Monday, November 25, 2024

ইবাদত শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা এবং দুনিয়াবি কাজে কি সওয়াব পাওয়া যায়

 প্রশ্ন: ইবাদত শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা কি? ব্যবসা, চাকুরী, সাংসারিক কাজ-কারবার ইত্যাদি দুনিয়াবি কাজে কি সওয়াব পাওয়া যায়?

▬▬▬◄✪✪► ▬▬▬
উত্তর: ইবাদত العبادة শব্দের অর্থ: গোলামী বা দাসত্ব করা, আনুগত্য করা, বিনয় প্রকাশ করা ইত্যাদি।

আর পারিভাষিক ব্যাপক অর্থে ইবাদত হল, সকল প্রকার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ঐ সকল কথা ও কাজ যেগুলো মহান আল্লাহ ভালবাসেন এবং সন্তুষ্ট হন। [শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.]। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইবাদত তিনটি ক্ষেত্রে বিভক্ত। যথা: অন্তর, মুখের ভাষা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
🌀 উদাহরণ:
▪অন্তর দ্বারা ইবাদত: যেমন, আল্লাহর প্রতি ভয়, ভরসা, ভালবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আগ্রহ, সৎ নিয়ত, আল্লাহকে মনে মনে স্মরণ করা, সৃষ্টি জীব নিয়ে ভাবা ইত্যাদি।
▪ মুখের ভাষা ও অন্তর দ্বারা ইবাদত: যেমন, তাসবিহ, (সুবহানাল্লাহ), তাহলীল (লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ) ইত্যাদি দুআ ও জিকির পাঠ করা, আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আদায় করা, কুরআন তিলাওয়াত করা ইত্যাদি।
▪ শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অন্তর দ্বারা ইবাদত: যেমন, সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ্জ, জিহাদ ইত্যাদি ।
এছাড়া আরও অনেক ধরণের ইবাদত রয়েছে যেগুলো আদায়ের মাধ্যম হল, অন্তর, ভাষা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।

🌀 ইবাদত এমন একটি বিষয়, যাকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা’আলা সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন:
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِي، مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِي، إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ
“একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্যই আমি জিন ও মানব জাতি সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে জীবিকা চাইনা এবং এটাও চাইনা যে, তারা আমার আহার্য যোগাবে। আল্লাহ্‌ তা’আলাই তো জীবিকা দাতা, মহাশক্তির আধার ও পরাক্রান্ত।” [সূরা যারিয়াত: ৫৬-৫৮]

🌀 দুনিয়াবি কাজকর্মে কি নেকি পাওয়া যায়?

মানুষ আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ইবাদত-বন্দেগি করে যেমন সওয়াব অর্জন করে তেমনি দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম যেমন- ঘুমানো, পানাহার, বেচাকেনা, জীবিকার অনুসন্ধান, বিবাহ-শাদি ইত্যাদি- এগুলোর মাধ্যমেও সওয়াব অর্জন করবে যদি তার উদ্দেশ্য হয় যে, এ সকল বৈধ কাজ-কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের কাজে শক্তি অর্জন করবে অর্থাৎ এগুলোর মাধ্যমে সুস্থ ও ভালো থেকে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করবে।

এই সৎ নিয়তের কারণে মানুষ দুনিয়াবি কাজকর্মের মাধ্যমেও সওয়াব অর্জন করবে ইনশাআল্লাহ।

▪ এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত হাদিসটি প্রণিধানযোগ্য:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
وَفِي بُضْعِ أَحَدِكُمْ صَدَقَةٌ. قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيَأْتِي أَحَدُنَا شَهْوَتَهُ وَيَكُونُ لَهُ فِيهَا أَجْرٌ؟ قَالَ: أَرَأَيْتُمْ لَوْ وَضَعَهَا فِي حَرَامٍ أَكَانَ عَلَيْهِ وِزْرٌ؟ فَكَذَلِكَ إذَا وَضَعَهَا فِي الْحَلَالِ، كَانَ لَهُ أَجْرٌ”
“আর তোমাদের নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাস করাও সদকা। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে কেউ যখন যৌন আকাঙ্ক্ষা সহকারে স্ত্রীর সাথে সম্ভোগ করে, তাতেও কি সওয়াব হবে?

তিনি বলেন, “তোমরা জানো না যে, যখন কেউ হারাম পদ্ধতিতে যৌন সম্ভোগ করে তখন সে গুনাহগার হয়!?

সুতরাং অনুরূপভাবে যখন সে ঐ কাজটি হালাল পন্থায় সম্পন্ন করে তখন সে তার সওয়াব পায়।” [মুসলিম: ১০০৬]
সুতরাং প্রতিটি মুমিনের উচিত হবে, দুনিয়াবি সব ধরণের কাজ-কারবার যেমন, খাওয়া-দাওয়াহ, বিবাহ-শাদি, লেখাপড়া, কৃষিকাজ, চাকুরী, ব্যবসা ইত্যাদি দুনিয়াবি কাজকর্মে সৎ নিয়ত পোষণ করা। তাহলে এ সব দুনিয়াবি কাজ করেও সে অর্জন করবে অবারিত সওয়াব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহু আলাম। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
▬▬▬◄✪✪► ▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স: মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

পিতার হারাম সম্পদে সন্তানের করণীয়

 প্রশ্ন: কারো বাবা সারাজীবন সুদি ব্যাংকে চাকরি করে ছেলে মেয়েদের ঐ বেতনের টাকা দিয়ে লালন পালন করেছেন। এখন তিনি অবসরপ্রাপ্ত। পেনশনের টাকা পান। এক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের কি গোনাহ হবে? বর্তমানে বাবার পেনশনের টাকায় কেনা খাবার খেতে বা পোশাক পড়তে পারবে কিনা? এতে কি ছেলে মেয়েরা গোনাহের ভাগীদার হবে? নিজের বাবাকে এই গোনাহ থেকে বাঁচাতে সন্তান হিসাবে কি করণীয় হবে?

উত্তর: বাবার জন্য ফরজ হচ্ছে, হালাল পন্থায় তার স্ত্রী-পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা। তিনি তা না করলে তিনি গুনাগার হবেন এবং কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাঠগড়ায় তাকে জবাবদিহি করতে হবে; স্ত্রী বা সন্তানকে নয়।

সুতরাং পিতা যদি সুদি ব্যাংকে চাকরি করে অর্থ উপার্জন করে অথবা ব্যাংক থেকে অবসর গ্রহণের পরে সেখান থেকে প্রাপ্ত পেনশনের অর্থ দ্বারা সংসার পরিচালনা করে তাহলে এর দায়-দায়িত্ব তার উপরে বর্তাবে; স্ত্রী পরিবার ও সন্তান-সন্ততির উপরে নয়। কিন্তু তারা অন্তর থেকে হারাম কে ঘৃণা করবে এবং সম্ভব হলে তাকে হারাম উপার্জন পরিত্যাগ করার অনুরোধ জানাবে।

প্রশ্ন: শাইখ ইবনে উসাইমিন রাহ. কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: যদি কেউ ব্যক্তি যদি জানতে পারে যে, তার বাবার সম্পত্তির উৎস হারাম, তাহলে কি সে তার বাবার খাবার খাবে? আর যদি সে তার বাবার খাবার না খায়, তাহলে কি তা পিতার অবাধ্যতা হিসেবে গণ্য হবে?
উত্তর:
“الرجل الذي علم أن مال أبيه من الحرام إن كان حراماً بعينه، بمعنى: أنه يعلم أن أباه سرق هذا المال من شخص فلا يجوز أن يأكله، لو علمت أن أباك سرق هذه الشاة وذبحها فلا تأكل، ولا تُجِبْ دعوته ، أما إذا كان الحرام من كسبه يعني: أنه هو يرابي أو يعامل بالغش أو ما يشابه ذلك ، فكل ، والإثم عليه هو .
، ودليل هذا: أن النبي صلى الله عليه وعلى آله وسلم أكل من مال اليهود وهم معروفون بأخذ الربا وأكل السحت، أهدت إليه يهودية شاةً في خيبر مسمومة ليموت ، ولكن الله عصمه من ذلك إلى أجلٍ مسمى . ودعاه يهودي إلى خبز شعير وإهالة سنخة (أي : دهن متغير الرائحة) فأجابه وأكل ، واشترى من يهودي طعاماً لأهله وأكله هو وأهله ، فليأكل والإثم على والده ” انتهى من “لقاء الباب المفتوح” (188/13) .

“যে ব্যক্তি জানতে পারবে যে, তার বাবার সম্পত্তি হারাম, যদি সে মূল সম্পদটাই হারাম হয় অর্থাৎ যদি সে নিশ্চিতভাবে জানে যে তার বাবা কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে চুরি করেছে, তাহলে সে তা খাবে না। যেমন: যদি তুমি জানতে পারো যে, তোমার বাবা কোনও ছাগল চুরি করেছে এবং তা জবাই করেছে, তাহলে তুমি তা খাবে না এবং তার দাওয়াতেও যাবে না। কিন্তু যদি হারাম উপার্জন তার ব্যবসায়িক কাজ থেকে আসে, অর্থাৎ সে সুদ খায়, প্রতারণা করে বা অনুরূপ অন্য কোনও কাজ করে, তাহলে তুমি খেতে পারো। এই ক্ষেত্রে গুনাহ তার উপরই থাকবে।

এর প্রমাণ হল, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ই/হুদিদের সম্পত্তি থেকে খেয়েছেন, যারা সুদ খাওয়া এবং হারাম উপার্জনের জন্য পরিচিত ছিল। এক ই/হুদি নারী নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বিষাক্ত খাবার দিয়েছিল কিন্তু আল্লাহ তাকে রক্ষা করেছিলেন। এক ই/হুদি তাকে জবের রুটি এবং রুটির সাথে মাখিয়ে খাওয়ার জন্য দ্রবীভূত মাখন বা চর্বি খাওয়ার জন্য দাওয়াত করেছিল। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এক ই/হুদি থেকে তার পরিবারের জন্য খাবার কিনেছিলেন এবং নিজেও খেয়েছিলেন। অতএব, তুমি খেতে পারো। গুনাহ তোমার বাবার উপরই থাকবে।” [উৎস: বাবুল মাফতুহ, ১৮৮/১৩]
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার,
সৌদি আরব।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বক্তৃতার ধরণ কেমন ছিল এবং সুর দিয়ে ওয়াজ করার বিধান কী

 প্রশ্ন: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওয়াজ বা বক্তৃতার ধরণ কী? সুর দিয়ে ওয়াজ বা ইসলামি আলোচনা করা কতটা বৈধ?

উত্তর: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাধারণতঃ বক্তব্যের ধরণ ছিল, তিনি সুস্পষ্ট উচ্চারণে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বক্তব্য দিতেন। মনে হতো, তিনি সেনাবাহিনীকে সতর্ক করছেন। এতে তার গলার রগগুলো ফুলে উঠত, আওয়াজ উঁচু হতো ও চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে যেত। যেমন: প্রখ্যাত সাহাবি জাবের বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত,

كانَ رَسولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عليه وَسَلَّمَ إذَا خَطَبَ احْمَرَّتْ عَيْنَاهُ، وَعَلَا صَوْتُهُ، وَاشْتَدَّ غَضَبُهُ، حتَّى كَأنَّهُ مُنْذِرُ جَيْشٍ
“যখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দিতেন, তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে যেত এবং তাঁর আওয়াজ উঁচু হত ও তাঁর ক্রোধ কঠিন রূপ ধারণ করত। যেন তিনি (শত্রু) সেনা থেকে ভীতি প্রদর্শন করছেন।” [সহিহ মুসলিম, হা/৮৬৭]

এর ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেছেন, এটা বক্তৃতার বিষয় এবং শ্রোতাদের অবস্থার উপর নির্ভরশীল হতো। যদি তিনি এমন বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন যখন মানুষকে সতর্ক করার প্রয়োজন হতো অথবা শ্রোতাদের মধ্যে কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে পারতেন যে, সে আল্লাহ ও রসুলের অবাধ্যতা করেছে বা আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করেছে তখন তার বক্তৃতার ধরণ এমন হতো।
আবার কখনো তিনি নরম ভাষায় অন্তর বিগলিত করার মত বক্তব্য দিতেন। এতে শ্রোতাদের দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। যেমন:

◈ ইরবাজ ইবনে সারিয়াহ রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

وعَظَنَا رسولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- مَوْعِظَةً وجِلَتْ منها القلوبُ، وذَرَفَتْ منها العيونُ ، قال : فقلْنَا : يا رسولَ اللهِ، كأَنَّ هذه مَوْعِظَةُ مُودِّعٍ

“রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এমনভাবে ওয়াজ করলেন যাতে আমাদের অন্তর ভীত হয়ে পড়লো ও আমাদের চোখ বেয়ে অশ্রু নির্গত হয়ে গেলো। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসুল, এটা মনে হচ্ছে, শেষ বিদায়ের উপদেশ বার্তা। তাই আপনি আমাদেরকে ওসিয়ত (অন্তিম উপদেশ) দান করুন…।” [আবু দাউদ(৪৬০৭) ও তিরমিজি, (২৬৬) হাদিসটি বর্ণনা করার পর বলেছেন যে, এটা সহিহ (হাসান)।]

তিনি তাড়াহুড়ো করে বা অতিরিক্ত টেনে লম্বা করে, সুর দিয়ে হেলে দুলে বক্তব্য দিতেন না। এগুলো তার আদর্শ পরিপন্থী কাজ।

◈ মা-জননী আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন,

إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَمْ يَكُنْ يَسْرُدُ الْحَدِيثَ كَسَرْدِكُمْ

“রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের মত দ্রুত কথা বলতেন না (বরং তিনি ধীর স্থির ও স্পষ্টভাবে কথা বলতেন।” [সহীহ বুখারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৫০/ আম্বিয়া কিরাম আ., পরিচ্ছেদ: ২০৭৩. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিবরণ]

◈ তিনি (আয়েশা রা.) আরও বলেন,

كَانَ يُحَدِّثُ حَدِيثًا لَوْ عَدَّهُ الْعَادُّ لَأَحْصَاهُ

“তিনি এমন ভঙ্গিমায় কথা বলতেন, যদি গণনাকারী চাইত তাহলে তা গণনা করতে পারত।” [বুখারী ৩৫৬৭, মুসলিম ৭৭০১]

◆ ইবনে হাজার আসকালানি বলেন,

المراد بذلك المبالغة في الترتيل والتفهيم

“এর অর্থ হলো, সুস্পষ্ট উচ্চারণ এবং বোঝানোর ক্ষেত্রে জোর দেওয়া।” অর্থাৎ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া কথা বলার ক্ষেত্রে ধীর স্থিরতা অবলম্বন করতেন এবং প্রতিটি শব্দকে সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণের ক্ষেত্রে জোর দিতেন।

তাই ওয়াজ, খুতবা বা বক্তৃতার ক্ষেত্রে গান বা কবিতার মতো করে সুর দিয়ে বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়। কারণ তা শ্রেষ্ঠ আদর্শ মানব প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ পরিপন্থী। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ এসব শ্রুতি মধুর ও আকর্ষণীয় বক্তৃতা তৃপ্তি লাভের উদ্দেশ্যে শ্রবণ করে থাকে; হেদায়েত বা উপদেশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে নয়। তাছাড়া এ ধরনের বক্তার মনে মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জনের মনোভাব বা রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যা বক্তার আমল বিনষ্ট করার পাশাপাশি দাওয়াতের এ মর্যাদাপূর্ণ অঙ্গনকে কুলুষিত করে।

◆ মিসরের সিনিয়র স্কলার শাইখ আলী মাহফুজ বলেন [মৃত্যু: ১৯৪২]

الترنم في الخطيب من البدع المحدثة

“বক্তাদের সুর দিয়ে বক্তব্য দেওয়া নব আবিষ্কৃত বিদআতের অন্তর্ভুক্ত।” [আল ইবদা ফি মাযাররিল ইবতিদা, পৃষ্ঠা নম্বর ৪৫]

◆ অনুরূপভাবে শাইখ বকর আবু জায়েদ একই কথা বলেছেন। [তাসহীহুদ দুআ, পৃষ্ঠা নম্বর: ৪৫৫]

এছাড়াও ইমাম ইবনুল জাওযি সুর করে বক্তব্য দেওয়াকে মুনকার বা গর্হিত কাজ হিসেবে এবং মোহাম্মদ রশিদ রেজা এটিকে মাকরুহ বা অ পছন্দনীয় কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে আরও বিভিন্ন ওলামাদের বক্তব্য রয়েছে।

✪ ইবনুল জাওযি-এর নিম্নোক্ত বক্তব্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন,

تأملت أشياء تجري في مجالس الوعظ ، يعتقدها العوام وجهال العلماء قربة ، وهي منكر وبعد . وذاك أن المقرئ يطرب ويخرج الألحان إلى الغناء ، والوعظ ينشد بتطريب أشعار المجنون وليلى ، فيصفق هذا ، ويخرق ثوبه هذا .. ومعلوم أن هذه الألحان كالموسيقى ، توجب طرباً للنفوس ونشوة ، والتعرض لما يوجب الفساد غلط عظيم .. ألا إن الواعظ مأمور بأن لا يتعدى الصواب ، ولا يتعرض لما يفسدهم

“আমি লক্ষ্য করেছি যে, অনেক ওয়াজ মাহফিলে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যাকে সাধারণ মানুষ এবং স্বল্প জ্ঞানী বিদ্বানরা ভুল করে আল্লাহর কাছে নৈকট্য লাভের উপায় মনে করে। কিন্তু আসলে তা গর্হিত কাজ এবং আল্লাহর নৈকট্য থেকে দূরের বিষয়। যেমন: কুরআন তিলাওয়াত কারী গানের মতো সুরে তিলাওয়াত করে এবং বক্তা লায়লা-মজনুর মতো প্রেমিক কবিদের কবিতা গাইতে গাইতে উপদেশ দেন। কেউ হাত তালি দেয়। কেউ আবার নিজের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। এটা স্পষ্ট যে, এই ধরনের সুর ও গান মিউজিকের মত মনের মধ্যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে। অথচ এমন কিছু করা যা মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে পারে তা বিশাল ভুল। স্মরণ রাখতে হবে যে, একজন বক্তা বা উপদেশ দাতার কাজ হল, নিজে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়া এবং এমন কিছু না করা যা মানুষকে ভ্রষ্ট করে দেয়।” [সাইদুল খাতের, পৃষ্ঠা নং ১০৭]
অবশ্য বক্তব্যের মধ্যে কুরআনের আয়াতের অংশটুকু সুর করে তেলাওয়াত করতে কোন আপত্তি নেই। কেননা হাদিসে সুর করে কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
আল্লাহু আলাম।
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

Saturday, November 9, 2024

উপরে ওঠার সময় আল্লাহু আকবার এবং নিচে নামার সময় সুবহানাল্লাহ পাঠ করা

 একটি হারিয়ে যাওয়া সুন্নত: উপরে ওঠার সময় আল্লাহু আকবার এবং নিচে নামার সময় সুবহানাল্লাহ পাঠ করা:

প্রশ্ন: উঁচু স্থানে উঠার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ এবং নিচু স্থানে নামার সময় ‘সুবহানাল্লাহ’ পাঠ করা সুন্নত। ঘরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা বা নামার ক্ষেত্রেও কি তা সুন্নত?
উত্তর: উঁচু স্থানে উঠতে আল্লাহর বড়ত্ব প্রকাশ স্বরূপ ‘আল্লাহু আকবার’ এবং নীচে নামতে ‘সুবহানাল্লাহ’ বলা সুন্নত। প্রখ্যাত সাহাবি জাবির রা. বলেন,

كُنَّا إِذَا صَعِدْنَا كَبَّرْنَا وَإِذَا نَزَلْنَا سَبَّحْنَا

“আমরা যখন উপরের দিকে উঠতাম, ‘আল্লাহু আকবার’ ও যখন নীচের দিকে নামতাম তখন ‘সুবহানাল্লাহ’ বলতাম।” [বুখারি, হা/২৯৯৩]

অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كَانَ النَّبِيُّ ﷺ وَجُيُوشُهُ إِذَا عَلَوا الثَّنَايَا كَبَّرُوا، وَإِذَا هَبَطُوا سَبَّحُوا

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সেনা বাহিনী যখন উঁচু জায়গায় উঠতেন তখন আল্লাহু আকবার বলতেন। আর যখন নিচু জায়গায় নামতেন তখন সুবহানাল্লাহ’ বলতেন।” [আবু দাউদ, হা/২৫৯৯, সনদ সহীহ]

❒ আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ.-এর ফতোয়া:

বর্তমান শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ ও আলেমে দ্বীন আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ. কে প্রশ্ন করা হয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদিসে এসেছে যে, তিনি কোনও উঁচু জায়গায় ওঠার সময় তাকবির বলতেন এবং কোনও নিচু জায়গায় নামার সময় তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ) বলতেন। এখন প্রশ্ন হলো, এই তাকবির ও তাসবিহ কি শুধুমাত্র সফরের সময় পাঠ করতে হয় নাকি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বা তৃতীয় তলায় ওঠানামার সময়ও তাকবির ও তাসবিহ বলা যাবে? জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।
উত্তরে তিনি বলেন,
” كان النبي صلى الله عليه وسلم في أسفاره إذا علا صَعداً كبر، وإذا نزل وادياً سبح، وذلك أن العالي على الشيء قد يتعاظم في نفسه، فيرى أنه كبير، فكان من المناسب أن يكبر الله عز وجل فيقول: الله أكبر، وأما إذا نزل فالنزول سفول فناسب أن يسبح الله عز وجل عند السفول، هذه هي المناسبة .
ولم ترد السنة بأن يفعل ذلك في الحضر، والعبادات مبنية على التوقيف، فيقتصر فيها على ما ورد، وعلى هذا فإذا صعد الإنسان الدرجة في البيت فإنه لا يكبر، وإذا نزل منها فإنه لا يسبح، وإنما يختص هذا في الأسفار” . انتهى من (لقاءات الباب المفتوح 3/102).

“নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফরের সময় কোনও উঁচু জায়গায় উঠলে তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলতেন এবং নিচু জায়গায় নামলে তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ) বলতেন। কারণ উঁচু জায়গায় উঠলে মানুষ নিজেকে মহান মনে করতে পারে। সে মনে করতে পারে, সে বড়। তাই সে সময় তাকবির তথা আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা দেওয়াটা অধিক প্রাসঙ্গিক। আর অবতরণ মানে উপর থেকে নিচে চলে যাওয়া। এ সময় তাসবিহ পাঠ বা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করাটা অধিক প্রাসঙ্গিক। এখানে এটাই তাকবির ও তাসবিহ পাঠের প্রাসঙ্গিকতা।
সুন্নতে এমন কোনও দলিল নেই যে, আবাসে থাকাকালীন এই আমল করতে হয়। আর ইবাদত শুধুমাত্র দলিলের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং ঘরের দ্বিতীয় বা তৃতীয় তলায় ওঠানামার সময় তাকবির ও তাসবিহ বলা যাবে না। এই আমলটি কেবল সফরের সাথেই খাস। [সূত্র: লিকাউল বাবিল মাফতুহ, ৩/১০২]

❒ সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায.-এর ফতোয়া:

সৌদি আরবের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায. কে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয় যে, কোনও উঁচু জায়গা থেকে নামার সময় তাসবিহ পাঠ করা এবং উপরে ওঠার সময় তাকবির পাঠ করা-এটা কি শুধু সফরের সময় করতে হয় নাকি আবাসেও করা যায়?

তিনি উত্তরে বলেন,

المعروف في السفر، أما في الحضر فإنَّه يُسبّح ويُكبّر في الصعود والنزول، يُكثر من الذكر، سواء في الحوش، أو في السطح، أو غير ذلك.

“সাধারণত সফরের সময় এটা করা হয়। এ বিষয়ে এটাই প্রসিদ্ধ কথা। তবে আবাসে থাকাকালীন উপরে উঠা, নিচে নামার সময় তাকবির পাঠ করবে, তসবিহ পাঠ করবে এবং অধিক পরিমাণে জিকির করবে। তা বাড়ির আঙ্গিনা, ছাদ বা অন্য যেকোনো জায়গায় হতে পারে।”

• প্রশ্ন: এ ক্ষেত্রে সবাই মিলে একসাথে তাকবির বলা কি জায়েজ?

জবাব: না, প্রত্যেকে নিজ নিজে তাকবির বলবে। অন্যের আওয়াজের দিকে খেয়াল করবে না। সবাই মিলে তাকবির বলার কোনও ভিত্তি নাই। এটা বিদআত। প্রত্যেকে নিজের অবস্থান অনুযায়ী আল্লাহর জিকির করবে; অন্যের আওয়াজের দিকে খেয়াল করবে না।

• প্রশ্ন: যখন কেউ সিঁড়ি বেয়ে ওঠে তখন কি তাকবির বলবে?

জবাব: হ্যাঁ, ওঠার সময় বা নামার সময় উভয়ক্ষেত্রেই তাকবির বলা যায়।

• প্রশ্ন: যখন কেউ সিঁড়ি বেয়ে নামে তখন তাসবিহ পড়ে?

জবাব: এটাও খুব ভালো। অথবা নামার সময় আন্যান্য জিকির-আজকার করতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ

“তারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং পাশ ফিরে শুয়ে আল্লাহর জিকির করে।” [আল ইমরান: ১৯১] তবে পাহাড়ের উপত্যকা বা খাদে নামার সময় খেয়াল করে তাসবিহ পাঠ করবে সফর অবস্থায়।” [binbaz.org]

❂ তবে কতিপয় আলেমের মতে, সিঁড়ি ব্যবহারের সময়ও উক্ত আমল করা যায়। অর্থাৎ বাড়ি বা কোনও ভবনের সিঁড়ি বেয়ে বা লিফটের মাধ্যমে উপরে উঠার সময় বলবে, আল্লাহু আকবার এবং নিচে নামার সময় বলবে, সুবহানাল্লাহ। তবে এ ক্ষেত্রে প্রথম মতটি অধিক অগ্রাধিকারযোগ্য। কিন্তু এই উঠানামার সময় সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার ইত্যাদি যেকোনো জিকির ও দুআ তাসবিহ পাঠ করা যায়। আল্লাহু আলাম।

মোটকথা, কোনও উঁচু বিল্ডিং-এর সিঁড়ি বেয়ে বা লিফটের মাধ্যমে উপরে উঠার সময়, নামার সময়, পায়ে হেঁটে অথবা গাড়ি চালনা বা গাড়িতে অবস্থানকালে উপরে ওঠা এবং নিচে নামার সময় আমরা সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি নানা ধরণের জিকিরের মাধ্যমে আমাদের জিহ্বাকে সচল রাখার চেষ্টা করা উচিৎ। তবে বিশেষভাবে সফরে পথ চলার সময়, গাড়ি ড্রাইভ করার সময় বা বাহনে থাকা যখন আমরা পাহাড় বা অন্যান্য উঁচু স্থানে উঠব তখন খেয়াল করে এই সুন্নতটি প্রতি আমল করার চেষ্টা করব। অর্থাৎ উপরে ওঠার সময় আল্লাহু আকবার আর নিচে নামার সময় সুবহানাল্লাহ পাঠ করব। এতে আমাদের আমলনামায় জামা হবে অবারিত সওয়াব ইনশাআল্লাহ।
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, বর্তমানে এই সুন্নতটি আমাদের মাঝ থেকে প্রায় বিদায় নিয়েছে। তাই এটিকে পুনর্জীবিত করা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার। সৌদি আরব।

Translate