
“যদি আমাকে এমন ব্যক্তির কথা বলা হয়, যার পূর্বাপর সকল জ্ঞান আছে, তার সাথে দেখা না হলেও আমি দুঃখ করি না। কিন্তু যদি শুনি কারো উত্তম আদব আছে, তাহলে তার দেখা পেতে ইচ্ছা করি এবং সাক্ষাৎ না হলে আফসোস করি।”
[আল-মাকদিসী, আল-আদাবুশ শারইয়্যাহ, ৪/২০৭]
✪ ৯. আলি ইবনে আবি তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সূরা তাহরিম-এর নিমোক্ত ৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা করো”) অর্থাৎ তাদেরকে আদব (শিষ্টাচার) শিক্ষা দাও এবং তাদেরকে জ্ঞান (ইলম) শিক্ষা দাও।”
[আল-মাকদিসী, আল-আদাবুশ শারইয়্যাহ, ৪/২০৮-২০৯]
তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত, জ্ঞানের চেয়ে সন্তানদের আদব ও নৈতিকতার ওপর বেশি জোর দেওয়া, যাতে এমন একটি প্রজন্ম তৈরি হয় যারা জ্ঞান অর্জনের আগেই জ্ঞানী ও জ্ঞানের মূল্য বুঝতে পারে।
মূল উৎস: alukah
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদ আরব।

Translate