Thursday, October 16, 2025

রাসুলুল্লাহ কর্তৃক এক বৃদ্ধ মহিলাকে বোঝা বহনে সাহায্য করা এবং তার ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে প্রসিদ্ধ গল্পটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট

❑ প্রচলিত গল্পটি নিম্নরূপ:
মক্কার প্রখর রোদ ও উত্তপ্ত বালির উপর দিয়ে এক বৃদ্ধা মহিলা অতি কষ্টে কাঠের একটি ভারী বোঝা বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
তাঁকে দেখে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (নাম উল্লেখ না করে) এগিয়ে গেলেন এবং বিনয়ের সাথে তাঁকে সাহায্য করার প্রস্তাব দিলেন। তিনি বৃদ্ধার কাঁধ থেকে ভারী বোঝাটি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এবং নীরবে তাঁর বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। দীর্ঘ পথে যেতে যেতে বৃদ্ধাটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে কুৎসা রটনা করতে লাগলেন। তিনি লোকটিকে সাবধান করে বললেন যে মক্কায় ‘মুহাম্মাদ’ নামে এক জাদুকর আছে, যে খারাপ চরিত্রের মানুষ এবং তার কথা যেন তিনি ভুলেও না শোনেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নীরবে সব কথা শুনলেন এবং কোনও প্রতিবাদ না করে বোঝা বহন করতে থাকলেন। অবশেষে তাঁরা বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছালেন। কাঠ নামিয়ে দেওয়ার পর কৃতজ্ঞ বৃদ্ধাটি তাঁকে কোনও প্রতিদান দিতে না পেরে পুনরায় সেই ‘জাদুকর’ মুহাম্মাদ থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিলেন।
তখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “যদি আমিই সেই মুহাম্মাদ হই, তাহলে কি তখনও তুমি আমাকে অবিশ্বাস করবে?” তাঁকে এমন বিনয়ী, ধৈর্যশীল ও দয়ালু হিসেবে দেখে বৃদ্ধা মহিলা চমকে উঠলেন এবং তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন যে, যাকে তিনি খারাপ বলছিলেন, তাঁর চরিত্র আসলে কত মহৎ। মুহূর্তেই তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন এবং শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন।
(قصة الرسول صلى الله عليه وسلم مع امرأة عجوز: رأى رجل امرأة عجوزًا في مكة تحاول أن تحمل حزمة من الحطب، ولما رآها عجوزًا اتجه نحوها، وقال: أنا أحملها عنك، دُليني على دارك، وكان الطريق طويلًا، والرمال ملتهبة، والشمس حارقة، والهواء لافحًا، والبيت بعيدًا، والحمل ثقيلًا، فلما وصل إلى منزل تلك العجوز قالت له: يا بني، ليس لدي ما أكافئك به، ولكني سأُسدي إليك نصيحة، إذا رجعتَ إلى قومك في مكة، فهناك رجلٌ ساحر يدَّعي النبوة، يقال له محمد، إذا رأيته لا تصدِّقه، وإياك أن تتبعه، فقال: لماذا؟ قالت: لأنه سيِّئ الخُلق، قال: حتى وإن كنت أنا محمدًا الرسول؟ فقالت تلك
العجوز: إنْ كنت أنت محمدًا فأشهد أن لا إله إلا الله، وأنَّك رسول الله)).
الدرجة: لا أصل لها
[dorar..net]
এ গল্পটি কেউ কেউ এভাবে বলে যে━মক্কা বিজয়ের সময় এক বৃদ্ধ মহিলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভয়ে প্রাণপণে পালিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় তিনি তাকে সাহায্য করে তার বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। অতঃপর সেই মহিলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- নিকট তার পরিচয় জানতে পেরে কালিমা শাহাদাত পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
❑ হাদিসটির মান: (বানোয়াট বা ভিত্তিহীন)
উক্ত গল্পগুলো আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ওয়াজ মাহফিলে অনেক বক্তা, মসজিদের মেম্বরে অনেক খতিব বা কেউ যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মহান চরিত্র মাধুরীর উদাহরণ পেশ করতে চায় তখন তারা এ জাতীয় গল্প পেশ করে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হল, এই গল্প কোনও নির্ভরযোগ্য হাদিস বা সিরাতের কিতাবে আসেনি। অর্থাৎ এটি একটি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন গল্প-যা হাদিসের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র মাধুরী এবং নিঃস্বার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে একজন সমালোচনা কারীর হৃদয়ে ইসলামের আলো প্রজ্বলিত করার প্রমাণ হিসেবে এসব বানোয়াট ও ভিত্তিহীন গল্পের আদৌ প্রয়োজন নাই। কেননা এ সংক্রান্ত বিশুদ্ধ হাদিসের অভাব নেই। আমাদের কর্তব্য, সে সকল বিশুদ্ধ হাদিস পেশ করা। দুঃখজনক বিষয় হল, আমাদের সমাজের অনেক বক্তা, ইমাম, খতিব, দাঈ, ইসলামি সংগঠনের নেতা সহ অনেক মানুষ হাদিস যাচাই-বাছাই ছাড়া অনেক ভিত্তিহীন ও অপ্রমাণিত হাদিস বা হাদিসের গল্প পেশ করে থাকে! কিন্তু এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ইসলামের দৃষ্টিতে এ কাজটি কবিরা গুনাহ। কেননা হাদিসে এসেছে, কেউ জেনে-বুঝে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে মিথ্যাচার করলে তার পরিণতি জাহান্নাম। মনে রাখা কর্তব্য যে, মানুষের সাথে সাধারণ মিথ্যা কথা এবং আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে মিথ্যা কথা এক নয়। সাধারণ মিথ্যা কথা হারাম, কবিরা গুনাহ এবং মুনাফেকির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু হাদিসের নামে মিথ্যাচার করার পরিণতি এর থেকেও ভয়াবহ।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إنَّ كَذِبًا عَلَيَّ ليسَ كَكَذِبٍ علَى أَحَدٍ، مَن كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
“আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, আমার প্রতি মিথ্যারোপ করা তোমাদের কারো প্রতি মিথ্যারোপ করার মত নয়। যে ব্যক্তি জেনেশুনে ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার প্রতি মিথ্যারোপ করে সে যেন জাহান্নামে তার বাসস্থান নির্ধারণ করে নেয়।” [সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমী)। মুকাদ্দামাহ (ভূমিকা), পরিচ্ছেদ: ২. রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর মিথ্যারোপ গুরুতর অপরাধ]
আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের নামে সব ধরণের মিথ্যা তথ্য পরিবেশন, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট গল্প ও হাদিস প্রচারের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
লেখক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি।

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ অ্যাসোসিয়েশন, সৌদি আরব। 

সরকারী নিষেধাজ্ঞার সময় ইলিশ মাছ ​ধরা ও ক্রয়-বিক্রয় করার বিধান

প্রশ্ন: বর্তমানে চলছে ইলিশ মাছ ধরার সরকারী নিষেধাজ্ঞা। প্রশ্ন হল, এই নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ মাছ কিনে খাওয়া জায়েজ আছে কি?
উত্তর: সরকার বছরের নির্দিষ্ট কিছু দিন যে সব নদ-নদীতে ইলিশের প্রজনন হয় সে সব নদ-নদীতে সর্ব প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে থাকে যেন মা ইলিশ স্বচ্ছন্দে ডিম পড়ার সুযোগ পায়।
ইলিশ গবেষকরা বলেছেন, “এই সময়ে ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মা ইলিশ রক্ষা করা, যাতে তারা নিরাপদে নদীতে ডিম ছাড়তে পারে। এই ডিম রক্ষা করতে পারলে তা নিষিক্ত হয়ে জাটকার জন্ম হবে। সেই জাটকা রক্ষা করা গেলে দেশে বড় আকারের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।” (BBC/Bengali)
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এক ঘোষণা বলেন, “মা ইলিশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে চলতি বছর (২০২৫) আগামী ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এই সময়কে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম হিসেবে চিহ্নিত করে ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০২৫’ পরিচালনা করা হবে। এই সময় ইলিশ ধরা, পরিবহন, বিক্রয়, মজুদ এবং জলসীমায় মাছ ধরার ট্রলারের প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকবে। নদীতে ড্রেজিং সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হবে। অভিযানে মৎস্য কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌ-বাহিনী ও বিমান বাহিনীসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অংশগ্রহণ করবে।” [সূত্র: btv gov bd]
উল্লেখ্য, প্রতিবছর আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে-পরে মিলিয়ে মোট ১৫ থেকে ১৭ দিন হচ্ছে, ইলিশের ডিম ছাড়ার আসল সময়। এসময় সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ নদীতে ছুটে আসে। এই সময়কে বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও মোট ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এ সময় ইলিশকে স্বাচ্ছন্দ্যে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতেই সরকার দেশের সব নদ-নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। [Banglatribune]
সুতরাং সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত সময়ে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বা চুরি করে ইলিশ ধরা বৈধ নয়।
ইসলাম মানুষকে নীতি-নৈতিকতা ও শৃঙ্খলা বোধ শেখায়। সুতরাং বৃহত্তর স্বার্থে জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রণীত সরকারী আইন-কানুন অনুসরণ করা প্রতিটি নাগরিকের জন্য আবশ্যক। অন্যথায় আইন লঙ্ঘন করার কারণে আল্লাহর নিকট গুনাহগার হওয়ার পাশাপাশি সরকারী আইনে জেল-জরিমানার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে তার অর্থ এই নয় যে, এ সময় ইলিশ খাওয়া যাবে না বা ক্রয় করা যাবে না। কেননা হয়ত ব্যবসায়ীগণ অনুমোদিত সময়ে ইলিশ ধরে ফ্রিজে সংরক্ষণ করেছিল। এখন অতিরিক্ত লাভের আশায় সেগুলো নন মৌসুমে বিক্রয় করছে।
যাহোক, আপনি যদি নিশ্চিতভাবে জানতে পারেন যে, মাছ বিক্রেতা চোরাইভাবে নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরেছে বা জেলেদের নিকট থেকে মাছ ক্রয় করেছে তাহলে তাদের কাছে তা ক্রয় করা বৈধ নয়। কারণ তা অন্যায় কাজে সহায়তা করার শামিল। আর ইসলামে অন্যায়, দুর্নীতি ও চোরাকারবারিতে সহায়তা করা হারাম। (সূরা মায়িদা: ২) তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু না জানা গেলে যে কোনও সময় বাজার থেকে ইলিশ ক্রয় করতে কোনও আপত্তি নাই ইনশাআল্লাহ। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী।

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, KSA. 

জানাজার সাথে গমনের সওয়াব এবং এ ক্ষেত্রে পায়ে হাঁটা কিংবা গাড়িতে যাওয়া এবং গাড়িতে জানাজা বহন সংক্রান্ত বিধিবিধান

 প্রশ্ন: জানাজার সাথে গমনের সওয়াব কতটুকু? এ ক্ষেত্রে সওয়ার হয়ে যাওয়া এবং পায়ে হেঁটে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান কী? অনুরূপভাবে গাড়িতে জানাজা বহনের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে দয়া করে জানাবেন ইনশাআল্লাহ।

উত্তর: নিম্নে সংক্ষেপে এ সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
❒ জানাজার সাথে গমন করার সওয়াব:
◈ কবরস্থান পর্যন্ত জানাজার সাথে অনুগমন করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«من تبع جنازة مسلم إيمانا واحتسابا وكان معها حتى يصلى عليها ويفرغ من دفنها فإنه يرجع بقيراطين كل قيراط مثل جبل أحد»
“যে ব্যক্তি ইমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় কোন মুসলিমের জানাজায় অংশগ্রহন করল এবং দাফন পর্যন্ত তার সাথে থেকে দাফন কর্ম শেষ করল সে দু’কিরাত নেকি নিয়ে ফিরবে, প্রত্যেক কিরাত ওহুদ পাহাড় পরিমাণ”। [সহিহ বুখারি]
◈ তাছাড়া এটি এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের অন্যতম একটি হক (অধিকার)।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ رَدُّ السَّلَامِ وَعِيَادَةُ الْمَرِيضِ وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِزِ وَإِجَابَةُ الدَّعْوَةِ وَتَشْمِيتُ الْعَاطِسِ
‘‘একজন মুসলিমের অপর মুসলিমের উপর পাঁচটি হক বা অধিকার রয়েছে;
১. সালামের জবাব দেওয়া
২. রোগীকে দেখতে যাওয়া বা তার শুশ্রূষা করা।
৩. জানাজার সাথে গমন করা
৪. দাওয়াত কবুল করা
৫. এবং হাঁচির জওয়াবে (আলহামদু লিল্লাহ বলা শুনলে) ‘য়্যারহামুকাল্লাহ’ বলা।’’[সহিহুল বুখারি ও মুসলিম]
❒ জানাজার সাথে পায়ে হেঁটে গমন করা উত্তম নাকি গাড়িতে আরহণ করে যাওয়া উত্তম?
জানাজার সাথে পায়ে হেঁটে গমন করা অধিক উত্তম। কিন্তু প্রয়োজনবোধে বাহনে চড়ে যাওয়া জায়েজ। যেমন: কবরস্থান অনেক দূরে হওয়া, আবহাওয়া প্রচণ্ড গরম বা ঠাণ্ডা হওয়া, কাদা, পানি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি কোন কারণে পায়ে হাঁটা কষ্টকর হওয়া ইত্যাদি।
তবে আরহীগণ লাশ বহরের পেছনে পেছনে চলবে। কারণ আগে গাড়ি চললে ধুলোবালি উড়তে পারে যা হয়ত পেছনের জানাজা বহনকারী লোকজনের জন্য কষ্টের কারণ হবে।
আর পায়ে হাঁটার ক্ষেত্রে লাশের সামনে-পেছনে, ডানে-বামে চলতে কোন সমস্যা নেই। তবে উত্তম হল, পেছনে চলা।
✪ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
الرَّاكِبُ يسيرُ خلفَ الجَنازةِ ، والماشي يَمشي خلفَها ، وأمامَها ، وعن يمينِها ، وعن يسارِها قريبًا مِنها
“সওয়ারি (আরোহণকারী) জানাজার পেছনে চলবে আর হেঁটে যাওয়া ব্যক্তি জানাজার পেছনে, সামনে, ডানে এবং বামে তার কাছাকাছি থেকে চলতে পারে।”
[মুগিরা বিন শোবা রা. হতে বর্ণিত, সহিহ আবু দাউদ, হা/৩১৮০]
▪️ শায়খ আলবানি রাহ. বলেন: “কিন্তু হেঁটে যাওয়া উত্তম।‌ কারণ এটিই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর থেকে বেশি পরিচিত। তিনি জানাজার সাথে কখনো আরোহণ করেছেন বলে জানা যায় না। বরং সাওবান রা. বলেছেন: রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাজার সাথে থাকা অবস্থায় তাঁর কাছে একটি বাহন আনা হল। কিন্তু তিনি তাতে চড়তে অস্বীকার করলেন। যখন তিনি ফিরে এলেন, তখন তাঁর কাছে বাহন আনা হল এবং তিনি তাতে আরোহণ করলেন। তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন:
«إِنَّ المَلَائِكَةَ كَانَتْ تَمْشِي فَلَمْ أَكُنْ لِأَرْكَبَ وَهُمْ يَمْشُونَ، فَلَمَّا ذَهَبُوا رَكِبْتُ»
“ফেরেশতারা হেঁটে যাচ্ছিল, তাই তারা হেঁটে যেতে থাকলে আমি আরোহণ করতে চাইনি। যখন তারা চলে গেল, তখন আমি আরোহণ করলাম।” [সুনানে আবি দাউদ, হা/ ৩১৭৭, সহিহ]
উক্ত হাদিস থেকে জানা গেলো, সওয়ারি থাকা স্বত্বেও কবরস্থান পর্যন্ত পায়ে হেঁটে গমন করা অধিক উত্তম। আর ফিরে আসার ক্ষেত্রে যানবাহনে আরোহণ করায় কোন সমস্যা নেই। উপরোক্ত হাদিসের পাশাপাশি অন্য হাদিসেও বর্ণিত হয়েছে যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনুদ দাহদাহ (রা.) এর জানাজার শেষে ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে আর সাহাবিগণ তাঁর চারপাশে হেঁটে হেঁটে এসেছেন।
❑ গাড়িতে করে জানাজা বহন করার বিধান:
আল্লামা শাইখ উসাইমিন রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়, জানাজার দাফন দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য গাড়িতে করে জানাজা বহন করা উত্তম হবে নাকি কষ্টসাধ্য হলেও পায়ে হেঁটে বহন করা উত্তম হবে?
উত্তরে তিনি বলেন,
حملُ الجنازة على السيارة خطأ، إلا لحاجة كقلة المُشَيِّعين، أو بردٍ شديد، أو حرٍّ شديد، أو مطر. وإلا، فالسنَّة أن تُحمَلَ على الأكتاف.
ذلك لينتفع المُشَيِّعون، وليكون فيه عبرة لهم، ولئلا يُتَّخذ حملُها كحال الزفاف والولائم. لكن إذا صارت هناك حاجة، فلا بأس.
“গাড়িতে করে জানাজা বহন করা ভুল কাজ। তবে প্রয়োজন হলে তা করা যেতে পারে। যেমন: জানাজায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কম হলে অথবা তীব্র শীত, কিংবা তীব্র গরম, অথবা বৃষ্টি-বাদলের কারণে। প্রয়োজন না হলে, সুন্নাহ হল, জানাজাকে কাঁধে বহন করা। এর উদ্দেশ্য হল, জানাজায় অংশগ্রহণকারীরা যেন এর দ্বারা উপকৃত হতে পারে এবং এটি যেন তাদের জন্য একটি শিক্ষা ও উপদেশ হয়। আর যাতে জানাজা বহন করাকে বিয়ে-শাদি বা ভোজের মতো আনন্দদায়ক অনুষ্ঠানের বহনের মতো মনে না করা হয়। তবে যদি প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে এতে কোনও অসুবিধা নেই।” আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

পাত্রী পছন্দ হলে আংটি পরানো

 প্রশ্ন: পাত্রের তরফ থেকে পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় যে আংটি পরানো হয় তার মূল্য কি বিয়ের সময় মোহরানার টাকার সাথে ধার্য (হিসাব) করা হয়?

উত্তর: বিজ্ঞ আলেমদের মতে, পাত্রী দেখতে গিয়ে পছন্দ হলে তাকে আংটি পরানোর প্রচলন খৃষ্টানদের থেকে এসেছে। তাদের রীতি অনুযায়ী পাদ্রী গির্জায় পাত্রীর আঙ্গুল আংটি পরিয়ে দেয়। তাদের বিশ্বাস, এটি তাদের পরস্পরের মাঝে আকর্ষণ সৃষ্টি করবে বা ভালবাসা তৈরি করবে। সুতরাং ইসলামে এ ধরণের রীতি সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা তা অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বনের শামিল-যা ইসলামে নিষিদ্ধ। তাই মুসলিমদের উচিত, এ প্রথা থেকে বের হয়ে আসা। যাহোক, অজ্ঞতা বশতঃ এমনটি করা হলে সে ক্ষেত্রে তা ‘উপহার’ বলে গণ্য হবে; মোহর নয়। কারণ তখনও বিয়ের কথা চূড়ান্ত হয়নি এবং তা দেওয়ার সময় মোহর বলেও উল্লেখ করা হয়নি। আল্লাহু আলাম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

আল্লাহ আরশের উপরে রয়েছেন আবার তিনি নিচের আসমানেও নেমে আসেন সে সময় কি আরশ খালি হয়ে যায়

 আল্লাহ আরশের উপরে রয়েছেন আবার তিনি নিচের আসমানেও নেমে আসেন। সে সময় কি আরশ খালি হয়ে যায়? এ বিষয়ে সঠিক আকিদা কী?

প্রশ্ন: আল্লাহ তাআলা বলেন, “রহমান (দয়াময় আল্লাহ্‌) আরশে সমুন্নত।” [সূরা ত্ব-হা: ৫]। সেই সাথে এটাও সত্য যে, আল্লাহ তাআলা প্রতি শেষ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন, যা বহু সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
আমার প্রশ্ন হলো, আমার জিজ্ঞেস হলো, আল্লাহ আরশে আজিমে আছেন। তাহলে প্রতি রাতে তিনি প্রথম আসমানে নেমে আসেন। এ বিষয়ে আকিদা কী পোষণ করব? একটু বুঝিয়ে বলুন।
উত্তর:
✪ প্রথমত: প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জানা জরুরি যে, কুরআন ও হাদিসে আল্লাহ তাআলার যে সকল সিফাত (গুণ ও‌ বৈশিষ্ট্য ) বর্ণিত হয়েছে সেগুলো যেভাবে এসেছে হুবহু সেভাবে বিশ্বাস করা অপরিহার্য। এগুলোর কোন ধরনের আকার-আকৃতি, সাদৃশ্য, ধরণ ও প্রকৃতি বর্ণনা করা যাবে না। সেগুলোকে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করাও যাবে না। বরং কুরআন ও হাদিসে যেভাবে এসেছে হুবহু সেভাবেই প্রকৃত অর্থে বিশ্বাস করতে হবে।
✪ দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তায়ালা সাত আসমানের উপরে সমুন্নত রয়েছেন-এটা যেমন কুরআন ও হাদিসের অসংখ্য নস দ্বারা প্রমাণিত তেমনি তিনি রাতের শেষ প্রহরে নিচের আসমানে নেমে আসেন সেটাও বহু নস দ্বারা প্রমাণিত। অতএব উভয়টির প্রতি বিশ্বাস করা আবশ্যক। আরও বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, আল্লাহ তাআলা সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান।
✪ তৃতীয়ত: তিনি কীভাবে আরশের উপরে সমুন্নত, কীভাবে নিচের আসমানে নেমে আসেন,‌ এই সময় আরশ খালি হয়ে যায় কিনা, পৃথিবীর কোথাও রাতের শেষ প্রহর অথচ কোথাও দুপুর, কোথাও বিকেল, কোথাও বা রাতের প্রথম প্রহর তাহলে তিনি কোথায় কীভাবে নিচের আসমানে অবতরণ করেন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করা জায়েজ নেই। এগুলো বিদআতি প্রশ্ন। কারণ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবিগণ কখনো এইসব প্রশ্ন করেননি। বরং তারা বিনা প্রশ্নে আল্লাহর এই সকল সিফাতের উপরে বিশ্বাস পোষণ করেছেন। সুতরাং তাদের মতই আমাদেরকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী হতে হবে।
✪ চতুর্থত: “আল্লাহ আরশ থেকে কীভাবে নিচের আসমানে নেমে আসেন?” এই জাতীয় প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়ার কারণ হল, আমরা আল্লাহর সিফাতগুলোকে মানবিক বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা বিচার করি। কিন্তু এটি সঠিক পদ্ধতি নয়। আল্লাহর সিফাতকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা অনুমান করা বা বিচার বিশ্লেষণ করা কখনো সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহর সিফাত বা গুণ-বৈশিষ্ট্য গুলো অবশ্যই তাঁর কোনো সৃষ্টি জীবের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। ‌ আমাদের কার্যক্রম এবং গুণ-বৈশিষ্ট্য খুবই সীমিত ও দুর্বল কিন্তু আল্লাহ তাআলার গুণ বৈশিষ্ট্য অসীম অপার, অতুলনীয় ও অপরিমেয়। সুতরাং আল্লাহর আরশে উপরে অবস্থান করা এবং দুনিয়ার জমিনে অবতরণ করা অবশ্যই সত্য কিন্তু তার ধরণ-প্রকৃতি আল্লাহর জন্য যেমনটা শোভনীয় ঠিক তেমনই। আমাদের কোন কিছুর সাথে তার সাদৃশ্য বা মিল নেই। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এই প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিয়েছেন।‌ তা হলো, “আল্লাহ তাআলা নিচের আসমানে অবতরণ করলে আরশ খালি হয়ে যাওয়া আবশ্যক নয়। যেভাবে মানুষ ঘুমালে তার আত্মা আল্লাহর নিকটে চলে যায় কিন্তু তা মানুষের দেহ থেকে পরিপূর্ণভাবে আলাদা হয় না।” আল্লাহু আলম।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।

Translate